ধারাবাহিক - সায়ন্তন ঠাকুর
Posted in ধারাবাহিক
৮
চারপাশে ঘন সবুজ সমুদ্র। গাছপালার জংলা গন্ধে প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসে। তার মাঝে দ্বীপের মতো জেগে আছে একটুকরো পরিস্কার জমি। ছোট বারান্দা দিয়ে ঘেরা এক গাছবাড়ি। ওই বারান্দা যেন সবুজ সমুদ্রের বুকে ভাসমান কোনও জাহাজের ডেক। যেখানে থেকে গাছপালা ভেদ করে নীলকান্ত মণির মতো আকাশ দেখা যায়। বারান্দাটি গোল হয়ে ঘরটিকে আগলে রেখেছে। একপাশ দিয়ে নেমে এসেছে রোগা সিঁড়ি। আরও একটু দূরে আপনমনে বয়ে যাচ্ছে সরু এক নদী। স্বচ্ছ কাঁচের মতো জলের নীচে রঙ বেরঙের নুড়ি পাথর। গোড়ালিও ডোবে না এই শীতকালে। রোদ্দুরের আলো ওঠার আগে ঘন কুয়াশায় ঢেকে থাকে এই অপরূপ দৃশ্য। তারপর আয়নায় নিঃশ্বাসের দাগ যেভাবে আঙুল দিয়ে মুছে মুছে স্পষ্ট হয় নিজের চেহারা সেভাবেই নরম হলদে আলো একটু একটু করে এঁকে তোলে ওই গাছবাড়ি, রোগা নদী, সবুজ পান্নার মতো অরণ্যকে।
হর্নবিলের ডাকে মুখর হয়ে ওঠে চরাচর।দু একটা ভীত সারস হেঁটে বেড়ায় জলের ওপর।বনটিয়ার ঝাঁক পাক খেয়ে উড়ে বেড়ায়। কখনও সখনও একা এক সম্বর নদীর ওপারে নুনির লোভে এসে জোটে। ঘাসের ডগা তখনও ভিজে। ময়ূরের দল নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ায় তার ওপর। ইচ্ছে হলে মেলে দেয় পেখম আবার পরমুহূর্তে গুটিয়ে নেয়।
নদীর পারে একটা পাথরের ওপর বসে আছি। মাটিতে শোয়ানো বাচ্চু রহমানের সাইকেল। বাচ্চুদা মেন্দাবাড়ির এই গাছবাড়ির ম্যানেজার। সরকারি কর্মি। মাঝবয়সী। আমি এবার বাচ্চুদার বাড়িতেই উঠেছি। কাছেই দক্ষিণ সাতালি গ্রামে ওঁর বাড়ি। চিলাপাতা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এক মায়াবী ছায়াঘেরা রাস্তা ধরে পৌঁছানো যায় সে-বাড়ির উঠোনে। একতলা পাকা বাড়ি,খড়ের চাল মাথায়। নিকোনো মাটির উঠোন। লাল পোষা মোরগটা চড়ে বেড়ায়। চারপাশে শালগাছের ঘন বসত। দাওয়ায় মাটির বড় উনোন। শুকনো কাঠ জ্বেলে আজ রাতে ওখানেই রাঁধব শুয়োরের ঝাল ঝাল মাংস। মাটির হাঁড়িতে নিভু নিভু আঁচে কষতে হবে থলথলে দিশি শুয়োরের চর্বিওয়ালা মাংস। আজ শনিবার। রঙিন হাট বসবে চিলাপাতায়। ফেরার পথে দুপুর গড়িয়ে যাবে। আরও হলুদ হবে আলো। দীর্ঘ হবে গাছের ছায়া। নেমে আসবে ঠাণ্ডা নীল কুয়াশা আস্তে আস্তে। হাট থেকে শুকনো লঙ্কা কিনব, সর্ষের তেল, পেঁয়াজ, মেটে আলু, টম্যাটো। সাইকেল চালাব আমি,পেছনের কেরিয়ারে বাচ্চুদা বাজারের থলি হাতে বসবে।
গাছবাড়িতে আজ দুজন গেস্ট এসেছেন। তাঁদের রান্নাবান্নার সব বন্দোবস্তো করতেই সাত সকালে এসেছেন বাচ্চুদা। কাজ মিটলেই বেরিয়ে পড়ব দুজন। ওই যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে তরুণ দম্পতি। অবাক বিস্ময়ে মেয়েটি চেয়ে আছে সামনে। শ্যাওলা রঙের একটা স্টোল গায়ে। চোখে মুখে বাসি ঘুম লেগে আছে এখনও। লম্বা কোঁকড়ানো চুল এলোমেলো খোঁপায় বাঁধা। ছেলেটিও ভারী সুঠাম চেহারার। সাদা রঙের পাঞ্জাবী পরে আছে। কাটা কাটা নাক। ফর্সা রঙে লালের ছোপ। নরম অল্পবয়সী দাড়ি সারা মুখে।
হঠাৎ একটিবারের জন্য নুনীর সামনে পেখম মেলল ময়ূর! মেয়েটির জীবনে বোধহয় এমন দৃশ্য প্রথম! উত্তেজনায় জড়িয়ে ধরল ছেলেটির হাত। আরও ঘন হয়ে এল ওরা দুজন। দূরে কোথাও শোনা গেল হাতির ডাক। আশ্চর্য নীরবতার ভেতর মেয়েটি দুহাতে ভরে নিল ছেলেটির মুখ। যেন কোনও সতেজ পদ্ম। ঠোঁট উঠে এলো ছেলেটির ঠোঁটে। যেমন করে মধুকর পান করে মধু। মাথা নামিয়ে একটু ঝুঁকে দাঁড়াল পুরুষটি। চরাচর স্তব্ধ করে রচিত হল এক দীর্ঘ চুম্বন। কত যুগের তৃষ্ণা। কী অবলীলায় সমগ্র অরণ্যে ওরা মিশে গেল মুহূর্তে!
ধীর পায়ে প্রায় নিঃশব্দে নদীর ধার থেকে উঠে এলাম। আমি থাকলেই ভেঙে যেতে পারে এই দৃশ্যকাব্য। অপরূপ সকালে ওরা ভালোবাসুক নিজেদের। তারই কিছু টুকরো ভেসে বেড়াক চিলাপাতা অরণ্যের নিভৃতে, একাকী, শীত বাতাসে ভর করে।
একটু বেলা বাড়লে ওদের দেখতে আসবে হয়তো একদল বুনো হাতির পাল। বাতসে খড়খড় করে উড়ে বেড়বে শুকনো পাতা। পালে মায়ের পেটের তলায় ক্ষুদে বাচ্চাও থাকবে, আগলে আগলে রাখবে মা তাকে। ওরকম বাচ্চার কথা ভাবলেই আমার সেই তার কথা মনে পড়ে।
মাস তিনেক বয়স তখন। ভারী মিষ্টি মুখ,মাথার ওপর খোঁচা খোঁচা রোম,গায়ের রঙ ধূসর। মেরেকেটে ফুট চারেক হবে লম্বায়। জলদাপাড়া জঙ্গলে একা একা শুঁড় তুলে করুণ স্বরে চিৎকার করছিল। সামনে দল ঘাসের ঘন বন। গতরাতের শিশিরে ভিজে ঝুপুস। ঘাসের ডগায় জলের বিন্দুর মধ্যে ঝিকমিক করছে প্রথম সূর্যের আলো। চারপাশ হলুদগোলা জলে কে যেন রাঙিয়ে তুলেছে। আকাশ এখনও ফ্যাকাশে। বেলা গড়ালে নীল জামা পরে সেজেগুজে যেন হেসে উঠবে।
বৈজয়ন্তীবালার পিঠে চেপে টহল দিচ্ছিল মনোহর মাহুত। সজাগ দৃষ্টি। হাতে একখানা অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরির তৈরি দোনলা বন্দুক। যদিও মনোহর জানে বিপদে ওই বন্দুক তেমন কাজে আসবে না,প্রখর দৃষ্টিশক্তি,গন্ধ পাওয়ার সহজাত ক্ষমতা আর সাহসই জঙ্গলের একমাত্র সম্বল। দল ঘাসের ঝোঁপেই পা ছড়িয়ে বসেছিল বাচ্চাটা। বৈজয়ন্তীবালা এগিয়ে এসে গায়ে শুঁড় ঠেকাতেই উঠে চারপায়ের ফাঁকে ঢুকে আশ্রয় নেয়। খুঁজতে থাকে দুধ। কতক্ষণ খায়নি, হয়তো দলছুট হয়ে সারারাত পড়েছিল। এমন ঘটনা স্বাভাবিক নয়,তবুও কত কী ঘটে এখনও!কিছুদিন আগেই মা হয়েছে বৈজয়ন্তীবালা, স্তনভর্তি দুধ। সেই বছর দুয়েক আগে হলং পিলখানার থানে কোথা থেকে এক মাকনা এসে জুটেছিল, শীৎকারে ভরে উঠেছিল বাতাস, তারপর মাস তিনেক আগেই পৃথিবীতে এসেছে রাম সিং!
মা-হারা বাচ্চাটা সেই থেকেই থেকে গেল হলং পিলখানায়। রেঞ্জারবাবু আদর করে নাম রেখেছেন বলরাম! দুটোকেই সামলায় বৈজয়ন্তীবালা,কিন্তু ইদানীং দুধে টান পড়ছে তার! সেরেল্যাক খায় ইয়া বড় এক বোতলে বলরাম। যদিও শুকনো গুঁড়ো সেরেল্যাক তার বেশি প্রিয়! ঘুরঘুর করে সেরেল্যাক যেখানে রাখা তাকে তার আশেপাশে। দামাল বাচ্চা। লাফিয়ে লাফিয়ে গুড়গুড় করে ডাকে আর ঘুরে বেড়ায়। হলং লজের হাতি সাফারির সময় বৈজয়ন্তীবালার পিছু পিছু যায়। মাঝে মাঝে পেটের নিচে হাঁটতে থাকে। এই জগত, তিরতিরে হলং নদী, ওই বাজপড়া গাছের ডালে বসে থাকা একাকী ঈগল, দল ঘাসের অরণ্য, বড় বড় গামহার, অর্জুন, শাল গাছের গন্ধ, গণ্ডারের গায়ের গোবর গোবর গন্ধ সবই তার প্রিয়। এই তার শৈশবের পৃথিবী! কী স্নেহ আর ভালোবাসায় পূর্ণ!
কবেকার কথা সব। চিলাপাতা থেকেই সেবার গেছিলাম হলংএ। বাচ্চুদা তখন হলং বাংলোর হেড কুক। রোগা হলং নদীর ধারে সে এক রাজকীয় বাংলো। উজ্জ্বল মেহগনি কাঠের আসবাব প্রতি ঘরে। শীতের রোদ্দুর পিঠে নিয়ে ওই নিবিড় অরণ্যবাসে যাঁরা বাচ্চুদার হাতের পাতলা অতি স্বাদু বোরোলি মাছের ঝোল আর মিহি বাতাসের মতো তুলাইপাঞ্জি চালের ভাত খেয়েছেন তাঁরা জানেন কেন রান্নাঘরকে আদর করে রসবতী বলে ডাকা হয়!
তা সেদিন বলরামকে নিয়েই কথাই হচ্ছিল হলং পিলখানা থেকে একটু দূরে ছোট কাঠের একচালা ঘরের দাওয়ায় বসে। বুধন পাতাওয়ালার ঘর। তার বউ লতা ঘরের সামনে চৌকাঠে ঠেস দিয়ে বসে বলরামের কীর্তিকলাপ বলছিল! ভারী মায়া ওর বলরামের ওপর। তাই নিয়ে বুধনের সঙ্গে অশান্ত। মনোহর মাহুতের কুড়িয়ে আনা বাচ্চা কেন লতা মানুষ করবে! মনোহরের সঙ্গে লতার কি আশনাই আছে? আজ সকালেও মারধর করেছে বুধন লতাকে। রেঞ্জারবাবু অবধি গড়ায় কথা। প্রচণ্ড বকাবকি করেছেন তিনি বুধনকে। তারপর থেকে বুধনের পাত্তা নেই।
সন্ধে ঘন হয়ে এসেছে এখন। একটা হ্যারিকেনের ম্লান আলো সেই অন্ধকারকেই যেন উসকে দিয়েছে একটু। শুকনো পাতা ঝরার আওয়াজ ভেসে আসছে মাঝে মাঝে। নির্মেঘ আকাশ, লক্ষ নক্ষত্রের ওড়না দিয়ে ঢাকা। চাঁদ আজ দেরী করে উঠবে।
—তোমার যে বর ফিরল না,খোঁজখবর নাও! গেল কোথায় বুধন? —জিজ্ঞেস করি আমি
—উয়ার কুথা যাওনের আছে নাকি! উই কোদালবস্তির ছেমরির টে যাওন ছাড়া!
—কে গো সে? বাঁধা মেয়েছেলে নাকি?
—যাউক গা।—মুখ ঝামটে ওঠে লতা।
আমি একটু মজা করার লোভ সামলাতে পারি না।
—মনোহরকেও তো দেখছি না আজ সারাদিন! সে আবার কোথায় গেল?
হলদে আলোয় মুহূর্তে নরম হয়ে এলো লতার মুখ। কোথাও ক্যাঁও ক্যাঁও করে চিৎকার করে উঠল ময়ূর। সব নিস্তব্ধতা ছিঁড়ে গিয়ে পরক্ষণেই ফিরে এলো দ্বিগুন হয়। বাতাসে শীতরাত্রির ছোঁয়া। নীচু স্বরে লতা বলে উঠল
—গোরুমারা যাইছে।
—গোরুমারা কেন, হঠাৎ?
—কুথাকার এক মাকনা আসি জুটিছে। পুরা মস্তী। রগ বাইয়া রস গড়িছে। উয়াকে জঙ্গলটে ফিরিয়া যাউনের লেগে মনোহর যাইছে।
—বলো কী? মনোহর পারবে সামলাতে?
—উ তো ফান্দি। কত করিছে ইমন।
লতার গলার স্বরে কী এক গর্ব স্পষ্ট শোনা যায়। প্রিয় মানুষের জন্য। পরক্ষণেই একরাশ চিন্তা, সেই প্রেমাস্পদের চিরকালীন অমঙ্গলের আশংকা বেজে ওঠে
—ভাবন হয়! না ফিরিয়া আসন যতক্ষুণ
লতার চোখদুটো ম্লান আলো, এই শীতরাত, শুকনো পাতার সরু পথ ছাড়িয়ে, চাঁদ হীন আকাশের তলায় কোথায় যেন হারিয়ে গেছে তখন।
কী অপূর্ব এই পথ চেয়ে বসে থাকা। এই অরণ্য থেকে কতদূরে আমার দেশ গাঁয়ে সেই মাটির দাওয়ায় এমন করেই তো কেউ অপেক্ষা করে তার প্রিয় মানুষের জন্য। আলপনা দেয়। চৌকাঠে সিঁদুর। উনোনে ভাত চাপিয়ে অপেক্ষা করে। ফুলকাটা আসন। ঠাণ্ডা জলের গ্লাস। কী শ্রী কী মায়া এই অপেক্ষার। আমার শহরেও কি কেউ এমন করে অপেক্ষা করে? ছোট ফ্ল্যাটবাড়ির জানলায়,গলির নিভু নিভু আলোর ছায়ায়, অসময়ের ছাতিম গন্ধে?করে কেউ? এগিয়ে দেয় তৃষ্ণার জল? কে জানে!
হঠাৎ খালি গলায় লতা গান ধরে।
হস্তীর নড়ান হস্তীর চড়ান
হস্তীর গলায় দড়ি
হস্তীর নড়ান হস্তীর চড়ান
হস্তীর গলায় দড়ি
....
ও তোমরা গেইলে কি আসিবেন
মোর মাহুত বন্ধুরে!
....
মোর মাহুত বন্ধুরে!
মোর মাহুত বন্ধুরে!
কবেকার পুরনো গান। ওর দেশের গান। ওই গানের ছড়িয়ে দেওয়া সুরের পথেই কি তবে ফিরবে ওর পিরীতের মরদ? পাখা মেলে ঘন রাত, হলুদ ম্লান আলোর বৃত্ত, এই চরাচর ব্যাপী স্তব্ধতা সব ফেলে রেখে ওই সুর ভাসতে থাকে হাওয়ায়। উড়ে যায় দূর নক্ষত্রের দেশে। পৃথিবীর সব ভালোবাসা পার হয়ে কোন দূর গ্রহের অপার্থিব মায়ায় সে বন্দী করে ফেলে আমাদের মতো নশ্বর মানুষ মানুষীদের।
কতদিন যাইনি হলং! তাও হল বছর আটেক। কে জানে কেমন আছে লতা,বুধন পাতাওয়ালারা বউ!
কাল গেলে হয় একবার। বাচ্চুদাকে সঙ্গে নিয়ে!
0 comments: