জংলা ডায়েরি - শিবাংশু দে
Posted in জংলা ডায়েরি
৯
"... সে কি জানিত না যত বড়ো রাজধানী
তত বিখ্যাত নয় এ-হৃদয়পুর
সে কি জানিত না আমি তারে যত জানি
আনখসমুদ্দুর
আজ সেই ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবি
এমন ছিলো না আষাঢ়-শেষের বেলা
উদ্যানে ছিলো বরষা-পীড়িত ফুল
আনন্দ-ভৈরবী।" (শক্তি)
ড্যাঞ্চিবাবুর বৃত্ত থেকে বেরিয়ে কোয়েল কারো-কে খোঁজা বড়োশহরের বাবুদের ঠিক আসেনা।
আমি তো নিজে সারান্ডারই সন্তান। চার পুরুষ জামশেদপুরে বাস আর কর্মসূত্রে দীর্ঘ থেকেছি চাইবাসা, জাদুগোড়া, মুসাবনি। সারা সিংভূম, পূর্ব-পশ্চিম, প্রায় হাতের তালুর মধ্যে থাকে। তাদের যাবতীয় পরিধির দশদিক আমার অস্তিত্বের অংশ। চাইবাসা থেকে সারান্ডা যেতে গেলে দক্ষিণ-পশ্চিম। অভ্যেসবশে চিরকাল ঐ পথে গেছি। হয় চক্রধরপুর, সোনুয়া, গইলকেরা, মনোহরপুরের রাস্তা ধরে। নয়তো হাটগামারিয়া, জগন্নাথপুর, নোয়ামুন্ডি, কালাবুরু, বড়াজামদা, বড়বিল, বোলানি, মহিষানির পথে বরাইবুরু, কিরিবুরু, মেঘাতুবুরু, থলকোবাদ। সারান্ডা এদেশের সবচেয়ে বড়ো ও ধনী জঙ্গলমহাল ছিলো তো এককালে।
ওড়িশার দিক দিয়ে সারান্ডার দক্ষিণ দিক ধরে কেঁদুয়াঝাড়ের (পূর্বতন কেঁওঝর) পথে বর্ষামুখর সারান্ডার স্মৃতিকাতর টান। বহুদিনের পুরোনো পিরিতি ফিরে এলো নির্বিবাদ, জংলির কাছে যেমন ফেরে জঙ্গল আর বুদ্ধ গুহের কাছে 'শালবনের' কেচ্ছা লেখাতে ফিরে ফিরে আসে প্রকাশক।
কিরিবুরু আর মেঘাতুবুরু, প্রায় তিন হাজার ফুট পাহাড়ের উপর দুটো ছোট্টো শৈল বসতি। সেল কোম্পানির লোহা খাদান ঘিরে বসবাস। পাহাড়ের পায়ের কাছে সিংভূমের শেষ। অন্যপারে পাহাড় পেরিয়ে কেঁদুয়াঝাড় জেলা । সারান্ডা অরণ্যের কেন্দ্র এই শিখর শহর দুটি। হো ভাষায় 'সারান্ডা' মানে সাতশো পাহাড়। এটা সাতশো পাহাড়ের দেশ। সঞ্জীবচন্দ্রের দৌলতে ইংরিজিজানা বাঙালির কাছে পলামুর বনজঙ্গল পরিচিতি পেয়েছিলো ঊনবিংশ শতকেই। বেতলা, লাতেহার, ছিপাদোহর, মহুয়াডাঁড়, গাড়োয়া, গারু, কুটকু, বড়াসাঁড়, নানা ফরেস্ট রেঞ্জ। পূর্বদিকে নেতারহাট থেকে শুরু করে পশ্চিমে মির্জাপুর। উত্তরে হান্টারগঞ্জ, চাতরা থেকে দক্ষিণে গুমলা, সরগুজা। সে তুলনায় বাঙালির কাছে সারান্ডা ছিলো অচেনা। উত্তরে পোড়াহাট আর কোলহান অরণ্য, সারান্ডা জঙ্গলে রেঞ্জ আছে চারটি। সামটা, কোয়না, সসাংদা আর গুয়া, এটাই সাতশো পাহাড়ের দেশ। এই অরণ্যের হৃদয়দেশে দু'টো বনবাংলা, আজ তারা অতীত, থলকোবাদ আর কুমডি। বড়াজামদার দিক দিয়ে গেলে কিরিবুরু'র কাছে পড়তো কুমডি। আরো পনেরো-কুড়ি কিমি এগিয়ে গিয়ে থলকোবাদের সেই পুরোনো বনবাংলা। যা'কে বিভূতিভূষণ চিনিয়ে ছিলেন বাঙালিদের কাছে। বহুদিন আগে শক্তি আর সন্দীপনকে নিয়ে গিয়েছিলুম কুমডি বাংলায়। তাঁদের রাত জেগে কখনও ঘুম, কখনো নেশা, কখনও পাগলামি, আর এতোলবেতোল প্রমত্ত প্রলাপের অভিনীত অপ্রকৃতস্থতা থেকে উঠে আসা পরবর্তী কালের লেখালেখির বীজ, শুনেছিলুম আমরা। রাতের বেলা ওসব জায়গায় কোনও রকম শব্দদূষণ একেবারে মানা। তাই টেনশন নিয়ে পাহারা দিতে হয়েছিলো রাতভর। কিন্তু সেবার অন্ধকারে হরিণের সবুজচোখ ছাড়া আর কিছু দেখা যায়নি। মাঝে মাঝে সমতল, কিন্তু ক্রমাগত চড়াই-উৎরাই। অরণ্য কখনও ঘন, কখনও ছোটো ছোটো গ্রামের কাছে এসে হাল্কা হয়ে যাচ্ছে। কোন প্রাক ইতিহাসকাল থেকে সিংভূমের এই শালের জঙ্গল, পিয়াল, জারুল, আমলকী, বট, কাঁঠাল, সেগুন, মানুষের নির্বাণভূমি হয়ে জেগে আছে , কে জানে? একটা পাক খাওয়া রাস্তার চড়াই উঠলেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো থলকোবাদ বনবাংলা। আজ সে রয়েছে শুধু স্মৃতিতে।
সূর্য এখানে এভাবেই অস্ত যায়। প্রথম শাদা, থেকে নীলাভ ছায়। তার পর হলুদ, সোনালি, কমলা। তারপর হঠাৎ আকাশের স্মেল্টার থেকে উপচে গলন্ত লোহার মতো আগুন ছড়িয়ে যায় এপার ওপার সাতশো পাহাড়ের নীলিম দিগন্তে। কিমাশ্চর্যম... আমি যদি যুধিষ্ঠির হতুম, নহুষ যক্ষের প্রশ্নের উত্তর হতো অন্যরকম। রোজই সারা পৃথিবী জুড়ে সূর্য ওঠে আর অস্ত যায়, কিন্তু কখনও পুরোনো হয়না কেন ? বারান্দায় বসে দেখি ঝুঁঝকো আঁধার নেমে আসছে, ঘাসজমি, লালমোরম, ঘোরানো পথের নক-টার্ন মিলিয়ে যাচ্ছে নিশ্চুপ। সবুজ অরণ্যের আভা গাঢ় হয়ে মিশে যাচ্ছে আবহের অন্ধকারে। জঙ্গলে যখন রাত নামে, গোধূলির জ্বলানেভা আলোর তির আড়াল করে দেয় শাল-সেগুনের মস্তো পাতায় টাঙানো চাঁদোয়া। ঝুঁঝকো আঁধার নামে পাখিদের বাড়ি ফেরার আকাঙ্খায় সপ্তম সিম্ফনির আকাশ চেম্বার। আঁধার নামে ঝপ করে। টের পেতে দেয়না কখন তার আঁচল দিয়ে ঢেকে দিলো চারদিক। যত দূর চোখ যায়। ঝরা পাতাদের ভেজা, জৈব গন্ধ গাঢ় হতে থাকে ভারি হাওয়ায়। জঙ্গলে বসন্তের বাতাসটুকুর মতো মিঠে ফিল্মি পেলবতা থাকেনা তেমন। হয় বৃষ্টির ঝাপটে এলোমেলো ঝড়, নয় নিঃশব্দ পাতাদের দুলিয়ে দিয়ে এখান ওখান পাতার নূপুর। বনবাংলার বারান্দায় লন্ঠনের কাঁপা আলো, বেতের রং'জলা চেয়ার আর মৃদু সিঙ্গল মল্টের স্বস্তি। গান শুনতে গেলে ইয়ারফোন আর শান্তিতে বসতে গেলে মশার ক্রিম। শোর মচানা মনা হ্যাঁয়। কেয়ারটেকার ভালো হলে দেশি মুর্গির ঝোল আর ভাত। সঙ্গে লেবু দেওয়া চাকা চাকা পেঁয়াজ। রুটি বানানো খুব ঝামেলা এখানে। লাগেও না। রাত যত বাড়ে, জঙ্গলে ইতিউতি জন্তুদের ডাকও বেড়ে ওঠে। কিছু চেনা, কিছু অচেনা। তবে আবহসঙ্গীত হিসেবে নিখুঁত। আরো একটু ঘন হলে অন্ধকার, বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে শিশির পড়ার টুপটাপ। মাপতে গেলে গান্ধারের পর্দা মেনে তার স্বরলিপি। টপ্পার মতো ঠেকায় বাজে তার তালের মাত্রা। মশা ছাড়া কোনও আতঙ্ক নেই।
গোটা তল্লাটই ফ্যালসিপেরামের তীর্থ। কিরিবুরু হাসপাতালে যে কোনও রকম জ্বর হলেই কিছু না শুনেই আগে ক্লোরোকুইন।
অনেকে জিগ্যেস করেন, কোন জঙ্গল আপনার সব থেকে প্রিয়? বলা মুশকিল। সত্যিই বলা খুব মুশকিল। কারণ প্রতিটি জঙ্গলই বহুরূপী। প্রতিবারই গিয়ে দেখি কিছু আলাদা দৃশ্য, আলাদা গন্ধ, আলাদা অহংকার । চমকে দেয় বারবার। পুরোনো হয়না কখনও। ডায়রি খালি থাকতে দেয়না। তুমি আখর না চেনালে আজও কিছু লেখা হতোনা। নিজের দলমা গ্রাম যদিও একনম্বরে থাকবে চিরকাল। আমার ধরাছোঁয়ার অমরাবতী। তার পর? নাহ, চিরিমিরি, পঞ্চমড়ি, জাফু, কর্বেট, কওসানি কেউ নয়। বাড়ির পাশের সিমলিপাল রেঞ্জ। জানতে চেও না বেহাগ কেন বেশি ভালো লাগে দরবারির চেয়ে। বারিপদার দিক দিয়ে ঢোকা। লুলুং, জোরান্ডা, বড়েইপানি, চাহালা, বৃন্দাবন পেরিয়ে জশিপুর। বম্বে হাইওয়ে। উত্তরে গেলে বাদামপাহাড় রেঞ্জ, দক্ষিণে করঞ্জিয়া। সিমলিপালের এটা মধ্য-উত্তর অংশ। কুমারী নয়। তবে কুমারসম্ভবের পার্বতী বলা যায় তাকে। দক্ষিণ এলাকাটা অবশ্য একেবারে কুমারী অরণ্য। কিন্তু আম-আদমির (আক্ষরিক অর্থে) প্রবেশ নিষেধ সেখানে। মানুষের অত্যাচারে অন্য জন্তুরা সব সেখানে পৌঁছে গেছে। হয়তো ভালো'ই আছে তারা। যতোদিন আমরা তাদের ভালো থাকতে দিই। চাহালায় ময়ূরভঞ্জের রাজামশায় একটা শিকারঘর বানিয়ে ছিলেন। এখন সেটা বনবাংলো। দু'দণ্ড নাটোরের ছায়া বুলিয়ে দেবে চোখেমুখে। তার পাশেই জনতার অতিথশালা। চারদিকে জঙ্গল, মাঝখানে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা। পায়ে পায়ে ময়ূর ঘুরে বেড়ায়। আজ থাক। সিমলিপালকে নিয়ে অন্য একদিন। শাল-সেগুনের প্রেয়সীদের সময় দিতে হয়। সন্ধেবেলা স্নানশেষে চৌকাঠ ধরে যেমতি দাঁড়াবে, ত্রিভঙ্গে, ততক্ষণ...
".... এখনো বিকেল হলে জল থেকে উঠে আসো, আমি
বারান্দায় ব'সে ব'সে দেখি, দেখি অপরাজিতার
সুনীল বাঁধনে রোদ সবুজে সোনায় মিশে আছে,
সন্ধ্যাবেলা আসবে বলে কথা আছে, সন্ধ্যে হয়ে এলো।"
(রাজহাঁস/ ৯- মণিভূষণ ভট্টাচার্য)
(ক্রমশ)
কিস্তিগুলো আর একটু বড় হোক ! এই জঙ্গলের গান বড় মায়া!!
ReplyDelete