0

ছোটগল্প - জয়িতা সরকার

Posted in


ছোটগল্প


রোদ্দুর
জয়িতা সরকার



সবে এপ্রিল মাসের দশ তারিখ। এখনই যা গরম! দুপুর বেলায় প্রায় লু বইছে।

ভাগ্যিস এ টি এম-এর সিকিউরিটির চাকরিটা এই সময় জুটে গেলো। দুপুরটা সারাটা দিন ওই এসির মধ্যেই কেটে যায়। বিমলের শিফট সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যে ৬টা। বাড়ি থেকে প্রায় দেড় ঘন্টার দূরত্বে এস. বি. আই-এর এই এ টি এম টা। যাতায়াত করে আর কতটুকুই বা হাতে থাকে! তাও মন্দের ভালো।একদম বেকার অবস্থার থেকে।

বাবা-মা প্রায় উনিশ দিনের ব্যাবধানে যখন মারা যায় তখন বিমলের বয়স সতেরো। সেই থেকে দাদার সংসারে। ভাইঝিটার আজকাল বেশ নাম ডাক হয়েছে সদ্য রিয়েলিটি শো-র কল্যাণে।

বাড়িতে আজকাল বেশ নানান রকম লোকের আনাগোনা। ওর পরিচয় দিতে যে সবাই স্বচ্ছন্দ নয়, তা বেশ ভালোই বোঝে বিমল। তাই প্রায় না থাকার মতনই মিশে থাকে ওদের সংসারে। সেই কোন সক্কালে বেরোয়। ফিরতে ফিরতে মাঝ রাত। শুধু ঘুমনোর সময়টুকু ছাড়া দাদা-বৌদির সংসারের সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় নেই বললেই চলে।

তাও যদি বাড়িটা বাবা না রেখে যেতো, এতদিনে হয়তো সেখান থেকেও পাট চুকাতে হতো।

দুপুর তিনটে। এসির ঠাণ্ডা হাওয়ায় একটু যেন ঝিম লেগে গিয়েছিলো বিমলের চোখে...

এক ভদ্রমহিলা প্রায় ঝড়ের গতিতে এ টি এম-এ ঢুকলেন। মুখটা প্রায় পুরোটাই বাঁধা, মাথায় হেলমেট। চোখে ঢাউশ সানগ্লাস।

‘‘ম্যাডাম, হেলমেটটা খুলে ঢুকবেন প্লিজ। আর রুমালটাও।’’ বলে বাইরে বেরিয়ে এলো বিমল।

‘‘আচ্ছা।’’ বলে উনি ভেতরে ঢুকে গেলেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ভেতরে ডাক পড়লো।

‘‘একটু আসবেন প্লিজ।’’

বিমল দেখে যা বুঝলো, লিংক ফেল। কিন্তু ভদ্রমহিলাকে যেন খুব চেনা মনে হচ্ছে...

‘‘আপনি একটু অপেক্ষা করতে পারেন ম্যাডাম। হয়তো খানিকক্ষণের মধ্যেই লিংক চলে আসবে। আজ সকাল থেকেই বারবার এরকম হচ্ছে।’’

‘‘চলে আসবে বলছেন? আচ্ছা, তাহলে একটু অপেক্ষা করেই যাই।’’

বিমল যেন এতক্ষণে আন্দাজ করতে পারলো ভদ্রমহিলাকে।

‘‘ম্যাডাম যদি কিছু মনে না করেন, একটা প্রশ্ন করতে পারি?’’

‘‘হ্যাঁ করুন।’’

‘‘আপনার নাম কি সুনন্দা রায়? বিধান পল্লীতে থাকতেন? আপনার বোনের নাম কি জুঁই?’’

ভদ্রমহিলা খুব অবাক হয়েই বললেন, ‘‘হ্যাঁ আমি সুনন্দা। আপনি আমায় চেনেন? দাঁড়ান দাঁড়ান! আপনাকে কোথায় যেন দেখেছি মনে হচ্ছে। খুব চেনা মুখ,কিন্তু কিছুতেই...।’’

‘‘আমি বিমল রে। মনে আছে, শিবেন স্যার আমাদের বাড়িতে কোচিং ক্লাস করাতে আসতেন? তুই আর তোর বোন জুঁইও আসতি। সেই সিক্স, সেভেন তখন।’’

‘‘আরে, বিমল তুই? কেমন আছিস। আর তোর অমন সুন্দর কোঁকড়ানো চুলগুলো উধাও হল কি করে? কাকু কাকিমা কেমন আছেন?’’

‘‘বাবা-মা মারা গেছেন রে। সেও প্রায় একযুগ। তুই কিন্তু একদম পাল্টাস নি সুনন্দা, তাই তোকে চিনতে আমার একটুও অসুবিধে হয়নি।’’

সুনন্দা যেন এবার একটু লজ্জাই পেলো। ‘‘ধুর! কি যে বলিস! আমার মেয়ের বয়সই এখন ছয়। বিয়ে হয়েছে প্রায় দশ বছর। স্কুলে চাকরিও প্রায় বারো বছর। তোর খবর কি? তুই এ টি এম-এ, এই পোশাকে? এত ভালো ফুটবল খেলতি, আমি যে কিছুই মেলাতে পারছি না।’’

‘‘আসলে তোদের মত ভালো স্টুডেন্ট তো ছিলাম না কখনও। তোর হয়তো মনে নেই, কতদিন তোর খাতা থেকে অংক করে শিবেন স্যারের মারের হাত থেকে বেঁচেছি। তারপর বাবা, মা মারা গেলো। পড়াও বন্ধ হয়ে গেলো। পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়লো। ব্যাস, খেলাও বন্ধ। আজ এটা কাল সেটা, শেষে এখন এ টি এম-এর গার্ড... যাক গে, আমার কথা ছাড়। আর কার কার সাথে যোগাযোগ আছে তোর? প্রত্যুষের খবর কি রে?’’

‘‘ও তো এখন অস্ট্রেলিয়ায়, বিরাট চাকরি করে। এই তো সেদিন ফেসবুকে গ্লেন ম্যাকগ্রার সঙ্গে ছবি পোস্ট করলো। স্টুডেন্ট লাইফে কেউ ভাবেওনি এত ওপরে যাবে ছেলেটা।’’

‘‘আর পাপিয়া?’’

‘‘বুঝেছি, যাকে চোখে হারাতি তো? ও এখন মস্ত ডাক্তার। ওর ফোন নাম্বার দিয়ে যাবো, কোনও অসুবিধে হলে যোগাযোগ করিস নিজের পরিচয় দিয়ে।’’

‘‘কি যে বলিস! তুই যে আমার সাথে কথা বলবি, আমি কি তাও ভেবেছিলাম নাকি? কোথায় তোরা, আর কোথায় আমি!’’

‘‘সায়ন্তনীর ছবি দেখলাম, বরের সাথে সুইজারল্যান্ড-এ গেছে গরমের ছুটি কাটাতে। অমিত এখন জে এন ইউ-তে পড়ায়। ফেসবুকের কল্যাণেই যা যোগাযোগ পুরনো বন্ধুদের সাথে। নইলে কার আর সময় আছে বলতো পুরনো দিনের মতন আড্ডা দেওয়ার? পৃথিবীর এক এক প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছি আমরা।’’

বিমল মৃদু গলায় বললো,‘‘জানিস, মৃদুলকে মাঝে মাঝে টিভি তে দেখি। ওর খেলা গুলো একটাও মিস করিনা। কিন্তু কখনও কাউকে বলিনা আমরা বন্ধু ছিলাম। একক্লাসে পড়তাম। আমি বরাবর ব্যাকে খেলতাম, আর ও ফরোয়ার্ড। ওর বলটা আটকাতে পারলাম না রে। শেষে নিজেই মাঠের বাইরে বেরিয়ে গেলাম।’’

খুব মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো সুনন্দার। বললো,‘‘থাক না এসব। এবার অন্য কথা বল।’’

পুরনো দিনের কথাগুলো বলতে বলতে একটা অদ্ভুত ঔজ্জ্বল্য ফিরে আসছিলো বিমলের চোখে মুখে। সুনন্দারও মন ভালো হয়ে যাচ্ছিলো।

বিমল ডাকলো,‘‘এই, লিংকটা বোধহয় এসে গেছে। তুই টাকাটা তুলে নে। তারপর একটা কথা বলবো, মানে একটা অনুরোধ, যদি তুই রাখিস।’’

‘‘কি বলনা।’’

‘‘না রে, আগে টাকাটা তুলে নে। নইলে আবার লিংক ফেল হয়ে যেতে পারে।’’

মনে একটা খচখচানি নিয়ে এ টি এম-এর ভেতর ঢুকল সুনন্দা। কি বলবে বিমল? টাকা ধার চাইবে নাকি?

হয়ত হাজার খানেক চেয়েই বসবে। একদম না করে দেবে মুখের ওপর। যেমন বাজে স্টুডেন্ট তার তেমনি চাকরি। নাহ্, এই এ টি এম-টায় আর আসা যাবে না।

‘‘কি রে, টাকা পাসনি?’’

‘‘না, পেলাম তো।’’

‘‘তাহলে মুখটা অমন করে রেখেছিস কেন?’’

‘‘তুই কি বলবি বলছিলি, আমার একটু তাড়া আছে।’’

‘‘আচ্ছা, একটু আড়ালে আয়। এখানে বলা যাবেনা। কেউ এসে যাবে।’’

‘‘কি বলবি বল না, এত ভনিতা করছিস কেন? দেখ, আমার মেয়ের স্কুল থেকে ফেরার সময় হয়ে গেলো।’

‘‘হ্যাঁ রে, জানি, তোদের খুব তাড়া।’’

নিজের রূঢ় ব্যবহারে এবার নিজেরই খারাপ লাগল সুনন্দার। ‘‘আচ্ছা বল, কি বলবি।’’

খুব ধীরে ধীরে বললো বিমল। ‘‘জানিস, অনেকগুলো বছর তো এমনিই কেটে গেলো। খেলার মাঠটাও হারিয়ে গেলো। একটা সংসারের বড্ড সাধ হয়। দেখবি আমার জন্য একটা মেয়ে? খুব সাধারণ। একদম ঘরোয়া। এক কাপড়েই যদি কেউ আসে... আমার যেটুকু সামর্থ্য, তার কোনও অনাদর হবেনা। এখন মনে হয় বাড়ি ফিরলে যদি কেউ অপেক্ষা করতো...’’

সুনন্দার বুকের ভেতরটা কেমন দুমড়ে মুচড়ে যেতে লাগলো। ‘‘নিশ্চয়ই দেখবো রে। তোর ফোন নাম্বারটা দিয়ে রাখ আমায়।’’

বিমল খুব লজ্জা পেয়ে বললো, ‘‘না রে, তোরা ব্যস্ত মানুষ, কখন সময় হবে বলিস, আমিই তোকে ফোন করে নেবো।’’

‘‘আমি তোর বন্ধু, এটা কখনো ভুলিস না। তোর যখন ইচ্ছে তখন আমায় ফোন করবি। আজ আসি রে। মেয়েটা বোধহয় ফিরেই গেছে স্কুল থেকে।’’

‘‘তুই দাঁড়া, আমি স্কুটিটা এগিয়ে দিচ্ছি।’’ বললো বিমল।

মনটা ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছিলো সুনন্দার। চোখে জল।

যেতে যেতে একবার পেছনে ফিরলো। দেখলো, বিমলের চোখে মুখে শূন্য থেকে শুরুর অদ্ভুত প্রত্যয়। যেন ভবিষ্যতের মধ্যেই সে রেখে যেতে চায় তার যাবতীয় স্বপ্নের বীজকে। তার রোদ্দুরকে...

এও বা কম কি? আরেকটা নতুন জীবন নতুন ভাবে...

নিজেই গুনগুন করে উঠলো...

"ভয় নাহি, ভয় নাহি                গগনে রয়েছি চাহি।
জানি ঝঞ্ঝার বেশে                    দিবে দেখা তুমি এসে
                    একদা তাপিত প্রাণে রে।"

0 comments: