0

অনুবাদ সাহিত্য - অংকুর সাহা

Posted in

অবিস্মরণীয় প্রেমের কবিতা - ৩

এবারের কিস্তি শুরু হচ্ছে পোল ভাষার এক মহিরুহ কবির প্রেমের কবিতা দিয়ে। কবির নাম Czesław Miłosz -- দুটো “L” এরই পেট কাটা; যতদূর জানি নামটির উচ্চারণ হবে “চেসোয়াভ মিউশ”। “অর্ফিউস এবং ইউরিডাইস” কবির শেষ প্রকাশিত কবিতা। সাপ্তাহিক “টাইগডনিক পাওসেকনি” (“বিশ্বজনীন সাপ্তাহিক”) সাময়িকপত্রে মিউশ লিখতেন নিয়মিত। মূল পোল ভাষার কবিতাটি সেখানেই প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ইংরেজি ভাষায় তার অনুবাদ। কয়েক মাস পরে আগস্ট মাসের ১৪ তারিখে তাঁর মৃত্যু।

চেসোয়াভ মিউশের জন্ম ১৯১১ সালে লিথুয়ানিয়ায় একটি গ্রামে রাশিয়ার জারের সাম্রাজ্যে। পূর্ব ইয়োরোপের নানান শহরে তাঁর শৈশব; মাতৃভাষা পোল -- সেই ভাষাতেই তাঁর সাহিত্য রচনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নবগঠিত পোল্যান্ড রাষ্ট্রের ডিপ্লোম্যাট হিসেবে ইয়োরোপে ও আমেরিকায় বাস করেন; ১৯৫১ সালে দেশত্যাগের পর ফ্রান্সে বসবাস করেন প্রায় এক দশক।

১৯৬০ সাল থেকে তিনি বার্কলে শহরে অবস্থিত ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং লেকচারারের পদ গ্রহণ করেন। দু বছর পরে তিনি সেখানে স্লাভিক ভাষা ও সাহিত্যের স্থায়ী অধ্যাপকের কাজ নেন। ১৯৭৮ সালে অবসর চাকরি থেকে। ১৯৮০ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার।

১৯৮০ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে, নিজের দেশ পোল্যান্ডে কবি হিসেবে তিনি ছিলেন অপরিচিত। তাঁর পোল ভাষার গ্রন্থগুলি প্রকাশিত হত প্যারিস থেকে এবং ইংরেজি অনুবাদ আমেরিকায়। ইংরেজি অনুবাদ করতেন কবি নিজে ও তাঁর বান্ধব এবং সহকর্মী রবার্ট হাস। 

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটার পর তিনি প্রথমবার তাঁর নিজের দেশ পোল্যান্ডে ফিরে যান পাঁচ দশক পরে। তাঁর বাকি জীবন কাটে ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে এবং পোল্যান্ডের ক্রাকুভ শহরে সময় ভাগ করে। ১৯৮০ এবং ১৯৯০ এর দশাব্দে কয়েকবার তাঁর কবিতা পাঠ এবং বক্তৃতা শোনা আমার এক রমণীয় অভিজ্ঞতা।

মিউশের সঙ্গে আছেন আরও ছ’জন কবি। ভিয়েতনাম থেকে আর্মেনিয়া ঘুরে ফ্রান্স পেরিয়ে স্কটল্যান্ড -- এইসব বিচিত্র দেশের কবি তাঁরা। আছেন জার্মান ভাষার তুলনাহীন কবি পল সেলান; চিরন্তন প্রেমের চিরন্তন কবিতা।

চেসোয়াভ মিউশ: (পোল্যান্ড, ১৯১১-২০০৪)

অর্ফিউস এবং ইউরিডাইস 

পাতালের প্রবেশপথের সামনে ফুটপাথে পাথরের ফলকের ওপর 
ঝোড়ো হাওয়ায় অর্ফিউস কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে 
বাতাস বিঁধছে তার পোশাকে, মিলিয়ে যাচ্ছে কুয়াশার তরঙ্গে,
উড়িয়ে দিচ্ছে গাছের পাতা। তার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির হেডলাইট 
ঢেউ এর ওঠানামার মতন প্রখর ও মৃদু হতে থাকে।

তিনি থামলেন কাচের দরজার বাইরে, সন্দিহান 
শেষ বিচারের মুখোমুখি হবার শক্তি অবশিষ্ট আছে কি না।

মনে পড়লো সেই নারীর কথা: “মানুষটা তুমি ভালো।”
কিন্তু বিশ্বাস হয় না। তিনি জানেন -- গীতিকবিরা 
সাধারণতঃ -- কঠিন হৃদয়ের মানুষ।
অনেকটাই অসুখের মতন। শিল্পে নিখুঁত হবার প্রচেষ্টা 
তার পরিবর্তে এরকম ব্যাধি হতেই পারে।

কেবল নারীর প্রেম তাঁকে করেছে উষ্ণ, মানবিক।
সেই নারীর সংস্পর্শে নিজেকে অন্যরকম ভাবতে পেরেছেন।
সে এখন মৃত, কিন্তু তাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভাঙতে পারেন না তিনি।

দরজা ঠেলে ঢুকলেন তিনি, ভেতরে গোলকধাঁধার মধ্যে হাঁটা 
বারান্দা, এলিভেটর। জীবন্ত আলোক, কিন্তু আলো নয় 
পৃথিবীর জড়ো করা অন্ধকার।
ইলেক্ট্রনিক গোয়েন্দা কুকুর নীরবে পার হল তাঁকে।
অনেক তলা নামলেন তিনি: একশো, তিনশো, আরও নিচে।

শীতবোধ হল তাঁর, বুঝলেন তিনি অস্তিত্বহীন।
হাজার হাজার বরফজমা শতাব্দীর আচ্ছাদনে,
বংশানুক্রমে মৃত মানুষজনের পড়া ছাই জমে জমে,
তৈরি হয়েছে এক রাজ্য -- অতল ও অন্তহীন।

তাঁকে ঘিরে ধরে চলন্ত ছায়ার ভিড়।
তিনি চিনতে পারেন কয়েকটি মুখ।
রক্তে অনুভব করেন ছন্দ।

অপরাধবোধ সমেত হলেও নিজের জীবনে তাঁর গভীর বিশ্বাস 
যাদের ক্ষতি করেছেন তাদের মুখোমুখি হবার ভয়।
কিন্তু মনে রাখার মতো কোনো ক্ষমতা নেই তাদের 
কবিকে একঝলক দেখে, তারা আপনমনে চলে যায় নিরাসক্ত।

প্রতিরক্ষার জন্যে সঙ্গে আছে একটি নয়-তারের বীণা।
তিনি বয়ে এনেছেন তাতে পৃথিবীর সংগীত, যে অতল গহ্বরে 
সব শব্দ লীন হয়ে যায় নীরবে, তার বিরুদ্ধে।
সংগীতের পায়ে নিজেকে সঁপে দেন তিনি, মিশে যান 
গানের বাণীর ঝংকারে, উৎকর্ণ হয়ে শুনতে শুনতে,
নিজেই বীণার মতন তার যন্ত্র হয়ে দাঁড়ান।

শেষে তিনি পৌঁছে গেলেন সম্রাটের প্রাসাদে।
পার্সিফনি, তাঁর বাগানে শুকনো আপেল আর ন্যাসপাতি গাছের,
কালো হয়ে যাওয়া নগ্ন ডাল আর পচাগলা পল্লবের ফাঁকে,
শোকমিছিলের মতন বাদামিরঙা সিংহাসনে বসে কান পেতে শোনেন।

কবি গান গেয়ে যান উজ্জ্বল প্রত্যূষের আর সবুজ নদীর সংগীত,
গোলাপিরঙা ভোরে জল থেকে উঠে আসা ধূসর ধোঁয়ার গান 
আরো অনেক গান; রঙের: গাঢ় লাল, গভীর লাল, পোড়া তামাটে, নীল,
পাহাড়ের পদতলে সুখনিবিড় সমুদ্রস্নানের,
নিচে বন্দরের জেলেডিঙির কোলাহল শুনতে শুনতে ছাদে ভুরিভোজের,
মদ, জলপাই তেল, বাদাম, সর্ষে, লবণ চেখে দেখার,
চড়াই আর বাজপাখির জীবন্ত উড়ন্ত ডানার,
উপসাগরীয় আকাশে উড্ডীন সম্মানিত পেলিক্যান ঝাঁকের,
বর্ষায় ভেজা মুঠো মুঠো লাইলাক সুগন্ধের,
সর্বদা মৃত্যুর প্রতিরোধে কথা সাজিয়ে লেখা তাঁর 
অনস্তিত্বের প্রশংসায় তিনি ছন্দ মেলাবেন না কোনোদিন।

দেবী বললেন, জানি না, তুমি ভালোবেসেছ কিনা সেই নারীকে 
কিন্তু তুমি এসেছ তার পিছু পিছু তাকে উদ্ধারের আশায়।
আমি তাকে ফিরিয়ে দেব তোমার হাতে। কিন্তু শর্ত থাকলো --
ফেরত যাত্রায় তার সঙ্গে কথা বলা নিষেধ, এমন কী 
একবার ঈষৎ ঘাড় ঘুরিয়ে, সে পেছনে আছে কিনা, দেখাও নিষেধ।

হার্মিস সঙ্গে নিয়ে এলেন ইউরিডাইসকে 
সে আর আগের মতো নেই, সব চুল শাদা,
তার চোখের পাতা নত, ছায়া ঘনায় অক্ষিপঙ্খে।
পুতুলের মতন পা ফেলে ফেলে সে এলো প্রভুর হাত ধরে 
এবং তাঁর নির্দেশ অনুসরণ করে। অর্ফিউসের ইচ্ছে হল 
তাঁর নাম ধরে ডাকেন, ভাঙান তাঁর শান্ত নিদ্রা।
কিন্তু কিছু করার নেই, শর্ত মানতেই হবে।

রওনা হলেন তাঁরা। প্রথমে কবি নিজে, আর তারপর, এবং ঠিক 
তারপরও ওই, দেবতার চটির চটচট, তার পায়ের মৃদু মেয়েলি টুপটাপ 
পরনের ঘিরে থাকা জোব্বার জন্যে অনিশ্চিত পদচারণা।
হঠাৎ চমকালো সামনের খাড়া চড়াই পথ 
অন্ধকার গুহার দেওয়ালের মতন।
কবি থামলেন এবং কান খাড়া করলেন। তারাও থামলো 
এবং থামলো তাদের পদশব্দের প্রতিধ্বনি।
আবার তিনি চলতে শুরু করলে, দ্বৈত পদশব্দও শুরু হল।
কখনো খুব কাছে, কখনো বেশ দূরে।
ফাটল ধরলো তার বিশ্বাসে, সন্দেহ জাগলো 
এবং জড়ালো তাকে শীতল পুষ্পলতার মতন।
যে কোনো মরণশীল মানুষের মতন তাঁর অবস্থা এখন,
মৃতকে জাগিয়ে তোলার মানবিক আশা হারিয়ে তিনি অসহায়,
কান্না পায়, কিন্তু উপর নেই কাঁদার।
নীরব তাঁর বীণা, তবু তিনি স্বপ্ন দ্যাখেন, প্রতিরক্ষাহীন একা।
মনে বিশ্বাস রাখা প্রয়োজন, কিন্তু বিশ্বাস এখন অসম্ভব।
আরও অনেকটা পথ -- সহ্য করো, ধৈর্য ধরো;
আধো নিদ্রায় পা গুনে গুনে হাঁটেন তিনি।

ভোর হয়ে আসে। চোখের সামনে জেগে ওঠে পাহাড়।
পাতাল থেকে উজ্জ্বল চোখে বেরিয়ে আসেন তিনি।
যা ভেবেছিলেন, তাই হল। পেছন ফিরে তাকালেন তিনি --
শূন্য পথ জনহীন, কেউ কোথাও নেই।

সূর্য এবং আকাশ। সাদা সাদা মেঘ আকাশে।
কেঁপে ওঠে চরাচর তাঁর শ্রবণে - ইউরিডাইস!
তোমার সঙ্গে ছাড়া, সান্ত্বনা ছাড়া কিভাবে বাঁচবো আমি!
চারিদিকে বুনো ওষধির সুরভিত সুগন্ধ, মৌমাছির মৃদু গুঞ্জন,
সূর্যালোকে উষ্ণ ধরায় কপোল ছুঁইয়ে নিদ্রা যান কবি।

টীকা : যেহেতু গ্রিক পুরাণের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ অনিয়মিত এবং সুদূর, কবিতাটির চরিত্রগুলির বিষয়ে অল্প কিছু কথা বলা বিধেয়।

পাতাল: গ্রিক পুরাণে এবং বাইবেলের নতুন সুসমাচার উল্লিখিত হেইডিজ; মৃত মানুষের বাসস্থান।

অর্ফিউস: গ্রিক পুরাণের কবি ও গায়ক। মৃতা স্ত্রী ইউরিডাইস এর আত্মাকে অনুসরণ করে তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন পাতালে এবং সম্রাট প্লুটোকে খুশি করে অনুমতি পান স্ত্রীকে মর্ত্যে ফিরিয়ে আনার। শর্ত ছিল, ইউরিডাইস স্বামীর পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে মর্ত্যের দিকে যাবেন। কিন্তু পিছু ফিরে তাকানো চলবে না অর্ফিউসের। যাত্রাপথের প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছে অর্ফিউস পেছন ফিরে তাকান এবং ইউরিডাইস হারিয়ে যান চিরকালের মতন। প্রসঙ্গত: উল্লেখযোগ্য যে কবির স্ত্রী ক্যারোলের মৃত্যু হয় ২০০৩ সালে এবং তার কয়েক মাস পরে কবিরও মৃত্যু।

পার্সিফনি: গ্রিক দেবতা জিউস এবং ডিমিটারের কন্যা। পাতালের সম্রাট প্লুটো তাঁকে হরণ করে আনেন এবং রানির মর্যাদা দেন। স্ত্রীকে তিনি অনুমতিও দেন প্রতি বছর কয়েক মাস মর্ত্যে এসে থাকার। ঠিক সেই সময় নাকি বসন্ত আছে ধরায়।

হার্মিস: স্বর্গের ঘোষক এবং সংবাদবাহক দূত। অবসর সময়ে পথ, বাণিজ্য, আবিষ্কার, শঠতা এবং চৌর্যবৃত্তির দেবতা।

[কবিতার ইংরেজি অনুবাদ করেছেন রবার্ট হাস এবং কবি নিজে। অনুবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল “দি নিউ ইয়র্কার” পত্রিকার মে ১৭, ২০০৪ সংখ্যায়।]


ভু হোয়াং চুয়ং, (ভিয়েতনাম, ১৯১৬-১৯৭৬)

কালো জলপরির প্রতি 

তোমার সঙ্গে আমার অভিসার হলে -- বাকি জীবন খেদ রাখবো না মনে;
অতীতে যা ঘটেছে, শোক করবো না তার জন্যে।
তোমার হালকা নীল চুলের বিনুনি দোলাও আমার গায়ে;
আর ওই বাদামি ধূসর ঠোঁট রাখো আমার ঠোঁটে।

আজকের রাত শীতল -- অন্ধকারে খুঁজে বেড়াই তোমায়,
তোমার হাতে তুলে দেব আমার ব্যর্থ বছরগুলি।
আমার প্রেমসত্তা কেন সেই পথেই ফিরে ফিরে আসে
যেখানে ঝুলছে অতীত হেমন্তের দু:খভরা স্মৃতি?

তুমি হয়তো জানো, এই পথ দিয়েই
প্রেম একদা গেল শুকিয়ে, স্বপ্ন ভেঙে টুকরো টুকরো।
পথের ধারে সাজানো করুণ সমাধি থেকে
চেনা সুখস্মৃতি টেনে ধরবে আমার পা।

আর না, প্রিয়তমা আমার, বিন্দুমাত্র সাহস পড়ে নেই --
অশ্রু ও ভালোবাসার স্রোতটিও গিয়েছে শুকিয়ে।
তোমার চোখের অন্তরালে আগুন জ্বালিয়ে রাখো আমার জন্যে 
দু:খের কণামাত্র এখনো লেগে আমার শুকনো ঠোঁটে।

এলিয়ে দাও আমার গায়ে তোমার আলুথালু চুল;
আমার ঠোঁটের ওপর রাখো তোমার স্বপ্নালু ঠোঁট।
তারপর, আলতো করে তুলে নাও আমায় তোমার ডানায়
বিস্মরণের ঢেউ এসে গ্রাস করুক আমার সর্বস্বকে। 

[ভিয়েতনামের জনপ্রিয় কবি, প্রাচ্যের ঐতিহ্য ও পরম্পরা নিষিক্ত তাঁর সাহিত্যে। প্রথমে লেখাপড়া করেছিলেন আইনশাস্ত্রে, পরে গণিতবিদ্যায় ডিগ্রি করেন। গণিতের শিক্ষক ছিলেন আজীবন। সুখ্যাত ভিয়েতনামি কবি দিন হাং (১৯২০-১৯৬৭) এর ভগিনীর প্রেমে পড়েন এবং বিবাহ ১৯৪৪ সালে। সায়গনে দক্ষিণ ভিয়েতনামের কবি ও সাহিত্যিকদের রাষ্ট্রীয় সংস্থার সভাপতি ছিলেন ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৩; ১৯৭৫ সালে সায়গনের পতনের পর তাঁকে জেলে বন্দি করা হয় এবং সেখানে গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন; জেল থেকে পাঁচদিনের ছুটিতে বাড়িতে এসে তাঁর মৃত্যু। কবিতা ছাড়াও তিনি গান এবং অপেরা রচনা করেছেন। ভিয়েতনামি ভাষা থেকে কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ হ্যান সান থং।]


শুয়ান দিউ: (ভিয়েতনাম, ১৯১৭-১৯৮৫)

প্রেমের জন্যে 

প্রেমের জন্যে অল্পক্ষণ মরে যায় হৃদয়,
তুমি ভালোবাসো, কিন্তু জানো কি সে ভালোবাসে কি না?
উজাড় করে দাও তুমি, বিনিময়ে পাও খুব অল্প --
অন্যেরা শোনে না তোমার কথা, ফিরে তাকায়।

জোড়ায় থাকো বা একা, তফাৎ নেই কোনো।
মলিন হয় চাঁদ, ফুল ঝরে, অন্তর শোকস্তব্ধ,
তুমি ভালোবাসো, কিন্তু জানো কি সে ভালোবাসে কি না?
প্রেমের জন্যে অল্পক্ষণ মরে যায় হৃদয়।

প্রেমের খোঁজে বেরোয় কামনাতাড়িত মূর্খেরা,
পথ হাতড়ায় অন্ধকার দু:খের দেশে।
জীবন হয়ে দাঁড়ায় সুখবিহীন মরুভূমি,
প্রেম গাঁটছড়া বাঁধে দু:খের সঙ্গে।
প্রেমের জন্যে অল্পক্ষণ মরে যায় হৃদয়।

[রোমান্টিক কবি, তাঁর প্রেমের কবিতা নারী ও পুরুষ উভয়ের প্রতিই নিবেদিত। ব্যক্তিগত জীবনে সমকামী ছিলেন, কিন্তু সারাজীবন গোপন রাখতে হয়েছিল সে কথা। ভিয়েতনামের স্কুলে পড়ানো হয় তাঁর কবিতা; হ্যানয় শহরের একটি রাজপথের নামকরণ তাঁর নামে। ভিয়েতনামি ভাষা থেকে কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন হ্যান সান থং।]


সিলভা কাপুটিকিয়ান: (আর্মেনিয়া, ১৯১৯-২০০৬)

নিরাপদে ফিরে এস 

কেবল একবারই “যাই” বলতে 
কেবল শেষবারের মতো হলেও 
অনিচ্ছা সত্ত্বেও 

কেবল আমাকে আঘাত দিতে হলেও 
কেবল সমালোচনার তীক্ষ্ণ হুল 
ফুটালেও 

এমনকী নতুন করে ব্যথা দিলেও 
এমনকী অন্য কোনো রমণীর 
শয্যা থেকে হলেও 

ফিরে এসো, এসো। 

[বিংশ শতাব্দিতে আর্মেনিয়ার প্রধান কবি। আর্মেনিয় এবং রুশ, দুই ভাষাতেই কবিতা লিখেছেন। রাজনৈতিক আন্দোলনের কর্মী এবং কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষস্থানীয় সদস্য ছিলেন। আর্মেনিয়ায় তাঁর নামে মিউজিয়াম, রাজপথ এবং বিদ্যালয়ের নামকরণ হয়েছে। আর্মেনিয় ভাষা থেকে কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ডায়ানা দার হোভানেসিয়ান (১৯৩৪-২০১৮)।]


পল সেলান: (রোমেনিয়া ও ফ্রান্স, ১৯২০-১৯৭০)

ফুল ফুটুক 

হেমন্ত তার পাতা চিবোয় আমার হাত থেকে: আমরা বন্ধু।
বাদামের খোসা থেকে সময় ছাড়াই, হাঁটতে শেখাই তাকে:
সময় আবার ঢুকে পড়ে খোসায়।

আয়নায় দেখা দেয় রোববার,
স্বপ্নের মধ্যে ঘুম,
ঠোঁট নড়লেই বেরোয় সত্যি কথা।

চোখ চলে যায় প্রেমিকার উরুসন্ধিতে:
চোখে চোখ পড়ে,
অন্ধকারের কথা বলে যাই আমরা।
পপিফুল আর স্মৃতির মতন সঙ্গমে মাতি,
ঝিমোই, ঝিনুকে মদ যেন,
সমুদ্রে চাঁদের রক্তক্ষরণ।

তাকে জড়িয়ে ধরে জানালায় দাঁড়াই, দ্যাখে পথচারী:
লোকজনের জানা উচিত এবার!
পাথর থেকে ফুল ফুটতে শুরু করুক,
হৃদয় স্পন্দিত হোক অস্থিরতায়।
তার সময় এসে গেছে।

এসে গেছে সময়।

[জন্মসূত্রে নাম “পল আন্টশেল, রোমেনিয়ার জার্মানভাষী ইহুদি পরিবারে জন্ম; হিটলারের ইহুদি হত্যাকাণ্ডে বিধ্বস্ত হয় তাঁর পরিবার, কেবল তিনি নিজে শ্রমশিবিরে বন্দি থাকেন ৩ বছর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে “পল সেলান” ছদ্মনামে জার্মান ভাষার প্রধান কবি। হলোকাস্ট-প্রলয়ের ছায়া তাঁর জীবনে ও সাহিত্যে। মৃত্যুশীতল, বিভীষিকার কবিতার ফাঁকে ফাঁকে কিছু নিটোল প্রেমের কবিতাও লিখেছিলেন। ৪৯ বছর বয়েসে প্যারিসের সেইন নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। জার্মান ভাষা থেকে কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ জন ফেলসটিনার (১৯৩৬- )।]


এডুইন মরগ্যান: (স্কটল্যান্ড, ১৯২০-২০১০)

স্ট্রবেরি 

এরকম ভালো স্ট্রবেরি 
আর কোনোদিন খাইনি 
সেই গুমোট বিকেলে 
কাচের দরজার ঠিক বাইরে 
সিঁড়িতে বসে
দুজনে মুখোমুখি 
আমার হাঁটুতে তোমার হাঁটু 
আমাদের কোলে নীল প্লেট 
উজ্জ্বল রোদে 
ঝকমক করছে স্ট্রবেরি 
তাদের চিনিতে ডুবিয়ে 
একে অন্যের দিকে তাকাই 
খেতে তাড়াহুড়ো নেই 
একটার পর একটা 
দুই খালি প্লেট 
একসঙ্গে পাথরে রাখা 
দুটো ফর্ক আড়াআড়ি 
আমি কাছে সরে আসি 
মধুর বাতাসে 
বাহুর বন্ধনে 
শিশুর মতন পরিত্যক্ত 
তোমার অধীর ঠোঁট থেকে 
স্ট্রবেরির স্বাদ 
আমার স্মৃতিতে 
হেলান দিই আবার 
ভালোবাসতে দাও 
সূর্য এসে আঘাত করুক 
আমাদের ভুলো মন 
এক ঘন্টার মতন 
উদ্দাম উত্তাপ 
আর কিলপ্যাট্রিক পর্বতে 
কালবোশেখির বিদ্যুৎ 

ঝড় এসে প্লেট ধুয়ে দিক 

[স্কটল্যান্ডের প্রথম আধুনিক কবি এবং সেই দেশের সাহিত্যের নবজাগরণের পুরোধা। মার্কিন বিট কবিদের দ্বারা অনুপ্রাণিত। “মেরিলিন মনরোর মৃত্যুতে” তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতা। ২০০৪ সালে তিনি স্কটল্যান্ডের “জাতীয় কবি” নির্বাচিত হন।]


ব্লগা দিমিত্রোভা: (বুলগেরিয়া, ১৯২২-২০০৩)

মরুভূমি 

আমি জন্মেছিলাম ভালোবাসা দিতে 
আর ভালোবাসা পেতে।
কিন্তু শেষ হতে চললো আমার জীবন 
প্রেম ছাড়াই।

সব ক্ষমা করে দিই আমি:

অভিযোগ করি না 
এত ধূসর মরুভূমি 
পার হবো কেন?

বিস্ময়-জড়ানো চোখে 
তাদের শুধোই:

কোন গুলবাগিচার পথে 
নিয়ে চলেছে আমায়?

কাল দেখা হবে 

“কাল দেখা হবে,” বলে চলে গেলে তুমি।
ভয়ার্ত দুচোখে বিদায় দিলাম তোমায়।
কাল দেখা হবে তো কিন্তু আগামীকাল 
অবর্ণনীয় দূরে। আর কত প্রহর একা একা থাকবো আমরা?

কাল পর্যন্ত দেখতে পাবো না আমি 
তোমার আননে রৌদ্র-ছায়ার খেলা,
তোমার কণ্ঠস্বরের উষ্ণ ওঠানামা,
তোমার চিন্তাসূত্রের গোপন ক্ষরণ।

রাত ভোর হবার আগে, তোমার তেষ্টা পেলে --
সুস্বাদু ঝর্ণা হয়ে সামনে দাঁড়াবো না আমি,
শীতে কাতর হলে --
আগুন শরীরে জড়াবো না তোমায়র
অন্ধকার এলে --
হবো না তোমার চোখের আলো।

“কাল দেখা হবে,” বলে বিদায় নাও তুমি,
আমার জবাব কানেও নাও না তুমি।
আমি চাই তুমি বলবে,
“একমাত্র মৃত্যু এসে বিচ্ছিন্ন করবে আমাদের!”
আর সঙ্গে থাকবে চিরকাল।

[পূর্ব ইউরোপের প্রধান কবি এবং বুলগেরিয়ার উপ-রাষ্ট্রপতি ছিলেন। এঁকে নিয়ে একটি গল্প লিখেছেন মার্কিন লেখক জন আপডাইক (১৯৩২-২০০৯) -- “বুলগেরিয়ার নারীকবি“। স্লাভিক ভাষা থেকে কবিতা দুটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন নিকো বরিস এবং হেদার ম্যাকহিউ।]

নভেম্বর ২০১৯ [ক্রমশঃ]

0 comments: