ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
জল রেখা ৬
নন্দিনী সেনগুপ্ত
‘‘আরে অফিসারবাবু, আসুন আসুন! কদ্দিন পরে আপনার পায়ের ধুলো পড়ল’’... জিপ থেকে নামতে নামতে নিরূপ শুনতে পেল উষ্ণ অভ্যর্থনা। ভুরু কুঁচকে উঠল, যদিও একচিলতে হাসি লেগে রইল নিরূপের ঠোঁটের কোণায়। দৃঢ়পায়ে এগিয়ে গেল স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বারান্দায়, যেখান থেকে আসছে এই আওয়াজ। সরমা, ডঃ সরমা চৌধুরী এগিয়ে এলেন। ছিপছিপে গড়ন, চল্লিশ ছুঁই ছুঁই সরমাকে দেখলে যে কেউ কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীবলে ভুল করতে পারে, তাঁর মুখের কমনীয় ভাবের জন্য। কিন্তু ভাল করে দেখলে নজরে পড়ে যে তাঁর ঝকঝকে চোখ আর সুগঠিত চিবুক চেহারায় একটা বাড়তি ব্যক্তিত্ব যোগ করেছে।
নিরূপ মৃদু হাসি হেসে বলে, ‘‘এ আবার কিরকম কথা সরমাদি? তুমি আমাকে এভাবে ‘আপনি’ ‘আজ্ঞে’‘অফিসারবাবু’ এসব করছ কেন?’’
সরমা একটু গাম্ভীর্যের ভাব মুখে এনে বলে, ‘‘না, না, আমি এবার থেকে আপনি আজ্ঞে করেই বলব ঠিক করেছি। সেই যে দেওয়ালির সময় ক্লাবের পুজায় দেখা হয়েছিল, তার পরে আর কোনও দেখা নেই আপনার। আমার বাড়িতে সরস্বতীপুজায় আপনাকে নিমন্ত্রণ জানালাম। ক্যাম্পে চিঠি পাঠালাম নীলকণ্ঠর হাত দিয়ে। আপনি ব্যস্ত মানুষ।কাজে আটকে গেছেন বুঝলাম। কিন্তু আর না কোনও খবর, না কোনও বার্তা। না না... আপনি বুঝিয়ে দিয়েছেন আপনি খুব দূরের মানুষ।’’ এতগুলো কথা একটানা বলে সরমা একটু চেষ্টা করে মুখের হাসি লুকিয়ে ফেলে।
নিরূপ মাথা ঝুঁকিয়ে অপ্রস্তুতভাবে হাত বোলায় নিজের টিকলো নাকে, তারপর শব্দ করে হেসে ফেলে, হাসতে হাসতেই বলে, ‘‘উফফফ... কি করব বল, ফিল্ডে ছিলাম তো। বনে জঙ্গলে আদাড়ে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। আমি কি আর সভ্য মানুষ যে এইসব শহুরে নিয়মকানুন মেনে কাজ করি?তুমি এককথায় বলতে পারো যে আমি একটা জংলী। জংলীমানুষ এইসব পূজাপাঠে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এলে তোমার বাকি নিমন্ত্রিতরা ভয়ের চোটে পালিয়ে যেত। সেটা খুব ভাল হত কি? তার চেয়ে আমি আসিনি... এইই ভাল হয়েছে।’’
‘‘যাক গে, কোনটা ভাল আর কোনটা খারাপ এই বিচার পরে হবে। এখন বলে ফেলা হোক কি কারণে এদিকে আসা হল?’’সরমার ভাববাচ্যে কথা বলা দেখে নিরূপ বুঝতে পারে এখনও রাগ পড়েনি। আমতা আমতা করে বলে, ‘‘সেরকম কিছু নয়। আসলে দুদিন আগে ফিল্ডে কাজ করতে গিয়ে মাথাটা একটু ঘুরে গিয়েছিল আমার, মিনিটখানেক মত ব্ল্যাকআউট ছিল। হয়তো খাওয়াদাওয়ার গণ্ডগোল থেকে অ্যাসিডিটি, এসব থেকেও হতে পারে। তবুও একবার তোমার কাছে এলাম... একটু প্রেসারটা চেক করেই দাও। আগামীকালের মধ্যে এখানকার অফিসের কাজও শেষ হয়ে যাবে। পরশু ক্যাম্পে ফিরে যাবো। ভাবলাম একটু চেক আপ করেই যাই।’’
সরমা ব্যস্ত হয়ে ওঠে...‘‘আরে আগে বলবে তো! যাও যাও সোজা চেম্বারে চলে যাও।’’
নিরূপ ইতস্তত করে, ‘‘কিন্তু সরমাদি, এত পেশেন্ট বাইরে বসে আছে, এদের টপকিয়ে তুমি আমাকে আগে দেখে দেবে? এটা কি ঠিক হবে? তার চেয়ে আমার কিছু কাজ আছে, আমি সেরে আসি। তুমি আরও ঘণ্টাখানেক আছ তো? আমি বরং ঘুরেই আসি।’’
সরমা হেসে বলে, ‘‘ঠিক আছে। সেটাই ভাল হবে। আমারও হাত ফাঁকা হয়ে যাবে ততক্ষণে। কিছুক্ষণ বাংলায় আড্ডা দেওয়া যাবে তোমার সঙ্গে। ঘুরে এসো।’’
পাথুরে জমির রুক্ষতা, তার সামনে পলাশের আগুনরঙের উল্লাস মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছিল নিরূপ। ফিরে এসে অপেক্ষা করছিল স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বারান্দায়। সব রুগী দেখিয়ে চলে যাওয়ার পরে সরমার অ্যাসিস্ট্যান্ট শনিচারী এসে ডেকে নিয়ে গেল নিরূপকে চেম্বারে।
প্রেসার চেক করতে করতে প্রশ্ন করে সরমা, ‘‘তুমি কি কিছু প্রেসারের ওষুধ খাচ্ছ নিয়মিত?’’
নিরূপ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে, ‘‘না... মানে আমার তো প্রেসার কোনওদিন ছিলনা। তাই ওষুধ কিছু খাইনা।’’
সরমা বলে, ‘‘না, তাহলে এখন খাবার দরকার নেই। তোমার যা বয়েস, সেই তুলনায় তো আপাতত প্রেসার ঠিকই আছে। তবে ঐ মাথা ঘোরা এবং ব্ল্যাকআউট কিন্তু স্পনডিলসিস থেকেও হতে পারে। তুমি পরশু ক্যাম্পে ফিরবে বলছ? এক কাজ কর, একটা এক্স রে করে নাও। আমাদের এখানেই হয়ে যাবে। আজ তো প্রায় বেলা গড়িয়ে গেল, আজ হবে না। আগামীকাল আমি ত্রিপাঠীজিকে বলে রাখছি। অফিস যাবার পথে ঘাড়ের এক্স রে একটা করিয়ে নাও। বিকেলের মধ্যে রিপোর্ট হয়ে যাবে। তাহলে একেবারে নিশ্চিন্ত হয়ে ক্যাম্পে যাও।’’
নিরূপ হাসে, ‘‘আচ্ছা সরমাদি একটা কথা বলবে? তোমরা ডাক্তাররা এত ভয় দেখাও কেন সবকিছুতে?’’
সরমাও হাসে, ‘‘এতে ভয়ের কি দেখলে তুমি? শুধু নিশ্চিন্ত হওয়া। ভাবো তো, এই গণ্ডগ্রামে ভয় দেখিয়ে কি ডাক্তারি করা সম্ভব? উল্টে গ্রামের লোকজন এসে আমাকেই মেরে ধরে রেখে যাবে।’’
নিরূপ গম্ভীর হয়ে বলে, ‘‘তা বটে! আচ্ছা... একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম বারান্দায় বসে অপেক্ষা করতে করতে। যেসব রুগী এসেছিল, এদের মধ্যে অনেকেরই ঐ বাঁকা হাঁটুর অসুখ। কি যেন বল তোমরা ডাক্তারি ভাষায়... নক-নী... না কি যেন... ঠিক মনে পড়ছে না। আমি ফিল্ড করতে করতে কোনও কোনও গ্রামে এরকম মানুষ দেখেছি। এই এলাকায় কি এই অসুখটাবেশি হয়? সেটা কেন?’’
‘‘হ্যাঁ,নক- নী বা জেন্যু ভালগাম, এটা এই অসুখের নাম।’’ চিন্তিত মুখে বলে সরমা...‘‘হ্যাঁ, এটাই এখন প্রধান সমস্যা এই অঞ্চলের। পুর্নাপানিরদিক থেকে প্রচুর রুগী আসে। আর সার্জারি ছাড়া সেভাবে এটার পার্মানেন্ট রিলিফ হওয়া মুস্কিল। এখানকার গরিব মানুষরা সেটা অ্যাফোর্ড করতে পারেনা। শিশুবয়স থেকে ঠিকঠাক চিকিৎসা হলে তাও একরকম, কিন্ত... এখানে সচেতনতার অভাব আছে। আর, আমি তো বেশীদিন এখানে আসিনি। এগুলো স্পেশালিষ্ট ডক্টর দেখলে ভাল, বিশেষ করে অর্থোপেডিক। আমি গাইনি, কিন্তু কি আর করা! গরিব লোক কোথায় যাবে? ফেরাতেও পারিনা। খুব অসহায় লাগে নিজেকে। বেশী ডিফরমিটি দেখলে শহরে রেফার করি। কিন্তু ওই কিছুদিন পরে আবার আমার কাছে ঘুরে আসে। গত দেড় বছর ধরে এইই চলছে।’’ একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সরমা।
‘‘কিন্তু এই এলাকায় এটা বেশী হয় কেন? সেটার কি কোনও বিশেষ কারণ আছে?’’ প্রশ্ন করে নিরূপ।
‘‘দ্যাখো, এই অসুখ অনেক কারণে হয়। এরা গরিব, অমনিতেই অপুষ্টিতে ভোগে। ঠিকঠাক ডায়েট... প্রোটিন বা ক্যালসিয়াম এসব নিয়ে আর এখানে কে ভাবে বল! কাজেই কেন এই অঞ্চলে এটা বেশী, সেটা এককথায় বলা মুস্কিল।’’ উত্তর দেয় সরমা।
‘‘হুমম... আসি আজ। রোদ্দুরের তাপ বাড়ছে। অফিসে কিছু কাজ আছে, সেগুলো সারতে হবে। রিপোর্ট দিতে হবে কালকের মধ্যেই।’’উঠে দাঁড়ায় নিরূপ। চলে যেতে গিয়ে আবার ফিরে আসে, ঘুরে প্রশ্ন করে, ‘‘সরমাদি, তুমি কি এখনি ফিরবে বাড়িতে? চল আমার সঙ্গে জিপ আছে। তোমাকে ড্রপ করে দিয়ে যাই।’’
‘‘তাহলে একটু দাঁড়াও। হ্যাঁ, ভালো কথা! দুপুরে লাঞ্চ হয়নি নিশ্চয়ই?আমাররান্নাঘরে ঝোল ভাত আছে। খেয়ে যাও।’’ একরকম আদেশের সুরে বলে ওঠে সরমা।
‘‘উফফফ... ঝোল ভাত। কেন? কেন এরকম লোভ দেখাও বলতো? একটু লজ্জা লজ্জা ভাব করে ‘খাবো না’ বলতেও পারিনা। কতদিন যে পাতলা ঝোল ভাত জোটে না আমার কি বলব!’’ কপাল চাপড়ায় নিরূপ।
‘‘ঠিক ধরেছি আমি। ঝোল ভাত রান্না করা কি এমন একটা ব্যাপার। ক্যাম্পে নিজে রাঁধলেই তো পারো।’’ বলে ওঠে সরমা।
‘‘দুররর... যত হাঙ্গামা!’’ বলে নিরূপ, ‘‘মাছ ওইসব দিকে পাওয়া যায়না। নদী আছে বটে, কিন্তু আমি মাছ ধরতে জানিনা। শেষে ফিল্ডের কাজ শিকেয় তুলে মাছ ধরব নাকি? কি যে বল!’’
‘‘তা বটে!’’ মুচকি হাসে সরমা।
সরমার বাড়িতে লাঞ্চ করে অফিসে ঢুকতে ঢুকতে পিওন গিরিধারী জানালো যে নিরূপের ‘‘ঘর সে এক ফোন আয়া থা।’’ নিরূপ একটু হতভম্ব বোধ করে। বাড়ি থেকে কে ফোন করবে? কেন? সব ঠিকঠাক তো? কলকাতার বাড়িতে ফোন করতে গিয়ে নিরূপের মনে পড়ে যে গত ছ মাস ধরে মা বাবা নীরুকে নিয়ে হুগলীর বাড়িতে শিফট হয়ে গেছেন। হুগলীর বাড়ির ফোন নম্বর নিরূপের মনে নেই। তার মানে সে গত ছমাসে মা বাবার সঙ্গে কথা বলেনি। নিজের ওপর অসহ্য ক্রোধ হয় তার। ক্রোধের মাঝেই মনে পড়ে, মায়ের কোনো একটা চিঠিতে ফোন নম্বর দেওয়া ছিল। কিন্তু সেটাও বেশ কয়েকমাস আগের হবে। ফিল্ড ব্যাগের পেছনের পকেটে থাকে মায়ের চিঠিগুলো। ওখানে থাকলে মনে হয় মা সঙ্গেই আছে। খুব ভারি না হলে পোস্টকার্ডগুলো ব্যাগ থেকে বের করে না সে। লাফ দিয়ে অফিসে নিজের চেম্বার থেকে বেরিয়ে অফিসের সামনের বাগানে এসে জিপের পেছনের সিটের নিচ থেকেবের করে সে ফিল্ডের ব্যাগ। হ্যাঁ, প্লাস্টিকে জড়ানো পোস্টকার্ডগুলি আছে। এই ব্যাগেই আছে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচে নিরূপ। পেয়ে যায় মাসচারেক আগের চিঠিতে মায়ের হাতে লেখা, ‘‘নতুন ফোনের কানেকশান নিলাম এই বাড়িতে। এই নম্বরে ফোন করতে পারো।’’ ... নিরূপ অ্যাদ্দিন পরে লাইনগুলির মধ্যে খুঁজে পায় একটা অভিমানের সুর। মা তো বলেনি ‘ফোন করো’। বলেছে ‘করতে পারো’। হঠাৎ ভীষণ কান্না পায় নিরূপের। বীভৎস একা মনে হয় এই গ্রীষ্মের দুপুরে নিজেকে। নিজের দোষে তার এই একা থাকা, এটা সে জানে। মায়েরও কি তবে তার কাছে কোনও এক্সপেকটেশান নেই? এসব ভাবতে ভাবতে ফাঁকা মাথায় গিয়ে সে ফোন করে হুগলীর বাড়ির নম্বরে। রিঙ হচ্ছে। ফোনটা তুলল কেউ। একটা মিষ্টি গলা... ‘‘হ্যালো’’ বলে উঠল। সে এপাশ থেকে বলল... ‘‘নিরূপ বলছি।’’ওপাশ থেকে মিষ্টি রিনরিনে গলাটা বলে উঠল... ‘‘বাবা? বাবা বলছ?’’...নিরূপের বুকের মধ্যে অনেক কিছু পাক খেতে থাকে। মনে হয় যেন একটা আগ্নেয়মুখ খুলে যাচ্ছে কোথায়, নাকি বহুদিনের লুকিয়ে থাকা একটা ঝর্ণা পথ পেয়ে বইতে শুরু করল নদীর মত। কণ্ঠস্বরটা আবার ডাকে... ‘‘বাবা...’’
0 comments: