0

গল্প - অনিরুদ্ধ ভৌমিক

Posted in


৩০শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭। আপার ওয়াটার ফলসের ১১,০০০ ফুট উচ্চতায় টেন্টের লাইট জ্বালিয়ে ডায়েরিটা হাতে নিয়ে বসে আছি। কাছেপিঠে কোথাও একটা অ্যাভালাঞ্জ ফল হলো। শহরের লালিত পালিত আমি। আমার জীবনে বা স্মৃতিতে কাল রাত্রের অভিজ্ঞতার মতো খুব বেশি কিছু আর বেঁচে থাকবে বলে মনে হচ্ছিল না। যুক্তি, তর্ক এই ১১,০০০ ফুট উচ্চতায় হিমালয়ের বুকে মনুষ্য জনবসতিহীন বিস্তীর্ণ পর্বত শ্রেণীর মাঝে আজ বড়োই অপাংক্তেয়। যুগ যুগ ধরে এখানে বিরাজমান বিশ্বাস। জিম করবেট, ‘দ্য ম্যান ইটার অফ রুদ্রপ্রয়াগ’ বইতে বলেছেন- “there are many things in nature that cannot be described by science”. ঠিক এমনই এক বিশ্বাস, যা কেবল এই মানব বর্জিত হিমালয়ের পথে মানতে ইচ্ছে করে, কলকাতার রাসবিহারী মোড়ে দাঁড়িয়ে বললে একটা নিপাট বুজরুকি গল্প ছাড়া মনে হয় না।

আমাদের ৬ জনের দল সকাল ন টা নাগাদ ৮৩০০ ফুট  জিসকুন ছেড়ে চলেছিল বুরাসকান্ডির দিকে। পাহাড়ি গ্রাম পেরিয়ে একটু এগোতেই, গ্রামের রাতায় কিচু না বলেই এসে হাজির হলো চোখ ধাঁধানো জন্মদিনের বেলুনের মতো প্রার্থনা পতাকার দল, আর আমাদের ভালো থাকার প্রার্থনা উজাড় করে দিলো নিঃস্বার্থে। রাস্তা আজ হালকা চড়াই, খানিক পর থেকেই শুরু হলো ঘন ট্রি লাইন। ঐতিহাসিক যুগ থেকে নানা ইতিহাসের সাক্ষী এই গাছগুলো। শান্ত, দৃঢ় ও অভিজ্ঞতার দম্ভে ভরা এদের গঠন। সূর্যালোককে অবহেলায় সরিয়ে রেখে ট্রেকারদের জন্য বানিয়ে রেখেছে এক শান্ত ক্যানোপি। চারিদিকে এক ঘন সবুজের অন্ধকার অবয়ব। জঙ্গলের পথ পেরিয়ে এবার নীচে নামার পালা। আজ আমরা রূপিং অভিযানে এসে এই প্রথম রূপিং নদী পেরোলাম। উচ্ছল উদ্যম বেগে রূপিং ছুটে যাচ্ছে নিচের দিকে। নদী পেরিয়ে শুরু হলো বোল্ডার জোন। ছোট, বড়, মাঝারি, চ্যাপ্টা, সরু পাথরের দল। যে যেমন পেরেছে জায়গা দখল করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে আছে। ফেলে আসা রূপিং নদী এখানে ছোট ছোট ধারায় বিভক্ত হয়ে গুটিসুটি মেরে এগিয়ে যাচ্ছে নিচের দিকে। জুন জুলাই মাসে আসলে এই সমস্ত জায়গাতেই বিভিন্ন ট্রেকারদের ক্যাম্প সাইট দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু সেপ্টেম্বরের শেষে রূপিং পাস প্রায় বন্ধ হয়ে যায়, তাই আমাদের ৬ জনের দল আর পোর্টার, গাইড ও কুক ছাড়া সমগ্র রাস্তায় আর কোনও ট্রেকারদের দেখা পেলাম না।

জীবনে অনেক জঙ্গলে, পাহাড়ে থেকেছি, ঘুরেছি, ক্যাম্প করেছি কিন্ত বুরাসকান্ডির মতন এমন সুন্দর ক্যাম্প সাইট এর আগে কখনও দেখিনি। সামনে ড্রাই রিভার বেডটাকে আড়াআড়ি পার করে রূপিং-এর একটা খরস্রোতা প্রশাখার পাশে একটা সবুজ ঘাসজমির ওপর পাইন ও দেওদার গাছ আবৃত জায়গায় আমাদের টেন্ট লাগানো হলো। আর ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডের ঠিক পেছনে নব্বই ডিগ্রি ঢাল ধরে উঠে গেছে হাজার ফুট উঁচু একটা পাহাড়ের গা। যুগযুগান্ত ধরে এই পাহাড় বোধহয় বুরাসকান্ডির স্বতন্ত্র প্রহরায় রয়েছে। এইখানেই দর্শন মিলল শ্বেতশুভ্র হিমালয়ের। নামকরণহীন নানা ছোট বড় পিক বরফের চাদর জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

সন্ধ্যা থেকে আবহাওয়ার অবনতি ঘটতে শুরু করলো, উত্তরের পাহাড়ের গা বেয়ে ধেয়ে আসছে মেঘ, বয়ে নিয়ে আসছে কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া, দেখতে দেখতে সমস্ত পরিবেশ পাল্টে গেল আধঘন্টার মধ্যেই। ঝুপ করে সন্ধে নেমে এলো পাহাড়ের বুকে। স্পষ্ট করে দূরের কিছুই আর দেখা যাচ্ছে না। সমস্ত জায়গা জুড়ে শুধু মেঘের আবরণ, সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। তাপমাত্রা এক ধাক্কায় এক ডিগ্রীর কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। গাইড এসে টেন্টের সামনে আগুন করে দিয়ে গেল আর জানালো “বাবু ইঁহাপর ইধর উধর টয়লেট মৎ কিজিয়েগা আউর রাত মে ডিনার করনে কে বাদ আকেলা মৎ ঘুমিয়েগা”, কারণ জিজ্ঞেস করতে একগাল হেসে নিজের টেন্টে চলে গেল। বৃষ্টি ভেজা কনকনে হাওয়ায় গা শিরশির করছে। নানারকম লতাপাতা, জংলি ফুলের বিস্মৃত গন্ধ ভেসে আসছে হাওয়ায়, তার সাথে ছিল কাঠের আগুনে পোড়ার গন্ধ। এমন আবহাওয়ায় বাইরে বসে থাকা যাচ্ছিল না। যে যার তাঁবুতে বসে আমরা গল্প করছিলাম। ক্রমে ঝিরঝির বৃষ্টির দাপটে জ্বালানি কাঠ ভিজে আগুন নিবে গেল। টেন্টের পর্দা সরিয়ে অবাক হয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বসে রয়েছি। অন্ধকারে দেখা যায় না বলে জানতাম এতদিন; কিন্তু অন্ধকার নিজেও যে দেখার মতো এক বস্তু যা এই ট্রেকিং-এ না আসলে জানতে পারতাম না।

একভাবে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বসে একলা রূপিং নদীর একঘেয়ে স্রোতের শব্দ শুনতে শুনতে বোধহয় একটু ঝিমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ চোখের ওপর জোরালো টর্চের আলো এসে পড়ায় ঝেড়েমেড়ে উঠলাম। আলোটা সরতেই দেখলাম আমাদের এক পোর্টার রাত্রের খাওয়ারের জন্য ডাকতে এসেছেন। শুভদা পাশের টেন্ট থেকে বলে উঠলো “ভাইয়া সাম কো আট বাজে হমলোগ কলকাত্তাওয়ালে চায়ে পিতে হ্যায় আউর তুমলোগ রাত কা খানা লাগা দিয়া?” পোর্টার কেমন যেন সংকোচ করে বলে উঠলো “বাবু, কালতক ইস টাইম মে হামলোগ বহুত কম উপর মে আতে হ্যায় আউর যো আতে হ্যায় জলদি জলদি খানা ওয়ানা খতম করকে টেন্ট পে শো যাতে হ্যায়। কৌন ঝামেলা পুহায়েগা বাবু?” বলেই সে ডাইনিং টেন্ট এর দিকে চলে গেল। কথাগুলো কেন জানিনা কানে বাজছিল আমার। কাউকে কিছু না বলে সবাইকে টেন্ট থেকে বার করে ডাইনিং এর দিকে নিয়ে চললাম রাত্রের ডিনার সারার জন্য।

বৃষ্টি কিছুটা কমেছে, ততোধিক বেড়েছে ঠাণ্ডা। টেন্টের গায়ে থার্মোমিটার ঝুলছে, তাপমাত্রা মাইনাস চার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। খেয়ে উঠে আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছি, গাইড এসে সবার টেন্টে গরম জলের বোতল দিয়ে সন্ধের সতর্ক বার্তা আবার বলে নিজের টেন্টে চলে গেল। অমিত বললো, “অনিদা, এদের কি কিছু সমস্যা আছে? সন্ধ্যে থেকে ভয় দেখিয়ে যাচ্ছে আমাদের”, আমি বললাম “না না, তেমন কিছু নয়। অজানা জায়গায় এসেছি তো, শীত পড়ে গেছে, পাহাড় থেকে জংলি জানোয়াররা নীচে নেমে আসতে পারে, সেইজন্যই সতর্ক বার্তা। তাছাড়া আর কি হতে পারে বল”!

ঠাণ্ডা বাড়তে থাকায় আর বাইরে দাঁড়ানো যাচ্ছিল না, সবাই যে যার টেন্টে গিয়ে চেন আটকে স্লীপিং ব্যাগের ভেতরে ঢুকে গেছি। আমার সঙ্গীর সাথে গল্প করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়েছি। রাত তখন কটা হবে ঠিক খেয়াল নেই, হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। কে যেন বাঁশি বাজাচ্ছে দূরে। প্রথমবার বিশ্বাস হয়নি। চোখ রোগড়ে কান খাড়া করে আবার শুনলাম- হ্যাঁ,ঠিক শুনছি, কেউ যেন বাঁশি বাজাচ্ছে দূরে। বৃষ্টি ভেজা পাহাড়ি প্রকৃতিতে সেই সুর পিছলে পড়ছে। আমার অজানা স্থানীয় কোনও ভাষায় পাহাড়িয়া কোনও গান অদ্ভুত মোনোসিলেবল্-এ বাজিয়ে যাচ্ছে বাঁশিওয়ালা। পাহাড় থেকে পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে ভেসে আসছে তার সুর। গান জানা না হলেও স্পষ্ট বোঝা যায় এই গান কোনও বিষাদের গান। এই গান কোনও বিচ্ছেদের করুণার্তি। ঝিরঝির করে আবার বৃষ্টি হচ্ছে, বাইরে, টেন্টে গায়ে তার ফিসফিসানী শব্দ শোনা যাচ্ছে। চারিদিকে চাপ চাপ অন্ধকার। কিন্তু এত রাত্রে এই ঠাণ্ডায় কে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে? আমার সাধারণ বুদ্ধিতে এর কোনও উত্তর খুঁজে পেলাম না। প্রায় দশ মিনিট ধরে সে গান আমি শুনেছি, তারপর আস্তে আস্তে সে সুর মিলিয়ে গেছে। আমি পাস ফিরে যাবার ঘুমিয়ে পড়ি।
 
ঘন্টা দেড়েক বাদে আমার সঙ্গী হঠাৎ আমায় ধাক্কা দিয়ে ডেকে বললো, “কিরে মারছিল কেন?” আমি ঘুম চোখে বললো, “কে কাকে মারছে?” ও বললো, “তুই তো মারলি আমায়”। আমি বললাম “স্বপ্ন দেখছিস নাকি? তোকে খামোখা মারবো কেন? ছোট থেকে মশা আর আরশোলা ছাড়া যে কাউকে মারেনি সে কিনা ট্রেকিং-এ এসে তোর মতো ধাড়ি শুয়োরকে মারবে?” ও বললো, “বিশ্বাস কর, কে যেন সজোরে আমাকে মারলো। একবার না, দুবার। যে কারণে আমার ঘুম ভেঙে গেল”। আমি বললাম, “ভাই, আমি নিজে ঘুমাচ্ছিলাম। তোকে কেন খামোখা মারতে যাবো বলতে পারিস?” 

আর কথা না বাড়িয়ে আমরা চুপচাপ পাস ফিরে শুয়ে রইলাম। আমরা দুজনেই এবারে জেগে আছি। এহেন রসিকতার কোনোও মানে হয় না। ভাবলাম কোনও পোর্টারের কাজ। আর একবার করুক, ধরে এক ঘ বসিয়ে দেব বাইরে গিয়ে। মিনিট পাঁচেক পর তিন নম্বর টেন্ট থেকে সৌভিক এর তারস্বরে হঠাৎ চিৎকার শুনতে পেলাম। ঋদ্ধদার গলা শুনতে পাচ্ছি। ঋদ্ধদা চিৎকার করে বলছে, “বাঁচাও, বাঁচাও... আমাদের টেন্ট তুলে ফেলে দিচ্ছে। ধড়মড়িয়ে উঠে বসে আমরা টর্চ আর ওয়াকিং স্টিক হাতড়ে বেড়াচ্ছি। শুভদাদের টেন্ট থেকেও অমিত চেঁচিয়ে উঠলো..কৌন? কৌন? হামলোগো কা টেন্ট কই ফাড় রাহা হ্যায়”! ইতিমধ্যে টর্চ জ্বালিয়ে যেই আমরা দুজনে টেন্টের ঠিক বাইরে এসেছি, দেখলাম টেন্টের আশেপাশে কেউ কোত্থাও নেই। মনোজিৎ, আমার সঙ্গী বললো, “এটা নিশ্চই কোনও পাহাড়ি ভাল্লুক নেমেছে রাতের অন্ধকারে” -বলেই আমরা সৌভিকদের টেন্টের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে পেছন ফিরে দু'জন প্রায় একসাথে দেখতে পেলাম একখণ্ড সাদা মেঘ ঠিক যেন একটা সাত আট ফুট উচ্চতার দানবীয় চেহারার মানুষের মতো আমাদের টেন্টের ঠিক পেছন দিয়ে ঘেঁষে পাহাড়ের দিকে চলে গেল। যদিও পাহাড় থেকে ক্রমাগত বুরাসকান্ডির দিকে হাওয়া ছুটে আসছিল, সেখানে একখণ্ড মেঘ কি করে হাওয়ার বিপরীতে চলে গেল, কোনও যুক্তিতেই তা আর বোধগম্য হলো না। মনোজিৎ ও আমার চোখাচোখি হলো। আমরা দুজনেই একই কথা ভাবলাম ও আমাদের শব্দহীন ভাষায় একে অপরকে সমর্থন করলাম। 

টর্চের আলোয় সৌভিকদের টেন্টটা দেখে বুঝতে পারলাম কেউ সত্যি যেন বাইরে থেকে টেন্টটাকে ঝাঁকিয়ে দিয়েছে। এত জোর সে ঝাঁকানো যে, টেন্টের একটা দড়ি পর্যন্ত ছিঁড়ে গেছে। ঋদ্ধদা ও সৌভিকের মুখে আতঙ্কের ছায়া। আমরা চারজনে মিলে শুভদাদের টেন্টের সামনে গিয়ে দেখলাম, টেন্টের গায়ে সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম আঁচড়ের দাগ। শুভদা ও অমিত বেরিয়ে এসে বললো, “না চ‍্যাঁচালে বোধহয় জানিস টেন্টটাকে আজকে ছিঁড়েই দিত। তোরা দেখতে পেয়েছিস কি ছিল?” মনোজিৎ উত্তর দিলো, “মেঘ”। সৌভিক বললো, “মেঘ? মেঘ তাঁবু ঝাঁকিয়ে দিয়ে যায় নাকি আজকাল? নাকি মেঘের নখ আছে যে টেন্টের গায়ে আঁচর কেটে দিয়ে যাবে?” মনোজিৎ খুব শান্ত কিন্তু গম্ভীরভাবে উত্তর দিলো “ভাই, যেটা দেখেছি, তাই বললাম”। আমাদের চ‍্যাঁচামেচিতে গাইড, পোর্টাররা উঠে পড়েছে। গাইড দুজন পোর্টারকে নিয়ে টর্চ জ্বালিয়ে এলো। জিজ্ঞেস করলো, “কেয়া হুয়া সাব? কুছ মুসিবত হুয়া কেয়া?” আমরা সবাই প্রায় একসঙ্গে বলতে শুরু করলাম হুড়মুড়িয়ে। শেষে সবাই সবার বক্তব্য শেষ করার পর একজন বৃদ্ধ পোর্টের বললো, “হামক পতা থা ও আয়েগা। সাল কা ইস টাইম মে ও হরবার আতে হ্যায়। উসকা খোয়া হুয়া প্রেমিকা কো খোঁজনে কে লিয়ে”। সবার কথা একসাথে বন্ধ। আমাদের ছয় জনের চোখ পোর্টার দাদার দিকে নিবদ্ধ। কি বলতে চাইছে লোকটা? আমাদের শত সহস্র প্রশ্ন যে চোখেমুখে ফুটে উঠেছে, তা যেন এই তিনজন পাহাড়ি মানুষের চোখে মুখে স্পষ্ট। পকেট থেকে একটা বিড়ি ধরিয়ে বয়স্ক পোর্টার বললেন, “আজ সে পাঁচ সাল পেহলে ব্যাঙ্গালোর সে এক টিম আয়েথে ট্রেকিং কে লিয়ে, সাব। উস টাইম মে ভি মেইনে পোর্টার বানকে আয়াথা উস টিম কে সাথ আউর হামারে সাথ গৌতম সিং নামকা এক কম উমর কা লেড়কা, ও ভি পোর্টার বানকে আয়েথে। বহুত আচ্ছা লেড়কা থা। বহুত সুন্দর বাঁশি ভি বাজাতা থা ও। উ টিম মে তিনজন লড়কা আর পাঁচজন লেড়কিলোগ ছিল, বাবু। তার মধ্যে দুজন সাদিসুদা ছিল, বাবু। সবাই খুব হাসিখুশি, খুব মজা করতো। 

আমাদের ওই কম বয়সী লেড়কাটা, গৌতম, জীবন সম্বন্ধে অনেক কিছু কল্পনা করে নিয়েছিল, লেকিন জীবনের অভিজ্ঞতা ছিল খুব কম। সে বেচারা তন্ভী বলে ওই গ্রুপের একজন বিবাহিত মেয়েকে মনে মনে কখন ভালোবেসে ফেলেছিল, তা আমরা প্রথমে কেউ টের পাইনি, বাবু। তন্ভীও বোধহয় ওকে মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছিল। আসলে আমরা নিজেরাই হয়তো ঠিক বুঝিনা, ভালোবাসি কাকে? যার অপেক্ষায় পাঁচ থেকে ছ’বছর বয়সে থাকি তাকে? নাকি যাকে ছাড়া এক পূর্ণিমার রাতও কাটতে চায় না তাকে?” 

যাহোক বাবু, সেবার জলদি জলদি শীত পরে গেছিলো আর বরফ ভি বহুত পড়েছিলো। আমাদের পুরো টিম আপার ওয়াটার ফলস থেকে রূপিং-এ সামিট করে সেদিনই রন্টিগার্ড নেমে যাওয়ার কথা কিন্তু শুরু করতে করতে একটু বেলা হয়ে গেছিল। রতিফেরি বলে একটা জায়গা আছে যেটা আপার ওয়াটার ফলস আর রূপিং টপের মাঝামাঝি একটা জায়গা। গ্লেসিয়াল ব্রিজ পার করে উপরে উঠতে হয়। তার তলা দিয়ে রূপিং-এর একটা ধারা বয়ে গিয়ে আপার ওয়াটার ফলস থেকে পনেরো'শ ফুট নীচে রূপিং নদীর সাথে মিশেছে। প্রথমে গাইড যাচ্ছিল, তার পিছু পিছু ছিল ট্রেকারদের পুরো টিম। ওদের টিমের মধ্যে তন্ভী বলে মেয়েটা ছিল সবার পেছনে। তার পেছনে ছিল গৌতম। আর গৌতমের ঠিক পিছে পিছে আমরা চারজন আসছিলাম। হঠাৎ দেখি ওই ব্রিজ পার করার সময় তন্ভী স্কিট করে নদীতে পড়ে যায়। পাহাড়ি নদী, বাবু, খুব তেজ। দেখতে দেখতে তন্ভীকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে নদী নীচের দিকে। সেই দেখে গৌতম তার কাঁধ থেকে মাল ফেলে দিয়ে ওই বরফ গলা জলে লাফ মারে। জলের স্রোতের চেয়েও বেশি ছিল ওর মনের টান, বাবু। তাই ও তন্ভীকে পাকড়ে ফেলে আর একটা বোল্ডারের খাঁজে ওকে ঠেলে তুলে দেয়। কিন্তু এই করতে গিয়ে গৌতম পা পিছলে সোজা পাহাড়ি নদীর মাঝখানে পড়ে যায়। আমাদের সব্বার চোখের সামনে ওই রাক্ষুসে ঝর্ণা গৌতমকে টেনে নিয়ে যায় নীচে। দেড় হাজার ফুট নিচে চলে যায়। 

গৌতমকে পাওয়া যায়, কিন্তু শুধু শরীর, প্রাণ পাওয়া যায় না। এক্সপেডিশন বন্ধ করে আমরা সবাই নীচে চলে আসি। গাঁয়ের লোক ছুটে আসে, পুলিশ আসে। আপনারা যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, তার থেকে পাঁচশো মিটার দূরে রূপিং-এর ঠিক এই পাড়েই ওকে পোড়ানো হয়। ওর অপমৃত্যু বলে গাঁয়ের পুরোহিত কোনও কাজ করেনি। তাই আজও এই সময়ে গৌতম বাঁশি বাজায় পাহাড়ের কোনও ঢালে বসে, আর নিজেকে সামলাতে না পেরে ছুটে আসে তাঁবুতে তাঁবুতে তন্ভীর খোঁজে”।

0 comments: