0

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in




















১৪. অ্যানি এরনো, যার লেখা নিজের স্মৃতিকেই অবিশ্বাসের মুখে দাঁড় করায়





প্রিয় বাসু,

গতকাল তোমার চিঠি পেয়েছি। বেনারস ভ্রমণ শেষ করে নিশ্চয় ফিরে গেছো। খুব ছোটবেলায় বেনারস গিয়েছিলাম বাবা মায়ের সাথে, সে স্মৃতি ফিকে হয়ে এসেছে। বেনারসও নিশ্চয় বদলে গেছে অনেক। কি অবাক কান্ড দেখো তুমি যখন রেলগাড়ির কামরায় বসে ভার্জিনিয়া উলফের আত্মহননের কথা লিখছো আমি তখন পড়ছি অ্যানি এরনোর দ্য ইয়ার্স। ষাটের দশকে, যখন অ্যানি এরনোর বয়স কুড়ি থেকে পঁচিশ, তখন ভার্জিনিয়া উলফ পড়ে পড়ে তার মধ্যে লেখালেখির তীব্র ইচ্ছা ঘনিয়ে উঠেছিল। কাছাকাছি সময়ে আঁদ্রে ব্রেটনের ‘ফার্স্ট ম্যানিফেস্টো অব সুররিয়ালিজম’ পড়ে জীবন এবং লেখালেখির ও জীবনযাপনের একটি পথরেখার সন্ধান পেয়েছিলেন। জারমেইন গ্রিয়ারের ‘দ্য ফিমেইল ইউনাক’ বইটি তার দার্শনিক চিন্তায় নারীর সামাজিক অবস্থানকে প্রবিষ্ট করে দিয়েছিল। ১৯৬৫-তে প্রকাশিত হয় জর্জ পেরেকের ‘ষাটের গল্প : বিষয় আশয়’। জর্জ পেরেকের রচনাকৌশল তাকে ভাবিয়েছিল। এই সবকিছু তাকে চেনা-পরিচিত জগৎকে নতুন করে উপলব্ধির দিকনির্দেশনা দিয়েছিল। ভার্জিনিয়া উলফের মতো তারও মনে হয়েছিল লিখতে হলে প্রথমে বর্ণনাতীত বাস্তবকে তীব্রভাবে অনুভব করে নিতে হবে। লেখালেখির লক্ষ্য হবে হৃদয়ের গভীরে অনুভূত বাস্তবকে সাহিত্যের নতুন কোনো ভাষায় উত্থাপন করা। তুমি অ্যানি এরনোর লেখা পড়েছো কিনা জানি না, আমি এর আগে এই লেখকের কিছুই পড়িনি, আর পড়িনি বলেই আফসোস হচ্ছে। মনে হচ্ছে কত কম জানি আমি! উনাকে যত পড়ছি আমি মুগ্ধ হচ্ছি। দ্য ইয়ার্স বইটি ফ্রান্সের অর্ধ-শতাব্দীর এবং পরিবর্তনের বিবরণ। এর সঙ্গে বিশ্বের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো যেমন বিটলস, ৯/১১, ইরাকের যুদ্ধ, ইত্যাদি বিষয়কে ফরাসী দৃষ্টিকোণ থেকে লেখক উপস্থাপন করেছেন। উত্তর-পশ্চিম ফ্রান্সের নরম্যান্ডির ছোট্ট শহর ইভতো-তে ১৯৪০ সালে জন্ম ও বেড়ে ওঠা অ্যানির। আধুনিক সাহিত্যে স্নাতকোত্তর হওয়ার পরে কিছু দিন স্কুল শিক্ষিকার কাজ করেন। তার পরে ১৯৭৭ সালে অধ্যাপিকা হিসেবে যোগ দেন ফ্রান্সের দূরশিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় ‘সিএনইডি’-তে। ২০০০ পর্যন্ত সেখানেই অধ্যাপনা করেছেন তিনি। লেখালিখি শুরু করেন যখন বয়স ত্রিশের কোঠায়। এক সাক্ষাৎকারে অ্যানি বলেছিলেন, ‘‘লেখক হয়ে ওঠার পথটা আদপেই সহজ ছিল না।’’ ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘লে আরমোয়ার ভিদ’। আদ্যন্ত আত্মজৈবনিক এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার পরেই তার ‘সাহসী’ কণ্ঠস্বরের জন্য সাড়া ফেলে দিয়েছিল। ‘দ্য ইয়ার্স’ গ্রন্থকে ফরাসি জীবনের স্মৃতিচারণার ‘মাস্টারপিস’ বলেন সাহিত্য সমালোচকেরা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাময়িকী দ্য নিউইয়র্কার ২০২০ সালে লিখেছিল, অ্যানি এরনো তাঁর ২০টির বেশি বইয়ে শুধু একটি কাজ করেছেন: নিজের জীবনের খুঁটিনাটি তুলে আনা।

কয়েকমাস আগেই আমি অ্যানি এরনোর নাম শুনি, তখন থেকেই তাকে নিয়ে যেখানে যা পাচ্ছি তাই পড়ছি। তাঁর কাহিনি কখনও চলে ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণের পথ ধরে। কখনও সেই পথ থেকে দৌড়ে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ান তিনি। ব্যক্তিগত স্মৃতিকেই দেখেন দূর থেকে। নিজের স্মৃতিকে নিজেই অবিশ্বাস করেন। নিজেকে নিজেই প্রশ্নের সামনে দাঁড় করান। ফরাসি ভাষার স্মৃতিচারণ মূলক সাহিত্য চর্চা তিনি করেন। তাই বার বার তাঁর সঙ্গে তুলনা চলে এসেছে প্রায় একই ঘরানার কিংবদন্তি সাহিত্যিক মার্সেল প্রুস্তের। তিনি কি প্রুস্ত দ্বারা অনুপ্রাণিত? যদিও অ্যানি বলেছেন, তাঁর উপর প্রুস্তের প্রভাব খুবই কম। বরং তাঁর উপর অনেক বেশি প্রভাব রয়েছে আমেরিকার সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের। খুব সচেতনভাবেই তিনি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন ফরাসি সাহিত্যের সব ধরনের বৈশিষ্ট্য। ভাষাটুকু বাদ দিয়ে তিনি নিজেই হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছেন একেবারে স্বতন্ত্র এক ঘরানা। ফরাসি ‘মিঠে বোল’, মেদুরতা, রোম্যান্টিসিজমকে বুড়ো আঙুল দেখাতেই ভালো লেগেছে তাঁর। নিজ ভাষ্যেই তিনি হয়ে উঠেছেন কর্কশ, কঠিন, এবং অবিশ্বাসী। আর সেটিই তাঁকে তাঁর নিজের দেশ, নিজের ভৌগলিক সীমারেখা, নিজের জাতিসত্ত্বার থেকে অনেক দূরে নিয়ে গিয়ে ফেলেছে। আশ্চর্য় বিষয় কি জানো ২০০৮ সালে প্রকাশিত এই বইটিকে ইংরেজি অনুবাদক এলিসন স্ট্রেয়ার এরনোর অন্যান্য রচনাগুলির নিরিখে এক বিচ্যুতি বলেছেন। আপাতভাবে কথাটি যথার্থ। রচনার দৈর্ঘ্যে, বা বহু স্বরের ব্যবহারে এমনকী এর বিশাল ব্যাপ্তিতেও এই বই এরনোর অন্যান্য বইয়ের থেকে আলাদা। কিন্তু নিহিত বিচারে এই বইয়ের মধ্যেও লক্ষ্য করা যায় তাঁর লেখার সাধারণ চিহ্নগুলি। এই বইয়ের মতোই একের পর এক বইতে নিজের অতীতে ফিরে গিয়েছেন এরনো, এটি সম্পূর্ণ অনুভূতিহীন গল্প। লেখক কমই প্রকাশ করেছেন নিজকে। অথচ পুরোটাই ব্যক্তিগত গল্প। পরিবার, সন্তান, লেখকের বিয়ের সমাপ্তি এসেছে, কিন্তু আসেনি প্রেম। অ্যানির মায়ের আলঝেইমার এসেছে, বেড়ালের চোখের দিকে তাকানোর সঙ্গে খেয়াল করা এবং প্রাক্তন প্রেমিকা যখন একজন কম বয়সী সঙ্গীকে খুঁজে পায় - এসব নিয়ে তাঁর ঈর্ষার কথা, কিন্তু অন্যগুলো একেবারেই আবেগহীন। আর সেখান থেকে খনন করে এনেছেন নানান স্মৃতিচিহ্ন, যেগুলিকে জড়ো করে পুনর্নির্মাণ করেছেন একেকটা অধ্যায়। নিজেকে বুঝবার জন্য তো বটেই, একইসঙ্গে নিজেকে ভেঙেচুরে নিজের মাধ্যমে জীবনকে বুঝবার এক বিরামহীন প্রয়াসে ব্রতী হয়েছেন। ভাষাকে ছুরির মতো ব্যবহার করেন তিনি, যা কল্পনার পর্দা ছিঁড়ে ফেলবে। সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সী, ফেলুদা কিংবা হালের একেন বাবুর অপরাধ দৃশ্য পুনর্নির্মাণ করার মতো তাঁর লিখনপদ্ধতি। যেখানে কেউ সন্দেহের বাইরে নয়, নিজের স্মৃতিকেও বারংবার প্রশ্নচিহ্নের সামনে এনে দাঁড় করাচ্ছেন। সশরীরে ফিরে যাচ্ছেন স্মৃতিবিজড়িত জায়গাগুলিতে। কুড়িয়ে নিচ্ছেন কিছু বস্তুনিষ্ঠ সূত্র, কিছু ইঙ্গিত — কখনো নিজের ডায়েরির পাতা, কখনো কোনো সাদা কালো ছবি, কখনো কোনো বিজ্ঞাপনের সুর, কোনো গানের লাইন, কোনো বন্ধুর করা একটা আলগা মন্তব্য। স্মৃতির ফাঁকফোঁকর দিয়ে যাতে কোনোমতেই মিথ্যার অনুপ্রবেশ না ঘটে, তাই তাঁর এই নিরলস পরিশ্রম।

'ইন আ উওম্যানস্ স্টোরি'তে অ্যানি লেখেন, "আমি কেবল কুড়ুনি মাত্র"। তাই তাঁর লেখায় শুধু নিজের কথাই লেখেননি। সেখানে জড়ো হয়েছে তাঁর প্রজন্ম, তাঁর বাবা মায়ের প্রজন্ম এবং নানান শোষিতের কথকতা। এই বিশাল ব্যপ্তির স্তরে স্তরে গাঁথা যৌনতা ও অন্তরঙ্গতার থিম, সামাজিক বৈষম্য, যন্ত্রণা, লজ্জা— এই ইঁটেদের ফাঁকে ফাঁকে সময় আর স্মৃতির দ্বৈরথ। অথচ এমন থিমের বয়ান অত্যন্ত সাদামাটা গদ্যে। পাঠকের হাত ধরে সেই গদ্য করে তোলে নানান দ্বন্দ্বের মধ্যমণি। সে কারণেই এমন সরল গদ্য বেছে নেওয়া। অথচ এই সরলতার মধ্যেও এরনোঁর নিজস্ব বোধ কাজ করে ক্রমাগত। যে বোধ চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, কোনও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তা এক নির্দিষ্ট সমাজ-রাজনীতির অংশ। এই রাজনৈতিক বোধ অভিজ্ঞতাকে 'ব্যক্তিগত' বলে ঝেড়ে ফেলা যায় না। স্মৃতিও পিচ্ছিল। যার একদিক অস্বচ্ছ, অপরিষ্কার, সেদিকটা পক্ষপাতিত্বের ভার জমে জমে ক্রমশ ঝুঁকে গিয়েছে। কাজেই ভরসার অযোগ্য। তাতে ভরসা করলে আছাড় অনিবার্য। সেদিক থেকে তাঁর উক্তির সত্যটা খানিক খাটে বৈকি! কুড়ুনি হিসেবে তাঁর কাজ আদতে নৃতত্ত্ববিদের মতোই। খুঁড়ে খুঁড়ে ধ্বংসাবশেষ টুকু তোলা, ফসিল জমানো, সেই সব টুকরো জীবন তারপর এক তালে বাঁধার চেষ্টা। তাতে এই মহাকালের নিরিখে ব্যক্তির অবস্থান ফুটে ওঠে। যতটা ফোটানো যায় আর কী! তারই চেষ্টা মাত্র। অ্যানি এরনোকে যতটা পড়েছি আমার মনে হয়েছে শুধুমাত্র গল্প ও বিষয়বস্তু নয়, ফর্ম সম্পর্কে বেশি দৃষ্টি দিয়েছেন তিনি। তাঁর গদ্যশৈলীও এই কাজে তাঁর সহায়ক ও পরিপূরক। নির্মেদ, অনাড়ম্বর ঝরঝরে বাক্যগুলো যেন বিজ্ঞানের বস্তুনিষ্ঠা আর সাহিত্যের সত্যের মধ্যে এক আশ্চর্য্য মেলবন্ধন। তাঁকে পড়তে গিয়ে বারবার মনে হয় এই পাঠ ধ্রুব নয়। গতিহীন নয়। পড়ার প্রতিটি বাঁকে, প্রতিটি স্মৃতিচারণে, যতবার সে পাঠের দিকে নজর ফেরে পাঠ বদলে যেতে থাকে। অনবরত নিজের স্মৃতির প্রতি পাঠককে সন্দিগ্ধ করে তোলেন এরনো। নিজ অতীতের ময়নাতদন্তে লেখিকা খোদ পাঠকের ভিড়ে মিশে যান। থেকে থেকে উঠে আসে বিবিধ ধারাবিবরণী। নিজের সম্বন্ধে হোক বা দুনিয়ার, কোনো কিছুই লুকোচ্ছেন না এরনো। শরীরে আগত এই নতুন প্রাণটির প্রতি কোনো দয়ামায়া তার হয়নি, হয়নি অপত্যস্নেহের উন্মেষ। নিজের ডায়েরিতে নিজেকে ‘গর্ভবতী’ বলে উল্লেখ তো করেন নি, জরায়ুর অভ্যন্তরে থাকা প্রাণটিকেও শুধুমাত্র একটি বস্তু হিসেবে দেখেছেন, লিখেছেন ‘জিনিসটা’, ‘ওটা’। কলেজের এক পুরুষ সহপাঠী, সে তখন আন্দোলন করছে মেয়েদের নানা অধিকার নিয়ে, তাকে সবটা বলেছেন, কিন্তু সাহায্য পাওয়া তো দূরস্থান, বরং সেও সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছে। এরনো ক্ষোভ প্রকাশ করছেন না, বরং সহজভাবে লিখছেন, “আসলে, ঘটনাটা শুনে ওর মনে আমার সম্পর্কে ধারণাটা পাল্টে গিয়েছিলো, আমি তখন সেই ধরনের মেয়ে যে ‘হ্যাঁ’ বলবে, ‘না’ বলবে না। ছেলেরা তখন এই দুই ভাগেই মেয়েদের ভাগ করতো।” এইসব খোলামেলা স্বীকারোক্তির পাশাপাশি, তাঁর লেখায় অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে খুঁটিনাটি জিনিসের স্মৃতি। ঋতুস্রাবের রক্ত, একটা ছোপ লাগা অন্তর্বাস, একটা সরু লম্বা দণ্ড (যেটা যোনির মধ্যে ঢুকিয়ে গর্ভপাত করা হবে), একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা, একটা ওষুধের শিশি — ছোট ছোট এই ছবিগুলি ছড়িয়েছিটিয়ে থাকে তাঁর লেখায়, অতীতকে জ্বলজ্যান্ত করে তোলে। মনে পড়ে যায় টি এস এলিয়টের নৈর্ব্যক্তিকতার তত্ত্ব — objective correlative : কবিতা হলো কবির ব্যক্তিগত আবেগ বা অনুভূতির প্রকাশ নয়, বরং আবেগ থেকে মুক্তি। এই তত্ত্ব অনুসারে, একজন কবিকে ঐতিহ্য ও ব্যক্তিগত প্রতিভার মধ্যে একটি ভারসাম্য রাখতে হয়, যেখানে কবি ঐতিহ্যকে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জন করেন এবং এর মাধ্যমে তিনি অতীত ও বর্তমানের মধ্যে একটি 'যুগপৎ ক্রম' তৈরি করেন। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কবি একটি 'নৈর্ব্যক্তিক' শৈল্পিক সত্তা তৈরি করেন, যা তাঁর ব্যক্তিগত অনুভূতিকে ছাপিয়ে যায়। কবি তাঁর ‘আমি’কে আনবেন না কাব্যে, তাঁর অনুভূতির, যন্ত্রণার বর্ণনা করবেন না; তিনি শুধু কিছু শব্দ, কিছু বস্তু, কিছু ছবি সাজিয়ে দেবেন, পাঠকের মনে দৃশ্যটি আপনিই ফুটে উঠবে, অনুভূতিগুলি জাগরুক হবে। নারীবাদীরা সঙ্গত কারণেই তাঁকে দলে টেনেছেন। তাঁর লেখায়, যাপনে, দৃষ্টিভঙ্গিতে বুভোয়ার, গ্রিয়ার, মিলেটদের ছাপ অনস্বীকার্য। কিন্তু কোলরিজ যেমনটা বলেছিলেন, প্রকৃত স্রষ্ঠার মন লিঙ্গভেদের ঊর্ধ্বে। এরনোর লেখায় তাই নারীজীবনের কথা মর্মে মর্মে অনুধাবন করতে পুরুষ পাঠকের সমস্যা হয় না। দেশকালের তফাতে অনেক ছোটখাটো রেফারেন্স হয়তো সবসময় ধরা যায় না, কিন্তু একটা জীবনের মধ্যে দিয়ে সময়ের বহমানতা, একজন ব্যক্তির মধ্যে দিয়ে সমাজের গতিপ্রকৃতি, আর সর্বোপরি একজনের স্মৃতির মধ্যে দিয়ে সর্বজনীন সত্যের প্রকাশ পাঠক সহজেই দেখতে পান। তাঁর অ্যাবর্শনের ট্রমা, খেটে খাওয়া পরিবারের মেয়ে হওয়ার লাঞ্ছনা, নিজেকে শিক্ষিত করার অবিরত চেষ্টা পুঙ্খানুপুঙ্খ ফুটে ওঠে কালের কাগজে। পুরুষশাসিত এই দুনিয়ায় নারীর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব কতটুকু স্বীকৃত? হয় এক নিমেষে বাতিল করা, ছোট করা নয় নিজের আকাঙ্ক্ষার সামগ্রী হিসেবে আপন করা— এই দুই গত পুরুষের। এর বাইরে নারীকে একজন মানুষ হিসেবে কি আজও স্বীকৃতি দিয়েছেন পুরুষেরা? আত্মনির্ভরতার হিসেব নারীর এখনও বুঝে নেওয়া বাকি— এরনোর 'কুড়ুনিয়া' সাহিত্য আমাদের বারবার এই নগ্ন সত্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। প্রলেপের বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করেই।

নিজের অতীতকে এতো শীতল, বস্তুনিষ্ঠ গদ্যে ফুটিয়ে তোলা, প্রায় আবেগহীন, বাহুল্যবর্জিতভাবে — এমন উদাহরণ বিশ্বসাহিত্যে বিরল বললেও অত্যুক্তি করা হবে না! আত্মজৈবনিক রচনায় তা আরোই অপ্রতুল। সর্বত্র নিজেকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানোর যুগে, আত্মপ্রেমে ও আত্মগরিমায় হাবুডুবু খাওয়ার, আর অহরহ সত্যের সাথে মিথ্যেকে গুলিয়ে ফেলার এই সময়ে এমন একটি নৈর্ব্যক্তিক, ঋজু ও সত্যনিষ্ঠ স্বর তাই বিশ্বের পাঠককূলের কাছে এক আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবে, সন্দেহ নেই। ‘আমি’কে ছাপিয়ে যেতে পারা, নিজের অতীতকে এক নির্লিপ্ত দূরত্ব থেকে দেখতে ও দেখাতে পারা — এটাই বোধয় অ্যানি এরনোর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব, যা তাঁর আত্মকথাগুলিকে সাহিত্যপদবাচ্য করে তুলেছে, এনে দিয়েছে সাহিত্যের সর্বোচ্চ পুরস্কার।

অ্যানি এরনো আমাকে মোহগ্রস্থ করে ফেলেছে। তোমার ভ্রমণ কেমন হলো? বেনারস ছাড়া আর কোথায় কোথায় গেলে? সব কিছু জানার অপেক্ষায় রইলাম। আমার চিঠি তোমার হাতে যাবার আগেই হয়ত তোমার চিঠি পাবো, নিরন্তর ভালো থেকো। মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের গেছে যে দিন সে কি একেবারই গেছে, কিছুই কি নেই বাকি? অ্যানি এরনো পড়তে পড়তে নিজেকে কোথায় খুঁজে পাচ্ছিলাম। আচ্ছা আমাদের ব্রেকাপটা কেন হয়েছিল বলতে পারো? তোমার কি আমাকে দায়ী মনে হয়? অনেক প্রশ্ন ঘিরে ধরছে, ঘড়ির কাটা চার ছুঁই ছুঁই করছে, কাল অফিস আছে তাই আর লিখছিনা।


অন্তে ভালো হোক

সুস্মি

০১.১০.২০২৫

0 comments: