প্রবন্ধ - মলয় রায়চৌধুরী
Posted in প্রবন্ধ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর, আয়ওয়া পোয়েট্রি ওয়র্কশপ থেকে সদ্য ঘুরে-আসা, ইউরোপীয় সাহিত্যের নিবিষ্ট পাঠক, ‘জনসেবক’ সংবাদপত্রের সাহিত্য বিভাগের প্রাক্তন সম্পাদক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর প্রথম উপন্যাসের নাম “আত্মপ্রকাশ” কেন রেখেছিলেন, তা এক রহস্য হয়ে থেকে গেছে সুনীলের বন্ধুর ভাই ও ‘আত্মপ্রকাশ’-এর নগণ্য চরিত্র পরিতোষের কাছে। যখন উপন্যাসটি ‘দেশ’ পত্রিকার জন্য লেখেন, তখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বয়স ছিল একত্রিশ বছর। বই হিসাবে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৬ সালে, আমার সামনে রয়েছে বইটির ষষ্ঠদশ মুদ্রণ, ২০১৭ সালে প্রকাশিত। অর্থাৎ বইটি বেশ জনপ্রিয়।
‘আত্মপ্রকাশ’ নাম হলেও, উপন্যাসটি কিন্তু ‘কিউনৎসেলরোমান’ নয়, যে অর্থে পঁচিশ বছর বয়সে লেখা জেমস জয়েসের উপন্যাস ‘পোরট্রেট অফ দি আর্টিস্ট অ্যাজ এ ইয়াং ম্যান’, পঁচিশ বছর বয়সে লেখা টমাস মানের ‘টোনিও ক্রোগার’, পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে লেখা রাইনের মারিয়া রিলকের ‘দি নোটবুকস’, আটত্রিশ বছর বয়সে লেখা স্যামুয়েল বাটলারের ‘দি ওয়ে অফ অল ফ্লেশ’ কিংবা ছেচল্লিশ বছর বয়সে লেখা গ্যেটের ‘উইলহেল্ম মিয়েস্টার্স অ্যাপ্রেন্টিসশিপ’, যে বইগুলোর বিষয়বস্তু একজন লেখক বা কবির আত্মপ্রকাশ সংক্রান্ত, অর্থাৎ বইগুলো কিউনৎসেলরোমান সাব-জনারের (মূল জনার বিলডুংসরোমান) অন্তর্গত। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এই বইগুলোর সঙ্গে পরিচিত ছিলেন বলেই মনে করে পরিতোষ।
আত্মপ্রকাশ উপন্যাসের ভাষাবিন্যাস ও কাঠামো সম্পর্কে ভেবেছে পরিতোষ; তার মনে পড়েছে যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাস লিখেছিলেন ছাব্বিশ বছর বয়সে, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পথের পাঁচালি’ পাঁচ বছর সময় নিয়ে লিখেছিলেন, কিন্তু আরম্ভ করেছিলেন উনত্রিশ বছর বয়সে। ভাষার কাজ যে অত্যন্ত জরুরি এবং বাংলা সাহিত্যকে উচ্চতর মানে নিয়ে যেতে হবে, তা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই উপন্যাসগুলো থেকে স্পষ্ট। ‘আত্মপ্রকাশ’ লেখার সময়ে এই উপন্যাসগুলোর ভাষা-নির্মাণ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মরণে ছিল না, তা বিশ্বাস করে না পরিতোষ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস ‘কুয়োতলা’র পাণ্ডুলিপি পড়েছিল পরিতোষ, পাণ্ডুলিপিতে মাঝে-মাঝে জায়গা ছাড়া ছিল এবং সে-বিষয়ে প্রশ্ন করলে শক্তি চট্টোপাধ্যায় পরিতোষকে বলেছিলেন, ‘এখানে ভাষার খেলা দেখাবো’। তিনি ‘কুয়োতলা’ লিখছিলেন ১৯৫৬-১৯৫৭ সালে, যখন তাঁর বয়স তেইশ বছর, উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬১ সালে। নিজের কবিতাকে তিনি যেমন ‘পদ্য’ বলতেন, তেমনই উপন্যাসকে বলতেন গদ্য। ‘কুয়োতলা’ তাঁর আত্মজীবনী, এবং এই বই থেকে পরের পর একাধিক উপন্যাসে নিরুপম অর্থাৎ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের আত্মপ্রকাশের সঙ্গে আমরা পরিচিত হই। ‘কুয়োতলা’ উপন্যাসের গদ্যবিন্যাসই কেবল নয়, বিভিন্ন চরিত্রচিত্রণ, ও উপন্যাসের কাঠামোয় প্রতিফলিত হয় তাঁর সাহিত্যনির্মাণের জন্য পরিশ্রম, একাগ্রতা ও সততা। পরিতোষ জানে যে, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘কুয়োতলা’ উপন্যাসের ভাষানির্মাণের পরিশ্রমের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আরেক বন্ধু সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, যাঁর সঙ্গে পরিতোষের ভালো পরিচয় ছিল, ১৯৬১ সালে আঠাশ বছর বয়সে ‘ক্রীতদাস ক্রীতদাসী’ গল্প লিখে সাড়া ফ্যালেন, প্রধানত তাঁর লিখনভাষার কারণে। তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি একটি নিজস্ব ভাষাশৈলী আয়ত্ব করেছিলেন এবং তা আজও অননুকরণীয় হয়ে আছে; নিজস্ব গদ্যবিন্যাস নির্মাণের জন্য প্রায় তিন বছর অবিরাম পরিশ্রম করেছিলেন তিনি। তাঁর নাম না থাকলেও বোঝা যায় রচনাটি সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের।
কয়েকজন বিদেশি ঔপন্যাসিকের প্রথম বই পড়ে মুগ্ধ হয়েছিল পরিতোষ, যেমন গুন্টার গ্রাসের ‘দি টিন ড্রাম, মার্গারেট মিচেলের ‘গন উইথ দি উইণ্ড’, চার্লস ডিকেন্সের ‘দি পিকউইক পেপার্স’, জেন অস্টেনের ‘সেন্স অ্যাণ্ড সেনসিবিলিটি’, এই জি ওয়েল্সের ‘দি টাইম মেশিন’, জে ডি স্যালিঞ্জারের ‘দি ক্যাচার ইন দি রাই’, কুর্ট ভনেগাটের ‘প্লেয়ার পিয়ানো’, সিলভিয়া প্লাথের ‘দি বেল জার, উমের্তো একোর ‘দি নেম অফ রোজ’, খালেদ হুসেইনির ‘দি কাইট রানার’, জোসেফ হেলারের ‘ক্যাচ-২২’ ইত্যাদি। তাই পরিতোষ, যে কিনা তার দাদার বন্ধু সুনীল গাঙ্গুলির সঙ্গে স্কুলে পড়ার সময় থেকেই পরিচিত ছিল, আশা করেছিল যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস নিশ্চয়ই ওই পর্যায়ের হবে। হয়নি বলে খারাপ লেগেছিল পরিতোষের।
আমেরিকার আয়ওয়া পোয়েট্রি ওয়র্কশপের জন্য সেখানে থাকাকালীন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একটি চিঠিতে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে লিখেছিলেন, “গদ্য লিখে আপনাকে খুশি করতে পারব এমন দুরাশা আমার নেই। সত্যি নেই। কারণ, আপনি গ্রেট গদ্য লিখেছেন একসময়, এখন আর তেমন না। কিন্তু যা লিখেছেন, তার ধারে-কাছে আর কেউ পৌঁছোতে পারেনি। আমি ওরকম গদ্য লিখতে পারি না। লিখব না। কিন্তু ওই গদ্যই আমার প্রিয় পাঠ্য। আপনি পড়বেন, এই ভয়ে আমি সহজে গদ্য লিখতে চাই না। তবু কখনও লিখি, হয়তো টাকার জন্য, টাকার জন্য ছাড়া কখনও গদ্য লিখেছি বলে মনে পড়ে না, লিখেছিলুম একটা উপন্যাস, সেটা ছাপার সম্ভাবনা নেই।” ওই চিঠিতে তিনি সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে আরও লিখেছিলেন, “লেখক হিসেবে, ‘প্রতিভাবান’ এই শব্দটা যদি ব্যবহার করতে হয় -- তবে আমাদের পুরো জেনারেশনে তন্ময় দত্ত ছাড়া -- শুধু আপনার সম্বন্ধেই আমি ও কথা ভাবি।”
পরিতোষের মনে হয়েছে, এ কেমনধারা যুক্তি, টাকার জন্য যেমন-তেমন একটা উপন্যাস খাড়া করার চেষ্টা! টাকার অভাব শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের আরও বেশি ছিল, তিনি উল্টোডাঙার একটা বস্তিতে থাকতেন, কিন্তু নিজের কবিতা ও উপন্যাসের প্রতি তাঁর ভালাবাসাবোধকে টাকার ক্ষয়রোগ থেকে দূরে রেখেছেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যদি টাকার জন্য ‘আত্মপ্রকাশ’ লিখেও থাকেন, তিনি কিছুটা সময় সাগরময় ঘোষের কাছে চেয়ে নিতে পারতেন যাতে উপন্যাসটি সত্যিই তাঁর ‘আত্মপ্রকাশ’ হয়ে ওঠে; টাকার প্রয়োজনের কথা সাগরময় ঘোষকে বললে তিনি উপন্যাসের জন্য অগ্রিমের ব্যবস্থা করে দিতেন বলেই মনে হয় ।
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে লেখা উপরোক্ত চিঠিতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিজের ও সন্দীপনের সাহিত্যিক লোভ সম্পর্কে এই কথাগুলো লিখেছিলেন, “আমি জানতুম, আপনি লোভী নন। আপনার সঙ্গে বহুদিন বিছানায় শুয়েছি, পাশাপাশি রোদ্দুরে হাঁটার সময় একই ছায়ায় দাঁড়িয়েছি। সেই জন্য আমি জানতুম। আমি আমার লোভের কথা জানতুম। সেই জন্যেই বুঝেছিলুম, আপনার লোভ আমার চেয়ে বেশি নয়।” দেশ পত্রিকার পাতায় তাঁর উপন্যাস প্রকাশের লোভে তিনি যে আক্রান্ত হয়েছিলেন, এই বিষয়ে সুনীল গাঙ্গুলির বন্ধুর ছোটো ভাই পরিতোষের কোনো সন্দেহ নেই।
পরিতোষ জানে যে সাগরময় ঘোষের প্রস্তাবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লোভ জেগে ওঠে, আর তিনি বেশ তাড়াতাড়ি একটা উপন্যাস নামিয়ে ফ্যালেন। তাড়াতাড়ি উপন্যাস নামিয়ে ফেলার এই কর্মপ্রক্রিয়ায় তিনি সারাজীবনের জন্য নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন, যে-কারণে তাঁর সঙ্গে বহুপ্রসু ঔপন্যাসিক হুমায়ুন আহমেদের তুলনা করা হয়, গদ্যশিল্পী ঔপন্যাসিক আখতারুজ্জমান ইলিয়াসের তুলনা করা হয় না। এখানে ‘নির্বাস’ উপন্যাসের শুরুতে অমিয়ভূষণ মজুমদার যে মতামতটা প্রসঙ্গক্রমে দিয়েছেন তা উল্লেখ্য; তিনি লিখেছেন, “চেতনায় অন্য কারো জীবনের ছায়া যদি মুহূর্তের জন্যও পড়ে তবে সে বাইরের বিষয় থেকে নিষ্কৃতি পাবার একমাত্র উপায়ই হচ্ছে ছায়াটাকে বিশ্লেষণ করে দেখা, তা নিয়ে আলোচনা করা, অন্য কথায় গল্পটা বলে ফেলা।” ‘আত্মপ্রকাশ’ উপন্যাসে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় গল্পটা বলে ফেলার বদলে ‘বয় মিটস গার্ল’ ধরণের এনটারটেনার ও জ্যাক কেরুয়াকের ‘অন দি রোড’ উপন্যাসে বন্ধুবান্ধবদের উচ্ছৃঙ্খল জীবন কাটানো নিয়ে লেখার দোটানায় ভুগেছেন; ছায়াগুলো বিশ্লেষণের প্রয়াস করেননি। ফলে তা মিলস বুনও যেমন হয়নি, তেমন কেরুয়াকও হয়নি।
উল্লখ্য যে আমেরিকায় থাকাকালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পরিতোষকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “বালজাকের মতো আমি আমার ভোকাবুলারি তৈরি করে নিয়েছি কবিতা ও গদ্যে।” ‘আত্মপ্রকাশ’ পাঠান্তে পরিতোষের সন্দেহ জেগেছে যে তিনি অমন ভোকাবুলারি তৈরি করে প্রয়োগ করার কথা সত্যিই তাঁর প্রথম উপন্যাসটি রচনার সময়ে মনে রেখেছিলেন কিনা। বালজাক চেয়ারে বসে লিখতেন না, দাঁড়িয়ে একটি উঁচু ডেস্কে লিখতেন এবং ঘরে পায়চারি করার সময়ে আলমারিতে রাখা বই ঘাঁটতে তাঁর অসুবিধা হতো না, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতন তাঁরও মুখ গোল এবং চেহারা ছিল গোলগাল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একের পর এক রচনা লিখে গেছেন বসে থাকা অবস্হায়। লাগাতার বসে থাকলে প্রস্টেট এবং প্রস্টেটের ক্যানসারের সম্ভাবনা দেখা দেয়। যাঁরা বসে লেখেন, তাঁরা তাই উঠে একটু পায়চারি করে নেন মাঝে-মধ্যে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তা করতেন না বলেই মনে হয়।
অনরে দ্য বালজাককে বাস্তববাদী সাহিত্যের জনক বলে মনে করা হয়। একশোটি উপন্যাসে, নেপোলিয়ানের পতনের পর জনগণের বাস্তব জীবনযাত্রা ধরে রেখেছেন বালজাক। তিনিও টাকা রোজগারের জন্য সতেরো-আঠারো ঘণ্টা লিখতেন। এই দিক থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে বালজাকের মিল আছে; সুনীলও শতাধিক উপন্যাস লিখেছেন। ক্রমশ উচ্চবর্গ সমাজের অন্তর্গত হবার দরুন সুনীল পরবর্তীকালের উপন্যাসে সেই সমাজের চরিত্রদের আনার প্রয়াস করেছেন। বালজাকের মতনই তাঁরও মনে হয়ে থাকবে অমরত্বের জন্য তাঁর পাঠবস্তুগুলো ধারে না কাটলেও ভারে তো কাটবে।
‘আত্মপ্রকাশ’ উপন্যাসে প্রধান চরিত্রের নাম সুনীল গাঙ্গুলি, কিন্তু উপন্যাসের সুনীল গাঙ্গুলির বন্ধুরা সকলেই ফিকটিশাস বন্ধু (শেখর, তাপস, অবিনাশ, পরীক্ষীৎ, সুবিমল, অরুণ, নুরুল প্রমুখ। একমাত্র পরিতোষ চরিত্রটি বাস্তব, তাই শুরুতেই চরিত্রটিকে আক্রমণ করেছেন), তাঁর ফিকশান রচনার জন্য গড়ে নেয়া বন্ধু, চরিত্রচিত্রণের জন্য তাদের সম্পর্কে বিশেষ চিন্তা করেননি লেখক, তারা কেউই শক্তি, সন্দীপন, সমীর, শরৎ, তারাপদ, শংকর, দীপক, উৎপল, পার্বতী মুখার্জি নয়।
লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘আত্মপ্রকাশ’ লেখার পর নিজের বন্ধুদের নিয়ে আসেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রী’ উপন্যাসে, কেননা ততোদিনে তিনি টের পেয়ে গিয়েছিলেন যে ফিকটিশাস বন্ধুদের কাউকেই তিনি ‘আত্মপ্রকাশ’ উপন্যাসে দাঁড় করাতে পারেননি, তারা সকলেই ভাসা-ভাসা। বস্তুত ‘অরণ্যের দিনরাত্রী’ উপন্যাসই তাঁর সত্যকার ‘আত্মআবিষ্কার’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে কথাবার্তায় গালমন্দ প্রয়োগ করতেন না, কিন্তু তাঁর বন্ধুরা, বিশেষ করে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় বাঞ্চোৎ ও বাইনচোৎ শব্দটি প্রয়োগ করতেন, দীপক মজুমদারও কথাবার্তায় গালমন্দ প্রয়োগ করতেন, অথচ ‘আত্মপ্রকাশ’ আর ‘অরণ্যের দিনরাত্রী’ উপন্যাসগুলোয় বন্ধুরা তা নিজেদের মধ্যে প্রয়োগ করেন না; করলে অবশ্য ব্রাহ্মবাড়ির মানুষ সত্যজিৎ রায় উপন্যাসটি নিয়ে ফিল্ম করতেন না। অগোছালো জীবনযাত্রার চিত্রণ করলেও, চরিত্রগুলো মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ-কাঠামো ভেঙে বেরোতে পারেনি। ‘অরণ্যের দিনরাত্রী’ উপন্যাসে দেখা যায়, যে চরিত্রটি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আদলে তৈরি, সে যুবতীদের সামনে খালি গায়ে স্নান করতে লজ্জা পায়, অথচ ‘আত্মপ্রকাশ’ উপন্যাসে সে বেশ্যালয়ে যেতো!
তাঁর জীবনী ‘অর্ধেক জীবন’ গ্রন্থে ‘আত্মপ্রকাশ’ সম্পর্কে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, “সাবলীল ও যথেচ্ছভাবে অনেকখানি লেখার পর হঠাৎ আমার মনে হল, এ যা লিখে যাচ্ছি, গল্পের মাথামুণ্ডু নেই, এ কী সত্যি পাঠযোগ্য? নাকি নিতান্তই ভাবালুতা? অথবা সৈয়দ মুজতবা আলির ভাষায় গর্ভস্রাব?” তিনি আরও লিখেছেন, “দেশ শারদীয় সংখ্যা প্রকাশের সময়ে আমি লজ্জায় ও আতঙ্কে কিছুদিন লুকিয়েছিলুম কলকাতার বাইরে। উপন্যাসটার জন্য নিন্দা ও প্রশংসা দুইই জুটেছিল। তবে, নিন্দা, বিরূপ সমালোচনা, এবং কটুক্তিই বেশি। পাঠক যদি বলেন এসব এলোমেলো গদ্যপ্রবাহের কী মানে হয়।”
‘আত্মপ্রকাশ’ লেখার সময়ে তিনি যে সিরিয়াস ছিলেন না, তা ‘অর্ধেক জীবন’ বইয়ের এই কথাগুলো থেকে স্পষ্ট হয়, “জোর করে ঢুকিয়ে দিলুম একটা উপকাহিনি। পূর্ববঙ্গের এক অভিনেত্রীর ঘটনাটি অন্যের মুখে শোনা, আমার নিজের অভিজ্ঞতার নির্যাস নয় বলেই বেশ কৃত্রিম, এবং আত্মপ্রকাশ উপন্যাসের সেই অংশটিই সবচেয়ে দুর্বল।” প্রশ্ন হল, একত্রিশ বছর বয়সে তো তাঁর প্রচুর অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছিল, কলকাতার বন্ধুবান্ধবদের কেন্দ্র করেই কতো ঘটনার সঙ্গে তিনি জড়িয়েছিলেন, আমেরিকার কয়েকটি শহর, লণ্ডন ও ফ্রান্স ঘুরেছিলেন, এক বিদেশিনীর সঙ্গে প্রণয়সম্পর্ক গড়েছিলেন, অথচ উপন্যাস লেখার সময়ে লাফিয়ে-লাফিয়ে সুনীল গাঙ্গুলি নামের চরিত্রটিকে শেখর, তাপস, অবিনাশ, পরীক্ষীৎ, সুবিমল, অরুণ, নুরুল প্রমুখ চরিত্রদের সঙ্গে ঘটনাহীন সংলাপে জুড়তে-জুড়তে উপন্যাসটিকে তাড়াতাড়ি এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রয়াস করলেন।
উত্তম পুরুষে লেখা উপন্যাসটির লেখক, ‘অর্ধেক জীবন’ পড়ে স্পষ্ট হয়, নিজেই সন্দেহে ভুগছিলেন যখন, তখন সন্দেহ নিরসনের পর ঠাণ্ডা মাথায় বইটা লেখা উচিত ছিল না কি? ‘অর্ধেক জীবন’-এ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, “সুনীল নাম দিয়ে আমি বোঝাতে চেয়েছি যে এটা আমার জীবনের ঘটনা। কিন্তু আত্মজীবনী নয়।” জীবনের ঘটনায় দেশভাগে চার বছরের বাচ্চা তার বাবা-মা দিদির সঙ্গে বহরমপুরে চলে আসে, যুবাবস্থায় বাবার সঙ্গে মনোমালিন্যে ‘রিফিউজি ছোঁড়া’ কলকাতায় চলে যায়।
এই ‘রিফিউজি ছোঁড়া’ নিজে বা তাঁর বাড়ির কেউই, অথবা বহরমপুরের রিফিউজি পরিবারের যুবতীটি, তাঁরা কেউই পূর্ববঙ্গের বুলিতে কথা বলে না; পূর্ববঙ্গের বুলি সর্বত্র এক নয়। সুনীল গাঙ্গুলি নামের ‘রিফিউজি ছোঁড়া’ আর তার পরিবার বিমূর্ত রয়ে গেল, পূর্ব পাকিস্তানের কোন গ্রাম বা শহর থেকে তারা এসেছিল তা টের পাওয়া গেল না। ‘আত্মপ্রকাশ’ লেখার সময়ে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে উত্তর কলকাতা নিবাসী লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আত্মিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন, এবং একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন কলকাতা মেট্রপলিসের কৈশোর-যৌবনের জীবনযাপনের সঙ্গে। সম্ভবত ‘রিফিউজি ছোঁড়া’ ভাবকল্পটি ব্যবহৃত হয়েছে গর্ববোধের উৎস হিসাবে, কেননা যে-সময়ে তিনি ‘আত্মপ্রকাশ’ লিখেছিলেন সেই সময়ে গরিব-হওয়া-ভালো, উদ্বাস্তু-হওয়া-ভালো, সর্বহারা-হওয়া-ভালো ইত্যাদি প্রয়োগ করা হচ্ছিল কলকাতা কসমোপলিসের বিপরীতে নবতম মূল্যবোধরূপে খাড়া করার জন্য। সুনীল গাঙ্গুলি নামের চরিত্রটিতে দেশভাগের ট্রমা কেন ছাপ ফেলেনি সে প্রশ্ন ওঠে।
উপন্যাসটিতে লেখক নিজেকে এবং বন্ধুদের উপস্হাপন করতে চেয়েছেন ছন্নছাড়া জীবন, খেদ, যৌনতা, বেশ্যাগমন, হতাশা, সামাজিক সীমালঙ্ঘন, টাকাকড়ির অভাব এবং তা সত্বেও জুয়াখেলার প্রতি আসক্তি, ব্যর্থ প্রেমের ঘেরাটোপে আবদ্ধ জীবনের আঙ্গিকহীন কাহিনির মাধ্যমে। কিন্তু আগে থাকতে ভেবে লিখতে নামেননি বলে কাহিনি বা প্লট গড়ে ওঠেনি। ব্যাস, মধ্যবিত্ত যুবকের উদ্দেশ্যহীন দিনযাপন ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস করা হয়েছে। উপন্যাসের তিনটি নারী চরিত্র হলো যমুনা, সরস্বতী এবং মনীষা, যাদের ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস করেননি লেখক; তিনি যেভাবে উপস্হাপন করেছেন, যমুনা হলো দেবী, মনীষা ছলনাময়ী, সরস্বতীর চরিত্র ঘোলাটে। বস্তুত দেবী ব্যাপারটি যে ঠিক কী, তা ১৯৬৬ সালেও ব্যাখ্যা যোগ্য ছিল না, আর এখন তো হাস্যকর; কোনো তরুণীকে ছলনাময়ীর তকমা দেয়াটা বিশ শতকে আরও গোলমেলে নয় কি?
সবশেষে বেশ্যা বীণার বোন নুরজাহান বেগমের উপকাহিনি ঢুকিয়ে দিলেন ফিল আপ দি ব্ল্যাংক করার জন্য, যার কোনো আগাপেছু নেই, অথচ তাকে দিয়েই ‘আত্মপ্রকাশ’ উপন্যাস আচমকা শেষ হয়েছে। বীণার ঘরের বর্ণনা পড়লে মনে হয়ে লেখক একটি বাঙালি বেশ্যার ঘর খুঁটিয়ে দেখেননি, যা আমরা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের বর্ণনায় পাই।
পরিতোষের ধারণা, সাধারণ পাঠক-পাঠিকাদের সমাদর পেয়েছে ‘আত্মপ্রকাশ’, নয়তো পঞ্চাশ বছর যাবত বার-বার মুদ্রণ হতো না।
0 comments: