0

ধারাবাহিক - বিশ্বনাথ রায়

Posted in


ধারাবাহিক


‘যাবনী-মিশাল ভাষা’র সন্ধানে - ৩
বিশ্বনাথ রায়



বাংলার সঙ্গে সংস্কৃত, হিন্দি, ব্রজবুলি, ফারসি প্রভৃতি ভাষার মিশ্রণ ঘটিয়ে কবিতা লেখার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন ভারতচন্দ্র। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ প্রকাশিত ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনকান্ত দাস সম্পাদিত ‘ভারতচন্দ্র গ্রন্থাবলী’র শেষ দিকে যে-সব বিবিধ প্রকীর্ণ কবিতা আছে, তার মধবে সে প্রমাণ মিলবে। এরকম দু্’টি কাব্যাংশ উদ্ধার করলে বোঝা যাবে বিষয়টি:



ক.     যদি কিঞ্চিৎ ত্বং বদসি       দূর্ জানে মন্ আয়ৎ খোসি
        আমার হৃদয়ে বসি          প্রেম কর খোস্ হোয়কে।
          ভূয়ো ভূয়ো রোরুদসি          ইয়াদৎ নমুদা যাঁ কোসি
             আজ্ঞা কর মিলে বসি           ভারত ফকিরি খোয়কে।।

                                                                (মিশ্রকবিতা / চৌপদীচ্ছন্দঃ)


‘চণ্ডীনাটক’-এ চরিত্র অনুযায়ী ভাষা ব্যবহার করেছেন ভারতচন্দ্র। সূত্রধার সংস্কৃতে, নটী ও ভগবতী ব্রজবুলিতে আর মহিষাসুর হিন্দিতে সংলাপ বলেছে। যেমন – মহিষাসুরের বাক্যে ভগবতীর ক্রোধ:

ত্রিভুবন ঘুঁটত। রবিরথ টুটত। ঘনঘন ছুটত
          যেঁও পরলয়রে।                                 (চণ্ডীনাটক)


‘হাওয়া বর্ণন’-এর একটি স্তবক এবং ‘হিন্দি ভাষার কবিতা’ও ভারতীয় প্রাদেশিক ভাষা নিয়ে তাঁর কাব্যচর্চা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফসল। এ হেন বহু ভাষাবিদ্ ভারতচন্দ্র অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি নবাবি আমলে (১৭৫২) যখন তিন খণ্ডের সুবৃহৎ অন্নদামঙ্গল কাব্য লিখছেন, তখন বঙ্গদেশে য়ুরোপের বণিকরা বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করলেও পলাশীর যুদ্ধ হয়নি। পাশ্চাত্ত শিক্ষালাভ তাঁর সময়ে সম্ভব ছিল না। তবু ফরাসি ও ওলন্দাজ উপনিবেশে কিছুকাল অতিবাহিত করার ফলেতাঁর আয়ত্তাধীন হয়েছিল কিছু পশ্চিমী শব্দ। অন্নদামঙ্গল কাব্যে তার চমৎকার ব্যবহার সচেতন পাঠকের নজরে পড়বেই –

ইংরেজ ওলন্দাজ ফিরিঙ্গি ফরাস।।
দিনমার এলেমন করে গোলন্দাজী।
                                        (অন্নদামঙ্গল, দ্বিতীয় খণ্ড, গড়বর্ণন অধ্যায়)

নিজের কাব্যকে ‘নৌতনমঙ্গল’ বলে ঘোষণা করা ভারতচন্দ্রের কাছে শুধু কথার কথা ছিল না। মঙ্গলকাব্যের প্রথা ভেঙে কাব্য বিষয়ের মধ্যে যেমন তিনি নতুনত্ব এনেছেন, তেমনি নিগড়বদ্ধ ‘বাংলা ভাষাকে শাপমুক্ত করেছেন’। শেষোক্ত কথাটা পরমথ চৌধুরীর। কারণ মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে ‘অন্নদামঙ্গল’ই একমাত্র কাব্য, যেখানে বাংলা, সংস্কৃত, ফারসি, হিন্দুস্থানি ভাষা সাবলীলভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। বহুভাষাবিদ ভারতচন্দ্রের মূল লক্ষ্য ছিল বুদ্ধিদীপ্ত কাব্যরস সৃষ্টি – কাব্যভাষা নিয়ে কোনও শুচিবায়ুগ্রস্ততাকে প্রশ্রয় না দেওয়া। কাব্য-বিষয় ও ঘটনা-পরিবেশ অনুযায়ী ভাষা বদল করে নিতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ‘বিরসকথা’কে ‘সরস’ করে বলতে ভারতচন্দ্রের জুড়ি মেলা ভার। তাই কাব্যোধৃত আখ্যানের ঘটনাস্থল যখন বঙ্গদেশ থেকে দিল্লির মুঘল দরবারে স্থানান্তরিত হল, তখন তার ভাষাও গেল বদলে। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সুবেদার মানসিংহ রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ভবানন্দ মজুমদারকে নিয়ে ‘পাতশা’ ‘জাহাঁগীর’-এর দরবারে হাজির হওয়ার পর থেকেই মধ্যযুগে প্রচলিত শিষ্ট বাংলার পরিবর্তে কব্যের অনেকটা অংশ লিখিত হল বাংলার সঙ্গে আরবি-ফারসি-হিন্দুস্থানি মিশ্রিত ভাষায়। ‘মানসিংহের দিল্লিতে উপস্থিতি’ অধ্যায় থেকে শুরু করে ‘পাতশার [বাদশার] নিকট বাঙ্গালার বৃত্তান্ত কথন’, ‘পাতশাহের দেবতা নিন্দা’, ‘দিল্লীতে উৎপাত’, ‘পাতশার নিকট উজিরের নিবেদন’, ভবানন্দে পাতশার বিনয় প্রভৃতি অধ্যায়ে ভাষাবিদ্ ভারতচন্দ্র কেন কাব্যভাষা পরিবর্তন করলেন, তার কৈফিয়ৎ দিয়েছেন প্রথমেই:

মজুন্দারে লয়ে গেলা পাতশার পাশে।
ইনাম কি চাহ বলি পাতশা জিজ্ঞাসে।।
মানসিংহ পাতশায় হৈল যে বাণী।
উচিত যে আরবী পারসী হিন্দুস্থানী।।
কিন্তু সে সকল লোকে বুঝিবারে ভারি।।

                                           (– মানসিংহের দিল্লীতে উপস্থিতি)

অর্থাৎ দিল্লীর দরবারে মানসিংহ ও বাদশার মধ্যে যে ‘আরবী পারসী হিন্দুস্থানী’ ভাষায় কথাবার্তা হয়, সেই সব ভাষায় অভিজ্ঞ ভারতচন্দ্র গোটা বিষয়টি ওই ভাষাতেই ‘বর্ণিবারে’ পারতেন। কিন্তু বাঙালি পাঠকের (‘লোকে’র) পক্ষে তা হত ‘বুঝিবারে ভারি’, অর্থাৎ দুর্বোধ্য। বুদ্ধিমান কবি পাঠলব্ধ ভাষাজ্ঞান উগরে না দিয়ে ‘দুর্দান্ত পাণ্ডিত্যপূর্ণ দুঃসাধ্য সিদ্ধান্ত’কে বর্জন করেছেন। সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রে সুপণ্ডিত কবি খুব ভালো করেই জানতেন কাব্যরসের আধার হল ‘সহৃদয় পাঠক’। ‘লোক বুঝাইতে’ মালাধর-কৃত্তিবাস যেমন কাব্য লিখেছিলেন, সেই লোকসাধারণের জন্যই ভারতচন্দ্র ‘রসকথা’ ‘সরস ভাষে’ বলতে চেয়েছেন। ‘তিনি যেই মতো পড়েছিলেন সেই মতো লেখেননি কেন’, এই কথাটা যদি আমরা ঠিকঠাক বুঝতে পারি, তা হলে কাব্যভাষা সম্পর্কে তাঁর দূরদর্শিতাকে যুগান্তকারী বলতেই হবে।

দ্বিতীয়ত, ‘প্রসাদগুণ হচ্ছে ভাষার একটি বিশিষ্ট রূপ’। ভারতচন্দ্র নিজের কাব্যকে প্রসাদগুণ সম্পন্ন ও রসাল করার আন্তরিক তাগিদে ভাষার বাছ-বিচার মানেননি। কেবল পাঠকদের সমস্যা হবে, এটাই একমাত্র কারণ নয়, ‘আরবী পারসী হিন্দুস্থানী’তে লিখলে –

না রবে প্রসাদগুণ না হবে রসাল।
অতএব কহি ভাষা যাবনী মিশাল।।

সুতরাং প্রাচীন সংস্কৃত কবিদের পথ অনুসরণ করে ও রসশাস্ত্রকারদের সমর্থন নিয়ে উচ্চকন্ঠে তাঁর ঘোষণা –

প্রাচীন পণ্ডিতগণ গিয়েছেন কয়ে।
যে হৌক সে হৌক ভাষা কাব্যরস লয়ে।।
রায়গুণাকর কহে শুন সভাজন।
মানসিংহ পাতশায় কথোপকথন।।

সুকবির কাছে কাব্যরসই মূল লক্ষ্য, কাব্যভাষা নিয়ে শুচিবায়ুগ্রস্ত হওয়া তাঁর সাজে না।

প্রমথ চৌধুরী ‘ভারতচন্দ্র’ শিরোনমে লিখেছিলেন কেবলমাত্র তাঁর কবিত্বশক্তির মূল্যায়ন ও অশ্লীল কবির অপবাদ দূরীকরণের জন্য নয়, তাঁর প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে উত্তরণের কালে ভারতচন্দ্রকে যুগান্তকারী ভাষাশিল্পীর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা। ‘বাংলা ভাষাকে শাপমুক্ত করে’ ‘প্রাণবন্ত সর্বাঙ্গসুন্দর’ রূপ দেওয়া তাঁর অন্যতম কীর্তি। ভারতচন্দ্রকে কৃষ্ণনাগরিকতায় ঋদ্ধ ‘জাতকবি’র অভিধায় ভূষিত করে তিনি লিখেছেন, ‘‘অমন সরল ও তরল ভাষাতাঁর পূর্বে আর কেউ লিখেছেন বলে আমি জানিনে।’’

ভাষার ক্ষেত্রে ভারতচন্দ্রের এই নাগরিক মনস্কতা ভুরশুট-মান্দারন থেকেই লব্ধ, পরে তার পরিণত রূপের প্রকাশ ঘটেছে কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভায়। সুতরাং ‘গুণাকর কবির’ ভাষায় গুণপনায় সমৃদ্ধ কাব্যটির ‘কারুকার্য’ ও ‘উজ্জ্বলতা’ রবীন্দ্রনাথেরও দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না।

সুপ্রসন্ন ভাষাই হচ্ছে প্রসাদগুণ সম্পন্ন ভাষা। ‘যাবনী মিশাল’ গুণাকরী বাংলায় সেই রসাল প্রসাদগুণের অভাব নেই অন্নদামঙ্গলের তৃতীয় খণ্ডের দিল্লি আখ্যান থেকে কয়েকটি দৃষ্টান্ত নিলেই তা বোধগম্য হবে:

ক. পাতশা কহেন শুন মানসিংহ রায়।
গজব করিলা তুমি আজব কথায়।।

* * * * *

সয়তানে বাজী দিল না পেয়ে কোরাণ।
ঝুটমুট পড়ি মরে আগম পুরাণ।।

* * * * *

ভাতের কি কব পান পানীর আয়েব
কাজী নাহি মানে পেগম্বরের নায়েব।।
আর দেখ নারীর খসম মরি যায়।
নিকা নাহি দিয়া রাঁঢ় করি রাখে তায়।। 

                               (– পাতশাহের দেবতা নিন্দা)


খ.      অরে রে নিন্দুক পুত                       দেখলাও কঁহা ভূত
                 নাহি তুঝে করুঙ্গা দোটুক।
নাহোয় সুন্নত দেকে            কলমা পড়াঁও লেকে
                        জাতি লেঁউ খেলায়কে থুক।। 
                                                            (– দাসুবাবুর খেদ)



গ.     বিবীরে পাইল ভূতে প্রলয় পড়িল।
             পেশবাজ ইজার ধমকে ছিঁড়া দিল।।
             চিতপাত হয়ে বিবী হাত পা আছাড়ে।
              কত দোয়া দবা দিনু তবু নহি ছাড়ে।।
              শুনি মিয়া তসবী কোরাণ ফেলাইয়া।
            দড় বড় রড় দিল ওঝারে লইয়া।।
            ভূত ছাড়াইতে ওঝা মন্ত্র পড়ে যত।
                বিবী লয়ে ভূতের আনন্দ বাড়ে তত।।
               অরে রে খবিস তোরে ডাকে ব্রহ্মদূত।
                 ও তোর মাতারি তুই উহারি সে পুত।।
            কুপী ভরি গিলাইব হারামের হাড়।
                                  ফতমা বিবীর আজ্ঞা ছাড় ছাড় ছাড়।। 

                                                                   (– দিল্লীতে উৎপাত)


‘অন্নদামঙ্গল’-এর এই সব কাব্যাংশে ভারতচন্দ্র-কথিত ‘যাবনী মিশাল’ ভাষাই ‘ইসলামী বাংলা’ বা ‘মুসলমানী বাংলা’ বলে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষদিক থেকে অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দী জুড়ে কলকাতা ও তৎপার্শ্ববর্তী অঞ্চলে শ্রমজীবী মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। আবার দক্ষিণ-রাঢ়ের ভুরশুট-মান্দারনকে কেন্দ্র করে পার্শ্ববর্তী বালিয়া, মণ্ডলঘাট প্রভৃতি পরগনাতেও এই ভাষাকে অবলম্বন করে একটা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছিল উচ্চবর্গের মুসলমান সমাজে। ‘আরবী-ফারসী-হিন্দুস্থানী’ মিশ্রিত এই ‘যাবনী মিশাল’ কথ্য বাংলা চমৎকার কাব্য-ভাষা হয়ে উঠতে পারে এবং তাতে বিন্দুমাত্র কব্যরসের বিঘ্ন ঘটে না; প্রথমোক্ত অঞ্চলে কবি কৃষ্ণরাম এবং তারপরে শেষোক্ত অঞ্চলের ‘বাকপতি’ কবি ভারতচন্দ্রের হাতে তা প্রমাণিত হওয়ায় এই ভাষাকে অবলম্বন করে অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়া্র্ধ থেকে খুলে যায় নতুন একটি সাহিত্যধারার অভিমুখ। পরবর্তীকালের গবেষকরা এই ভাষাকে বিচিত্র নামে অভইহিত করলেও অষ্টাদশ শতাব্দীতেই এই ভাষার চরিত্র-বৈশিষ্ট্য বিচার করে যথার্থ নামকরণটি করেছেন ভাষাবিদ্ ভারতচন্দ্র – ‘অতএব কহি ভাষা যাবনী মিশাল’। ‘যাবনী মিশাল’ ভাষাও আসলে ‘হিন্দুস্থানী’ ‘উর্দু’র মতোই বিশেষ একটি কালপর্বে বাংলা ভাষায় প্রচলিত ‘লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা’ (Lingua Franca)।



0 comments: