0

অনুবাদ সাহিত্য - অংকুর সাহা

Posted in



অবিস্মরণীয় প্রেমের কবিতা -- ৮
 
এবারের কিস্তি শুরু করছি সুদূর উত্তরের খর্খরে, শীতল হাওয়ায় -- ফিনল্যাণ্ড আর আইসল্যান্ডের কবিদের কবিতা দিয়ে।

দানিউব নদী ছিল রোম সাম্রাজ্যের উত্তর প্রান্তে -- সেই স্রোতস্বিনী পেরিয়ে ওপারে যেতে ভয় পেতো তার সৈন্যেরা। আরও সুদূরের বরফে ঢাকা দ্বীপগুলিরও খবর ছিল তাদের কাছে -- নাম দিয়েছিল ‘স্ক্যান্ডিনেভিয়া’ অর্থাৎ “দূর উত্তরের দ্বীপগুলি”। রুক্ষ প্রকৃতির দেশ, কিন্তু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অমলিন। মানুষগুলি সুভদ্র, সুশিক্ষিত ও শ্বেতকায় -- জন্মের হার কম এবং বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা বেশি; নারীর অধিকার, সংখ্যালঘুর অধিকার এবং সমকামীদের সমানাধিকার বিষয়ে দেশগুলি পৃথিবীর শীর্ষে। এক নারী অন্য নারীকে, অথবা এক পুরুষ অন্য পুরুষকে বিবাহ করে ঘর-সংসার করতে পারেন নির্বিঘ্নে, লালন-পালন করতে পারেন ক্ষেত্রজ অথবা দত্তক নেওয়া সন্তানদের। উদারপন্থী শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ঘুচে গিয়েছে কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িক গোঁড়ামি এবং ধর্মভীরুতা। মানুষ বাস করেন সন্তুষ্ট, শান্তিময় সহিঞ্ষুতায়। কিন্তু তাঁরা অনেকেই সঙ্গীহীন ও একাকী। মাথাপিছু মানসিক রোগীর সংখ্যা এবং আত্মহত্যার সংখ্যা খুব বেশি। দীর্ঘ নিশীথ এবং গভীর শৈত্য থেকে জন্ম হয় অকল্পনীয় নৈরাশ্যের আর তার ছায়া পড়ে সাহিত্যে।

সোলভেইগ ভন শুলৎস ফিনল্যান্ডের কবি কিন্তু লেখেন সুইডিশ ভাষায় -- ঠিক যেমন একসময় বাঙালিদের বৌদ্ধিকচর্চা চলতো সংস্কৃত অথবা ফার্সি ভাষায়। সাত দশক ধরে সাহিত্যের চর্চা করেছিলেন এই দীর্ঘজীবী সাহিত্য-সম্রাজ্ঞী; দক্ষিণ ফিনল্যান্ডের উপকূলে সুইডিশভাষী পরভো শহরে তাঁর জন্ম -- কবিতায় তিনি তাঁর নারীসুলভ অনুভূতিগুলি প্রকাশ করেছেন অনবদ্য শৈলীতে -- পৃথিবী, সূর্য, সমুদ্রের ঢেউ, বৃক্ষরাজি, মানব-মানবীর প্রেম। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার নির্যাসটুকু ছেঁকে নিয়ে প্রতীক ও উপমার মাধ্যমে তার আবেগহীন বহি:প্রকাশ। এক একটি কবিতা তাঁর কাছে এক বিন্দু বৃষ্টির জল, যার মধ্যে তিনি দেখতে পান মানব অস্তিত্বের পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলন। প্রথম গ্রন্থ থেকেই তাঁর কবিতায় প্রকৃতি সুন্দর, ভয়ঙ্কর, সতেজ ও মুখর। ইঙ্গমার বার্গম্যানের চলচ্চিত্রের মতন সেখানে শাদা আর কালো রঙের প্রাধান্য হলেও সেখানে মানবিক আবেদনের অভাব নেই।

আইসল্যান্ডের এক শীর্ষস্থানীয় কবি স্টাইন স্টাইনার -- মাত্র ঊনপঞ্চাশ বছর বয়েসে পোলিও রোগের আক্রমণে অকালমৃত্য না হলে তিনি ইউরোপের এবং পৃথিবীর এক প্রধান কবি হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল মধ্যে। বুদ্ধদেব বসুর সমবয়েসি কবি তাঁর কবিজীবন শুরু করেছেন প্রথাসিদ্ধ ধারায় কবিতা লিখে এবং পরবর্তীকালে সেই প্রথার নিগড় ভেঙে নির্মাণ করেছেন আইসল্যান্ডের আধুনিক কাব্যপ্রতিমা। খেতমজুরের পরিবারে তাঁর জন্ম, দিন কেটেছে খিদে আর ব্যাধির আক্রমণে। গৃহনির্মাণশিল্পে অল্প মজুরিতে কঠোর পরিশ্রম করে পাশাপাশি চালিয়েছেন সাহিত্যচর্চা। তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থের নাম “গন্তব্যহীন যাত্রা”।

স্টাইন স্টাইনার এর চেয়ে বয়েসে আট বছরের ছোট ইয়ন উর ভর, তাঁর যোগ্য উত্তরাধিকারী। শৈলির দিক থেকে তিনি আপাদমাথা ইয়োরোপীয় -- আইসল্যান্ডের কবিতার ঐতিহ্যকে পুরোপুরি বর্জন করেছেন তিনি। তাঁর সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল যে শহরতলিতে তিনি বাস করেন, সেখানে আন্তর্জাতিক মানের গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা -- সে কাজে তিনি সফল হয়েছেন। ১৯৮৬ সালে তিনি আইসল্যান্ডের সেরা কবির পুরস্কার পেয়েছিলেন। ২০০০ সালে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর নামে একটি প্রধান সাহিত্য পুরস্কার চালু হয়েছে।

একই সঙ্গে সংকলিত হয়েছেন পাঁচজন মার্কিন মানবীকবি। সংসারী এবং শরীরী কবি হিশেবে শ্যারন ওল্ডস এর দেশজোড়া খ্যাতি -- কবিতায় নৈর্ব্যক্তিক বিষয় নিয়ে তিনি মাথা ঘামান না বিশেষ; শাকসব্জি, রন্ধন, বাগানের কাজ, শিশুকে স্তন্যদান, অসুস্থ সন্তানের সেবা, আকাশের চাঁদ কিংবা বন্ধুত্ব নিয়ে কবিতা রচনা করেছেন তিনি। কিন্তু ঋতু শোণিত, ট্যাম্পন , শরীরের বয়েসজনিত স্ট্রেচমার্ক, টয়লেট, যৌন অযৌন শারীরিক প্রক্রিয়া -- কোনোকিছুই ব্রাত্য নয় তাঁর কবিতায়। অজাত শিশুরা লাইন বেঁধে দাঁড়িয়ে রয়েছে জন্ম নেবার অপেক্ষায় -- কেউ দাঁড়িয়েছে শিক্ষকের লাইনে, অন্যেরা সৈন্যদের লাইনে, লেখকদের লাইনে, উকিল, পুরোহিত, ব্যবসায়ীদের লাইনে, কিন্তু কবি হওয়ার অথবা মা হওয়ার লাইন একেবারে খালি -- সেখানে একজনও নেই -- এই কবি চেয়েছিলেন শূন্যস্থানটি পূর্ণ করতে।

বাকি চারজন মানবীকবিও কবিতায় এবং জীবনযাত্রার বৈচিত্রে বর্ণময়। কবি হিসাবে এঁরা সকলেই সাহসী, মুখর, দক্ষ ও বহুমুখী -- নানান পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত। আসুন তাঁদের কবিতাগুলি উপভোগ করি।

সোলভেইগ ভন শুলৎস (ফিনল্যাণ্ড, ১৯০৭-১৯৯৬)

স্বপ্ন

হঠাৎ আলোর ঝলক বন্যার মতন 
তার ঘাগরা বেয়ে ওপরে ওঠে 
ছড়িয়ে যায় তনুর অন্ধকার গভীরে।
নারী ত্বরিতে ঘাগরা খুলে ফেললে,
শাদা শাদা পপিফুল হয়ে 
তারা ওড়ে বিছানার ওপরে শূন্যে।
পুরুষটি ধরতে যায় তাদের 
মুখ ডোবায় তাদের শান্ত ও 
আত্মসমর্পণময় অস্তিত্বে।
এদিকে তার ভুলে যাওয়া নারীটি 
নগ্ন দাঁড়িয়ে 
শয্যার পাশে।


তুমি আর আমি 

এই তুমি আর আমি 
মানে আমরা।
এ সম্পর্ক চিরস্থায়ী।
কখনও তার বস্তুরূপ বা ওজন 
আমি দেখতে পারি হাতে নিয়ে 
উষ্ণ অথচ দৃঢ়, দেখার জন্যে,
ভাগ করে নিই তাকে 
যা রুটি আর নুনের মতোই 
অপরিহার্য।


প্রেমিক-প্রেমিকা 

।।১।।
যখন আমার হাতে হাত বোলাও তুমি
ধীর, অভ্যন্তর, নিরুচ্চার, ডান এবং বাঁ হাত --
গাছ গজায় আমার অন্তরে, বন্দি পাখির ঝাঁক উড়ে যায়।
যখন তুমি গ্রহণ করো আমার ওষ্ঠ, ডুবে যাও তার গভীরে,
দ্রুত ডানা ঝাপটায় আমার আঁখিপল্লব:
ছেড়ে দাও, মুক্তি দাও আমায়। আমি মুক্ত হতে চাই।

যখন তুমি চুমু খাও আমার স্তনে,
কলিরা কাঁপে, ফুল হয়, ত্বক খুঁজে পায় কণ্ঠস্বর:
আশ্লেষে চেঁচিয়ে আমি, নীরব চিৎকার।

।।২।।
চারপাশে ধরার বাতাসে মৃদু মর্মর,
শিকারী হাঁটে -- মন্থর অথচ দৃঢ় গতি,
তার সঙ্গী কুকুরটির নিরানন্দ আর্তনাদ,
অজানা গ্রহ থেকে তীর ছোটে --
এবং সব কিছু ছাপিয়ে কৃষ্ণ ঝড়ের গর্জন।

নক্ষত্রের শয্যায় টানটান শুয়ে আমরা,
নক্ষত্রের শয্যা, আমরা নির্ভয়।
যতক্ষণ আমার উষ্ণতামথিত নি:শ্বাস পড়ে তোমার কাঁধে,
আর তোমার হাতের শান্তি-বিশ্রাম আমার ঊরু-খিলানে,
যতক্ষণ আমরা চোখ বুজে মানবার্তা শুনতে থাকি,
প্রবেশ করি একে ভেতর, পুরানো কামনা ও স্মৃতি সমেত,
যতক্ষণ আমাদের মিলিত হাসি অন্ধকারের পানে বয়,
যতক্ষণ আমরা বাঁধা থাকি উজ্জ্বল বিশ্বাসে,
কোনো সন্তাপ স্পর্শ করে না আমাদের।

[গত শতাব্দীর সমবয়েসী ফিনল্যান্ডের এই শক্তিশালী কবি-সাহিত্যিক। তার মধ্যে সাত দশক ধরে তাঁর সাহিত্যচর্চা। পঞ্চাশটির বেশি গ্রন্থ: কবিতা, ছোটোগল্প , উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য। তাঁর উপন্যাস অবলম্বনে রচিত হয়েছে জনপ্রিয় চলচিত্র। তাঁর লেখা নাটক অভিনীত হয় মঞ্চে, বেতারে ও টেলিভিশনে। দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি থেকেই উঠে আসে তাঁর সাহিত্যের রসদ -- কিন্তু তার ফাঁকে ফাঁকেই ফুটে ওঠে বৃহৎ ও মহতের আভাস। সুইডিশ ভাষা থেকে কবিতাগুলির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন অ্যান বর্ন।]


স্টাইন স্টাইনার (আইসল্যান্ড, ১৯০৮-১৯৫৮)

সমুদ্রসৈকতে গ্রীষ্ম 

সূর্যের শুভ্র আলোক 
আর সমুদ্রের গুনগুন গান --
এরা আমার ভ্রাতা ও ভগিনী।

একা বসে কান পেতে শুনি,
সমুদ্র আমার সামনে 
উঠে আসে কটা চুলের নারীর বেশে।

আমি দেখি নিশীথের আগমন,
হাতদুটো ঘুমন্ত হলেও 
সারারাত জেগে থাকে হৃদয়।

আর আমার ভালোবাসায় মত্ত, সে নারী,
হাসে আর বলে:
আমি অলীক; আমি নেই।


সময় আর জলস্রোত 

।।১।।
সময় জলস্রোতের মতন,
আর জলরাশি -- শীতল এবং গভীর 
আমার অনুভূতির মতন।

আবার সময়কে মনে হতে পারে 
জলের রঙে আঁকা ছবি,
তার অর্ধেকটা এঁকেছি আমি।

আবার সময় ও জলরাশি 
বয়ে যায় চিহ্নহীন বিলুপ্তির দিকে 
আমার অনুভূতির চেতনায়।


।।২।।
সূর্য,
আমার সঙ্গেই থাকেন তিনি
হলুদ জুতো পায়ে
তন্বী নারীর ভঙ্গিতে।

জলের কুড়ি ফ্যাদম নিচে 
পাশাপাশি ঘুমোয় আমার বিশ্বাস ও প্রেম --
দোরঙা এক ফুল যেন।

আর সূর্য,
হলুদ জুতো পায়ে হাঁটেন 
সেই অসন্দিগ্ধ ফুলকে মাড়িয়ে।

।।৩।।
যে ঢেউ ভাঙে 
তামাটে রঙ বালুকায়;
যে বাতাস বয় 
নীল ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে;
সে ফুলটি মরে।

পাথর ছুঁড়ি 
সিমেন্টের দেওয়ালের গায়ে,
পাথর হাসে।

।।৪।।
আমার অনুভূতির থেকে 
তোমার ঠোঁট পর্যন্ত --
পথহীন সমুদ্র।

আমার উজ্জ্বল স্বপ্নগুলি 
চোরাস্রোতের ঢেউয়ে --
কিন্তু গভীর সমুদ্র ঘুমোয় তখন।

আমার গোপন দু:খগুলো 
লুকিয়ে দেখা করে তোমার সঙ্গে
দূরের কোন নীল সায়রে। 

।।৫।।
সূর্যের শাদা আলোয় তোমার রূপ 
মনে করিয়ে দেয় 
আমার হিপি দিনগুলোর কথা।

নকল নীল বৃষ্টির মতন 
তোমার অশ্রু পড়ে 
আমার দু:খের গায়ে।

আর তোমার দূরত্বকে 
আঁকড়ে ধরে শুই 
প্রথমবারের মতন।

।।৬।।
আমার দু:খের 
শুভ্র আলো এসে পড়ে 
তোমার জাগরুক চোখে।

আমার মনকে উড়তে দিই 
তোমার আঁখির 
পথহীন সমুদ্রে।

তোমার সুখ যাতে 
বইতে পারে আমার আঁখির 
শুভ্র আলো।

।।৭।।
আমার শাদা পশমি স্বপ্নের 
কল্পিত আলো 
ছড়ায় তোমার চিহ্নহীন পদক্ষেপে।

উল্টোমুখী হাওয়ার 
দ্বিধান্বিত স্রোতে 
তোমার মুখচ্ছবি দেখি।

আর তোমার মুখ 
হাড় কাঁপানো শীতল ছায়া হয়ে 
ছুটে যায় আমার নিদ্রা ও স্বপ্নের ফাঁক দিয়ে।

।।৮।।
রক্তবর্ণ সমুদ্রের মতন
নীরবতা ধুয়ে দেয়
আমার কণ্ঠস্বর।

মরচে ধরা অন্ধকার হয়ে 
নীরবতা মুছে দেয় 
আমার অস্তিত্ব।

নীরবতা উঠে এসে 
তিন-ফেরতা কম্বল হয়ে 
জড়ায় নীরবতাকে।

টীকা: 

ফ্যাদম -- জলের গভীরতার মাপক বাঁও। ১ ফ্যাদম = ৬ ফুট। 

[আইসল্যান্ডের প্রথম আধুনিক কবি। প্রাচীন কাব্যরীতিকে ভেঙেচুরে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন নতুন ধারার কবিতা এবং আইসল্যান্ডের কবিতাকে টেনে হিঁচড়ে পৌঁছে দেন বিংশ শতাব্দীতে। ইউরোপের কবিদের অনুপ্রেরণায় তিনি লিখেছে মুক্তছন্দের কবিতা, কিন্তু তার মধ্যেও ধরে রেখেছেন আইসল্যান্ডের ঐতিহ্যমূলক অলংকার ও অনুপ্রাস। মাত্র ঊনপঞ্চাশ বছর বয়েসে পোলিও রোগে মৃত্যু। আইসল্যান্ডিক ভাষা থেকে কবিতাগুলির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন মার্শাল ব্রেমেন্ট।]

ইয়ন উর ভর (আইসল্যান্ড, ১৯১৭-২০০০)

তুষার 

আকাশ থেকে নিষ্পাপ তুষার,
আকাশ থেকে নিষ্পাপ তুষার,
-- তোমার রূপ
সেই তুষারকণাগুলির মতন পবিত্র --

আর তোমার মুখের কথা 
তুষার পতনের মতন মনোরম।

তোমার কেশরাজি 
একদিন তোমার কেশরাজি ছিল 
আমার দৃষ্টি আকর্ষণের 
কুহক জাল।
পুরানো দিনের 
গন্ধতেলের ঘ্রাণ আজও 
পেয়ে যাই তার থেকে।

এখন তোমার দুহাত 
আগলে রাখে 
দুটি দুষ্প্রাপ্য, মহার্ঘ ডিম,
আমাদের ভঙ্গুর হৃদয়দুটি --
অন্তিম দিনগুলোতে 
দেখাশোনার জন্যে।

[ইয়ন ইয়নসনের জন্ম সমুদ্রের ধরে “ভর“ নামে জেলেদেরএকটিগ্রামে। কবিতা লেখার জন্যে তিনি যে নামটি গ্রহণ করেছিলেন, তার অর্থ হলো “ভর গ্রামের ইয়ন“। তাঁর কবিতা পুরোপুরি ইওরোপ-কেন্দ্রিক। আইসল্যান্ডের সাহিত্যিক ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণ বর্জন করেছেন তিনি। গ্রাম্য চাষা ও জেলেদের মুখের ভাষা তাঁর কবিতায় স্বমহিমায় উপস্থিত। আইসল্যান্ডিক ভাষা থেকে কবিতাগুলির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন মার্শাল ব্রেমেন্ট।]

শ্যারন ওল্ডস: (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৪২- )

প্রথমবারের যৌনতা

জে-এর জন্য 

আমি জানতাম খুব সামান্য, আর যা জানতাম 
বেশির ভাগ বিশ্বাস করতাম না -- এতবার মিথ্যে 
বলেছে সবাই, আমি ভাবলাম যা হয় হোক,
চাদরের ওপরে তার নগ্ন শরীর, পায়ের 
ছোটো ছোটো লোমগুলি সুন্দর সোনালি ঝিনুক --
কুঁকড়ে যায়, তার পুরুষাঙ্গ 
দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হচ্ছে আমার হাতের মুঠোয়, কিন্তু 
পাথরের মতন শক্ত হয়নি এখনো, তার মুখ 
ঋজু, ভয়ে যেন পিছিয়ে, তার শরীরের 
সব রন্ধ্র থেকে যেন ঝেঁপে আসে স্বেদবিন্দু 
গুটি গুটি হেঁটে চলা ছোট্ট শামুকের মতন, যেমন সময় 
তার হাঁটুতে লাগলো ঠোকাঠুকি, আর আমার হাতে 
জড়ো হওয়া শিশুর মতন কাঁপলো সে,
আর দুধের মতন ভেসে এলো শাদা তরলতা,
আমি দেখলাম তারা জ্বলজ্বল করছে তার পেটের ওপর,
অনেক কিছু বলছে আমায়,
আমি দুহাতে ক্রিমের মতন তাকে ঘষে নিই, 
আর এইভাবে ঢুকে পড়ি ঘটনটির ভেতর।

স্টিল লাইফ 

সহবাস শেষ -- আমি চিৎ হয়ে শুয়ে,
ঢাকা স্তনদুটি ঢাকনা দেওয়া ঝোলের বাটি -- ফাঁপা ও বক্র,
বৃন্তে বেরিফুলের ফুটকি, পরিবর্তনহীন, ঝলমলে। 
আমার পাদুটি অইখানে শায়িত বিছানার কোথাও, টেবিলের 
ধার থেকে উঁকি দেওয়া বড় সড় রূপালি মাছ যেন।
চরম ধ্বংসের দৃশ্য, নিখুঁত শান্তির দৃশ্য,
চকচকে লাল ও ঘন নীলরঙা মৃত বনমোরগের 
ঘাড়ের মেরুনরঙা পালক ও গভীর ক্ষতের মতন,
উজ্জ্বল, স্থির, আলোকময় যৌনমিলন,
আর আমার কপালের মাঝখানে এক ফোঁটা জল 
গোল, শাদা, জ্যোতির্ময় এবং তাতে 
সেই শিল্পীর নগ্ন, উপুড় হওয়া আত্মপ্রতিকৃতি, আলোকিত 
টর্চের মতন তোমার উঁচানো তুলি থেকে ঝরে ফোঁটা ফোঁটা রঙ।


মানচিত্র 

দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত উড়ে এসে ক্লান্ত 
আমরা, গা এলিয়ে দিই বিছানায় 
সমবেত, সাবধান, পাশাপাশি রাখা মানচিত্রের মতন 
মুখোমুখি, পুব থেকে পশ্চিমে, আমার 
সান ফ্রান্সিসকোর গায়ে ঘেঁষে তোমার নিউ ইয়র্ক, আমার 
সোনোমা ঢলে পড়ে তোমার ফায়ার আইল্যান্ডের ওপর, আমার 
নিউ অরলিন্স সটান ঢুকে যায় তোমার টেক্সাসের গহনে, তোমার 
আইডাহো উজ্জ্বল আলো ছড়ায় আমার হ্রদের গভীর জলে, আমার 
ক্যানসাস পুড়ছে তোমার ক্যানসাসের কামানলে, তোমার 
ক্যানসাস জ্বলছে আমার ক্যানসাসের দহনে, তোমার 
পূর্ব উপকূলের প্রমাণকাল চাপ দেয় আমার 
প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্রমাণকালে, আমার পার্বত্য লগ্ন 
এসে ধাক্কা মারে তোমার কেন্দ্রীয় লগ্নে, তোমার 
সূর্য চটপট উঠে পড়ে ডানদিকে, আমার 
সূর্য চটপট উঠে যায় বাঁদিকে, তোমার 
চাঁদ অলসগতিতে ওঠে বাঁদিক থেকে, আমার 
চাঁদ অলসগতিতে যায় ডানদিকে, যতক্ষণ না 
আকাশে স্থিত চার চারটে শরীর 
মাথার ওপর জ্বলে, জোড়া লাগায় আমাদের,
আমাদের সব শহরই যমজ,
আমাদের সব প্রদেশই আলিঙ্গনে নিবিড়, এক 
জাতি, এক প্রাণ, অবিভাজ্য,
সবার জন্যে সুবিচার ও স্বাধীনতা।

[আগুনের পরশমণির মতন ঝলসে ওঠে তাঁর কবিতা -- একটি বিখ্যাত কবিতার নাম “পোপের যৌনাঙ্গ”। ১৯৮০ সালে সাঁইত্রিশ বছর বয়েসে তাঁর প্রথম কবিতা সংকলন: “শয়তান উবাচঃ” -- গ্রন্থের চারটি অংশ: “কন্যা, নারী, মাতা, যাত্রা”। জীবনের অষ্টম দশকেও সেই সাহসী যাত্রা অব্যাহত; ২০১৩ সালে কবিতায় পুলিৎসার পুরষ্কার পেয়েছিলেন। তিনটি কবিতাই ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত “স্বর্ণকক্ষ” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।]

এরিকা জং: (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৪২- )

শীতলতর 

আমি আর ভাবি না সব নষ্ট মেয়েদের কথা।
তাদের সুগন্ধি স্তনের অভ্যন্তরে
বিশুদ্ধ সিন্দুক নুনের হৃদয়।
লটের স্ত্রীর মতোই পাপী তারা --
সব কটাই।

আমি কেয়ার করি না যদি আমার 
পুরুষকে নিয়ে তারা নাড়াচাড়া করে পার্টিতে,
বাড়ি নিয়ে গিয়ে সহজেই 
বসিয়ে দেয় স্বামী আর শিশুর ফাঁকে, 
আর চুমু-চোষণের ভঙ্গিতে 
ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের মতন খালি করে তার পকেট।

কিন্তু শীতলতা বিব্রত করে আমায়,
যখনই হে বাড়ি ফেরে।
বলে, “শীত করছে --”
(তাতে কিছু সাহায্য হয় যে তা নয়)।
গায়ে হাত দিয়ে বুঝি সে নিজে 
জানেও না সে কতোটা শীতল।

উদাসীন সঙ্গম।
মেয়েমানুষকে সপ্তাহে চারবার 
মরে পুড়ে ছাই হয়ে 
আবার নতুন করে জন্মে 
উপলব্ধি করতে হয় তার অভিজ্ঞতা।

ক্ষুরধার তার পাছা 
শ্রোণির হাড় ছুরির ফলা 
তার কনুই কাটতে পারে মাখন।

তার মুখ থেকে বেরোয় 
মেঘের মতন শীতল তুষার।
বিশুদ্ধ বরফে গড়া তার শিশ্ন --
ধোঁয়া উঠতে থাকে।
আমার মুখের ওপর শূন্যে ঝোলে 
তার মুখ -- বরফে খোদাই।

কোনো একদিন 
আমায় ভাঙবে সে 
অথবা 
গলে যাবে নিজেই।

টীকা:

লটের স্ত্রী: যীশু তাঁর শিষ্যদের বলতেন, “লটের স্ত্রীর কথা মনে রাখবে।” বাইবেলের কাহিনি: সডোম নগরী যখন ধ্বংস হচ্ছে, ঈশ্বর তখন লট ও তাঁর স্ত্রীকে আদেশ দেন, একবারও পিছনে না তাকিয়ে সোজা শহর ছেড়ে চলে যেতে। লটের স্ত্রী পিছন ফিরে তাকালে সেই মুহূর্তে তাঁর মৃত্যু হয় এবং তাঁর মৃতদেহ পরিণত হয় নুনের স্তম্ভে। আজও ডেড সি’র দক্ষিণ উপকূলে গাছের গায়ে নুনের পুরু আস্তর জমে মানুষের আকার ধারণ করে -- ট্যুরিস্টরা ছবি তোলেন তাদের পাশে দাঁড়িয়ে।

[যদিও গদ্যকার এবং বিতর্কিত নারীবাদী ব্যক্তিত্ব হিসেবেই তাঁর জনপ্রিয়তা বেশি, তিনি কবিতাও লেখেন নিয়মিত; ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত তাঁর “উড়ান-ভীতি” (“Fear of Flying”) উপন্যাসটি বিক্রি হয়েছে দু কোটির বেশি কপি। নারীর যৌন আকাঙ্খার এবং তার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কার্যকলাপের অকুন্ঠ, দ্বিধাহীন বর্ণনা। সেই তুলনায় তাঁর কবিতা মনোযোগ পেয়েছে কম। ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত “প্রেমশিকড়” কাব্যগ্রন্থ থেকে কবিতাটি সংকলিত হয়েছে। কবিতা অনুবাদের অনুমতি চেয়ে তাঁকে ইমেইল করলে, তাঁর উকিল উত্তরে অনুমতির সঙ্গে জানান যে কবির অন্তনামের উচ্চারণ হবে “জং”, “ইয়ং” নয়।]

লুইস গ্লাক: (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৪৩- )

বাধাবিপত্তির গান 

যখন প্রেমিককে বাহুবন্ধনে জড়াই, বুকের ভেতর মনে হয়
নড়তে শুরু করলো ধরিত্রীর আদিম হিমবাহ,
বিরাট, বিশাল পাথর উলটে সরতে লাগলো বরফ, তারপর 
গম্ভীর, কঠিন মুখের পাথর সব; আর জঙ্গল উপড়ানো 
বৃক্ষেরা মিলে তৈরি হল ছেঁড়াখোঁড়া ডালপালার সমুদ্র --
আর যেখানে দাঁড়িয়ে শহর, তারাও শুরু করলো গলতে,
দীর্ঘনি:শ্বাস ফেলা বাগান, উঠোনে বসে চকলেট খাচ্ছিলো 
যে সব খুকিরা, আর আনমনে ছড়িয়ে দিচ্ছিলো 
তাদের রঙিন খোশা: আর যেখানে শহর ছিলো,
তার আকর, তার উন্মোচিত রহস্য: আর আমি দেখি 
পাথরের চেয়ে বরফ শক্তিশালী, আত্মরক্ষার চেয়েও --

তারপর আমরা যাই যে যার যার পথে, সময় কাটতেই চায় না,
এক ঘন্টাও না।

[জার্মান-মার্কিন কবি -- বারোটি কাব্যগ্রন্থ। একটি কবিতা বিষয়ক সন্দর্ভের সংকলন। পুলিৎসার (১৯৯৩ সালে “বুনো আইরিস” কাব্যগ্রন্থের জন্যে) ও অন্যান্য নানান পুরষ্কার। আমেরিকার জাতীয় কবি ২০০৩-২০০৪। “কবিতা লেখা নিজের পরিস্থিতির বিরুদ্ধে এক ধরণের প্রতিশোধ -- দুর্ভাগ্য, পরাজয়, ব্যর্থতা, যন্ত্রনা।” কবিতাটি ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত “আকিলিসের বিজয়” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। ]

এলেন ব্রায়ান্ট ভয়েট: (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৪৩- )

অন্যেরা 

আমাদের দুই সন্তান বড়ো হয়েছে, এখন 
আমরা ভাবতে বসি 
অন্য সন্তানদের কথা:
আরও দুবার 

বিরাট মাথাওলা শুক্রাণু লাফিয়ে এসে
গোঁয়ারের মতন আঘাত করলো,
ছুটে এলো চটচটে ডিম্বাণুর দিকে --

বিবাহ 
আমাদের বিবাহ থেকে ক্ষিতি ও তেজ --
এবং তার পরে কী,
মুক্ত অঙ্গনে 

ইঙ্গিত -- ঈশ্বরের আঙুল থেকে 
আদমের হাতে?

আত্মা 
ফিরে গেল:

আমাদের ভাগ্যবান 
অথবা অভাগা চিরকালের জন্যে হারালো, 
তাদের কথা আমরা কখনো বলি না।

[ন’টি কাব্যগ্রন্থ এই মার্কিন কবি ও প্রাবন্ধিকের। তার মধ্যে একটির নাম “স্বর্গের ছায়া” (“The Shadow of Heaven”, ২০০২)। ভারমন্ট রাজ্যের সভাকবি ছিলেন তিন বছর। কবিতাটি “দি আটলান্টিক মান্থলি” সাময়িকপত্র থেকে নেওয়া হয়েছে।]

লোলা হাসকিন্স: (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৪৩- ) 

প্রেম

প্রেমকে সে ড্রেসের মতন গায়ে জড়ায়।
পরে মনে হয় ঠিক যেন ফিট করছে না,
তাই চেষ্টা করে খুলে ফেলতে।

সঙ্গে সঙ্গে খুলে আসে তার গায়ের চামড়া। 

[মার্কিন কবি এবং ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপিউটার সায়েন্সের অধ্যাপিকা। ছ’টি কাব্যগ্রন্থ। একটির নাম “তার কামনার রেখা -- নতুন ও নির্বাচিত কবিতা” (“Her Desire Lines -- New and Selected Poems”, ২০০১)। কবিতাটি “দি আটলান্টিক মান্থলি” সাময়িকপত্র থেকে নেওয়া হয়েছে।]

 [ক্রমশ:]

0 comments: