0

বইঘর, - পল্লববরন পাল

Posted in


নদী ও দেবদূত
মূল জার্মান কবি - কাটরিন শ্মিট
বাংলা অনুবাদ - সুলগ্না মুখোপাধ্যায়
গ্রন্থ পর্যালোচনা - পল্লববরন পাল



কবির নাম কাটরিন শ্মিট। জন্ম ১২ মার্চ জার্মানীর এরফুর্ট অঞ্চলের গোঠায় ১৯৫৮ সালে – জেনেই মনটা আনন্দে ভরে উঠলো, কারণ আমারই সমবয়সী এক জার্মান কবির কবিতা পড়ার সৌভাগ্য হলো। কাটরিন মনোবিজ্ঞানে স্নাতক। বইয়ের নাম ‘নদী ও দেবদূত’। তেত্রিশটি কবিতার বাঙলা অনুবাদ করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের কৃতী ছাত্রী স্বনামধন্যা সুলগ্না মুখোপাধ্যায়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা। প্রথম প্রকাশ ২০২০।

সুলগ্নাকৃত এই কবির কিছু কবিতার অনুবাদ বিচ্ছিন্নভাবে আমি এর আগে পড়েছি। যদিও টুকরো টুকরো অনুভুতির মধ্যেই থাকে অখণ্ড সম্পূর্ণতার প্রতিশ্রুতি, বিশ্বাস করুন ‘নদী ও দেবদূত’ পড়ার আগে আমি তার একটুও আভাস পাইনি। এ নিতান্তই আমার দৈন্যতা। কবির নিজের বয়ানে – ‘আমার শব্দের দ্বৈতার্থ আমি যেন দূরবীন দিয়ে দেখি আর পর্যবেক্ষণ করি, কেমন করে দুটি শব্দের মিলনে তৃতীয় শব্দটি তৈরি হয়, যার আসলে কোনো অস্তিত্বই নেই। একটি ভাষায় সৃষ্ট নতুন শব্দটির সমশব্দ অন্য ভাষায় ব্যক্ত করা, একটি দুঃসাধ্য কাজ’। একজন মগ্ন অনুবাদকের আসল কৃতিত্ব অমূর্ত অধ্যাহৃত ওই তৃতীয় শব্দটি আবিষ্কারে, যা সুক্ষ্ম শিরার মতো কবিতার আস্ত শরীরকে বোধের গভীর বুননে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধে আর পাঠকের চেতনায় নকশীকাঁথার বিচিত্র আলপনা ফুটিয়ে তোলে। কাজেই শুধু ভাষা জানলেই অনুবাদ হয় না, সেই তৃতীয় শব্দের আবিষ্কারে দেশ সমাজ সময় ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে গুলে খেতে হয়, তবেই সঠিকভাবে আত্মস্থ করা যায় অন্য ভাষার কবিতা।

দ্বিধাহীন বলি, ‘নদী ও দেবদূত’ পড়তে পড়তে কিছু জার্মান নাম যার অনুবাদ হয় না, বাদ দিলে কোথাও একবারের জন্যও মনে হয় না, এটা কোনো বিদেশী কবির কবিতা পড়ছি – এমনই অনায়াস স্পর্ধায় প্রিয় বান্ধবীকে বাঙলাসাহিত্যের পাঠকদের সঙ্গে পরিচয় করালেন সুলগ্না। 

শহরের পিছন দিকটা নোংরা
বাকি অংশটা তুমি ভাঁজ করে তোমার বুক পকেটে ভরে নিতে পার
মৃত ছোট নদীটা যার অনেক আগেই দেওয়া একটি প্রতিশ্রুতিকে মনে করিয়ে দেয়
সে-ও বয়ে চলে মৃত সৈনিকদের থেকেও দ্রুতবেগে 
তোমার হৃদয়কে সামান্য নাড়িয়ে যায়
তুমি বিশ্বাস করতে পার আবার না-ও ... [ছেড়ে যাওয়া]

বইয়ের প্রথম কবিতা। এগারো পংক্তির এই কবিতায় একমাত্র সপ্তম পংক্তির শেষে একটি যতিচিহ্ন – আর কোথাও কোনো পাঁচিল নেই, সম্পুর্ণ মুক্ত স্বাধীন বেপরোয়া ভঙ্গী দিয়ে গোটা বইয়ের চরিত্রটি বেঁধে দিলেন কবি কাটরিন - ‘নদী ও দেবদূত’ শিরোনামের নদীর সাথে পাঠকের পরিচয় করালেন - মৃত সৈনিকদের শবদেহবাহী যে নদী তার ফেলে আসা জমিকে উর্বর করে মানুষকে শস্য-ফসল উপহার দেয়, তোমার বিশ্বাসের তোয়াক্কা না করেই। এই ‘তুমি’ কে? সে কি পাঠক, প্রিয় বোন, বান্ধবী সিলভিয়া, নাকি তাঁর দেশ অবিভক্ত জার্মানী? নাকি আরো বড়ো মাপে আমাদের বিদগ্ধ সভ্যতার ইতিহাস? 

দ্বিতীয় কবিতায় চিত্রকল্পের বাহুল্য পাঠককে কোথাও কোথাও কুয়াশায় আচ্ছন্ন করবে কিন্তু তার মাঝখানেই সহসা বিদ্যুৎ ঝলকের মতো কিছু উচ্চারণ – 

‘আমার লেটারহেডটা যন্ত্রণা দিচ্ছে...’, ‘নিষেধাজ্ঞা আসে আর নিষেধাজ্ঞা যায়/ তার মাঝামাঝি কিছুই নেই...’, ‘এখন দেশের সীমান্তে অপেক্ষারত আরও একটি আঘাত আর ভিক্ষে...’, 

দুই জার্মানীর মিলন সংক্রান্ত রাজনৈতিক অভিমানচিত্রের পটভূমিকায় সেই সময়ের জার্মান সাহিত্যের প্রসঙ্গে কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত এই বইয়ের ভূমিকায় লিখছেন – ‘ক্রিস্টা হ্বোলফ কিংবা হ্বোলফ বীয়ারমান পুব-পশ্চিমের বিভাজন কবুল করে নিয়েও শেষ পর্যন্ত অবিভাজ্য একটি নিখিল প্রাণসত্তার অভিমুখেই আমাদের চ্যালেঞ্জসঞ্চারী একটি আমন্ত্রণ জ্ঞাপন করেছেন... এই লেখিকার অন্যতম থীম ব্যবধানসূচক প্রাচীরের প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি যাকে অনায়াসে ভেঙেচুরে দেওয়া একরকম অসম্ভব। একটু তলিয়ে দেখলে অবশ্যই আমরা ঠাহর করে নিতে পারি এই প্রাচীরের প্রকৃত শামিল যুগান্তবাহিত নারী ব্যক্তিজীবনে নির্জিত হয়েও মনের গহন কোণে যে রক্তদীপন মশাল জ্বালিয়ে সমস্তরকম ট্যাবু লুপ্ত করে দেয়’। কী নির্ভীক দাপটে এই নারী-কবি চাঁদনি রাতে গাড়ির চাকায় হাওয়া ভরেন, তারপর জ্বালানি ভরে টাকা মেটাতে গিয়ে গাড়ির আয়নায় নিজেকে দেখে ফেলছেন, আর পরক্ষণেই তাঁর নারীত্বের অহমিকাকে নিজ হাতে চুরমার করে ভাঙছেন পৈশাচিক উন্নাসিকতায় - 

আমাকে তাক করে গুলি ছুঁড়তে উদ্যত
আমার নারীত্ব আক্রান্ত সেইদিন থেকেই
আর তখন থেকেই আমি বয়ে নিয়ে চলেছি
ঋতুচক্রের চিহ্ন আমার সারা মুখে [রাতের তেল ভরা]

এ বইয়ের পাতায় পাতায় এক অস্থির সময়ের যন্ত্রণাক্লিষ্ট শব্দাবলীর রঙিন বাগান। দুই জার্মানীর মিলনে কবি ভারাক্রান্ত, রক্তাক্ত – একাধিক কবিতায় মৃত্যুর রূপক এসেছে বারেবারে বিভিন্ন মুদ্রায়। 

‘আমার মুখটা যেন মৃত মানুষের মত পাঙ্গাসে,
চুম্বনের আঘাতে মৃত, যে চুম্বন আমাকে অন্ধকার থেকে বাইরে আনে, 
যেন প্রতিটি যুদ্ধ এক একটি রাত 
ঘুমিয়ে আছে ভাড়াটে সৈন্যের পোশাকে [নামহীন কবিতা, পৃষ্ঠা ২৮] 

বইয়ের মলাটে ‘নদী ও দেবদূত’ শিরোনামের নিচে ছবিতে ছোপ ছোপ ওটা কি ভাসমান রক্ত? মলাট খুলে ভিতরে অনুপ্রবেশের পর আস্তে আস্তে পাঠকেরও মস্তিষ্কে সীমান্ত টপকে ঢুকে পড়ে পচা দুর্গন্ধময় একটা সময়, ক্ষত-বিক্ষত গোরস্তান, গুলিবিদ্ধ বিস্তৃতভূমি, গলাবন্ধনীর ফাঁসে শ্বাসরোধ আর তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সোচ্চার প্রতিশোধী উচ্চারণ।

তোমার গলার আওয়াজে গভীর জড়তা
আর প্রুশিয়া কড়া নাড়ছে তোমার দরজায়
স্টিয়ারিংটা চালানোর বদলে তুমি
তেরছাভাবে ঝুলিয়েছ তাকে
ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া মুখটাকে শ্বাসরুদ্ধ করছে গলাবন্ধনী
প্রতিশোধ নেবই আমরা!
এক সুরে বলে ওঠে ঘাতকেরা
শুনতে কি পাও সেই ঘাতকের ধ্বনি
যখন জার্মান ভাষার গলা রুদ্ধ হয়ে যায়, আর
হাওয়া যেদিকে সেদিকেই হেলে যায় সে?
যখন তোমার প্রতিবেশী দেশের ঘুঁটি পড়তে চায় না পুবে বা পশ্চিমে?
তুমি টেনে নিয়ে চলো গাড়িটা, স্টিয়ারিং-এর সাহায্যে,
আর তৈলমর্দন করো যতক্ষণ না ভেঙে পড়ে সেটা
ঠিক যেমন করে গলাবন্ধনীটি তোমাকে শ্বাসরুদ্ধ করে।
শুধুই শুল্ক জুগিয়ে যাও তুমি
আর মৌন থাক [লৌহ হাইনরীশ]

এই অনির্বাণ লড়াইআগুনে দাউদাউ ডানা মেলে যেন ফিনিক্স পাখি হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছেন কবি। কবিতার শেষে লক্ষণীয় যতিহীনতা এই আগুনকে আরো প্রসার ঘটিয়ে দাবানলে প্রলুব্ধ করে। কবি কাটরিনের এই প্রতিবাদ যতটা বহির্মুখি ও যত অনায়াস ঔদ্ধত্যে আন্তর্জাতিক দেশসীমান্ত কাঁটাতার তিনি অতিক্রম করেন, ততোধিক ধারালো ও নির্দয় বেত্রাঘাত তাঁর নিজস্ব অন্তর্জগতের বৈড়ালব্রতী ফেরেব্বাজির পিঠে, কাটরিন ততটাই তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত অন্তর্মুখ অভিসারী, ততটাই নির্জনতাপন্থী তিনি। এবং কোথাও কোথাও এই অন্তর্মুখ ও বহির্মুখ একাকার হয়ে যায় – ভিতর আর বাহির, এই দুইয়ের পৃথক অস্তিত্বের সীমানাও সসম্মানে সংহার করেন অদ্ভুত এক বেপরোয়া দেবদূতের মতো। এখানেই তিনি মহৎ, অন্য অনেক সমসাময়িক কবিদের পিছনে ফেলে দৃপ্তপায়ে হেঁটে এগিয়ে যান অমরত্বের দিকে। কয়েকটা উদাহরণ দিই।

এক - ‘... যেখানে দূরত্ব এবং আঘাত একে অপরের সাথে/ সহবাসে লিপ্ত, যেখানে দাঁড়িয়ে রেডেফিন গ্রাম আর আমার পিতা,/ স্থূলকায়া নারীরা চলেছে সেখানে পাশাপাশি।/ ... পুবের মেয়েরা অয়স্টার-এর স্বাদ জানে না,/ তাদের বাড়িতে রয়েছে শুধুই কড়াইশুঁটির গন্ধ।/ ... পুবের পুতুলেরা নাচে/ পশ্চিমের বার্বিদের অঙ্গুলি হেলনে’। 

দুই - ‘... আর শরৎ যতই কাছে এগিয়ে আসে/ শরীরে সে জড়ায় বর্ষাকে/ আর্থিক আগ্রাসনে বিলীন হয়/ দেশের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা/ আর আমার যোনির বিভাজিকার মাঝে/ তৈরি হয় এক স্বপ্নের ঘর/ আমি হই অন্তঃসত্ত্বা/ ... কিন্তু আমি অপারগ আগের মতন জন্ম দিতে/ রক্তাকত দেশ আজ অকারণে বিস্তৃত/ আর আমার আসন্ন মৃত সন্তানের জন্য/ সময়টা এখনও প্রতিকূল নয়’

তিন - ‘... শূন্য প্রহর বয়ে আনে সেই সোনালী ভবিষ্যৎ,/ যা জোগান দেয় তোমাকে বাঁচার রসদ/ শূন্য ঘন্টা যেন পরিত্রাতা যিশুর মতন/ সে জানে নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে,/ যদিও বারোটার ঘন্টা একটি দিনের সমাপ্তি ঘটায়/ আর অর্ধচক্রাকার/ যার থেকে বেরোনোর সব রাস্তাই বন্ধ’। 

চার - ‘... তোমাকে জোর করতে পারে যাতে নিজের/ মুখে তুমি ট্যাম্‌পন গুঁজে দাও/ কারণ তুমি তোমার যোনি আর মুখের/ মধ্যে কোনও প্রভেদ করতে পারছ না/ এমন একটা দিন যা তোমার/ গোপনাঙ্গের লোমের ক্ষতি করতে পারে/ কিংবা মুখে একটা অকারণ বিরাশি সিক্কা দেবে/ ... আর তোমাকে হাইজ্যাক করে ফেলে দেবে অন্য দেশে/ এমন একটা দিন যার গহ্বরে সেঁধিয়েছে কৃষ্ণাঙ্গ শিশুরা/ তারা চায় না জন্মাতে/ হিজড়েরা কাঁদছে উদ্দেশ্যহীনভাবে/ তাদের লিঙ্গবিহীন অবস্থার জন্য/ অকারণেই’

অজস্র উদাহরণ দেওয়ার থেকে বইটা সংগ্রহ করে পড়ে নেওয়া অনেক সহজ। এইখানে একটা কথা আমাকে বলতেই হবে। উপরোক্ত শেষ উদাহরণে ‘বিরাশি সিক্কা’ শব্দটি প্রয়োগে অনুবাদকের মগ্ন অনুশীলনকে সেলাম জানাতেই হয়। এই জটিল রূপকের আড়ালে কবির উচ্চারিত প্রতি দুটি শব্দের মাঝখানের ঐ অনুচ্চারিত শব্দটিকে সমুদ্র মন্থন করে প্রবালের মতো সংগ্রহ ও আবিষ্কার করা চাট্টিখানি কথা নয়। অনুবাদ ও অনুবাদক প্রসঙ্গে কবি কাটরিন নিজেই লিখেছেন – ‘আমরা একে অপরকে অনেকদিন ধরেই চিনি, আর এই অনুবাদের কাজটি চলাকালীন আমাদের দুজনের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। সুলগ্নার কোনো শব্দ বুঝতে অসুবিধা হলে, আমি চেষ্টা করতাম উদাহরণের মাধ্যমে তাকে সাহায্য করতে। এইভাবে আমি আমার কবিতার অনেকটাই ব্যাখ্যা করতে পেরেছি আর একই সঙ্গে অনুভব করতে পেরেছি এই অনুবাদের মূল অসুবিধার জায়গাগুলোকে। তবে আমার বিশ্বাস যে, যেখানে আমি অনুবাদককে আমার ব্যাখ্যার মাধ্যমে কোনওভাবেই সাহায্য করতে পারিনি, সেখানেও সে বাংলা ভাষায় তার একটা প্রতিশব্দ খুঁজে নিয়েছে’। এইরকম আরো উদাহরণ দেওয়াই যায়, তবে ঐ যে আগেই বলেছি সহজতর পন্থার কথা, সেটাই পাঠককে আবার অনুরোধ করছি। 

দেবদূত প্রসঙ্গে আসি। নইলে ‘নদী ও দেবদূত’ নামকরণের পশ্চাৎপটটা পরিষ্কার হবে না। অবশ্য পরিষ্কার হতেই হবে – এমন বাধ্যবাধকতা মেনে কোন যুগে কোন কবিই বা কলমে সার্ফ এক্সেল কালি ব্যবহার করেছেন? আমার ধারণা কবি কাটরিনও তার তোয়াক্কা করেননি। তবে সচেতন নিবিড় পাঠক তার নিজস্ব ভঙ্গিতে এর ব্যাখ্যা করে নেন – এটাই দস্তুর। এ বই পড়তে পড়তে কখনও মনে হয়েছে কবি নিজেই যেন নদী, ভেসে যাচ্ছেন নিজের স্পর্ধায় ও খেয়ালে – আদিম স্বেচ্ছাচারে – প্রথম কবিতার ‘তুমি’ কি তবে সেই পুরুষ দেবদূত’? 

‘সাইরেন-এর মধ্যে দিয়ে বার্তা পাঠাচ্ছে বিলম্বিত সময়
সমুদ্রের ঢেউ-এর ওপর দিয়ে ধেয়ে গিয়ে
গর্জে ওঠা মেঘের চারিপাশে চক্কর খায়
যারা দেবদূত ছিল তারাও চলেছে সেদিকে ধেয়ে ...’ 

স্প্রে নদীর ওপরের আকাশে ডানা ঝাপটে ঘুরপাক দিতে দিতে সেই দেবদূত হঠাৎ গোঁৎ খেয়ে ঢুকে যাচ্ছে নদীর সহবাসী বার্লিন শহরের বুকের গভীরে [‘বিবাহ’ কবিতায় কবি তাঁর বোনকে বলছেন – ‘আমি তোমাকে মনে করাতে চাইছি সেই কথাটা/ আমরা যেটা করতে পারতাম এই বিভাজনটা ঘোচাতে/ হয়তো আমরা একটা সোমত্ত পুরুষকে/ মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে ভান করতাম যেন কিছুই হয়নি’] - যে শহরের পিছন দিকটা নোংরা আর বাকি অংশটা তোমার বুক পকেটে ভাঁজ করা কাগজে ছোট্ট একটা নৌকো, মাঝের বিন্দুগুলোকে কেউ একজন তুলনা করছে মৃত্যুর সঙ্গে, মোটাসোটা ইঁদুরদের হাতের ক্রীড়ানক নদীর জলে ডুবে যাওয়া সেইসব অনায়াস মৃত্যু হঠাৎ জিজ্ঞেস করে উঠলো – তরবারি না লিলি? 

চতুর গ্রীষ্ম ততক্ষণে নদীর অন্য প্রান্তের চরাচর অনর্গল ভরিয়ে চলেছে লিলি ফুলের আদিগন্ত বাগানে। তো, কোথায় গেলেন সেই দেবদূত? 

‘...আমি এখনও জানি কীভাবে আমরা ওই দেবদূতকে বেত্রাঘাত করতাম
যে এই পৃথিবী আর কাঠের ঘ্রাণ নিত আর হাসত
মনোহ্বিৎস-এর দেবতা আমাদের সর্বদা কড়া নজরে রাখতেন
তিনি জার্মান ও জোর করে জার্মান বনে যাওয়াদের দেবতা’ [নদী ও দেবদূত]

‘মনোহ্বিৎস’ শব্দের অর্থ কী? সুলগ্না পৃষ্ঠার নিচে টিকা দিয়ে জানালেন – এটি নাৎসি জার্মানি অধিকৃত পোল্যান্ডের একটি কন্‌সেন্ট্রেশন ক্যাম্প।

পাঠক, এ ক্যাম্পে আপনি স্বেচ্ছায় অনুপ্রবেশকারী হয়ে ঢুকবেন – আমার স্থির বিশ্বাস। 

0 comments: