0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


















১৭ 

ফ্রান্সেস্কোর প্রার্থনাগুলো ক্রমশই দুর্বোধ্য এবং অস্বচ্ছ হয়ে উঠছিল। সে পরস্পরবিরোধী ভাবনায় প্রার্থনা করছিল। তার নিজেরই সন্দেহ হতে লাগলো যে সে যা চাইছে, তা কি একান্ত ব্যক্তিগত চাওয়া, নাকি স্বর্গের ঐশ্বরিক নির্দেশ, নাকি অন্য কোনো ভাবনা থেকে উৎসারিত! অর্থাৎ সে বুঝতে পারছিল না যে সে হয়তো বা নরকের মঙ্গলকামনা করে স্বর্গের আশীর্বাদ চাইছে। খ্রিস্টীয় সহানুভূতি এবং উদ্বেগের থেকে সে স্কারাবোটা পরিবারের মঙ্গল চাইছিল। কিন্তু যখন সে আগাথাকে বাঁচাবার কথা বলছিল, তখন সেই উদ্বেগ শুধুমাত্র এক যাজকের ভাবনায় সীমাবদ্ধ ছিল না। 

আপাতত সে এই প্রশ্নের ইতিবাচক উত্তর পেয়েছিল যে আবার সেই কন্যার সঙ্গে দেখা হওয়ার ফলেই এক অদ্ভুত তীব্র ভাব তার মনে জেগে উঠেছিল, অবশ্য তা তীব্র হলেও সম্পূর্ণ পবিত্র। নিজস্ব পরিবর্তনের কারণ হিসেবে ঐহিক পাপের ফলের ভাবনা তার মনে এভাবে চেপে বসেছিল যে, ফ্রান্সেস্কোর নজরে পড়েনি মেরীমাতা, অর্থাৎ ঈশ্বরের মা হিসেবে যার আরাধনা সে প্রতিনিয়ত করে চলেছে, তিনিই আসলে ম্যাডোনা ছিলেন অন্য এক জন্মে। পয়লা মে তারিখে সোয়ানার চার্চে প্রতিবারের মতই বিশেষ অনুষ্ঠান হওয়ার কথা, যা অন্যান্য জায়গাতেও হয়; মাতা মেরীর দিবসে বিশেষ উপাসনা হয়। এবার সেই অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নেবার আগে ফ্রান্সেস্কো যেন এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে ছিল। 

দিনের পর দিন, বিকেলের দিকে প্রধানত, ফ্রান্সেস্কো সোয়ানার মা-বোনেদের সামনে মেরী মাতা সম্পর্কে ধর্মীয় আলোচনা করতো। গির্জার প্রধান হলঘর মুখরিত হয়ে উঠছিল মেরিমাতার প্রশস্তিতে। চার্চের আনাচকানাচ ভরে গিয়েছিল বসন্তের উচ্ছ্বাসে আর পবিত্র কুমারীমাতার জয়গাথার সুরে। চার্চের বাইরের দোয়েলপাখির গান, ঝর্ণার গিরিখাত- সবার ধ্বনি মিলে যাচ্ছিল এই সুরেলা আওয়াজের সঙ্গে। এই আলোচনার সময়ে ফ্রান্সেস্কো মেরিমাতার মূর্তির সামনে এক অলৌকিক ভক্তিভাবের মধ্যে নিমজ্জিত থাকতো। 

সোয়ানার মা-বোনেরা হয়তো বা টের পাচ্ছিলো না যে নিজেদের অজান্তেই চার্চকে ঘিরে মেরিমাতার প্রশস্তির মধ্য দিয়ে তারা এমন একটা সম্প্রদায় নির্মাণ করে চলেছে, যারা ঘৃণিত পাপের ফলকেই মহিমান্বিত করে চলেছে দিনের পর দিন। যদি তারা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারতো, তাহলে মেরিমাতার স্তবগানের সুর হয়তো বা ধুলোয় মিশে যেত। কিন্তু সেসব কিছুই হল না, বরং এক অদ্ভুত ভক্তিভাবের ঢেউ ছড়িয়ে পড়লো চতুর্দিকে। আল্পসের সব গাছপালা, পাহাড়পর্বতও যেন সামিল হয়ে গেলো সেই তরঙ্গে। ধীরে ধীরে সোয়ানার ধনী, দরিদ্র নির্বিশেষে, নগরপাল থেকে শুরু করে ভিখারি অবধি, নির্বিকার নাস্তিক থেকে শুরু করে চরম ধার্মিক আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই ফ্রান্সেস্কোর পবিত্র ধর্মপ্রচারের প্রতি আকর্ষিত হল। 

গতানুগতিক পৌরোহিত্যের চেয়ে একটু আলাদা রাস্তা ফ্রান্সেস্কো বেছে নেওয়ায় কেউ আপত্তি জানায়নি, বরঞ্চ এসব কিছুই তার ভক্তির বিশেষ প্রকাশ বলে মনে হয়েছিল সবার। সে যে এতকিছু করে যাচ্ছিল, হয়তো তার মনে অবচেতনে এক কণা আশা ছিল যদি কোনোভাবে আগাথাকে জীবনের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনা যায়। দিন আটেক পরেই সে একটা তারিখ স্থির করেছিল, যখন সে স্কারাবোটা পরিবারের জন্য একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। তবে আটদিনের অপেক্ষাও তার কাছে দীর্ঘ মনে হচ্ছিল। 

প্রকৃতি যেন তখনও তার গোপন রহস্য মেলে ধরছিল তার সামনে, নানা ভাষায় তার সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছিল; যেমনি করে সেন্ট আগাথায় গিয়ে তার এক অদ্ভুত ঘোর লেগেছিল। তৃণদলের প্রতিটি খণ্ড, প্রতিটি ফুল, প্রতিটি গাছ, আঙুরলতার কুঞ্জবনের প্রতিটি পাতা যেন তাকে আপন অস্তিত্বের প্রয়োজন হাতে ধরে বোঝাবার চেষ্টা করছিল। প্রকৃতির গভীর নৈঃশব্দের মধ্য থেকে উঠে আসছিল এক প্রবল গর্জন। তার পবিত্র আত্মশক্তি পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল প্রকৃতির সুরে, এমনই বিশ্বাসে ভর করে চলেছিল সে এক তরঙ্গের সঙ্গে। 

কিন্তু ফ্রান্সেস্কো তার রাতের শান্ত, গভীর নিদ্রা হারিয়ে ফেলেছিল। মধ্যরাতের কোনো এক নিশিডাকে সে জেগে উঠতো; দূরে যেত তার প্রিয় ঘুম। তার তরুণ শরীরে সে অনুভব করতো প্রকৃতির স্পন্দন। তার মনে হত যেন অদ্ভুত রহস্য তাকে ঘিরে ফেলছে একটু একটু করে, জাগিয়ে তুলছে তার সমস্ত ইন্দ্রিয়। মুখঢাকা এক দেবীপ্রতিমা যেন দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে; সেই মূর্তির অবগুণ্ঠন সরে গেলেই হয়তো এখনই উন্মোচিত হবে সেই রহস্যের যবনিকা, কিন্তু তা হচ্ছেনা। অদ্ভুত উত্তপ্ত স্বপ্ন তাকে জাগিয়ে তুলতো। সোয়ানার জলপ্রপাতের ধ্বনি দ্বিগুণ মনে হত তার কানে, চাঁদের অবয়ব যেন প্রচণ্ড চেষ্টায় বেরিয়ে আসবার চেষ্টা করতো কালো মেঘের গ্রাসের মধ্য থেকে, এক অদ্ভুত গুঞ্জনধ্বনি ছড়িয়ে পড়তো চরাচরে, কুয়াশায় ঢেকে যেতো জেনারাসো পর্বতের শিখর। ফ্রান্সেস্কোর সমস্ত শরীর কেঁপে কেঁপে উঠতো আকুল প্রার্থনায়। এমন আকুলতা আগে কখনো অনুভব করেনি সে। জ্বরতপ্ত তৃষ্ণার্ত গ্রীষ্মের মাটি যেভাবে বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করে, তারপর বৃষ্টি এলে কেঁপে ওঠে শীতল বাতাসে, সেও যেন সেভাবে এক অদ্ভুত জ্বরের ঘোরে কেঁপে কেঁপে উঠতো। সে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাতো, যেন সে প্রকৃতির মাঝে প্রমাণ করতে পারে আপন অস্তিত্বের সার্থকতা, যেন সে চিনতে পারে সৃষ্টির পবিত্র অলৌকিক রহস্যের বীজ, যেন সে জীবনের মূলমন্ত্র উদ্ধার করতে পারে। 

সে বলে ওঠে, ‘হে প্রভু, আপনার সর্বশক্তিমান আলোকরশ্মি আমাকে ভেদ করে যাক! অস্তিত্বের সকল আনন্দ, এবং তার মর্মস্থল থেকে উৎসারিত হোক গভীর গোপন সুখানুভব। হে ঈশ্বর, আমাকে আপনার সৃষ্টির নানা রহস্যে এভাবে ভুলিয়ে রাখবেন না। আমার সামনে সুন্দর বস্তু এনে মোহিত করবেন না আমায়। হে প্রভু, আমাকে সৃষ্টির মূলমন্ত্র বলে দিন। আমি আপনার সঙ্গে মিলে যেতে চাই এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মহান সৃষ্টিধারায়। কেবলমাত্র সেভাবেই আমি আপনার স্বর্গের এক অংশ হয়ে উঠতে পারবো।’ 

ফ্রান্সেস্কো তার জ্বরগ্রস্ত শরীরের উত্তাপ হ্রাস করার জন্য নগ্নদেহে দৌড়ে বেড়াচ্ছিলো নিজের ঘরে, জানালা হাট করে খুলে দিয়েছিলো যাতে রাত্রির শীতল বাতাস লাগে সারা শরীরে। তার মনে হচ্ছিল যেন জেনারাসো পর্বতমালার দৈত্যাকার প্রাচীরের উপরে কালো বজ্রগর্ভ মেঘ স্থির হয়ে আছে, ঠিক যেন একটা অতিকায় বৃষ দাঁড়িয়ে আছে পিছনের পায়ে ভর দিয়ে। তার নাসারন্ধ্র থেকে ঝরে পড়ছে বৃষ্টি, তার আঁধার চোখ থেকে ঠিকরে পড়ছে বিদ্যুৎ, তার নিঃশ্বাসের শব্দের স্পন্দন মিলে গেছে সৃষ্টির ছন্দের সঙ্গে। 

তার এইধরণের ভাবনা অনেকটাই পাগান দর্শনের সঙ্গে মিলে যাচ্ছিল। তরুণ যাজক নিজের অজান্তেই হয়তো মিলেমিশে যাচ্ছিল প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম এই ভাবনতে। বসন্তের মাদকতায়, প্রকৃতির ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিল হয়তো বা। নেশার ঘোরে তার ঈশ্বরভাবনার সীমারেখা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিলো বারেবারে। আদিম প্রকৃতিতে মানুষ সর্বত্র ঈশ্বরের প্রকাশ দেখতে পেতো। ফ্রান্সেস্কোর আত্মা সম্ভবত অনেকখানি গভীর অবধি উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল যা কয়েক লক্ষ বছর আগেকার সুষুপ্তির অতলে থাকা চিত্র জাগিয়ে তুলেছিল। 

একদিন রাত্রে, আধো জাগরণে ফ্রান্সেস্কো এক ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখলো। জেগে উঠে সে কঠিন স্তব এবং উপাসনা শুরু করলো। উফফ, সেকী ভয়ঙ্কর দৃশ্য! সে কি সত্যি না বাস্তব! নাকি অতীতের কোনো রহস্য উন্মোচিত হওয়ার জন্য স্বপ্নের আকারে এলো তার চোখের সামনে। সে দেখছিল জেনারাসো পর্বতের কোলে কোনো এক মঠের ভেতর দিয়ে চলে গেছে এক গুপ্ত সুরঙ্গ, যা শেষ হয়েছে পাহাড়ের এক দুর্গম গোপন গুহায়। সেই রহস্যময় স্থানে অনেকগুলি বিশালদেহী পুরুষ, কয়েকজন আবার বৃদ্ধও আছেন, বিশাল লম্বা দাড়ি তাদের, পরনে গাঢ় বাদামী আলখাল্লার মত পোশাক, তারা পরপর হেঁটে আসছেন। তাদের চলা ফেরা গম্ভীর, তাদের মুখাবয়বে ফুটে উঠছে নিষ্ঠুরতা! মনে হচ্ছে তারা কোনো গুহ্য আচারে লিপ্ত হবেন এখনই। তাদের অতিকায় চেহারা দেখলে ভক্তিমিশ্রিত ভয়ের সঞ্চার ঘটে। তারা গুহার মধ্যে নেমে এসেছেন, তাদের দাড়ি গোঁফ মাথার কেশ মিলে মিশে যেন ছায়াময় গাছপালার মত দেখাচ্ছে। 


(চলবে) 
গেরহার্ট হাউপ্টমান রচিত ‘ড্যের কেৎজার ফন সোয়ানা’ অবলম্বনে লেখা

0 comments: