0

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in

৩য় পর্ব 

সোমবার অফিসে এসেই মাতুল সুরেন্দ্রনাথের তারটা পেলেন শরৎ। 'মন্দির' নামের যে গল্পটি বেনামে কুন্তলীনের জন্য দেশ ছাড়ার আগে দিয়ে এসেছিলেন সেটি এবার 'কুন্তলীন পুরস্কার ' পেয়েছে। কুন্তলীন একটি আদ্যন্ত স্বদেশী প্রসাধনী কোম্পানি। এইচ বোস হলেন তাঁর কর্ণধার। বাঙালীর দ্বারা যে কখনো ব্যবসা হয়না এই অপবাদটিকে সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণ করেছেন এই ভদ্রলোক। অল্পদিনের মধ্যেই দেশীয় পদ্ধতিতে ল্যাভেন্ডার আর কোলন মিশিয়ে 'দেলখোস' নামের সুগন্ধীটি বানিয়ে বাংলাদেশে সাড়া ফেলে দিয়েছেন। একই সঙ্গে 'কুন্তলীন' তেলটিও জনপ্রিয় সঙ্গে একটি বই প্রকাশনীর ব্যবসাও আছে তাঁর।সাহিত্যক্ষেত্রে নতুন প্রতিভার আবিষ্কারে এইচ বোস বেশ নাকি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন কয়েক বছর হল। এখন তাঁর বন্ধুবৃত্তে রয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, জগদীশ বসুর মত দিকপালেরা। 

শরৎ আদতে পল্লীবাংলার মানুষ হলেও কলকাতার আকর্ষণটিকে ঠিক উপেক্ষা করতে পারেন না। ইংরেজদের রাজধানী বলে শুধু নয়, নিজেকে ঠিকমত আত্মপ্রকাশ করতে চাইলে কলকাতার কাছাকাছি থাকাটা খুব জরুরী। 

দেশের রাজনৈতিক উত্তাপ এতদূরের বর্মায় বসেও টের পান। ইংরেজ শাসনের হিংস্র নখদাঁতগুলো দিনকে দিন প্রকটতর হয়ে উঠছে। ছোট ছোট জায়গায় স্থানীয় প্রচেষ্টায় একটু আধটু বিক্ষিপ্ত বিপ্লবী হানায় গোটা দুই সাহেব মারলেই যে দেশের স্বাধীনতা আসবে না সেটা এখনকার স্বদেশী করা যুবকদের বোঝানোটাই মুশকিল। কেবল শুধু শুধু তাজা প্রাণগুলো অকালে ঝরে যাচ্ছে। এরকম চলতে থাকলে দেশ যদি সত্যি কখনো স্বাধীন হয় তখন কিছু স্বার্থলোভী পরভৃৎ ছাড়া তাকে চালানোর সঠিক লোক পাওয়া যাবে কি করে? ম্যাৎসিনি আর গ্যারিবল্ডির জীবনী পড়ে শরৎের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে যে একজন যথার্থ দেশনায়ক যদি উদ্যম আর বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে সমগ্র জাতিকে আহবান করতো, বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে তবে হয়তো স্বাধীনতার সম্ভাবনা বাস্তবানুগ হত। কেবলমাত্র আবেদন- নিবেদনের মধ্যে দিয়ে রণনিপুণ ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদেকে হঠানো আদপেই সম্ভব নয়। 

রেঙ্গুনে থিতু হবার পর দিনগুলো কাটছে খুবই পরিচিত অভ্যস্তযাপনে। গোর্কীর 'দ্য মাদার' আর তলস্তয়ের 'ওয়ার এন্ড পিস' বইদুটি সবেমাত্র পড়া শেষ করেছেন। এই দুটি বই শরৎকে তাঁর স্বদেশভাবনায় এক পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয়। মনে মনে আক্ষেপ করেন আজ পর্যন্ত বিপ্লববাদকে মহিমাণ্বিত করে এমন কোন রচনা বাংলায় কেউ লিখলেন না কেন? রবীন্দ্রনাথ কে গুরুকল্প মানেন যদিও, তবুও কবির সাবধানী রচনাগুলিতে তাঁর স্বদেশিকতা প্রচ্ছন্ন থাকলেও সেগুলির যোগ্য সমাদরের মত পাঠক এখনো তৈরী হয়নি। কোথাও একটা তীব্র অথচ দূরতিক্রম্য ফাঁক তৈরী হচ্ছে সাহিত্যরচনা ও বাস্তব জীবনবোধের মধ্যে। সেই অভাবটাই বড় হয়ে উঠছে সে সব রচনায়। আজকাল নিজেকে প্রকাশ করার জন্য উসখুস করেন। অনেক না বলা কথাগুলো ভীড় করে আসে মাথায়। কিন্তু ইদানীং লিখতে বসলেই সেগুলো কোথায় যেন হারিয়ে যায়। ভাগলপুরে থাকতে কমবয়সের উদ্যমে দুটি খাতা ভর্তি কিছু অন্যস্বাদের গদ্যরচনা করেছিলেন। 'তরণী' বলে একটি হাতে লেখা পত্রিকাও জন্ম নেয় সে সময় বন্ধুবর সৌরীন্দ্রের মত আরো কিছু বন্ধুর উৎসাহেই। সেই সব দিনগুলোর সুখস্মৃতি শরৎকে আজ মরীচিকার মত পিছু ডাকে। রেঙ্গুনের তাসখেলা আর বন্ধুবৃত্তের স্থূলরুচির হাসি ঠাট্টার আড্ডা থেকে আজকাল একটু একটু করে সরিয়ে নিয়েছেন নিজেকে। 

এখন অবসরে বইপড়াটাই একটা নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁর এই প্রবাসী সঙ্গীদের অনেকেই জৈবিকতাড়না নিবৃত্তির জন্য এখানকার পতিতাপল্লীগুলিতে যাতায়াত করে থাকে। সেই দরিদ্র যুবতী মেয়েগুলির চড়া প্রসাধনমাখা অথচ রিক্ত শূন্যদৃষ্টির ক্ষুধাজীর্ণ লাস্যময়ী রূপটি দেখলে কি অব্যক্ত বেদনায় কষ্ট পান শরৎ। সভ্যতার আদিমব্যবসাটি বোধহয় এ পৃথিবীর একমাত্র চিরস্থায়ী বস্তু বলে ভ্রম হয়। 

সুরেশ আর মহিম নামের দুই সদ্যযুবার সাথে একটি সাহিত্যবাসরে এসে হঠাৎ আলাপ হল। সুরেশ সবে ডাক্তারী পাশ করে এখন পসার জমানোর জন্য চেম্বার খুলেছে রেঙ্গুনেই আর মহিম মাস্টারী করে পাডং এর একটি ইস্কুলে। এরা দুজনেই খুব বন্ধু কিন্তু চরিত্রের দিক থেকে একদম বিপরীত। সুরেশ যতটা হইচই করা আমুদে,মহিম ততটাই স্থীতধী। মহিম গোপনে ব্রিটীশবিরোধী বিপ্লবী কার্যকলাপের সাথে যুক্ত। শরৎদাদাকে দুজনেই এরা খুব পছন্দ করে, শরৎও এই দুই যুবকের নবীন চাপল্য আর সঙ্গ উপভোগ করেন। বন্ধু মণীন্দ্র আজকাল শরৎের বাসায় বেশীর ভাগ সময়ই রাতে থেকে যায়। একটা ছোট পত্রিকা যদি বের করা নিয়ে তার খুব উৎসাহ। শরৎও এ ব্যাপারে আজকাল উদ্যোগী হয়ে পড়েছেন। একটু একটু করে একটা নতুন উপন্যাসের খসড়াও তৈরী হচ্ছে। মণীন্দ্র তাই নিয়ে খুব উচ্ছ্বসিত। 

ইতিমধ্যে আরেকটা খুশীর খবর আসে কলকাতা থেকে। 'বড়দিদি' বলে একটা বড়গল্প লিখেছিলেন ভাগলপুরে থাকতে। সৌরীন্দ্র সেটির একটি কপি কোত্থেকে জুটিয়ে দুম করে 'ভারতী পত্রিকা'য় ছাপিয়ে দিয়েছে। সরলাদেবী এখন সম্পাদিকা। তিনি অবশ্য তিনটি সংখ্যায় ধারাবাহিক হিসাবে ওটিকে ছেপেছেন। বৈশাখ আর জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় লেখকের নাম উল্লেখিত না থাকায় অনেকেই ভেবেছেন এটি সরলার 'রবিমামা'রই নবতম সংযোজন বুঝি! লেখাটি পড়ে রবীন্দ্রনাথও মুগ্ধ। পরম বিস্ময়ে তিনি বলেছেন ' এ কোনো শক্তিশালী লেখকেরই লেখা বটে! ' এবারে আষাঢ় সংখ্যায় বড় বড় করে 'শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়' নামটি বেড়িয়েছে। গগনীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তিনজনেই সৌরীন্দ্রমোহন কে বলেছেন এই নবাগত অসামান্য লেখকটিকে শীঘ্রই সাহিত্যের বরাঙ্গনে বরণ করে নেওয়ার জন্য। 'ভারতী'র তিনটি সংখ্যা ও একটি সুবিস্তৃত চিঠি সহ সৌরীন্দ্রের আন্তরিকতা ও উচ্ছাস শরৎকে উৎফুল্ল করে। তাঁকে একদম না জানিয়ে লেখাটি 'ভারতী' র মত প্রথম সারির পত্রিকাতে তা হুট করে ছাপিয়ে দেওয়ার জন্য প্রিয় বন্ধুর ওপর কপট রাগ সহ ধন্যবাদের চিঠিটিও ডাকে পাঠিয়ে দেন তৎক্ষণাৎ। ওসব কাঁচা বয়সের মিঠেকড়া লেখা হলেও একধরণের তাজা আবেগ ওই লেখাগুলোয় মিশে আছে। সেইসব দিনগুলোয় তখন সবে চক্ষুষ্মান হয়ে দুনিয়াদারি আর আসমানদারি দেখতে শিখছেন, এই গল্পটি সেইসময়কারই ফসল। তখনকার লেখা আর একটি একটি উপন্যাসিকা 'অভিমানে'র পান্ডুলিপিটা খুঁজে পাওয়া গেলে শরৎের এখন পুনর্লিখন করতে ইচ্ছা হয়। মিসেস হেনরি উডের 'ঈস্ট লিন'এর ভাবানুবাদের প্রয়াস ছিল সেটি। 

কৈশোরের কথা ভাবতে বসলে আজকাল উথালপাথাল স্মৃতির ভীড় জমে। মনে পড়ে গ্রামের দুটি জীবনের অসমাপ্ত প্রেমের দীনতাকে। তাঁরই এক সহপাঠী কৈশোরেই ভালবেসে বিয়ে করে এক সাপুড়ের মেয়ে বিলাসী কে। শরৎ ছাড়া তাদের সেদিনের বিবাহবাসরে আর কেউ মঙ্গলদীপ জ্বালতে আসেনি। তখন নিজেও বিষহরির মন্ত্র শিখতে উৎসাহী হয়েছিলেন ওদের পাল্লায় পড়ে। অনেক লাঞ্ছনা গঞ্জনা সহ্য করেও ওরা পরস্পরকে ত্যাগ করেনি। গ্রামের সীমানার শেষে ঘর বেঁধে সাপ ধরে, খেলা দেখিয়ে বা শিকড়বাকড় আর মাদুলি বেচে তারা কোনওমতে দিন চালাত। একদিন সেই বিষবিদ্যারই চরম প্রকাশ ঘটে যায়। এক গোয়ালার ঘরে সাপ ধরতে গিয়ে বুনো খরিশের ছোবলে বন্ধুটি মারা যায়। বিলাসী সাপুড়ের মেয়ে হয়েও কোনও মন্ত্রেই তার স্বামীটির প্রাণ বাঁচাতে পারেনি সেদিন। শোকে, পরাজয়ে বিলাসীর সেই ভঙ্গুর মুখটি শরৎকে আজও তাড়া করে ফেরে। অবাক হয়েছিলেন এই দেখে যে মৃত্যুটিতে শোকের পরিবর্তে বরং গুরুজনেরা সকলে দোষ দিয়েছিল ওই মেয়েটিকেই। কারণ সে ছোটজাতের মেয়ে হয়ে বিয়ে করেছিল এক ভদ্র ব্রাহ্মণসন্তানকে। স্থবির পল্লীসমাজ মেনে নিতে পারেনি তা সেদিন। অপমানের জ্বালায় বিলাসীও গলায় দড়ি দেয় একদিন। 

শরৎের চোখের সামনে আস্তে অাস্তে চারপাশের অসার সমাজের কঙ্কালসার চেহারাটা ক্রমে বেরিয়ে আসতে থাকে। 

শরৎ নিজে এ নিয়ে তার পর অনেক ভেবেছেন যে শাস্ত্রমতে তারা দুজনেই হয়তো নরকে গেলেও তাদের সেই একান্ত অদম্য ভালবাসাটির লোভে যদি নিজেকেও একদিন সেই নরকেই গিয়ে দাঁড়াতে হয়, তিনিও তার থেকে পিছিয়ে আসবেন না কখনোই।

0 comments: