0

প্রবন্ধ - হিমাদ্রি মুখোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ


অগ্নিশিখা এসো এসো
হিমাদ্রি মুখোপাধ্যায়



একটাই তো সত্যিকারের প্রেম। একটাই বই। গীতবিতান। এক জীবনের পক্ষে যথেষ্ট। ভুল বললাম বুঝি! অনেক অনেক জীবনের পক্ষেও কি যথেষ্টের চেয়ে বেশি নয়? কোন প্রহরশেষের রাঙা আলোয় তার চোখে যে আমার সর্বনাশ দেখেছিলুম আজ মনে পড়ে না আর, তারপর কত কত পৌষ ফাগুনের পালা পার হয়ে এই দিনান্তবেলায় পৌঁছেছি। এরই মধ্যে কতবার রং বদলালো তার গান প্রেমে-অপ্রেমে, আনন্দে-বেদনায়। কতবার পালটে গেল গানের মানে, শব্দের দ্যোতনা—

বর্ষায়, বসন্তে, আলিঙ্গনে, প্রত্যাখানে, মিলন আর বিরহের অবিরাম, অবিশ্রাম ধারাস্রোতে। আরও যদি বেঁচে থাকি কিছুদিন, ধরা যাক আরো এক কুড়ি, সেদিনেও, এই কুড়ি-কুড়ি বছর পার হয়ে যাওয়া রিক্ত হেমন্তের শষ্যক্ষেত্রে দাঁড়িয়েও মনে কি হবে না, অন্ত পাওয়া গেল না তোমার কিছুতেই, তোমারই গানের কলি তোমাকেই কি ফিরিয়ে দিয়ে বলে যেতে হবে না - "মধুর তোমার শেষ যে না পাই"? "হার মানা হার"? বেশ তো। এটুকুই না হয় এবারে দিয়ে গেলুম। আমার প্রেম, আমার পূজা, আমার সমর্পণ তোমার যূথীমালিকার মৃদু গন্ধে নাহয় আরো কিছুকাল ধরা থাক।কতবার যে শুনেছি গানটা। "অগ্নিশিখাএসো এসো"...বড়ো প্রিয় গান আমার। আলো ভালোবাসি আশৈশব। তাই আলোর গানে আমার মুগ্ধতা অশেষ। উপনিষদের "তমসো মা জ্যোতির্গময়" মন্ত্রে আলোকের জন্য যে প্রার্থনা উচ্চারিত হয়েছিলো একদিন, রবিঠাকুরের গানে তা যেন পরিণত হয়েছে এক কার্নিভালে। গানে গানে অফুরাণ আলোকবন্দনা। রুদ্ধদ্বার অচলায়তনের প্রাচীর যেদিন ভেঙে পড়ে,আর আলোয় ধুয়ে যায় অন্ধ সংস্কারের অর্থহীন জঞ্জাল,তখন কী উল্লাসেই না বালকেরা গেয়ে উঠেছিলো-- "আলো আমার আলো ওগো আলোয় ভুবন ভরা..."। শুধু কী তাই, "আলো যে আজ গান করে মোর প্রাণে গো...", "আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও...", "আলোর অমল কমলখানি..."। সত্যিই "আলোয় আলোকময়" হয়ে আছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের রাজপথ। আর আলোর অনুষঙ্গে যদি ভাবি আগুন আর প্রদীপের কথা, তাহলে "আগুনের পরশমণি" থেকে "হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে"... কত যে আলোর গান লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ "ও তার অন্ত নাই গো নাই"। তেমনি আজ বারবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শুনে যাচ্ছিলাম ইউটিউবে... অগ্নিশিখা এসো এসো... বার দশেক তো বটেই...বার কুড়িও হতে পারে... এভাবেই গান শুনি আমি -- কতদিন কলেজ কামাই হ'য়ে যায় -- স্নান খাওয়া পড়ে থাকে, আজও যেমন পড়ে রইলো মৌসুমীর বসন্ত সংখ্যার কাগজের জন্য ফরমায়েসি লেখা (মেয়েটা বোধহয় এরপর আমাকে মেরেই ফেলবে)। পেরিয়ে গেলো ইলেকট্রিক বিল জমা দেওয়ার শেষ দিন,আর আমি অবিরাম শুনেই চলেছি আনুষ্ঠানিক পর্যায়ের ১৭ সংখ্যক গান- ১৯২৩ সালে লেখা ইমনকল্যাণাশ্রয়ী অগ্নিবন্দনা -- কখনো অচেনা কোনো কন্ঠে,কখনো বা রাধারাণী দেবীর অপরূপ ধ্রুপদী গায়ন ভঙ্গিমায় ----

               অগ্নিশিখা, এসো এসো, আনো আনো আলো।
               দুঃখে সুখে ঘরে ঘরে গৃহদীপ জ্বালো॥ 
       আনো শক্তি, আনো দীপ্তি,         আনো শান্তি, আনো তৃপ্তি,
               আনো স্নিগ্ধ ভালোবাসা, আনো নিত্য ভালো॥
               এসো পুণ্যপথ বেয়ে এসো হে কল্যাণী
               শুভ সুপ্তি, শুভ জাগরণ দেহো আনি। 
         দুঃখরাতে মাতৃবেশে               জেগে থাকো নির্নিমেষে
               আনন্দ-উৎসবে তব শুভ্র হাসি ঢালো॥

আর এই প্রথম খটকা লাগলো আমার। এ গান কি আদৌ কোনো আলোকবন্দনার গান? আক্ষরিক অর্থও যদি বিবেচনা করি, এই গান, কি সত্যিই অগ্নিশিখার কোনো আবাহন? যদি তাই হয়, "দুঃখে সুখে ঘরে ঘরে" কেবল গৃহদীপখানি জ্বালিয়ে দিয়ে যাওয়া তো আগুনের কাজ নয়। খাণ্ডবদাহন হলে বোঝা যেতো না হয়, কিন্তু কেবলই তৃপ্তিকর কোনো প্রদীপশিখা জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য, একটা দেশলাইকাঠি হলেই যেখানে চলে যায়, সেখানে স্তোত্রোচিত এরকম একটা গান লিখে ফেলা বড়োই বাড়াবাড়ি হয়ে যায়না কী? তরোয়াল দিয়ে শেভিং করার মতো কোনো বদভ্যাসের কথা রবীন্দ্রজীবনীকারেরা তো তাঁর সম্পর্কে লিখে যান নি কখনো। অগ্নিশিখা শক্তি আনে, দীপ্তিও, এটুকু আমরা জানি সকলেই, কিন্তু শান্তি, তৃপ্তি আর স্নিগ্ধ ভালোবাসা কি হতে পারে কখনো আগুনের চরিত্রলক্ষণ, আর "কল্যাণী" কি আদৌ হওয়া সম্ভব দূরকল্পনাতেও অগ্নির কোনো সম্বোধন, তা সে দাবানল বা হোমানল যাই হোক না কেন? আর তখনই অতর্কিত বিস্ময়ে আমরা আবিস্কার করি, এই অগ্নিশিখার গান আসলে আগুন নয়, নারীকে নিয়ে লেখা। অগ্নিশিখা এসো এসো- আসলে নারীরই বন্দনাগীতি -- সেই নারী যিনি একই সঙ্গে কল্যাণী এবং দনুজদলনী, একই সঙ্গে যিনি হতে পারেন জোন অফ আর্ক এবং ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গল -- সংহিতা যাঁকে বলেছেন, পূজনীয়া এবং গৃহের দীপ্তি স্বরূপা, "পূজার্হা গৃহদীপ্তয়ঃ"। ভেবে দেখুন, তিনিই কি শুভ্রহাস্যে নন্দিত করে তোলেন না আমাদের সব উৎসবের দিন, আবার দুর্যোগে দুর্দিনে, আমরা তাঁকেই কি দেখি না "দুঃখরাতে মাতৃবেশে জেগে থাকো নির্নিমেষে"? এ গান তাই কখনো হতে পারে না কেবলই অগ্নিশিখার কোনো আবাহন, যদি না সেই অগ্নিশিখা হয়ে ওঠেন যুগপৎ জায়া এবং জননী, ভগিনী এবং দুহিতা, রক্তকরবীর নন্দিনী এবং মার্কণ্ডেয় চন্ডীর "ত্বমেব সন্ধ্যা সাবিত্রী, ত্বং দেবী জননী পরা"। কত আলতো ভাবেই যে সারা জীবন শুনে আসছি রবীন্দ্রনাথের গান! কত ভুল ব্যাখ্যাই না করে চলেছি আপাত সরল কিন্তু বিপজ্জনকভাবে রহস্যময় তাঁর অক্ষরমালার। বয়েস বাড়ছে। ভয় বাড়ছে আরো। চল্লিশ বছর তাঁকে নিয়েই তো আছি, কিন্তু "মায়ার খেলা"র সখীদের মতো আজও যে কেন বারেবারেই বলতে হয় -- "ওরে বোঝা গেল না -- চলে আয়, চলে আয়"?


0 comments: