0

প্রবন্ধ - শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী

Posted in

১৯৭১ সালের বসন্তে বিখ্যাত আন্তর্জাতিক নাট্যপত্রিকা 'দ্য ড্রামা রিভিউ'-য়ের পক্ষ থেকে এ.জে. গুনবর্ধন একটি সাক্ষাৎকার নেন নাট্যব্যক্তিত্ব, তৎকালে স্বমহিমায় বিরাজমান, উৎপল দত্তের। প্রায় পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে আজ হঠাৎ এই সাক্ষাৎকারের উল্লেখ করা এই কারণেই, যে সাধারণ জনমানসে উৎপল দত্ত আমাদের কাছে এক কিংবদন্তী অভিনেতা, যাঁকে ভিলেন হিসেবে বা কৌতুকে দেখে আমরা আনন্দ পেতে অভ্যস্ত বহুকাল। এর বাইরে তিনি একজন ক্ষুরধার নাট্যকার, মঞ্চ অভিনেতা এবং রাজনৈতিকভাবে প্রো-একটিভ একজন শিল্পী। কিন্তু এই সরলীকৃত পরিচয়ের আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকে অনেকসময়ই তাঁর বিশদ বিপ্লবচেতনা, অভিসন্ধি এবং ক্রিয়াকর্মের অভিমুখ। যেমনটা হয়ে থাকে অনেকের ক্ষেত্রেই -- আমরা জানি খোলসটাকে। খোলস যে ভুল এমন নয়, কিন্তু খোলসের কাজই হলো অণু-পরমাণুকে সমগ্রতায় দেখানো। সমগ্রতার আড়ালেই লুকিয়ে থাকে সঠিক পাঠ।

কিছুটা এসব কথা ভেবেই ফিরে যাওয়া সেই সাক্ষাৎকারে, যেখানে উৎপল দত্ত নিজের নাট্যদর্শন, নাট্য-আদর্শের কথা সরাসরি তুলে আনছেন সময় ও সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে। মূলস্রোতের নাট্যব্যক্তিত্বই ছিলেন তিনি; এবং সে কারণেই, আজকের মূলস্রোত-শিল্পের এই আদর্শগত দৈন্যের দিনে প্রয়োজন অনুভব করছি তাঁর কথাগুলিকে আবার স্মরণ করার। তাঁর আদর্শের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ আমরা করতেই পারি; ভিন্নতায় শিল্পই সমৃদ্ধ হয়। কিন্তু মূলস্রোতেও যে দর্শন ও দায় থাকতে পারে, সেটুকু অন্ততঃ আজকের দিনে যদি আবার অনুভব করা যায়, সে-ই বা কম কী! সাক্ষাৎকারটির কিছু বিশেষ প্রশ্ন ও তার বিশ্লেষণ ধরেই নিচের আলোচনাটি এগোবে মূলতঃ চারটি খুঁটির সন্ধানে।

১। Weapon আর Revolution

প্রশ্নের আগে অবশ্য খেয়াল করা যাক সাক্ষাৎকারের শিরোনামটি: "Revolution: Calcutta/ Theatre as a Weapon"। দুটি শব্দ এখানে খেয়াল করার মতো। প্রথমেই, weapon -- অস্ত্র -- এক ধরণের সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে তোলার আভাস। সাক্ষাৎকারে বারবারই উৎপল দত্ত ব্যবহার করছেন একটি নির্দিষ্ট শব্দবন্ধ "cultural front" -- যা কমিউনিস্ট পার্টিরই সাংস্কৃতিক শাখা, প্রয়োজনে পার্টি যাঁদের নিয়োগ করছে আন্দোলনে, বা সংস্কারে। অ-সাংস্কৃতিক আঙ্গিকের অস্ত্রের চেয়ে ভিন্ন এই সাংস্কৃতিক পন্থার অস্ত্র -- থিয়েটার। অনুমেয়, এই ধারণার ভিত্তিতেই weapon শব্দটির একেবারে পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক ব্যবহার থিয়েটারের পাশে। 

Revolution কথাটি সরাসরিই আমাদের নিয়ে যায় উৎপল দত্তের দর্শনে। হয়তো অনেকেরই মনে থাকবে তাঁর লেখা একটি বিখ্যাত বইয়ের কথা, 'Towards a Revolutionary Theatre'। রেভলিউশনারি থিয়েটার বলতে তিনি কী বোঝেন, গুণবর্ধনেরও প্রশ্ন ছিল এটিই। সংক্ষিপ্ত চার-পাঁচ লাইনের উত্তরে উৎপল দত্ত বলেন, এটি মূলতঃ জননাট্য; জনসমাবেশে অভিনয়ের জন্যই এর জন্ম। শুধুমাত্র শহুরে বুদ্ধিবিত্তদের সামনে এই নাটকের অভিনয় অসঙ্গত, কারণ বৈপ্লবিক থিয়েটার যে বদলের কামনা করে, তা শহুরে এই মানুষদের মধ্যে আসবে না, বা তারা এই পরিবর্তনের সক্রিয় অংশও হবেন না। আরও নির্দিষ্ট করে দত্তমশায় বলছেন, মূলতঃ শ্রমিক ও কৃষকদের জন্য এই থিয়েটার। এর কাজ শুধুমাত্র সিস্টেমের গলদ ধরা নয়, তার তীব্র সমালোচনা করাও বটে।

২। রেভলিউশনারি থিয়েটারের বাস্তব উপযোগিতা

স্বাভাবিকভাবেই সংজ্ঞার পাশাপাশি উঠে আসে অবশ্যম্ভাবী আরেক প্রশ্ন। যে থিয়েটার স্টেট মেশিনারির এমন কঠোর সমালোচক হিসেবে জন্ম নেয়, এবং একমাত্র সেই অবস্থাই তার সঠিক গুরুত্ব নির্ণয় করতে পারে, সে থিয়েটার কি স্থান-কাল নির্বিশেষে সবসময়ই একইরকম উপযোগী? উত্তরে উৎপল দত্ত অবশ্য এর কার্যকারিতা বিচারে দুটি 'fixed parameter' নিয়ে আসছেন -- নির্দিষ্ট দেশ, এবং নির্দিষ্ট সময়বৃত্ত। ১৯৭০-এর ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বুকে রেভলিউশনারি থিয়েটারের ভূমিকা একরকম। তার মূল লক্ষ্য তৎকালীন সেট-আপকে প্রশ্ন করা এবং ভেঙে দেওয়া। কিন্তু উৎপল দত্ত এ বিষয়ে সচেতন, যে বিপ্লব-পরবর্তী অধ্যায়ে এর ভূমিকা সম্পূর্ণ বদলে যাবে, এবং তাই-ই কাম্য।

সাক্ষাৎকার থেকে বেরিয়ে এসে একটা ছোট অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমরা যে সময়ে বসবাস করছি, পূর্ণাঙ্গ রাজনীতি ও ছাত্র রাজনীতি, উভয়েই বেশ দোলাচল খেয়াল করা যায়। বিপ্লব প্রায় সকলেই চাইছেন; সে নিয়ে সভা, মিছিল, ভাষণ হয়েই চলেছে, এবং সঙ্গে থাকছে যুগ-যুগান্তরের স্লোগান: "বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক! লং লিভ রেভলিউশন!" এই স্লোগানটি শুনলে আমার ভারী মজা লাগে। বিপ্লবীরা নিজেদের, সাথীদের উদ্বুদ্ধ করার খাতিরে বলেন বটে এসব, কিন্তু এটা কি কখনও তারা ভেবে দেখেছেন, বিপ্লবই আসলে সবচেয়ে ক্ষীণজীবী/ ক্ষণস্থায়ী? ব্যর্থ বিপ্লবের ব্যাটন তবু কালানুক্রমে পরবর্তী বিপ্লবীদের হাতে তুলে দেওয়া যায় সাফল্যের আশায়। কিন্তু বিপ্লব সফল হলে তখন তা সবচেয়ে কষ্টের! কারণ, বিপ্লব এসে গেলে তার পর কী, এই প্রশ্নে বিশেষ কেউ যায় না। বিপ্লবের আশু লক্ষ্য এবং তৎসম্বন্ধীয় স্বপ্ন এমনই মোহময়, যে বিপ্লবের দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল বা উদ্দেশ্য অব্দি আর বড় একটা যাওয়া হয়ে ওঠে না। কিন্তু বিপ্লব যে পরিবর্তন আনে, তার ফলে সমাজে, সময়ে যে বদল আসে, বিপ্লবের পরবর্তী পদক্ষেপগুলি তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেদের বদলে নিতে পারে না বলেই রেভলিউশন "লং লিভ" আর হয় না কখনই। একেবারে সেই ফরাসী বিপ্লব থেকে শুরু করে হাল আমলের সামাজিক রদবদল -- সবই এই একই সত্যের আশেপাশে ঘোরাফেরা করে। অতএব, শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক জগতে নয়, ঘোর রাজনীতিতেও উৎপল দত্তের এই সচেতনতা অনুসরণীয়।

৩। প্রগতিশীলতা বৈপ্লবিক নয়

সাক্ষাৎকারে আলোচনা এগোতে এগোতে উঠে আসে উৎপল দত্তের বহুচর্চিত নাটক 'অঙ্গার'-এর কথা। দত্তমশায় এই নাটকটিকে সমালোচনার দৃষ্টিতেই দেখেছেন বেশিরভাগ সময়ে। সে প্রশ্ন উঠতে নিজেই বলেন তাঁর অসন্তোষের কারণ: অঙ্গার একটা সিস্টেমের বর্বরতাকে এক্সপোজ করেছিল, কিন্তু সেই সিস্টেমকে প্রতিহত করার পথ দেখায় নি। পাঠকেরা খেয়াল করুন, উৎপল দত্তের রেভলিউশনারি থিয়েটারের সংজ্ঞা অনুযায়ী 'অঙ্গার' কেবলমাত্র প্রথম ধাপেই সীমিত থাকছে -- দোষ নির্ণয় করা। তার চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে শোধন বা প্রতিহত করার পন্থা সে নিচ্ছে না। এই আদর্শগত স্থান থেকে 'অঙ্গার' তাঁর কাছে হয়ে উঠছে বড়জোর একটি "প্রগতিশীল" নাটক। 'প্রগতিশীল' শব্দটির মর্ম বোঝাতে দত্তমশায় তিনটি বিশেষণ ব্যবহার করছেন -- "damaging", "derogatory", এবং "abusive" -- ক্ষতিকর, মর্যাদাহানিকর, এবং অবমাননাকর। প্রগতিশীলদের দ্বিচারিতা তুলে ধরছেন উৎপল দত্ত তাঁর বিশ্লেষণে -- যারা কখনও বিপ্লবের কথা সক্রিয়ভাবে বলে না, কেবলমাত্র দূর থেকে, গা বাঁচিয়ে বিপ্লবের প্রতি সহানুভূতি জানায়। মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদেরই চিহ্নিত করছেন তিনি প্রগতিশীল হিসাবে, যারা বিপ্লবের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা "struggle"-কে কাব্যমধুর করে তোলেন, কিন্তু বিপ্লবের মূল সুরে সুরে মেলান না। ফলতঃ, সাধারণ জনমানসে প্রগতিশীলতা এবং বিপ্লব -- উভয় সম্বন্ধেই যে একধরনের সমভাব দেখা যায়, তার বিরুদ্ধে এই অবস্থানটি উল্লেখযোগ্য।

৪। পথনাটিকা

শেষ এই বিষয়টিই আলোচ্য। যাকে আমরা অন্য নামে চিনি street theatre বা streetcorner plays বলে, সেই পথনাটিকার ঘরেও উৎপল দত্ত আসেন একেবারে নির্দিষ্ট কিছু এজেন্ডা নিয়েই। মঞ্চনাটকের খ্যাতি ও আড়ম্বরের সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে অবস্থিত পথনাটিকার মূল লক্ষ্য সাধারণ মানুষের কাছে সহজে পৌঁছনো। বাদল সরকার তাঁর তৃতীয় থিয়েটারের আলোচনায় বলেছিলেন, থিয়েটারের হওয়া portable (সহজে যে কোনো স্থানে বহন করে নিয়ে যাওয়া যাবে সেই থিয়েটার), flexible (প্রয়োজন অনুসারে যে-কোনো স্পেসে বা ফর্মে সে সহজেই ভেঙেচুরে গড়ে তুলতে পারে নিজেকে), এবং inexpensive (সহজলভ্য)। প্রায় এই একই মাপকাঠিতে পথনাটিকাকে বিচার করেন উৎপল দত্তও। মঞ্চের বাইরে, জনবহুল বাজারে, বা কোনো রাস্তার মোড়ে গড়ে ওঠে এই নাটক, সেট ছাড়া, লাইট ছাড়া, কম সংখ্যক অভিনেতা নিয়ে। এর উদ্দেশ্য আদ্যন্তই রাজনৈতিক। যেখানে অভিনীত হচ্ছে, সেখানকার সামাজিক কোনো বিষয় নিয়েই মুখে মুখে বেশিরভাগ সময় তৈরি হয় এই নাটকের তাৎক্ষণিক সংলাপ। বদলে যায় এক অভিনয় থেকে অন্য অভিনয়ে।

১৯৫০-এর দশকে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির হাত ধরেই শুরু হয় পথনাটিকার প্রচলন, রাজনৈতিক বক্তব্যকে সাংস্কৃতিক একটি রূপ দেওয়ার তাগিদে। পার্টির সাংস্কৃতিক শাখা বলে উৎপল দত্ত যে সংগঠনকে চিহ্নিত করেছেন বাড়বে তাঁর নিজের লেখায়, সেই সংগঠনের সূত্রপাত কিছুটা পথনাটিকার কারণেই। অত্যন্ত জরুরি সময়েই ডাক পড়তো এই সংগঠনের, বিকল্প ভাষ্যের সন্ধানে; যেভাবে উৎপল দত্তের লেখা 'চার্জশীট' নাটকটি অভিনয়ের প্রচার করে সেই সমাবেশে নাটক শুরুর আগে, এবং নাটকের মধ্য দিয়ে পার্টি প্রয়োজনীয় বক্তব্য রেখেছে সাধারণের কাছে।

পরিশেষে, যে চারটি খুঁটির সন্ধান পাওয়া গেল এই সাক্ষাৎকারের সীমিত পরিসরে, সেগুলির প্রয়োজনীয়তা কী আজকের দিনে? না, রাজনৈতিক আদর্শ, অবস্থান, কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন উদ্দেশ্য -- এ কোনোটিই আমার আলোচ্য বিষয় নয় এখানে। আমি নিজে শুধু খুঁজে চলেছি এমন একজন বা কিছু শিল্পীকে আমার আজকের দিনে, যাঁদের শিল্পের সঙ্গে তাঁদের বাস্তব অবস্থান এবং সেই অবস্থানকে উল্লেখ করা বা পরিবর্তনের দায় জড়িয়ে আছে। বলতে গেলে, শুরুর সেই হতাশার কথাই আবার বলতে হয়। আধুনিক শিল্পের মূলস্রোতে আদর্শ, অবস্থান, দায়বদ্ধতা বড় সেকেলে, কাগুজে কথা মনে হয়। উচ্চারণে এবং সৃজনে কোথায় একটা ফারাক রয়ে যায়, বুঝি। বিকল্প ভাষ্যের শিল্পীরা মূলস্রোতের থেকে আলাদা হয়েও যে চর্চা করছেন, তা কিছুটা অনবধানে, কিছুটা কর্তৃত্বাভিমানে আড়াল হয়ে যাচ্ছে। শিল্পের দায় শুধুমাত্র বিনোদন নয়, বা অনান্দনিক, কুশ্রী বিরুদ্ধতাও নয়। শিল্প দায়বদ্ধ এক মধ্যপথের প্রতি, যে পথে অন্তর্দৃষ্টি আছে, শিল্প এবং শিল্পী কার্যকারণে যুক্ত যেখানে। সেটুকু নিজে বুঝতে, এবং সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতেই এই প্রসঙ্গের উত্থাপন, এই সাক্ষাৎকার, এবং উৎপল দত্তের মতো এমন এক সক্রিয় রাজনৈতিক শিল্পীর মধ্য দিয়ে শৈল্পিক চেতনা ও তার প্রতি সৎ থাকার ঐকান্তিক চেষ্টাকে ফিরে দেখা।

0 comments: