1

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - নীলোৎপল বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in

আমরা বিশ্বযুদ্ধ দেখিনি, ৭৬ এর মন্বন্তর দেখিনি, ৪৭ এর দেশভাগ বা ভারত-চিন যুদ্ধ দেখিনি। দেখিনি ১৯৭১ এর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। দেখেছি কার্গিল যুদ্ধ, দেখেছি টুইন টাওয়ার-পেন্টাগন আক্রমণ, দেখেছি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা। দেখেছি সারদা-রোজভ্যালি কাণ্ডের পর বাংলায় অর্থনৈতিক ডামাডোল। আমরা সার্স, বার্ড-ফ্লু, ইবোলা এগুলোও দেখেছি, শুনেছি, পড়েছি কিন্তু গায়ে মাখিনি। বার্ড ফ্লুতে মুরগি সস্তা হওয়াতে নতুন ওটিজি কিনে চিকেন কাবাব বানানোতে হাত পাকিয়েছি। চিনে বা মধ্যপ্রাচ্যে সার্স বা মার্স হওয়াতে নিশ্চিন্ত থেকেছি। গালমন্দ করেছি ‘ওদের’ বৃহস্পতি-শনি নিরামিষ খাওয়া ‘মহান’ আমরা। ভাগাড় কাণ্ডেও একইরকম আচরণ করেছি। 

এবার আর ছাড় নেই। নিজের ঘরে আগুন লেগে গেছে। আমরা চলছি মানব ইতিহাসের এক অন্যতম অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে যার কথা মনে রাখবে মানুষ চিরকাল, যেমন রেখেছে ব্ল্যাক ডেথের কথা! মানুষের সামাজিক পরিস্থিতির পাশাপাশি বিবেচিত হবে অর্থনৈতিক তথা মানসিক পরিস্থিতিও। ব্ল্যাক ডেথের সময় মানুষগুলোর মানসিক টানাপোড়েনের কথা কতটুকু জানতে পারি আমরা! কিন্তু মানবসৃষ্ট তথ্য-প্রযুক্তির কল্যাণে, আজকের এই পরিস্থিতিতে আমাদের ছোট ছোট মুহূর্তের ইমোশনগুলোও স্মৃতি হয়ে দেখা দেবে ফেসবুক মেমোরিতে এক বছর পরে। লেখাজোখা সবই থেকে যাবে হাজার বছর পরেও। গবেষকরা গবেষণা করবেন এই পরিস্থিতি নিয়ে আগামী বহু বছর। কত থিসিসে লেখা থাকবে আজকের দিনপঞ্জির যোগভাগগুলো। 

আজকে আমরা ক্ষণিকতার প্রভাবে দুষ্ট সকলেই। চণ্ডীমণ্ডপ যেমন উঠে এসেছে ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপে, আমরাও সকালে মনকেমন নিয়ে পোস্ট দিয়ে, বিকেলেই নেচে গেয়ে ভিডিও আপলোড করে দিচ্ছি। এইসবের মাঝে একটা জিনিস খুব চোখে পড়ছে, যে কারণে সরকার থেকে নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে যে গুজব ছড়ানো চলবে না, ছড়ালে উপযুক্ত শাস্তি হবে। সেই গুজবের অনেকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রকট হল, এই কোরোনা ভাইরাস ডিজিজ-২০১৯ বা সংক্ষেপে কোভিড-১৯ একটি জৈব-সন্ত্রাস। চিন এর মূল হোতা, কেউ কেউ আমেরিকাকেও দুষছেন সমানভাবেই। কেউ কেউ আরো একধাপ এগিয়ে বলছেন যে এই রোগটাই আসলে ভুয়ো এবং চিন নিজের একচ্ছত্র অধিকার স্থাপন করতে এই রোগ ছড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বময়। এর পেছনে অকাট্য যুক্তি খানিকটা এইরকম যে চিন নিজে ওষুধ আবিষ্কার করে ফেলেছে, অথচ বাকি বিশ্বকে সেটা জানাচ্ছে না, চিন এত তাড়াতাড়ি উহান প্রদেশকে রোগমুক্ত করে ফেলল কী করে যেখানে সেখান থেকে সারা দুনিয়ায় সার্স-কোরোনা ভাইরাস-২০১৯ ছড়িয়ে পড়েছে, ইত্যাদি আরও অনেক কিছু।

আমাদের এই চণ্ডীমণ্ডপের আলোচনা মজ্জাগত। ফেসবুক-হোয়াটসএপের তাৎক্ষণিকতায় তাকে ছড়িয়ে দেওয়া আরো সহজ হয়েছে। সেই ছাগল-চোর-ব্রাহ্মণের গল্পের মতন অনেক যুক্তিবাদীও টানা মিথ্যা শুনতে শুনতে ‘যা রটে তা কিছু বটে’ ভেবে টেবে এগুলো বিশ্বাস করতেও শুরু করে দিয়েছেন। মুশকিল হচ্ছে, যারা যুক্তিবাদী বা বিজ্ঞানচর্চা করেন তারাও এগুলো শেয়ার করে সাধারণ মানুষের ভয় বাড়িয়ে দিচ্ছেন। আমেরিকার এক আইনজীবী তো নানা যুক্তি সাজিয়ে প্রমাণ করেই ফেলেছেন যে এই ভাইরাস প্রকৃতির ‘স্পিলওভার ইভেন্ট’ নয়, চিনের ল্যাবে জৈব মারণাস্ত্র হিসেবে বানানো। সবথেকে ভয়ানক হলো চিকিৎসকরা পর্যন্ত গুজব শেয়ার করছেন। এর একটা কারণ হল, ভাইরাস সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাব। অন্য ক্ষেত্রের মানুষের কথা বাদই দিলাম, চিকিৎসকরা অবধি বাস্তবে ভাইরাস সম্পর্কে খুবই কম ধারণা রাখেন। ভাইরাল রোগগুলির চিকিৎসা প্রায় সবক্ষেত্রেই উপসর্গভিত্তিক এবং চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য উপসর্গের উপশম। তাই খোদ কলকাতা শহরের খুব খুব বিখ্যাত ও সিনিয়র শিশুরোগবিশেষজ্ঞ র‌্যাশ নিয়ে দুদিনের জ্বরে ভোগা শিশুকে ডেঙ্গির আইজিএম এলাইজা পরীক্ষা করতে দেন। যেখানে দেওয়ার কথা এনএসওয়ান, কারণ ডেঙ্গির ক্ষেত্রে শরীরে আইজিএম তৈরিই হয় সংক্রমণের পাঁচদিনের মাথায়। অতএব চিকিৎসকদেরও এবিষয়ে কতখানি সম্যক জ্ঞান রয়েছে সেটাও ভেবে দেখার মতন। আবার মহাভারতের মতন এমবিবিএস পাঠ্যক্রমে মাইক্রোবাইয়োলজিতে ভাইরোলজির জায়গাটা খুবই সীমিত। প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে আশির দশক থেকে ভাইরোলজিতে ক্লিনিক্যাল এমফিল ও এমডি পাঠক্রম চালু হলেও ভারতে এমসিআই কেন সে বিষয়ে দৃষ্টি দেন নি, সে কারণ আমার অজানা। একই যুক্তি খাটবে ইমিউনোলজিতে স্নাতকোত্তর পাঠক্রমের ক্ষেত্রেও। মলিক্যুলার বায়োলজি ত সেদিনের বিষয় এবং এমবিবিএসের নতুন পাঠক্রমে অল্পদিন হল অল্পভাবে সেটাও ঢুকেছে। কিন্তু আজকের পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এই তিনটি বিষয়ের ওপর প্রকৃত বিশেষজ্ঞের অভাব মালুম হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা রয়েছেন। তাঁরা বহুদিন ধরেই উচ্চমানের গবেষণা করে চলেছেন এই বিষয়গুলো নিয়ে। কিন্তু এরকম নতুন ভাইরাল মহামারির ক্ষেত্রে, যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক-পুল দেশের প্রয়োজন, তা সংখ্যায় অপ্রতুল। উপযুক্ত ‘ক্লিনিক্যাল-আই’ এবং গবেষণার অভিজ্ঞতা থাকলেই এইরকম ক্ষেত্রে দ্রুত সঠিক দিশা দেখানো সম্ভব।

এই প্রতিবেদনে আমি ২০২০ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত দুটি গবেষণাপত্রের মূল নির্যাস সাধারোনের উপযোগী করে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। একটি কোভিড-১৯ এর ডায়াগনোসিস, যেটি চিন-হংকং ও ইউরোপের নেতৃত্বস্থানীয় ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানীরা সমন্বিতভাবে লিখেছেন তাঁদের গবেষণার ওপর ভিত্তি করে, আরেকটি চিনের দুইজন বিজ্ঞানীর গবেষণাপত্র, যেখানে কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় কি কি ওষুধ প্রয়োগ করা যেতে পারে তা নিয়ে নির্দেশাবলী রয়েছে উপযুক্ত গবেষণালব্ধফল সহ। আর দুটিই ‘ওপেন এক্সেস’ অর্থাৎ পৃথিবীর সকলের জন্য উন্মুক্ত, এটি পড়তে পয়সা লাগে না, যে যন্ত্রে আপনারা গুজব ছড়াচ্ছেন বা মিম শেয়ার করছেন সেখানে এই দুটি গবেষণাপত্র পড়ে দেখতে পারেন। ইংরেজি না জানলেও ক্ষতি নেই, ট্রান্সলেশনের সুবিধা গুগুল বিনামূল্যেই দেয়। সেই অনুবাদ সর্বথা সঠিক ও যথাযথ না হলেও মূল বিষয়টি বুঝে নেওয়া যায়। ইংরেজি না বুঝলে, যারা বোঝেন তাদের থেকে বুঝে নিতে পারেন। দয়া করে গুজব ছড়াবেন না। ডাক্তারবাবুদের বলব, একটু পড়াশোনা করে নিন এই সুযোগে। একটু পেপার টেপার ঘাঁটুন। যাবৎ বাঁচি তাবৎ শিখি। 

এবারে সরাসরি আসব ডায়াগনোসিস প্রসঙ্গে। বিজ্ঞানীরা কি উপায়ে, কোন বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে কোভিড-১৯ এর ডায়াগোনস্টিক কিট বানিয়েছেন এবং দুনিয়ার দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ‘মলিক্যুলার ডায়াগোনস্টিক’ কোম্পানি ‘কায়াজেন’ আর ‘থার্মো ফিশার’ চটজলদি বানিয়ে ফেলে বাজারে বিক্রি করছে; সেই প্রযুক্তিকে সহজ ভাষায় বোঝানোর চেষ্টা করছি। 


কোরোনা ভাইরাস হল একধরনের ভাইরাস যাদের দেখতে সূর্যের চারপাশের কোরোনা স্তরের মতন (এ বিষয়ে বিশদে জানতে আমার লেখা আর একটি প্রবন্ধ পড়তে পারেন, লিংক দেওয়া রইল একদম শেষে)। এই ভাইরাস এই প্রথম নয়, আগেও হানা দিয়েছে মানব সমাজে, ২০০২ আর ২০১২ সালে। তবে সে সময় সারা পৃথিবীতে এইভাবে ছড়িয়ে পড়ল না কেন? এর পেছনে অনেকগুলো কারণ আছে, তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, বিশ্বময় বিমান পরিষেবার উন্নতি ও বিমান ভাড়া মধ্যবিত্তের নাগালে চলে আসার কারণে গত দশ বছরে মানুষের বিশ্বব্যাপী ভ্রমণ ভয়ানকভাবে বেড়ে গিয়েছে। আগেও তো উন্নত দেশের মানুষ বিশ্ব ভ্রমণ করত। কিন্তু এখন কর্পোরেট ক্ষেত্রে শুধু বড় কর্তা বা সিনিয়র ম্যানেজাররাই নন, জুনিয়র বা মিড লেভেল ম্যানেজাররাও চট করে ট্রেনিং দিতে বা নিতে, বা মিটিং কন্ডাক্ট করতে পাড়ি দিচ্ছেন বিদেশে। কলকাতা থেকে কুনমিং উইকএন্ডে ছুটি কাটিয়ে আসছেন লোকজন। দুনিয়াব্যাপী ট্র্যাভেল বেড়ে গিয়েছে এই দশ বছরে ভয়ানকভাবে, যার কারণে ভাইরাল রোগগুলিও ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত। ডেঙ্গি যেভাবে ইউরোপ ও আমেরিকার শীতপ্রধান অঞ্চলে ছড়িয়ে গেছে, সেটা এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ।

এই ভাইরাসটির পুরো নামকরণ হয়েছে সার্স-কোরোনা ভাইরাস-২০১৯। এটি সিভিয়ার একিউট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯, তাদের চিনের ‘কান্ট্রি অফিস’এ হুবেই প্রদেশের উহান শহরে অজানা কারণের ফ্লু আক্রমণের কথা নথিভুক্ত হয়। অজানা কারণ চিহ্নিত করে ৭ই জানুয়ারি ঘোষণা করা হয় যে একটি ‘নোভেল কোরোনা ভাইরাস’ এই ফ্লু-এর কারণ। এর নভেলটি বিষয়ে বিশদে জানতে শুরু হয় গবেষণা। তার তিনদিন পরে, ১০ই জানুয়ারি চিন সরকার তাদের কমিউনিটি অনলাইন রিসোর্স ‘ভাইরোলজিকাল ডট অআরজি’তে চটজলদি প্রকাশ করে এই নতুন ভাইরাসের একটি জিন সিকোয়েন্স। ঠিক দুদিন পরে অর্থাৎ ১২ই জানুয়ারি প্রকাশিত হয় আরো চারটি সিকোয়েন্স। মূলত আক্রান্ত রোগীদের লালা থেকে ভাইরাল আরএনএ এক্সট্র্যাক্ট করে তার সিকোয়েন্সিং করে এই জিনোম রিলিজ করা হয়। এটুকু কাজ করতে নতুন পুরোনো ভাইরাসের বিষয় আসে না। যে প্রযুক্তি আমরা এখন ব্যবহার করি, তাতে যেকোনো জীব কোষেরই আরএনএ বার করে তার সিকোয়েন্স করা সম্ভব। এর পরেই শুরু আসল খেলা। ভাইরাসের জিনোম তো চেনা হল। কিন্তু নতুন নতুন রোগী যে আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের দ্রুত ও বিশ্বাসযোগ্য ডায়াগনোসিস হবে কিভাবে? কেমন করে সাধারণ ফ্লু থেকে চটজলদি আলাদা করা যাবে এই রগক, যাতে রোগীকে প্রথম থেকেই ইন্টেন্সিভ কেয়ার দেওয়া যায়!!

এবার আসরে নেমে পড়ল ‘গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটা’। তারা নতুন সিকোয়েন্সগুলোকে কিউরেট করা শুরু করে। তারাই প্রথম জানায় যে, এই নতুন ভাইরাসটি ২০০২/০৩ এ হওয়া সার্স ভাইরাসের একটি তুতো ভাই এবং এশিয়া-ইউরোপের রাইনোলোফিড বাদুড়ের শরীরে যেসব কোরোনা ভাইরাস বাসা বাঁধে, এটি তারই অন্যতম। কিভাবে জানা গেল? খুব সহজ। আগের ভাইরাসগুলির সিকোয়েন্স তো জানাই ছিল। তাদের পাশাপাশি নতুনটিকে রাখা হল। বেশিরভাগ জায়গাতেই মিল। দু-একটা জায়গায় মিউটেশন পাওয়া গেল মাত্র। হুবেই প্রদেশের উহান শহরে তো বাদুড় থেকেই ভাইরাসটি এসেছে বলে বোঝা গেল। কিন্তু শুরুর দিনগুলিতে তখনো মানুষ-মানুষ ট্রান্সমিশন টের পাওয়া যায়নি। গেল, আরো আটদিন পরে। সর্বমোট ২৮২ জন ল্যাবরেটরি-কনফার্মড নোভেল কোরোনা ভাইরাস আক্রান্ত রুগীর খবর নিশ্চিত করল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ২০ জানুয়ারি ২০২০। এর মধ্যে দেশের বাইরেও ছড়াতে শুরু করেছিল এই ভাইরাস। উহান ফেরত দুই থাইল্যান্ডের নাগরিকের দেহে পাওয়া গেল এই ভাইরাস ১৩ আর ১৫ জানুয়ারি। জাপানে ওই একই শহর থেকে আসা মানুষ আক্রান্ত হল ১৫ জানুয়ারি এবং ১৯ জানুয়ারি দক্ষিণ কোরিয়াতেও একই ঘটনা ঘটল। উহান শহর থেকে আস্তে আস্তে ছড়াতে শুরু করল এই ভাইরাস। মানুষ-মানুষ সংক্রমণ শুরু হয়ে গেল।

ডায়াগোনসিস এর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল একাডেমিক আর পাবলিক হেলথ ল্যাবরেটরিগুলো। অন্যান্য ফ্লু-র ক্ষেত্রে, নাকের রস নিয়ে পরীক্ষা করে দেখা হয় ভাইরাল জিনের উপস্থিতি রিয়াল টাইম পিসিআর করে। এই প্রযুক্তি খুব কম সময়ে মানব শরীরের নমুনাতে ভাইরাসের কটি জিন উপস্থিত রয়েছে, অর্থাৎ ভাইরাল লোড কত সেটি গুণে বলতে পারে। এই ভাইরাল লোডের ওপরেই নির্ভর করে চিকিৎসাপদ্ধতি। অন্যান্য অজস্র রোগে এই পদ্ধতি গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড। কিন্তু গোল বাধল অন্য জায়গায়। অন্যান্য ক্ষেত্রে মূল জীবাণুটির নমুনা থাকে বিজ্ঞানীদের কাছে। অর্থাৎ পজিটিভ কন্ট্রোল থাকে। যার প্রেক্ষিতে রোগীর নমুনাকে পজিটিভ বা নেগেটিভ বলা হবে। ভাইরাল কালচার থাকে। সেখান থেকে জিন নিয়ে তাকে পজিটিভ কন্ট্রোল বানানো হয়। কিন্তু এই ক্ষেত্রে তো কিছুই নেই। কি করে কি হবে!! বুদ্ধি খাটিয়ে অন্য উপায় বার করা হল। ২০০২/০৩ এর সার্স কোরোনা ভাইরাসের সঙ্গে এই নোভেল কোরোনা ভাইরাসের মিলের কথা আগেই বলেছি। সেটাকেই কাজে লাগিয়ে আর সিন্থেটিক নিউক্লিক এসিড প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বানিয়ে ফেলা হল পজিটিভ কন্ট্রোল। চ্যারিটি এন্ড ইউনিভার্সিটি অব হংকং তাদের কাছে থাকা এযাবৎকালের সব কোরোনা আর ইনফ্লুএঞ্জা ভাইরাসের সেল কালচার স্যুপ পাঠালো ইউরোপে। চ্যারিটি মেডিক্যাল সেন্টার, হংকং-এ ২০১৯ আক্রমণের যা যতটুকু স্যাম্পল ছিল, তা পাঠানো হল। এছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বায়োব্যাংক থেকে পুরোনো যত এ জাতীয় ভাইরাস কালচার ছিল ক্রায়োপ্রিজার্ভ করে, তাদেরও পুনরুজ্জীবিত করা হল। এই ব্যাংকগুলো পাঁচটি জায়গায় ছিল, তাদের নাম একে একে, নেদারল্যান্ডের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর পাব্লিক হেলথ এন্ড দ্য এনভায়রনমেন্ট, একই দেশের রটারড্যামের ইরাসমাস ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল সেন্টার, লণ্ডনের পাব্লিক হেলথ ইংল্যান্ড ল্যাবরেটরি আর হংকং বিশ্ববিদ্যালয়। নমুনাগুলো সবই থুতু, নাক ও গলার সোয়াব থেকে নেওয়া হয়েছিল। সব স্যাম্পল এসে জমা হল জর্মনির চ্যারিটি ইউনিভার্সিটি বার্লিনের ইন্সটিটিউট অব ভাইরোলজিতে।এইবার কাজ শুরু।

এর ফাঁকে ভাইরাসটিতে কিরকমের মিউটেশন বা অদলবদল ঘটেছে সেইটা নিয়ে একটু বলি। ভাইরাসটির গঠন সম্পর্কে একটু জ্ঞান থাকলে ভালো। খুব সহজে ছবির সাহায্যে সেটা বুঝতে গেলে আগে উল্লেখ করা আমার বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত লেখাটি নিচের লিংকে গিয়ে পড়লে সুবিধে হবে। গোলাকার ভাইরাসটির মধ্যে তার জিন। এই জিন সমন্বিত হয়েছে কেবল আরএনএ নিয়ে। এখানে কোন ডিএনএ নেই। একে ঘিরে মেমব্রেন রয়েছে। তার চারিপাশে বহিরাবরণ বা এনভেলপ, সেই এনভেলপে আছে স্পাইক প্রোটিন। ভেতরে আছে নিউক্লিওক্যাপসিড প্রোটিন।এইসবগুলোই প্রোটিন। ভাইরাসটা তৈরিই হয়েছে প্রোটিন দিয়ে। তাই সাবান দিয়ে বারবার হাত ধোবার গুরুত্ব নিশ্চয়ই বুঝছেন। এছাড়া আছে আরএনএ-ডিপেন্ডেন্ট আরএনএ পলিমারেজ প্রোটিন। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ডায়াগোনসিস আর চিকিৎসায়। কেন? এই প্রোটিনটি শুধুমাত্র আরএনএ ভাইরাসেই থাকে। উন্নত প্রাণী বা মানুষে এই প্রোটিন থাকেনা। তাই এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ড্রাগ টার্গেট। ডায়াগনোসিস এও এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এখন এতসব প্রোটিনের মধ্যে, ২০০২/০৩ এর সার্স কোরোনা ভাইরাসের সঙ্গে ২০১৯ নোভেল কোরোনা ভাইরাসের মিল থাকলেও এনভেলপ প্রোটিনের জিন্‌ নিউক্লিওক্যাপসিড প্রোটিনের জিন আর আরএনএ-ডিপেন্ডেন্ট আরএনএ পলিমারেজ প্রোটিন জিনে মিউটেশন দেখা গেছে। এই পরিবর্তিত জায়গাগুলোই নোভেল। 

পদ্ধতিতে ফিরে আসি আবার। ওই যে ন্যাজাল সোয়াব ক্লিনিক্যাল স্যাম্পল নেওয়া হল, সেগুলো থেকে আরএনএ এক্সট্র্যাক্ট করে নেওয়া হল রস, জর্মনির ম্যাগ্না পিওর ৯৬ সিস্টেমে। ম্যাগনেটিক বিড প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে আরএনএ বার করা হল। এই প্রযুক্তি রোবোটিক আর্ম নির্ভর, তাই ব্যবহারকারীর সংক্রমণের ঝুঁকি কম। বায়োব্যাংক থেকে পুনরুদ্ধার করা সেল কালচারগুলো থেকে আরএনএ বার করা হল কায়াজেন, জর্মনির ভাইরাল আরএনএ মিনি কিট ব্যবহার করে। এই আরএনএকে সরাসরি রিয়াল টাইম পিসিআর প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হল। এর জন্য ইনভিট্রোজেন, জর্মনির সুপারস্ক্রিপ্ট ৩ ওয়ান স্টেপ রিভার্সট্রান্সক্রিপ্টেজ সিস্টেম আর প্ল্যাটিনাম ট্যাক পলিমারেজ ব্যবহার করা হল। এগুলো খুবই উন্নত ধরণের উৎসেচক। প্রথমে আরএনএকে ডিএনএতে রূপান্তরিত করবার জন্য এই পদ্ধতি। এবার যদি স্যাম্পলে একটাও আরএনএ থাকে, তার থেকে একটা ডিএনএ হবে। সেই ডিএনএই গুণিতকে বেড়ে কোটি সংখ্যক হবে। এই সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে প্রাইমার-প্রোব সিগ্ন্যাল পাঠাবে মেশিনকে। গোনা হয়ে যাবে ভাইরাল লোড। এটিই রিয়াল টাইম পিসিআর প্রযুক্তি। পিসিআর প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন বিজ্ঞানী ক্যারি মুলিস।

এই রিয়াল টাইম পিসিআর করে ভাইরাল লোড জানার পাশাপাশি নতুন ক্লিনিক্যাল স্যাম্পলে পাওয়া ভাইরাল আরএনএর সিকোয়েন্সও জানা গেল। তাকেই এবার পজিটিভ কন্ট্রোল বানিয়ে কিট তৈরি করতে লাগল। যে কিট দিয়ে সারা দুনিয়ায় এখন ডায়াগনোসিস হচ্ছে কোভিড-২০১৯। এর পরেও এই পরীক্ষার সেন্সিটিভিটি, স্পেসিফিসিটি নির্ণয় করবার জন্য আরো কিছু পরীক্ষা, স্ট্যাটিস্টিকাল এনালিসিস এসব করা হয়। সেগুলো আর লিখলাম না। 

শুধু এটুকু বুঝুন, একটি ডায়াগনোসিস কিট তৈরি হয়ে বাজারে আসতে দীর্ঘ সময় লাগে। ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ড, আমেরিকাল ফুড এন্ড ড্রাগ কন্ট্রোল এর ছাড়পত্র পেতে বা ইন ভিট্রো ডায়াগনোসিসের তকমা পেতে বহু সময় লাগে। আছে আইনি জটিলতাও। কিন্তু ২১ জানুয়ারির মধ্যে এতসব কাজ অতি দ্রুত সম্পন্ন করে মানুষের জন্য যে ডায়াগনোসিসের পদ্ধতি উদ্ভাবন করে সকল দেশের বিজ্ঞানীদের জন্য ফ্রি এক্সেস করে দিয়েছেন এই বিজ্ঞানীরা, তাদের সেলাম। আবারও বলছি, চিন নিজের কাছে কিছু গচ্ছিত রাখেনি, আমেরিকাও না। ইউরোপ তো নয়ই। সব তথ্য উন্মুক্ত। এখন আপনার দেশে সেই তথ্য কাজে লাগানোর মতন পরিকাঠামো সরকার করে রেখেছে কিনা, সেটা জানতে আপনার প্রশাসককে প্রশ্ন করুন। গুজব ছড়াবেন না। পড়াশোনা করুন।

এবার আসব চিকিৎসায় প্রযুক্ত ওষুধ নিয়ে। আগের গবেষণাটি চিনের দেওয়া তথ্যের সহায়তায় ইউরোপীয় বিজ্ঞানীরা করেছেন। এবার যেটির কথা বলব, সেটি সরাসরি চিনের বিজ্ঞানীরা লিখেছেন। আবারও বলছি, সব তথ্য উন্মুক্ত। 

চিনের শানডং প্রদেশের কিংডাও বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি এবং প্যাথলজি বিভাগের তিন বিজ্ঞানী একসাথে ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ এই গবেষণাপত্রটি লিখে জমা করেন ওপেন এক্সেস আর্টিকল হিসেবে একটি জর্নলে। শেষে সবকিছুর লিংক দেওয়া আছে। কোভিড-২০১৯ এর মোকাবিলায় তারা পাঁচটি ওষুধের প্রয়োগের কথা বলেছেন। কি কি পাঁচটি এবং কেন, সেটিই বিশদে জানাচ্ছি আমি। 

প্রথমেই বলছেন, পরপর দশদিন আইএফএন আলফা ভেপার হিসেবে ইনহেল করাতে দিনে দুইবার। সেই ভেপারে যেন পাঁচ মিলিয়ন আন্তর্জাতিক এককে আইএফএন আলফা থাকে। এটি কি? এটি একটি ইন্টারফেরন, যা আমাদের শরীরের কিছু শ্বেতকণিকা ভাইরাস আক্রমণ ঠেকাতে তৈরি করে। কিন্তু রোগীর ইমিউনিটি উপযুক্ত পরিমাণ আইএফএন আলফা তৈরি নাই করতে পারে। সে কারণে বাইরে থেকে প্রয়োগ করতে হবে। ভেপার ইনহেল করলে সরাসরি ফুসফসের ভাইরাস আক্রান্ত কোশগুলিকে ভাইরাস সহ মেরে রোগীর শরীরে ভাইরাসের পরিমাণ কমাতে পারবে। বহু ভাইরাল রোগে আইএফএন আলফার প্রয়োগ আছে। এর আগে ২০০২/০৩ এর সার্স কোরোনা ভাইরাস আক্রমণের সময়ও এর প্রয়োগে সুফল পাওয়া গিয়েছিল। 

দ্বিতীয় ওষুধ লোপিনাভির বা রিটোনাভির। এগুলো এন্টিরেট্রোভাইরাল ড্রাগ হিসেবে প্রচলিত/ একথা শুনেই চণ্ডীমণ্ডপের জ্ঞানীরা রে রে করে ওঠেন। আরে বাবা এইচআইভিও আরএনএ ভাইরাস, কোরোনাও, ডেঙ্গিও। এত ভাবার কিছু নেই। এই ওষুধ ২০০ মিলিগ্রাম করে মুখ দিয়ে জলের সাথে দিনে দুইবার খেতে হবে দশদিন। এরা ভাইরাসের সংখ্যা বাড়াতে বাধা দেবে। আগের ২০০২/০৩ এর ক্ষেত্রে এর প্রয়োগে প্রমাণিত সুফল পাওয়া গেছে।

এরপর বলছেন, ৫০০ মিলিগ্রাম করে দিনে দুই থেকে তিনবার রাইবাভিরিন শিরায় ইঞ্জেকশন দিতে হবে রোগীর অবস্থা বুঝে। এটি একটি নিউক্লিওসাইড এনালগ যৌগ। এ কি করবে? ভাইরাসকে বোকা বানাবে। একে পেয়ে ভাইরাস একে দিয়ে নিজের প্রতিলিপি বানাতে চেষ্টা করবে। যেই না একে ব্যবহার করবে, অমনি তার কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। অতেব দ্রুত ভাইরাল লোড কমাতে এর ব্যবহারের কারণ বুঝতেই পারছেন।

আর বলছেন, আর্বিডোল ব্যবহার করতে। দিনে দুইবার করে ২০০ মিলিগ্রাম মুখে জলের সাথে খেতে হবে। এটি ইনফ্লুএঞ্জার বিখ্যাত ওষুধ। ফ্লু এবং ফ্লুলাইক সিম্পটমের চিকিৎসায় এর ব্যবহার প্রমাণিত। তাই কোভিড-২০১৯ এও এর ব্যবহার করতে হবে। 

এর পরে শেষে বলছেন, বিখ্যাত ওষুধ ক্লোরোকুইন ব্যবহারের কথা। কেমোথেরাপির এইটা মজা। এক রোগের ওষুধ অন্য অনেক রোগে খুব ভালো কাজ দেয়। হয়তো তাদের আপাতভাবে কোনো মিলই নেই। আমার শিক্ষক বলেন, প্রকৃতি যে রোগ দেয়, তার ওষুধও সেখানেই দিয়ে দেয়। ক্লোরোকুইন ম্যালেরিয়ার ওষুধ। এটি ২০০৬ সালে এন্টিভাইরাল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। চিনের শেষ চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার নিয়ে একটু পড়ুন। খুব আনন্দ পাবেন। সেই রহস্যের কথা এখানে আর বলছি না। ক্লোরোকুইন ৩০০ মিলিগ্রাম দিনে দুবার মুখ দিয়ে খেতে হবে জলের সাথে। 

এই সমস্ত ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা চলবে দশদিন।


মজার কথা হল, সব ওষুধগুলোই পুরোনো। চণ্ডীমণ্ডপের বিজ্ঞানীরা বলছেন চিন এই মারণাস্ত্র বানিয়েছে। তাদের কাছে নাকি এর এন্টিডোট আছে। এই এন্টিডোট বলতে যে কি বলছেন তা তারাই জানেন। বাস্তব হল, চিনেও এই পুরোনো ও সর্বজনবিদিত ওষুধগুলো দিয়ে চিকিৎসা হচ্ছে। প্রকৃতিতে বানানো ভাইরাস নয় বলেই নাকি এইভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। আসলে স্প্যানিশ ফ্লু, ব্ল্যাকডেথ বা হালের বার্ড ফ্লু নিয়ে এদের কোনো ধারণা নেই। আসলে তখনো তো স্মার্টফোন মুঠোয় আসেনি আর তারাও ফেসবুক-হোয়াটস্যাপ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হননি।

যাক গে। একটু পড়াশোনা করুন। মানুষের ওপর ভরসা রাখুন। মানুষেই সব করেছে। মানুষেই সব ঠিক করবে। গুজব ছড়িয়ে আতঙ্ক বাড়াবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে। 

লেখক মাইক্রোবায়োলজিতে সাম্মানিক স্নাতক স্তরের পড়াশোনা শেষে কলকাতার স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন থেকে মেডিক্যাল বায়োটেকনোলজি নিয়ে মাস্টার্স করেছেন। পরে নেট, গেট পাশ করে ওই প্রতিষ্ঠানেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চিকুনগুনিয়া ইমিউনোলজি নিয়ে পিএইচডি ডিগ্রির জন্য গবেষণা করেছেন। তারপর বাংলাদেশে কিছুদিন প্রয়োগ-বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করেছেন। এখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গবেষণার সাথে যুক্ত। পাঁচটির মতন আন্তর্জাতিক জর্নলে গবেষণাপত্রের পাশাপাশি নিয়মিত সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে বিজ্ঞান বিষয়ে লেখালিখি করেন। 

দুটি গবেষণাপত্রের লিংক




লেখকের আগে প্রকাশিত লেখার লিংক


পাদটীকা – গবেষণাপত্রগুলি আমেরিকার ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফর্মেশন এর পাবমেড ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত। সারা পৃথিবীতে এটিই সর্বজনগ্রাহ্য বিজ্ঞান গবেষণার অন্যতম আর্কাইভ বলে স্বীকৃত। এই দুটি গবেষণাপত্র উন্মুক্ত। যে কেউই পড়তে পারেন নাগরিকতা নির্বিশেষে।

কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন হলে আমায় ইমেল করতে পারেন – nilotpal.medmicro@yahoo.co.in

1 comment: