0

অন্তরমহল - রুমঝুম ভট্টাচার্য

Posted in


মহামারীর রূপকথা 

সেই কোন ছোট্টবেলায় মায়ের কোল ঘেঁষে শুয়ে শুনতাম হরেক রূপকথার গল্প। সে আজ চল্লিশ বছর আগের কথা। মনে পড়ে সে সময়টা ছিল আজকের সময়ের থেকে অনেকটা অন্যরকম। বিশেষতঃ আমার ছোটবেলা কেটেছে নেহাতই এক ছোট জনপদে। সেখানে অন্ধকার নামলে লক্ষী পেঁচার ডাক রাতের নিস্তব্ধতা চিরে খানখান করে দিত। শেয়ালের সমবেত তান শুরু হয়ে যেত। তখনকার রাতও যেন ছিল অনেক বেশি গাঢ কালো। যেদিন চাঁদ উঠত সেদিন জোছনায় ভেসে যেত আমাদের বাড়ির ছাদ, বারান্দা সমস্ত চরাচর। মানে আমার শিশু মনে যতটা পরিসর জুড়ে সেই চরাচরের কল্পনা সম্ভব ছিল সেই সবটুকু। এমন সব রাতে আমি মায়ের কাছ ঘেঁষে শুয়ে মায়ের গায়ের সুঘ্রাণ নিতে নিতে শুনতে থাকতাম রূপকথার গল্প। সে সব রূপকথায় অবধারিতভাবে থাকত রাজকুমার রাজকুমারী, অনেক ভূত-পেত্নী দত্যি-দানো। দুয়ো রানির দুঃখে কচি মন উঠত কেঁপে। কিন্তু জঙ্গলে নির্বাসিত রানির দিন কিভাবে কাটত সে কথা বোঝার আগেই ঘুমের রাজ্যে চলে যেতাম হয়তো। আপনারা বলবেন মানব সভ্যতার এই দারুণ সংকটের সময় হঠাত করে ঠাকুরমার ঝুলি খুলে বসলাম কেন? কারণ আমরা সবাই যে এখন দুয়ো রানির মতো স্বাভাবিক সামাজিক জীবন থেকে নির্বাসিত। সে জীবন ঘিরে আছে অনিশ্চয়তা, আছে ভয়, আছে উদবেগ। বিষন্নতা গ্রাস করছে অনেককেই। অতিমারীর দানব তছনছ করে দিয়েছে সভ্যতার স্বাভাবিক ছন্দ। সবার মনে একটাই আকুতি কবে সব ঠিক হয়ে যাবে? আতঙ্কের একটা পরিমণ্ডল তৈরি হয়েছে আমাদের চারপাশে। এই করোনাতঙ্ক নামের দৈত্যের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাবার জন্য মনের মধ্যে চাই, মনের মতো এক পক্ষীরাজ ঘোড়া চেপে আসা রাজার কুমার। বীর পুরুষের মতো লড়বে সে। আজ্ঞে না মহামারীর এই রুপকথা মোটেও কাল্পনিক নয়। ঠাকুরমা কিংবা ঠাকুর্দার ঝুলির রূপকথা নয় মোটেও। 

দেখা গেছে ভীষণ কোনও সংকটে, বিশেষতঃ এমন অতিমারীর সংকটে শয়ে শয়ে মানুষের আচরণ বেশ বদলে যায়। মানুষের মধ্যে যুক্তির অভাব ঘটে। ভীত হয়ে পড়া, বেশি বেশি জিনিস কিনে জমা করা, এমনকি লুঠপাঠ চলতে থাকে অবাধে। এই সম্যক অবিন্যস্ত আচরণের কারণ হিসাবে কাজ করে আতঙ্ক। তবে কি একদম আতঙ্কিত হওয়া চলবে না? সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত কিছুটা চমকপ্রদ। আদতে আমাদের আবেগ অনুভুতি সারভাইভালেরই এক অঙ্গ হিসাবে কাজ করে। সামনে বিপদ, মনের মধ্যে দুরন্ত ভয় তৈরি হলে তবেই না আমরা বাঁচার আকুলতায় প্রাণপণ দৌড়বো, তাই না? বাঘের কবল থেকে বাঁচার জন্য হরিণের ছুটের মতো আর কি!! অর্থাৎ কিনা করোনাতঙ্ক দৈত্যকে আমাদের মারলে চলবে না, তাকে পোষ মানিয়ে আমাদের দাস করে রাখতে হবে। আতঙ্ক থাকলে তবেই আমরা নিয়ম মেনে মাস্ক ব্যবহার করবো, শারীরিক দুরত্ব বজায় রাখবো, হাত ধোয়ার সব বিধি বিধান যথাযথভাবে মানবো। অথচ আতঙ্কে অন্যের প্রতি সহমর্মী হতে ভুলব না। প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিস ঘর বোঝাই করব না। ঘরবন্দী হয়ে আছি বলে বাড়ির অন্যদের প্রতি রুঢ আচরণ করবো না। 

কেমন করে? আসুন এক মহামারীর দেশের রূপকথা শোনাই আপনাদের। কেমন করে আজ থেকে দু হাজার বছর আগে মনের জোরে এক রাজা লড়াই করেছিল এক মহামারীর সঙ্গে। সময়কাল ১৬৬ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৮০ খ্রীষ্টাব্দ। রোমের সাম্রাজ্য যুক্তভাবে শাসন করছেন মার্কাস অরেলিয়াস আর তাঁর ভাই লুসিয়াস ভেরাস। ১৬৫ সালের শেষের দিকে রোমে যুদ্ধফেরত সৈনিকরা এক ভয়াবহ রোগ আমদানী করেছিল সম্ভবতঃ প্রাচ্যের চীন থেকে। ক্রমে ক্রমে সেই রোগ মহামারীর আকার ধারণ করল। প্রাণ গেল বহু লোকের। একে একে রোগ ছড়িয়ে পড়ল গ্রীসে, ইতালিতে, ইজিপ্টে, নর্থ আফ্রিকায়। ১৬৯ সালে সম্ভবতঃ সেই রোগেই মারা গেল লুসিয়াস। এদিকে প্রতিকার নেই কোনও। কুড়ি বছর রাজার রাজ্যে চলল মারণ রোগের দাপট। কত প্রাণ চলে গেল। কি করলেন অরেলিয়াস? ভেঙে পড়লেন? না, একদমই না। তাঁর জীবন দর্শন ছিল স্টয়সিজমের ওপর আধারিত। প্রাচীন গ্রীস ও রোমে প্রচলিত এই দর্শন যাঁরা অনুসরন করতেন তাঁদের মতে কোনও প্রতিকুল পরিস্থিতিতেই যৌক্তিকতা হারালে চলবে না। এই জগত প্রকৃতির নিয়মে বাঁধা যেখানে রোগ, মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী চিরন্তন সত্য। তাই আমাদের প্রত্যক্ষণ যেন আবেগের জোয়ারে আপ্লূত না হয়। মারকাস মনে করতেন মৃত্যু আর রোগ ব্যাধি আসলে

বসন্তের গোলাপ আর শরতের ফলের মতোই সহজ সত্য। একে একে নিজের চোদ্দ জন সন্তানের মধ্যে সাত জনের মৃত্যুর সাক্ষী তিনি। আজকের সঙ্গে তুলনা করলে তখনকার কালে কতই বা চিকিৎসার সুযোগ ছিল। তবু এই মনের জোর ধরে রাখার জন্য মারকাসের ছিল দৃঢ জীবনবোধ। সেই প্রাচীনকালে স্টয়সিজমের প্রবক্তারা বলে গেছেন মানুষ সামাজিক জীব। একে অন্যের সাথে যুক্ত থাকতে পারলে সে নিশ্চিন্তবোধ করে। আজকের পরিস্থিতিতে আমরা যে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বাধ্য হচ্ছি তাতে আমাদের অনেকের মধ্যে অনিশ্চয়তার বোধ বাড়িয়ে তুলছে। আমি বলি কি এই পরিস্থিতিতে মানসিক স্থৈর্য্য বজায় রাখতে স্টয়সিজমের ধারণা কিছুটা প্রয়োগ করা যেতেই পারে। আমরা শারীরিক দূরত্ব বাড়াবো কিন্তু সামাজিক সম্পর্ক আরও দৃঢ করে তুলব। নিয়মিত ফোনে সবার সাথে যোগাযোগ রাখব। গোষ্ঠীগত সৌহার্দ্য বজায় রাখতে সবে মিলে সমাজের এই বিপদের দিনে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী এগিয়ে আসব। যাতে আমাদের মধ্যে এই বোধ জেগে ওঠে “we are waves of the same sea, leaves of the same tree, flowers of the same garden.” সামাজিক মাধ্যম খুব ভেবে চিন্তে ব্যবহার করা প্রয়োজন। কারণ অন্যের নেতিবাচক মনোভাব দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি।

১৮০ সালের ১৭ই মার্চ মারকাসের মৃত্যু হয় সম্ভবতঃ ওই মহামারীতে। কিন্তু সে মৃত্যু হেরে যাওয়ার গল্প শোনায় না। সে এক বীর পুরুষের মাথা উঁচিয়ে শেষ পর্যন্ত লড়ার গল্প। এই বিপদের সময়ে আমরাও মনের বল যেন না হারাই। কি হবে সে সম্বন্ধে অযথা নেতিবাচক চিন্তা না করে, এই মূহূর্তে কি করলে সব থেকে উপকার হবে সে ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। বাস্তব সত্যের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে, পরীক্ষিত নয় এমন তথ্য অগ্রাহ্য করতে হবে। আর এমন বন্দীদশার যে লাভজনক দিক আছে সেই দিকগুলো সম্বন্ধে সচেতন হতে হবে। কত কিছুই না পেতে পারছি না আমরা। এ বিষয়ে স্টয়সিকরা বলেছেন, 

“Until we have begun to go without them, we fail to realise how unnecessary many things are. We’ve been using them not because we needed them but because we had them.” এর থেকে চরম সত্য আর কি বা হতে পারে। শ্রী কৃষ্ণের মুখে শোনা যায় সেই একই সত্য, তস্মদ অপরিহার্থে না ত্বম শোচিতাম আরহাসি। অর্থাৎ কিনা, যা অবশ্যম্ভাবী তার সম্বন্ধে ভেবে চিন্তাগ্রস্ত হয়ো না। আসলে প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য দর্শন বলে আলাদা করে নয়। বিপদের দিনে চিন্তাশক্তি যেন লোপ না পায় সেইটাই আসল কথা। আজ ঠিক ১৮৪০ বছর পরে ইতালিতে আবার নেমে এসেছে মহামারীর কালো অভিশাপ। সারা পৃথিবীর সমগ্র মানব জাতি এক মহা সংকটের মুখে। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে আমরা তালি থালি কাঁসর ঘন্টা যাই বাজাই, যেন ভুলে না যাই চিন্তার যৌক্তিকতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। তবেই আমাদের জয় নিশ্চিত হতে পারবে। 

0 comments: