2

প্রবন্ধ - অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in
প্রথম ঘটনা: কলকাতা শহরের উত্তর প্রান্তসীমায় গঙ্গার ধারে আমাদের উনিশ শতকের বাড়ি। বাড়ির মধ্যে একাধিক পাতকুয়া। আগে প্রায় সব বাড়িতেই কুয়ো ছিল। ছোটবেলায় দেখেছি, সারা বছর বাড়ির যাবতীয় কাজ ওই কুয়োর জলেই হত। খাওয়া ও রান্নার জন্যে মিউনিসিপ্যালিটির টিউবকল থেকে ভারি বাঁকে করে টিন-ভর্তি জল মাটির জালা, কুঁজোয় ভরে দিয়ে যেত। আমার বড়ঠাকুমার বাড়িতে বড়-বড় মাটির জালায় সারা বছরের গঙ্গাজল থাকত রান্না-খাওয়ার জন্যে। তখনও গঙ্গা দূষিত হয়নি। গঙ্গা কাছে থাকায় অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় কুয়োর জলের মাত্রা ওঠানামা করত। আর বর্ষায় কুয়ো ভরে জল উপচে পড়ত। এ ছাড়া ছিল অনেক ছোট-বড় পুকুর, সেগুলোও বর্ষায় ভেসে যেত। 

দ্বিতীয় ঘটনা: কলকাতায় গত শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত দেখেছি, রোজ দু’বেলা চাপাকল থেকে হোসপাইপে করে গঙ্গার জলে রাস্তা ধোওয়া হোত। টালার ট্যাঙ্ক থেকে রাস্তার নীচে দিয়ে পাইপে বাড়ি বাড়ি পরিস্রুত জল আসত সকাল-বিকেল। বাড়িতে চৌবাচ্চায় জল ভরা থাকত সব কাজকম্মের জন্যে। পাইকপাড়া অঞ্চলে জলের চাপ এত বেশি থাকত যে পাম্প ছাড়াই দোতলায় জল উঠে যেত, আর অন্য জায়গায় পাম্পে করে ছাদের ওপরের ট্যাঙ্কে জল ভরা হত। রাস্তায় অনেক কল এবং বড়-বড় চৌবাচ্চা ছিল। সবগুলোতেই সারা দিন ধরে জল বাধাহীন পড়ে যাচ্ছে বা উপচে পড়ছে। সেই জল লোক বালতিতে ভরছে, তাতে চান করছে, কাপড় কাচছে। আজও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। 

তৃতীয় ঘটনা: গত শতকের সত্তরের দশকে রাজস্থানে আরাবল্লী পর্বতে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, উঁচু পাহাড়ের যে সব ঢাল বেয়ে বর্ষায় জল নামে, সেখানে পাথরের ইঁদারা বানিয়ে রাখা আছে যা ঝরনা নামে পরিচিত। সেগুলো ছিল গভীর এবং তা থেকে দু-তিনটে নালা বেরিয়ে গ্রামের দিকে চলে গেছে। প্রায়-মরু অঞ্চলে এই ভাবে বর্ষার জল ইঁদারার ভেতর দিয়ে ঢুকিয়ে পাথরের ফাটল দিয়ে মাটির নীচে পাঠানো হত। কিছু জল গ্রামে চাষের জন্যে খাল কেটে নিয়ে যাওয়া হত মাঠে, আর অন্য দৈনন্দিন ব্যবহারে কাজে লাগানোর জন্যে পুকুর কাটা হত। অনেক পুকুরও দেখেছি যেখানে পাহাড় গড়িয়ে জল এসে জমা হত। 

চতুর্থ ঘটনা: কর্মজীবনে দক্ষিণ গুজরাতের উপকূলবর্তী অঞ্চলে ভূ-পরিবেশ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আশির দশকে ডান্ডিতে ক্যাম্প করতে হয়েছিল। এখানেই মহাত্মা গান্ধী তাঁর লবণ আন্দোলন নিয়ে ডান্ডি মার্চ শেষ করেন। যে দিন জিপে করে দুপুরে পৌঁছলাম, এক তরুণী ক্যাম্পে এসে সবিনয়ে সে দিনই তার বিয়ের নেমন্তন্ন করে যায়। মেয়েটি ইঞ্জিনিয়ার এবং নিউজিল্যান্ডে চাকরি করে। সে এও জানাল যে বিয়ে করে সে তার বরকে নিয়ে যাবে ও দেশে। ক’দিন পর সেই মেয়েটির সাথে ভাল করে আলাপ হল। জানতে পারলাম, ডান্ডি ও আশপাশের গ্রামের অনেক ছেলে বা মেয়েই বিদেশে আছে এবং তারা প্রতি বছর গ্রামের উন্নতির জন্যে একটা ফান্ডে টাকা পাঠায়। সেই টাকায় গভীর নলকূপ বসিয়ে পাইপে করে নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় জল সরবরাহ হয়ে থাকে পঞ্চায়েতের মাধ্যমে। এ ছাড়াও সেই টাকাতেই নিম্নবিত্ত মানুষদের জন্যে বাড়ি ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়। আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখাল সে। সমুদ্র-তীরবর্তী জায়গায় মাটিতে লবণের ভাগ বেশি থাকায় চাষ সম্ভব নয়, তাই প্রতি বছর মাটি উল্টেপাল্টে দিয়ে পর পর চার বছর বর্ষার জল পড়ে মাটি লবণমুক্ত হয়ে চাষের উপযুক্ত হয়ে ওঠে। এ সবের জন্যে কারিগরি ব্যবস্থা তারাই করে। এ ছাড়া বর্ষার জল ধরে রাখার জন্যে পুকুর কাটানো, কুয়ো খনন ইত্যাদি ব্যবস্থাও করে। 

পঞ্চম ঘটনা: কচ্ছের রান অঞ্চলে বৃষ্টি প্রায় হয় না, কিন্তু সেখানেও দেখেছি বড় বড় পুকুর কেটে রাখা আছে, তাতে যেটুকু বৃষ্টির জল ধরা থাকে তাই তাদের জন্যে অনেক। এপ্রিল মাসের পর থেকে ট্রেনে করে জল প্রতিটা স্টেশনে ট্যাঙ্ক ভর্তি করে দিয়ে যায় এবং বাড়িপ্রতি জলের রেশন পরিমাণ গ্রাম পঞ্চায়েত ও স্টেশন মাস্টার মিলে ঠিক করেন। এক বার মে মাস অবধি ক্যাম্প করে ছিলাম, তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রিতে পৌঁছে গিয়েছিল। ট্রেনে আসা জলের পরিমাণ কমে গেল। আমাকে লিখিত মার্চিং অর্ডার ধরিয়ে দিয়ে বলা হল পরের দিন থেকে জল পাব না, কেননা গ্রামের লোকেদের জল পাওয়াটা সবার আগে দরকার। মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ, দক্ষিণাঞ্চল— সর্বত্র দেখেছি মাটি কেটে বড় বড় জলাশয়, বিশেষ করে তীর্থস্থানে তো বটেই, তা ছাড়াও গ্রামের নানা জায়গায় প্রয়োজনভিত্তিক পুকুর কেটে জল জমানো একটা ধর্মীয় এবং সামাজিক প্রথা ও সংস্কৃতি। 

ষষ্ঠ ঘটনা: ছোটবেলা থেকে যত বার ট্রেনে বাসে বাইরে বেড়াতে গিয়েছি, সঙ্গে বেডিং আর জলের বোতল অবশ্যই থাকত। স্টেশনে কিংবা রাস্তায় কলের জল বোতলে ভরে তৃষ্ণা মেটাতাম। তখন অবশ্য এখনকার মতো ‘লিটার’ বোতল ছিল না, ফেল্ট-ক্যাম্বিসে মোড়া ধাতুর জলের বোতল, জল ঠান্ডা থাকত। ছাত্রাবস্থায় এবং পরে কর্মজীবনে রাজস্থানে দেখেছি ক্যাম্বিসের জল-ব্যাগ ‘ছাগল’, অনেকটা ভিস্তির মত দেখতে। ব্যবহারও করেছি অনেক বছর। খুব শুকনো গরমের জায়গায় তাতে জল ভর্তি করে রাখলে আপনিই ঠান্ডা থাকে জল। আশির দশকে হঠাৎই রটে গেল, স্টেশনের জল খেলে কলেরা, পেটখারাপ হচ্ছে। সব জল দূষিত হয়ে গেছে। এই নিয়ে খবরের কাগজেও বড় করে রিপোর্ট হত। তার কয়েক বছর আগেই বিদেশি ঠান্ডা পানীয় বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে। আর এই ‘জল খারাপ হয়ে গেছে’ রটনার সঙ্গে সঙ্গেই বোতলে ‘লিটার’ জল বাজার ছেয়ে গেল। আমরাও ক্রমে অভ্যস্ত হয়ে উঠলাম বোতলের জল কিনে খেতে। এখন তো তা অবশ্যপানীয়। রটনা ও ঘটনার মধ্যে কোথায় যেন ব্যবসার গন্ধ, কারণ সেই বন্ধ-করে দেওয়া বিদেশি ঠান্ডা পানীয়ের কোম্পানিই লিটার জলের ব্যবসা চালু করে প্রথমে। 

সপ্তম ঘটনা: এই শতাব্দীর শুরুতে চাকরির পোস্টিং ছিল চেন্নাইয়ে। তখনই দেখেছিলাম এবং নিজেও পরীক্ষা করে জেনেছিলাম, ভূগর্ভস্থ জলের মাত্রা কমে যাওয়ায় সমুদ্রের লোনা জল ঢুকে ভূগর্ভস্থ মিষ্টি জলে মিশে যাচ্ছে। জলের অভাব তখনই চেন্নাইতে যথেষ্ট ভয়াবহ। সেই সময় জয়ললিতা মুখ্যমন্ত্রী। তিনি সময় নির্দিষ্ট করে দিয়ে ফতোয়া জারি করেন, সব বাড়িতে কূপ খনন করে বাড়ির ব্যবহৃত জল এবং বৃষ্টির জল সেই কূপের ভেতর ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে, নইলে বাড়ির ট্যাক্স নবীকরণ হবে না। জলসংরক্ষণের এই অভূতপূর্ব ব্যবস্থার জন্যে কয়েক বছরের মধ্যে ভূগর্ভস্থ জলের মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল এবং সমুদ্রের জল ঢোকাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পরে রাজনৈতিক পালাবদলে এই নিয়মে শিথিলতা আসে, চেন্নাই আবার জলাভাবের কবলে পড়ে। 

ভারতের সব রাজ্যেই বৃষ্টির জল ধরে জমিয়ে রাখার জন্যে পুকুর খনন এক অতি পুরনো ব্যবস্থা। বেদ, পুরাণ, মহাকাব্য সবেতেই বর্ষায় জল সংরক্ষণ এবং গরমে ব্যবহারের জন্যে পুকুর খননের কথা লেখা আছে। বৌদ্ধযুগ থেকে শুরু করে মুঘল রাজত্বকালেও ইতিহাসে পুকুরের উপকারিতার কথা জানতে পারি— সারা দেশে জলাশয় তৈরি হত। উপকূলবর্তী অঞ্চল বাদ দিলে বিস্তীর্ণ জায়গায় ভূগর্ভস্থ জলের আধার কম, ফলে জলও কম। নদীতে বাঁধ দিয়ে এক সময় জলের প্রবাহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাঠিয়ে চাষ ও অন্যান্য কাজে লাগানো হয়েছে। এ দিকে বাঁধের জন্যে নদী ক্রমশ শীর্ণকায় হতে হতে প্রায় মিলিয়ে যাওয়ার উপক্রম। ভূগর্ভস্থ জল অবৈজ্ঞানিক উপায়ে এবং অসংযত ভাবে পাম্পের সাহায্যে তুলে কৃষি ও অন্যান্য কাজে যথেচ্ছ ব্যবহার মাটির নীচে জলের মাত্রা কমিয়ে দিচ্ছে। 

প্রাকৃতিক কারণে পালটে যাচ্ছে বৃষ্টির চরিত্রও। এটা নতুন কিছু নয়, কিন্তু আমাদের জীবৎকালে দু-তিন প্রজন্মে এগুলো হয় না বলে আমাদের একটা পদ্ধতিতে যাপনের অভ্যস্ত মনে আতঙ্ক তৈরি হয়। চার হাজার দুশো বছর আগে এ রকমই আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে বদলে গিয়েছিল বৃষ্টির চরিত্র যাতে আজ আমরা অভ্যস্ত।

গত দু-তিন দশক ধরে প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর মানুষের যথেচ্ছ আক্রমণ প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করছে। নদী ও সমুদ্রতট থেকে বালি তুলে ফেলা হচ্ছে। নদী তার জল ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে, উপকূল ভাসিয়ে বন্যা হচ্ছে সামান্য বৃষ্টিতেই। অথবা বৃষ্টি না হলে বিস্তার বৃদ্ধি পাওয়ায় জল গরমে অতি মাত্রায় বাষ্পায়িত হবার সুযোগ পাচ্ছে। সারা দেশ জুড়ে পাহাড়ের পাথর কাটার যে উদ্যোগ তা শুধু বায়ুদূষণই বাড়াচ্ছে না, বৃষ্টির জল নির্দিষ্ট পথে গড়িয়ে যে স্রোতধারা বজায় রাখত তা-ও ব্যাহত করছে। ১৯৫০ সালের ‘টোপোশিট’ (Toposheet) নিয়ে এখন গেলে আরাবল্লী পাহাড়কে চেনা যাবে না। অনেক পাহাড়ের চূড়া উধাও, কোথাও পুরো পাহাড়ই উধাও। পাহাড় না থাকায় বৃষ্টির জল ধরে রেখে যে সব গ্রাম বাঁচত সেই গ্রামও অনেক সরে গেছে। পাহাড়ের নীচে যে সব জায়গায় এক সময় চাষাবাদ হত তা আর নেই, কারণ পাহাড়টাই তো নেই! পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওড়িশা-সহ সব রাজ্যেই এক অবস্থা। নগর বাড়তে বাড়তে চলে গেছে অরণ্যে। কাটা পড়ছে গাছ। এই শহরেরই উত্তরে, পূর্বে বা দক্ষিণে যে সব গাছপালা, জমিজমাজলা ও ছোট নদী ছিল সেখানে নগর থাবা বসিয়েছে। পুকুর বুজিয়ে বাড়ি উঠছে। নগরায়ন আর তথাকথিত সভ্যতার জাঁতাকলে শহরের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে। জোড়াতালি দিয়ে বৃষ্টি বা গরমে কোনও রকমে ‘ম্যানেজ’ করার চেষ্টা চলছে। এই ছবি সব শহরেই এক। গভীর নলকূপ বসিয়ে ভূগর্ভস্থ জলাধার থেকে যথেচ্ছ জল তুলে জলের আশু সমস্যা মিটছে বটে, কিন্তু জলকে আবার মাটির নীচে পাঠানোর উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকায় ভূগর্ভের খালি হওয়া জলাধার পুনরায় পূর্ণ হচ্ছে না, ঘাটতি থেকে যাচ্ছে এবং তা ক্রমশ বেড়েও যাচ্ছে। সাধারণ বোতলে বা ঠান্ডা পানীয়ের জন্যে জল পাম্প করে তোলা হয় সুগভীর নলকূপ বসিয়ে মাটির অনেক নীচ থেকে। আমাদের দেশে অনেক জায়গাতেই এ রকম সুগভীর নলকূপ আছে যা থেকে বড় বড় কোম্পানিগুলো যথেচ্ছ ভাবে জল তুলে যাচ্ছে। মাটির অত নীচের জলাধার খালি হয়ে গেলে পড়ে থাকবে বালি, যার ফলে ওপরের মাটি বসে যাবার পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। সরকার এই কোম্পানিগুলো থেকে অনেক টাকা পায় ট্যাক্স মারফত, ফলে সাতখুন মাফ। ঠিক একই ভাবে প্রচার হচ্ছে ‘গাছ লাগাও’, এ দিকে লক্ষ লক্ষ গাছ রোজ কাটা হচ্ছে কাগজ তৈরির জন্যে। আমাদের দেশে যত খবরের কাগজ রোজ বেরোয় তার তিরিশ থেকে চল্লিশ ভাগ, কখনও পঞ্চাশ ভাগ বিজ্ঞাপনে ভর্তি। এও একটা ব্যবসা। এক দিকে প্রচার হচ্ছে ‘গাছ লাগাও’ আর অন্য দিকে গাছ কেটে কাগজ করে বিজ্ঞাপন থেকে উপার্জন। প্রচার হল কম্পিউটার ব্যবহারে কাগজের খরচ কমবে কিন্তু ফল হল উল্টো, প্রতিলিপি বানাতে দেদার কাগজ খরচ হয়ে যাচ্ছে যা অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রয়োজনীয়। নিজে অসৎ হয়ে সততার উপদেশ সব জায়গায়। জল চাই অথচ জল সংরক্ষণের কোনও প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতা এবং পরিকল্পনা নেই স্বাধীনতার এত বছর পরেও। দেশের প্রতিটি লোককে পরিস্রুত পানীয় জল দেওয়া সম্ভব হল না আজও, যা বেঁচে থাকার ন্যূনতম শর্ত। জলের জন্যে মানুষের কষ্টের ছবি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে ভিজিয়ে চান করিয়ে দিচ্ছে কিন্তু কোথাও পুকুর খননের আর জায়গা নেই, সব জায়গা কংক্রিটের বাড়িতে ভর্তি। জঙ্গল কেটে শহর বাড়ানো হচ্ছে, সেখানে লোকে বসবাস শুরু করার পর তারাই কাগজে বড় বড় প্রবন্ধ লিখছে, তর্কে-সেমিনারে গলা ফাটিয়ে ফেলছে— ‘গাছ কাটার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চলছে চলবে’। নিজের দিকে ফিরে তাকাবার সৎ সাহস আর নেই। এ ভাবেই বয়ে চলেছে সরকার থেকে শুরু করে জনগণেরও প্রকৃত অনিচ্ছা। 

সাধারণ ভাবেই মনে প্রশ্ন আসতে পারে, কলকাতাও কি এই সমস্যার সম্মুখীন? কিছুটা তো বটেই। তবে কলকাতার নীচে আছে ৬০০ মিটার পুরু অ্যালুভিয়াম। এখানে যেহেতু সমুদ্র বার বার এসেছে এবং সরেছে তাই পলির চরিত্রও পালটেছে, কাঁকর-মিশ্রিত বালি এবং মাটি বা ক্লে পর পর স্তরে জমা আছে। বালির ভেতর জমা আছে জল আর তার ওপরে ও নীচে মাটি থাকায় সেই জল নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে আছে। পলির এই চরিত্রের জন্য ভূগর্ভস্থ জলের আধার অনেক স্তরে অনেকগুলো আছে এবং তা বেশ ভাল পরিমাণে। এর পাশাপাশি কলকাতা-হাওড়া-হুগলি সমেত অনেক জেলাই পেয়েছে গঙ্গা, যদিও আমরা হারিয়েছি অনেক নদী, উপনদী এবং শাখানদী— কিছুটা প্রাকৃতিক কারণে আর কিছুটা সভ্যতার আশীর্বাদে। না হলে এত বছর ধরে পৃথিবীর জল অপচয় হওয়ার পরেও এবং সারা দেশ জুড়ে অভূতপূর্ব জল সমস্যা প্রচার হওয়ার পরেও এখনও রাস্তার কলে জল পড়ে নষ্ট হলে মুখ ঘুরিয়ে চলে যাই এবং নিজেরাই বাড়িতে জলের কল বন্ধ করতে ভুলে যাই। 

মনে পড়ে সেটা ১৯৮৬ সাল। কচ্ছের রানে থাকার সময় এপ্রিল মাসে দিন তিনেক বৃষ্টি হয়েছিল। অনেকে তাদের জীবনে সেই প্রথম বৃষ্টি দেখেছিল। রাতে বৃষ্টিধারা তাঁবু ভিজিয়ে মাটির জল গড়িয়ে তাঁবুর ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল। সে দিন গ্রাম পঞ্চায়েতের হোমিওপ্যাথি ডাক্তার কন্যা আড্ডা মারতে আমার তাঁবুতে। আমি আর সেই মহিলা তাঁবু থেকে বেরিয়ে বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম আর আমি ভিজতে ভিজতে গলা ছেড়ে গাইছিলাম, “হে আকাশবিহারী-নীরদবাহন জল / আছিল শৈলশিখরে-শিখরে তোমার লীলাস্থল।”

2 comments:

  1. যথেষ্ট তথ্য সমৃদ্ধ মন ছুঁয়ে যাওয়া এই প্রবন্ধ.. ধন্যবাদ অমিতাভদা 🙏

    ReplyDelete
  2. অনেক নতুন কিছু জানলাম, ঋদ্ধ হলাম। ধন্যবাদ।

    ReplyDelete