0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in














২ 

দিল্লি কা লাড্ডু 

রূপেশ কেন বিয়ের মন্ডপে বসতে রাজি হল সে নিজেও জানেনা। কয়েকমাস আগের সেই হোলির বিকেলে ঘটে যাওয়া ব্যাপারটা? অপরাধবোধ? অথবা কম্পাউণ্ডার ভুরা শংকরের ক্যারম খেলতে খেলতে আলটপকা কথাটা? 

এক শুক্কুরবারের সন্ধ্যেয় শংকর আর ও ক্যারম খেলছিল। রামনিবাস বোর হয়ে উঠে গেছে। রাজন ফিল্ডে গেছল কিছু ব্যাড লোনের রিকভারির জন্যে, আহিরণ পেরিয়ে একটি গাঁয়ে, সঙ্গে ঠুল্লু। ওরা এখনও ফেরেনি। শংকর রানিকে ছেড়ে দুটো গুটি সেকন্ড পকেটে ফেলল, রূপেশ দেখছে। শংকর এবার চোখ কুঁচকে রানিকে দেখছে। তারপর স্ট্রাইকার সরাল, কারণ মিস করলে রানি সোজা রূপেশের কোলে, ওর কভার তৈরি রয়েছে। এবার ও অন্য একটা গুটি থার্ড পকেটে নেওয়ার চেষ্টা করল। গুটিটা না পড়ে ছটফটিয়ে সোজা রানিকে আড়াল করল।রূপেশ গম্ভীর। 

--এটা কী হল? 

শংকর মিচকে হেসে ইশারা করে—স্যার, আপনার দান। 

রূপেশের হিট রানিকে দুটো কালো গুটির পাহারা থেকে মুক্ত করতে পারল না। 

শংকর ওর চামড়ার ডাক্তারি ব্যাগ থেকে একটা স্টিলের বাহারি কৌটো বের করে তার থেকে একখিলি পান মুখে দেয়। জাফরানি পাত্তি, রিমঝিম ও কিমামের গন্ধে ঘর ভরে যায়। তারপর বেশ দার্শনিক ভঙ্গিতে বলেঃ সাহেব, অনেক হল; এবার একটা বিয়ে করে ফেলুন। 

রূপেশ চমকে উঠল। হঠাৎ এ কথা? ‘অনেক তো হল’ মানে কী? হোলির পর আটমাস কেটে গেছে। ভালুমার-দ্রুপতী কি ঘটনাটা গাঁয়ে চাউর করে দিয়েছে? না; হোলির পরে দ্রুপতীকে রূপেশ আর দেখেনি। সেভিংস ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নং ১/১০! তাতে ওই আটমাসের মধ্যে কোন লেনদেন হয়নি। 

রূপেশ শ্বাস টানে। স্ট্রাইক মিস করে এবং এই বোর্ডটি শংকর সহজে জিতে নেয়। তারপর কাগজে নোট করে –চার আনা! এরা প্রতিবোর্ড চার আনা হিসেবে খেলে। ছুরি গাঁয়ে এটাই দস্তুর। শংকর রূপেশকে বুঝিয়েছে—এটা জুয়ো নয়। সামান্য পয়সা বাজি ধরে খেললে কোন দোষ নেই, এ দিয়ে কি আপনার ঘরে আগরবাত্তি জ্বলবে? বরং রক্তে একটু জোয়ার আসবে, যেন এক্ষুণি একটা সিগ্রেট খেয়েছেন। 

--- চার আনাও জুয়ো, একশ’ টাকাও জুয়ো। 

-- হ্যাঁ হ্যাঁ, মানুষ মারলেও খুন, মশা মারলেও খুন। দুটোই তো প্রাণীহত্যা, কি বলেন? 

শংকর ভেঙচি কাটে। রূপেশ হেসে ফেলে। 

কিন্তু শংকরের আলটপকা বাউন্সার! নাঃ, ডাক করবে না, ব্যাট চালাবে। 

--এই যে বিয়ে বিয়ে করছ, ভেবে দেখেছ কি আমার বৌ আসলে এখানে সন্ধ্যেবেলা ক্যারম বোর্ড বা শতরঞ্চের ছক বিছানো – সব বন্ধ হয়ে যাবে। হম হ্যায় আজাদী-পসন্দ আদমী, ওহ সব ছিন জায়েগী। দেখে নাও তোমার ওই কঠঘোরা শাখার ম্যানেজারকে। সারাক্ষণ হয় ঘরওয়ালি নয় শাসু-মাকে খুশ করার চক্করে ঘুরে বেড়াচ্ছে; ধ্যেৎ! 

--আরে সর! শাদি হ্যায় দিল্লি কা লাড্ডু, যো খায়া ওহ ভী পস্তায়া, যো নহীঁ খায়া ওহ ভী পস্তায়া। তো জব পস্তানা হ্যায়, তো খাকে হী পস্তাইয়ে না! 

তখনই কি রূপেশ নিমরাজি হল? ঠিক তা ও নয়। আরও একটা ঘটনা, যা আরও একবছর পরে ঘটেছিল। 

একবছর? ওই ক্যারম খেলার পরের দিনই তো ট্র্যান্সফার অর্ডার ডাকে এসে পৌঁছল। 

না, বিলাসপুর নয়, ওকে যেতে হবে গেওরা শাখায়, আহিরণ নদীর অন্য পাড়ে। সেখানে গড়ে উঠছে বিশাল ওপেন কাস্ট কোল মাইনিং প্রোজেক্ট। একের পর এক গ্রাম নিয়ে নিচ্ছে সরকার, দিচ্ছে ক্ষতিপূরণ, গড়ে তুলছে নতুন জনপদ। এই বিশাল কর্মযজ্ঞে স্টেটব্যাংকের পাশাপাশি গ্রামীণ ব্যাংকও শাখা খুলবে, জনগণের কম্পেনসেশনের পয়সা যাতে নয়ছয় না হয় তা দেখবে, অর্থাৎ ওদের মধ্যে বচত বা সেভিংস এর অভ্যেস জাগিয়ে তুলে দরকার মত লোন দেবে। এবং এই কাজে শ্রীমান রূপেশ সবচেয়ে উপযুক্ত অফিসার। কারণ তিনি ছুরি শাখাকে খুলে এবং বিজনেস বাড়িয়ে নিজের দক্ষতা দেখিয়েছেন তথা গেওরা ও ছুরি ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে যুক্ত। 

রাজন বলল—চুতিয়া বনা রহে স্যার! ওই লঙ্গুর তিওয়ারিকে দেখুন, বিলাসপুর ব্র্যাঞ্চে অ্যাকাউন্ট্যান্ট! 

রূপেশ দ্রুত চার্জ বুঝিয়ে দিয়ে রিলিভ হয়ে যায়। খালি রাজনকে বলে যায় – একাউন্ট নম্বর ১/১০ কে ডরম্যান্ট হতে দিও না। মেয়েটা ঠিক ছুরিতে ফিরে আসবে, আমার মন বলছে। রাজন ঢোঁক গেলে, মাথা নাড়ে, কিন্তু রূপেশের চোখে দিকে তাকায় না। 

সাতদিন পরে কোরবা থেকে লোক্যাল ধরে সকাল দশটা নাগাদ শ্রীমান রূপেশ বর্মা পৌঁছে গেলেন এই লাইনের অন্তিম স্টেশন গেওরা রোডে। না, স্টেশনে কেউ নিতে আসেনি। স্টেশন থেকে গেওরা গ্রাম অন্তত: তিন কিলোমিটার দূর। একপাশে দুটো ক্রেন কয়লা তুলে তুলে দুটো বিশাল ডাম্পারে ভরে যাচ্ছে। শ্রীমান পাশ কাটিয়ে জঙ্গলের পথ ধরেছেন, কাঁধে এয়ারব্যাগ। ঘন জঙ্গল। আম-জাম-যজ্ঞডুমুর, বট-অশ্বত্থ-পাকুড়। শিরীষ-বাবলা-বাঁশঝাড়। তার মাঝ দিয়ে পায়েচলা পথ বা প্যারডগরি। আর মাঝে মাঝে আল ভেঙে গরুর গাড়ির চাকার দাগে তৈরি রাস্তা, স্থানীয় ভাষায় গাড়ারাবণ। কোথাও কোথাও পথের পাশে উইয়ের ঢিপি, এত বড়! এগুলোকেই বল্মীক বলা হত? খোঁচা দিয়ে ভেঙে দিলে ভেতরে তপস্যারত কোন রত্নাকর চোখে পড়বে! ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে জুতোর ডগা দিয়ে একটা বড় সড় ঢিপির গায়ে ঠোক্কর মারতেই ফোঁস্‌! কোথায় বাল্মীকি? ফণা তুলেছে একটি ডোমহি বা কেউটে। মানে মানে কেটে পড় হে! নইলে আজ আর তোমার ব্যাংকের সিন্দুকের তালা খোলা হবে না। 

এবার দেখা যাচ্ছে একটা দুটো করে কাঁচা ঘরবাড়ি। মূল গাঁয়ের সীমান্ত বা সরহদ। এগুলো অন্ত্যজদের পাড়া। এখানে আদিবাসীদের মধ্যেও অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া সমাজের, যেমন মঁঝওয়ার বা বিঁঝওয়ারদের বাসস্থান। আর আছে কয়েকঘর সহিস বা ঘসিয়া, যারা চামড়ার কাজ করে, প্রধানত: ঢোল-তবলা-মাদল বানায়, কিন্তু জুতো নয়। আবার খানিকটা জঙ্গল, কিন্তু আগের মত ঘন নয়। এবার একটা বাঁক পেরোতেই জেগে উঠল একটি পাকাবাড়ি, দোতলা, কিঞ্চিৎ জরাজীর্ণ। তার গায়ে লাগা ধানের মরাই, দুজন কামিয়া মোষ সামলাচ্ছে। আর একদিকে একটি অপেক্ষাকৃত নতুন একতলা দেহাতি বাড়ি। গায়ে ব্যাংকের সাইনবোর্ড। সামনে উবু হয়ে রোদ পোহাচ্ছে নতুন ম্যানেজারের দর্শনের আশায় সকাল থেকে প্রতীক্ষারত ভিন গাঁয়ের লোকজন। 

এদিক -ওদিক থেকে ওঠা হাত ও মৃদু ""জয়রাম সাহাব!'' সম্বোধনের মধ্যে মাথা নাড়তে নাড়তে ভ্যাবাগঙ্গারাম ভেতরে ঢুকে নিজের চেয়ারে বসে। 

এক গেলাস জল ও এক পেয়ালা চা। ক্রমশ: কমে আসা গুনগুন শব্দের মধ্যে ও জেনে নেয় আজকে ক্যাশ ব্যালান্স কত? স্টেট ব্যাংক থেকে ক্যাশ আনতে কাউকে কোরবা পাঠাতে হবে কি না! হেড অফিস থেকে কোন নতুন সার্কুলার বা নিদেনপক্ষে কোন ফোন এসেছে কি না? এইভাবে বেলা গড়িয়ে যায়। ব্যাচেলর রূপেশের জন্যে টিফিন ক্যারিয়ার ভরে ভাত-রুটি-ডাল-তরকারি এসে যায়। 

এভাবেই শুরু হয় ওর আরেক বনবাস, ও গ্রাহ্য করে না। জিদ করে দু’মাসের মধ্যে একবারও ভিলাই না গিয়ে ঘরে ঘরে আদিবাসীদের মধ্যে সেভিংস অ্যাকাউন্ট খোলে, বোঝায় যে স্টেটব্যাংকের চেয়ে ও এক পার্সেন্ট ইন্টারেস্ট বেশি দেবে, ভাল সার্ভিস দেবে। সকাল দশটা থেকে বিকেল চারটে অব্দি টাকা তোলা যাবে এবং ঘরের কাছে ব্যাংক হওয়ায় চোরডাকাতের ভয় নেই। স্টেটব্যাংকের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার প্রশ্ন নেই, কিন্তু যা ডিপোজিট আনে তাতে হেড অফিস খুশি; দু’বার লেটার অফ অ্যাপ্রিসিয়েশন পায় এবং সাতমাসের চেষ্টায় মোটামুটি দাঁড় করিয়ে ফেলে গ্রামীণ ব্যাংকের নতুন শাখাটিকে। 

হালকা শীত পড়েছে। ধান কাটা শুরু হয়েছে। এবার সময় থাকতে চাষিদের ঘরে ঘরে গিয়ে একটু আগাম হুঁশিয়ারি দেওয়া দরকার, যাতে ধানবিক্রির প্রথম খেপেই ব্যাংকের লোন শোধ করে দেয়। তাই লাঞ্চের পর থেকে রূপেশের মন আনচান; কতক্ষণে নিত্যিকর্মের মত এই একঘেয়ে লেনদেন শেষ করে মোটরবাইক স্টার্ট করবে। 

উঠবে উঠবে করছে এমন সময় একটা খ্যানখেনে চেরা আওয়াজ ওর মনের শান্তি কেড়ে নেয়। 

-- তঁয় হট্‌ যা মিঠলবরা! মোলা ম্যানেজারলা মিলে বর অন্দর জায়েকে দে বের্‌রা! 

সরে যা, মিঠেমিথ্যুক কোথাকার! আমাকে ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করতে হবে, ভেতরে আসতে দে, বদমাশ! 

গঙ্গারাম বিরক্ত হয়ে বকের মত গলা উঁচিয়ে ঝামেলা কিসের বোঝার চেষ্টা করল। চাপরাশিকে ধাক্কা মেরে কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে একটি মেয়ে। তারসপ্তক ছাড়িয়ে যাওয়া তার গলার আওয়াজ খানিকক্ষণের জন্যে আর সবার যাকে বলে একদম "বোলতী বন্দ্‌'' করে দিয়েছে। 

-- কী ব্যাপার! ক্যা হুয়া? 

-- সাহেব, আমার মা বিমার হয়ে বিছানা নিয়েছে প্রায় সাতদিন হল। ঘরের পয়সা শেষ। আপনার ব্যাংকে ওর টাকা জমা আছে। আজ কিছু টাকা তুলতে এসেছি তো আপনার এই "রোঘা'' চাপরাশি বলছে যে তোমার মাকে নিয়ে এস, ওর টিপসই চাই। কী অন্যায় বলুন তো? 

--- কিন্তু ও তো ঠিকই বলেছে। এটাই তো ব্যাংকের নিয়ম। 

-- বড় মুশকিল! পয়সা তো আমি নিয়ে যাচ্ছি, তাই আমার টিপসই নিলেই তো চলে। আপলোগ জবরন লফরা করতে হ্যাঁয়। 

-- বাজে কথা বলবে না! কিসের লফরা? অ্যাকাউন্ট তোমার মায়ের নামে, তুমি কি করে পয়সা বের করবে? যার নামে খাতা তার টিপসই ছাড়া সেই খাতা থেকে কি করে অন্যে পয়সা তুলবে? 

-- বাহ্‌ সাহাব, বাহ্‌! হর মাহ্‌ জব ম্যাঁয় পয়সা জমা করনে আতী থী তব তো নহী বোলে কি তোর দাঈকে খাতে মে ওকর আয়ে বিনা পয়সা কৈসে জমা হোহি! তখন তো দিব্বি দাঁত বের করে টাকা জমা করে নিয়েছেন। আমার টিপসইয়ে যদি মার নামে পয়সা জমা হতে পারে তা হলে পয়সা তোলা কেন যাবে না? ওইটুকু নিয়ম আমিও বুঝি। 

-- জমা করা আর টাকা তোলা আলাদা। বোকার মত কথা বোল না। 

-- কিসের আলাদা? জমা মানে টাকা আমার আঁচল থেকে বেরিয়ে ব্যাংকের সিন্দুকে ঢুকবে। আর টাকা তোলার সময় আপনাদের সিন্দুক থেকে বেরিয়ে আমার আঁচলে ফেরত আসবে। লেখাপড়া জানিনা, অংগুঠা ছাপ, কিন্তু এটুকু বুঝি। খামোকা ঘোরাবেন না। 

-- কেউ ঘোরাচ্ছে না। আমি যা বল্লাম সেটাই হল ব্যাংকের নিয়ম। তোমার মা না আসলে ওর নামে পয়সা তোলা যাবে না। 

-- আর মা যে সাতদিন ধরে বিছানা নিয়েছে? 

-- কাঁধে করে নিয়ে এস, গরুর গাড়ি করে নিয়ে এস। কিন্তু আনতে হবে। 

-- আচ্ছা? যদি দু'কোশ ধরে গরুর গাড়ি করে আনতে আনতে আমার সাতদিনের জ্বরে ভোগা বুড়িমা মরে যায়? তাতে আপনার কিছু আসে যায় না? এই তাহলে আপনার শেষ কথা? আপনি হলেন নিয়মকানুনের পোঙ্গা পন্ডিত। 

'ও কার চোখের চাওয়ার হাওয়ায়' 

তামাশা-দেখা ভীড়ের সামনে রাগে কাঁপতে থাকা রূপেশের ভেতরে কিছু একটা ঘটে যায়। হয়ত মেয়েটির কেমনযেন চাউনি, হয়ত অসুস্থ মায়ের প্রসংগ, ঠিক যে কী ও নিজেই জানে না। 

ওর গলার স্বর খাদে নামে। চাপরাশিকে জিগ্যেস করে মেয়েটার নাম কি? ওকে চেনে কি না? ওর গাঁ কতদূরে? 

--- জী সাহাব, ওহ ঘোরাপাট গাঁও কী বুধবারিন বাঈ সতনামী। ইহাঁ লে দু'কোশ দুরিহা মা ওকর গাঁও। 

রূপেশ ফরমান দ্যায় যে সেকেন্ড অফিসার চাপরাশিকে সঙ্গে নিয়ে বুধবারিন বাঈয়ের বাড়ি গিয়ে শয্যাশায়ী মায়ের টিপসই নিয়ে এসে ওকে ওর খাতা থেকে একশ' টাকা দিয়ে দেবে। 

মেয়েটি কোন কথা না বলে ওর দিকে আবার সেই কেমনযেন চোখে তাকিয়ে চলে যায়। 

ইতিমধ্যে সূর্য ঢলে পড়েছে। চাপরাশি এসে খবর দিল যে মকানমালিক প্রাক্তন জমিদার দাদুসাহাব চা খেতে ডাকছেন। 

একটু পরে দাদুসাহেবের বৈঠকখানায় চা আর চিঁড়েভাজা খেতে খেতে ও মেতে ওঠে খোশগল্পে। উঠে আসবে এমন সময় দাদুসাহেব বল্লেন-- আরে ভাল কথা, সন্ধ্যের পর কোথাও বেরোবেন না যেন! আজকে ব্যাংকের সামনে খোলা জায়গায় বাঁধানো চাতালে পঞ্চায়েতের বিচারসভা আছে। আপনিও আসুন। 

--- বিচারসভা? কিসের বিচার? ঝগড়া-ফ্যাসাদ? মারপিট? 

-- আরে না না, গাঁয়ে শান্তি বজায় আছে। আসলে একটি বিধবা মেয়ে, স্বভাবটা খারাপ। ইধার-উধার ডোরে ডালনে কী আদত। জোয়ানদের নাচিয়ে বেড়াচ্ছে। আমাদের কাছে শিকায়ত এসেছে। জাতধর্ম বলে কিছু থাকলো না। 

রাত্তির সাতটা নাগাদ খেয়েদেয়ে আসুন। নিজের চোখেই নজারা দেখতে পাবেন। 

‘কাজির কাছে হয় বিচার, একুশ টাকা দন্ড তার’ 

শীতের অন্ধকার একটু তাড়াতাড়িই নামে। বাঁধানো চাতালের চারপাশে একটু একটু করে ভীড় জমতে শুরু করেছে। ব্যাংক ম্যানেজার গঙ্গারামের অবসার্ভর স্ট্যাটাস, তাই চাতালের একটু পেছনে বারান্দার একটি থামের পাশে চেয়ারে বসে উসখুস করছে। ভীড়ের মধ্যে একটি অঘোষিত শৃংখলা আছে। পুরুষেরা একদিকে, মেয়েরা একদিকে। মেয়েদের দলটি অপেক্ষাকৃত হালকা। 

বয়স্কদের হাতে হাতে ঘুরছে হুঁকো আর অন্ধকারে এখানে ওখানে জ্বলে উঠছে বিড়ির আগুন, জোনাকিপোকার মত। জনাকয় পঞ্চ এসে চাতালের দুপাশে বসেছেন। কথাবার্তা চলছে মৃদুস্বরে। মেয়েদের দলের গুনগুন স্পষ্ট নয়। চৌকিদার এসে দুপাশে দুটো হ্যাজাকবাতি রেখে গেল। 

একজন বুড়ো খোঁজ নিলেন---" গুণাইত হাবে কা? যা, দাদুসাব লা বুলাকে লে আ। সব্বোজন আ গয়ে।' সবাই এসে গেছে, প্যাটেল যাও, দাদুসাবকে ডেকে আন। 

খাকি হাফ শার্ট আর ধুতি পরা সামারু প্যাটেল গিয়ে ভেতর থেকে একটা পুরোনো কাঠের চেয়ার নিয়ে এল। একটু পরে সবাই উঠে দাঁড়াল। সমবেত কন্ঠে শোনা গেল-- জয়রাম হো দাদুসাহাব, প্যার পরথন মালিক! 

দাদুসাহেব বসে পরিচিতদের কুশল-মঙ্গল জিগ্যেস করলেন। কে কে আসতে পারেনি জেনে নিলেন। ইশারায় ঘরের ভেতর থেকে ওনার রাউত( ঘরের চাকর, সাধারণত: জাতে গোয়ালা, লেখে যাদব) এসে সবাইকে গুড়ের চা দিয়ে গেল। ইদানীং ধানের কি দর চলছে? তিলহন-দলহন বোনা ( তিসি-ডাল) হয়েছে কি না-- এইসব নিয়ে কথাবার্তা কিছুক্ষণ চলল। এবার দাদুসাব গলা খাঁকারি দিতেই একদম সন্নাটা! 

গৌরচন্দ্রিকা করে উনি যা বল্লেন তার মর্মার্থ হল -- আজ সাততাড়াতাড়ি এই বৈঠক ডাকার উদ্দেশ্য হল একটি নালিশের ফয়সালা করা। আমাদের সমাজে নারীদের সম্মান সর্বোপরি। কিন্তু আজকাল কিছু বেয়াড়াপনা বেড়ে যাচ্ছে। এখন গাঁয়ের সিয়ান( বয়োবৃদ্ধরা) যদি কড়া হাতে লাগাম ও চাবুক না ধরেন তাহলে সমাজের গাড়ি রাস্তা ছেড়ে নালায় নেমে পড়বে। কাজেই--। উপসরপঞ্চ ঈশ্বরদত্ত তিওয়ারি নালিশের সার কথাটি সংক্ষেপে আপনাদের জানাবেন। 

আগের বুড়োটি বিড়ির আগুন নিভিয়ে থুতু ফেলে শুরু করলেন,--পঞ্চ-পরমেশ্বরকে নমস্কার!নালিশ করেছে আমাদের গেবরা গাঁয়ের কিরানা শেঠ( মুদিখানার মালিক) ভাগবত আগরওয়ালের ছেলে বিনোদ। অপরাধী ঘোরাপাট গাঁয়ের বুধবারিন বাঈ। দুজনেই হাজির? 

কোতোয়ার (কোতোয়াল) জানাল-- দুজনেই এসেছে। 

-- বিনোদ! বাতাও --কা হৈসে? পুরা পুরা বাতাও গ'। 

পরনে শার্ট-পাজামা, গায়ে একটি আলোয়ান,-- বছর বিশ-বাইশের বিনোদ আগরওয়াল উঠে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলতে শুরু করে-- শনিবারের বিকেল, তখনও পুরোপুরি অন্ধকার হয় নি। আমি সাইকেল নিয়ে কোরবা যাব বলে বেরিয়েছি। ওখান থেকে দোকানের জন্যে মাল বুক করে পেমেন্ট করতে বাবা বলে দিয়েছিলেন। সবে গাঁয়ের সরহদ পেরিয়ে নয়া-বরপালীর ভাটা পেরিয়েছি কি দেখি বড় একটা কোসম গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আমাদের বুধবারিন বাঈ। মাঝে মাঝে আমাদের দোকানে চাল-গম সাফ করতে আসে, তাই ভিন গাঁয়ের হলেও ওকে চিনি। রকম-সকম দেখে মনে হল দাল-মেঁ-কুছ-কালা-হ্যায়। ছটফট করছে, অস্থির অস্থির। যেন কারো অপেক্ষা করছে। আমিও বটগাছের আড়ালে লুকিয়ে দেখতে লাগলাম কি হয়। 

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। কোলিয়ারির দিক থেকে সাইকেলে হাজির হল আমাদের দুই মাস্টার,-- পটোয়া গুরুজি আর মিশ্রগুরুজি। 

তারপর কি আর বলব? এমন বেলেল্লাপনা সবার সামনে মুখে আনতে পারিনা। শুরু হয়ে গেল তিনজনের রাসলীলা। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। যখন হুঁশ ফিরল তখন ঝাঁপিয়ে পড়লাম ওদের ওপর। দু'ঘা দিতেই দুই গুরুজি সাইকেলে চড়ে হাওয়া। আর এই বাঈ বলল,-- তোর প্যার পরথন শেঠ! কোনো লা ঝন বাতাবে, তহুঁ লে লে। পর চুপ ঝা! 

আমি বল্লাম-- কাকে কী বলছিস্‌! তোর সাহস তো কম নয়? আমি রোজ হনুমান-চালিশা পাঠ করে দোকানে বসি আর--''। 

ব্যস্‌, হটাৎ যেন দীপাবলীর রাতে কালীপটকার লড়ি একসঙ্গে চড়বড় চড়বড় করে ফাটতে লাগল। কারণ আর কিছুই নয়-একটি মেয়ে। একটু দূরে ধানের মরাইয়ের বেড়ার পাশ থেকে আলকেউটের ফোঁস করার মত করে দাঁড়িয়ে উঠেছে একটি মেয়ে। অন্ধকারে চেহারা বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু গলার স্বরে ঠাহর হয় বয়েস তিরিশের নীচেই হবে। গলার চেরা আওয়াজে যেন কালীপটকার তীক্ষ্ণতা। 

--- ঝুট ঝন্‌ বোলবে শেঠ! ম্যঁয় তোলা বিনতি করে হন? কি তঁয় মোলা? 

মিথ্যে কথা বলিস না শেঠজী! আমি তোকে অনুরোধ করেছি? নাকি তুই আমাকে? 

আচমকা কেউটের ছোবলে ঘায়ল শেঠ মাটিতে গড়াগড়ি খায়। পঞ্চপরমেশ্বর ও ঘায়েল! কারণ মেয়েমদ্দর সংযুক্ত বৈঠকে মেয়েদের চুপ করে থাকাই প্রথা। কথা বলতে বল্লে তবে কেউ বলে। আর এমন গলা চড়িয়ে বলা? মেয়েটার নিঘ্‌ঘাৎ মাথা খারাপ! 

শেঠ আত্মপক্ষ সমর্থনে মরীয়া চেষ্টা করে। কিন্তু প্রথম হাফে আচমকা গোল খাবার পর ওর গলায় আত্মবিশ্বাসের সুর হারিয়ে গেছে। মওকা পেয়ে মেয়েটির হামলা একেবারে পেনাল্টি বক্সের ভেতরে! 

-- তোর নানহি লইকার সর মা হাত রাখকে বোল শেঠ! কে সত্যি কে মিথ্যে ফয়সালা হয়ে যাক। 

এবার জনতা উত্তেজনায় টানটান। বড় বড় সিয়ান (প্রবীণ) দের বাক্যি হরে গিয়েছে। 

তেঁতুলগাছের নীচে বসে থাকা মেয়েদের ছোট দলটির অনেকে কিচিরমিচির করে কথা বলতে শুরু করেছে, স্বর নীচু গ্রামে। কেউ কেউ ছোট বাচ্চার মাথায় হাত রেখে দিব্যি গেলার বিরোধিতা করে। 

এসবের মধ্যে আবার বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে টানাটানি কেন? আমরাও লইকা- নোনি নিয়ে ঘর করি। যদি পাপ হয়? যদি বাচ্চাটার কিছু অসুখ-বিসুখ হয়ে যায়? 

উৎকন্ঠায় লোকের চেঁচামেচি শুরু হয়ে যায়। 

এবার গর্জে ওঠেন দাদুসাহেব( খোকাসাহেব)। 

-- চুপ্‌! সবাই চুপ কর। এ কি পঞ্চায়েতের বৈঠক না কি মছলী বাজার! আর বুধবারিন বাঈ! তোমার এত সাহস? বড়দের সামনে বিনা অনুমতি মুখ খোল কি করে? আমি যাকে জিগ্যেস করব শুধু সে বলবে। 

শেঠ! কটার সময় তুমি গাঁয়ের সরহদে বুধবারিন বাঈ কে দেখতে পাও? 

-- পাঁচটা বেজে গিয়েছিল। 

-- কি করে জানলে? 

-- আমার কোরবা শহরে রেলপুল পেরিয়ে মাল কিনতে যাওয়ার কথা। বাবুজী পাঁচটা নাগাদ এসে গদিতে বসলেন, তখন আমি বেরুলাম। তাই মনে আছে। 

বুধবারিন কিছু একটা বলার জন্যে ছটফট করে। কিন্তু দাদু সাহেবের ধমকে চুপ মেরে যায়। 

-- পটেওয়া আর মিশ্র গুরুজি হাজির হয়েছে? 

--না ঠাকুরসাহাব! আমি ওদের ঘরে ডাকতে গিয়েছিলাম, কিন্তু দরোজায় তালা বন্ধ। হয়তো আজ বিলাসপুর গেছে। 

-- হুঁ:, মনে হয় পালিয়েছে। কিন্তু কদ্দিন আর গা ঢাকা দিয়ে থাকবে? এবার বুধবারিন তুই বল্‌-- কি হয়েছিল? 

মেয়েটি এবার সংযত নীচু স্বরে কেমন একটা সিং-সঙ্‌ ভয়েসে একটানা বলে যায়। 

-- শেঠোয়া ঝুট বলচে দাদুসাহেব! ওর আগে দুই গুরুজি পৌঁছেছিল। আমার সঙ্গে আগে কোন কথা হয় নি। আমাকে ভর সন্ধ্যেবেলা ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওরা সাইকেল থেকে নেমে এগিয়ে এল। পাটোয়া গুরুজি দাঁত বের করে বললো-- কেইসে ও? দেবে কা? 

-- আমি বল্লাম, মর্‌ রোঘা! তোর আঁখি ফুট গয়ে কা? মর ব্যাটা মরুটে! চোখের মাথা খেলি নাকি? 

এবার মেয়েদের দল থেকে একটা চাপা হাসির খিলখিলানি সভার মধ্যে ছড়িয়ে যায়। পুরুষেরা অস্বস্তি বোধ করে। শুধু গঙ্গারাম বুধবারিনকে সক্কালে- ব্যাংকে -এসে -ঝগড়া -করে –ওর- ইজ্জত –পাংচার- করে –দেয়া- মেয়েটি হিসেবে চিনতে পেরে ভ্যাবাগঙ্গারাম হয়ে যায়। 

একজন সিনিয়র পঞ্চ বলে-- তোলা ইঁহা কহানী শুনায়ে বর নহীঁ বুলায়ে। জলদি কাম কী বাত মেঁ আ! 

--- কা বলহুঁ মালিকমন! ওকর বাদ যো হোনা থা হো গিয়া! আমার মিশ্রগুরুজির বিরুদ্ধে কোন শিকায়েত নেই। কারণ উনি ব্রাহ্মণ দেবতা, আমি ওনাকে যা দিয়েছি তা স্বেচ্ছায় দিয়েছি। আমার কোন পছতাওয়া নেই। কিন্তু পটওয়া গুরুজি বড্ড জংলি! আমার সঙ্গে জবরদস্তি করেছে, পিঠ ছিঁড়ে দিয়েছে। ওলা সাজা মিলনা চাহি। 

এবার দাদুসাহেব গলা খাদে নামিয়ে কেটে কেটে জিগ্যেস করলেন, 

--ছোটা শেঠ কখন পৌঁছেছিলো? 

-- সব চুকেবুকে গেলে; ওকে দেখেই তো গুরুজীরা সাইকেলে চেপে পালিয়ে গেল। 

-- তারপর? 

-- তারপর বিনোদ শেঠ মিচকি হেসে বললো-- আমিই বা বাদ যাই কেন? আমি বল্লাম-- আরেক দিন। আজ আমার ভাল লাগছে না। পটোয়া গুরুজির নখে পিঠ জ্বালা করছে, গায়ে ব্যথা। তো শেঠ মানতেই চাইছিল না। বলছিল আগাম দেয়া টাকা ফেরত দে, নইলে পঞ্চায়তে নালিশ করব। অব্‌ অত্তি হো গইস্‌। হমোমন কহ দিন-- যা, করলে যা, ভড়ুয়া! তো আকে ঝুটমুট নালিশ করিস্‌। 

এবার অন্য পঞ্চেরা বল্লেন-- ঢের হয়েছে, এবার বসে পর বুধবারিন্‌ বাঈ! 

চারদিকে মাছির মত ভনভন শুরু হয়ে গেল। 

--- বিনোদ শেঠ! উঠে দাঁড়াও, তুইও উঠে দাঁড়া বুধবারিন। আমি পঞ্চায়েতের ফয়সালা শোনাচ্ছি। 

দুই গুরুজি মাস্টারদের নাম ডুবিয়েছে, আমাদের বাচ্চারা শিখবে কী? রেন্ডিবাজি? আইয়াশী? দুই গুরুজিকেই পঞ্চায়েতকে ১০০ টাকা করে জরিমানা দিতে হবে। দ্বিতীয়বার এইসব হলে গাঁ ছেড়ে যেতে হবে। আর বুধবারিন ব্রাহ্মণকে মাপ করে দিয়েছে। কিন্তু পটোয়া গুরুজি জোরজবরদস্তি করেছে। কাজেই পটোয়া গুরুজি বুধবারিন বাঈকে একটি লাল লুগরা (দেহাতি মহিলাদের লাল রঙা খাটো শাড়ি) কিনে দেবে। আর শেঠের ব্যাটা, তুমিও তো কম যাও না! এক মওকা দিচ্ছি,-- এবার ২০০ টাকা জরিমানা দাও আর বুধবারিনকে একটি লাল লুগরা কিনে দাও। 

এবার বুধবারিন, যদি গাঁ থেকে বার না হতে চাও তো একটু ঠিকঠাক থেকো, আমরা এ গাঁয়ে কোন বেচাল বরদাস্ত করব না। তঁয় এদারে গাঁও কে মন্দির কে জমিন মাঁ সাতদিন বেগারি দেবে। 

তুই গাঁয়ের মন্দিরের দেবোত্তর জমিতে সাতদিন বিনেপয়সায় জন খাটবি। 

সভা শেষ। ভিড় দ্রুত হালকা হয়ে যে যার ঘরের পথ ধরেছে। হালকা কুয়াশার ভাব। গঙ্গারাম উঠে শুতে যায়। ঘুম আসে না।ট্রানজিস্টর চালায়, একটু লো ভল্যুমে। রায়পুর স্টেশন থেকে বাজতে থাকে লোকগীত- " তঁয় একেলা যাবে, হংসা মোর, একেলা যাবে। যায়ে কে বেলা রে, একেলা যাবে।'' 

তুই একলা যাবি রে, তুই একলা যাবি। যাবার সময় ওরে তুই, একলা যাবি। 

ও আমার হংসরূপী আত্মা, তুই একলা যাবি। 

পরের সপ্তাহে শ্রীমান রূপেশ ভিলাইয়ের বাড়িতে চিঠি লেখে যে ওই চাপরাশি বুধরামের রান্না খেয়ে ওর অগ্নিমান্দ্য হচ্ছে। কিছু একটা করা দরকার।

0 comments: