0

ধারাবাহিক - সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in


ধারাবাহিক


বানরায়ণ – ১৭
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়



মেঘনাদের বাণবর্ষণে যুদ্ধক্ষেত্র প্রায় অন্ধকার হয়ে উঠছিলো। একজন মানুষ যে একটা রথের উপর থেকে ওই রকম অবিশ্রান্ত ধারায় তীর ছুঁড়তে পারে, সেটা চাক্ষুষ না দেখলে কোনওদিন বিশ্বাস করতাম না। রাম-লক্ষ্মণও প্রবলবেগে শরনিক্ষেপ করছিলেন। বিশেষত রামচন্দ্র। কিন্তু তাঁদের রথ নেই। তাই মাটির উপর দাঁড়িয়ে গতির সুবিধাটা তাঁরা পাচ্ছিলেন না। শুধু আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন মেঘনাদের বাণবর্ষণ প্রতিহত করার।

আমি যুদ্ধক্ষেত্রে গেছিলাম আহত সৈনিকদের সাহায্য করার অছিলায়। রোজই যেতাম দিনের কোনও না কোনও সময়। যু্দ্ধক্ষেত্রের অলিখিত নিয়ম, চিকিৎসাকর্মীদের আঘাত করা যা্বে না। সেই ভরসায় যেতাম প্রতিদিন। যুদ্ধ দেখাটা একটা নেশার মতন হয়ে গেছিলো।সেদিনও তাই গেছিলাম। বিশেষত আগের দিন ইন্দ্রজিতের ওই সাংঘাতিক পরাক্রম আমাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করেছিলো।

কিন্তু সেদিন বুঝলাম, অলিখিত নিয়ম থাকলেও তার যথাযথ পালন অন্তত যুদ্ধক্ষেত্রে সবসময় সম্ভব নয়। মাটিতে বসে একজন আহত সৈনিকের ক্ষত পরিচর্যা করছিলাম, আর দেখার চেষ্টা করছিলাম দূরের যুদ্ধ... যেখানে রথারূঢ় লঙ্কার রাজপুত্র বাণে বাণে আকাশ ঢেকে ফেলছেন, আর সেই ভয়াবহ আক্রমণের বিপরীতে মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রাণপণ যুদ্ধ করে চলেছেন অযোধ্যার দুই রাজকুমার... একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম ক্ষতে ওষুধের প্রলেপ লাগাতে লাগাতে। হঠাৎ আমাকে প্রচণ্ড চমকে দিয়ে একটা বিশাল লোহার তীর, যে ধরনের তীরকে এদের ‘নারাচ’ বলতে শুনেছি, প্রচণ্ড বেগে এসে আমার থেকে ঠিক দু’হাত দূরে মাটিতে অর্ধেক গেঁথে গেলো! সভয়ে তাকিয়ে দেখলাম, তীরটা দৈর্ঘ্যে আমার থেকে বড় জোর এক বিঘৎ কম! সম্ভবত মেঘনাদের লক্ষভ্রষ্ট তীর। এই জাতীয় তীর প্রচুর ব্যবহার করতে দেখেছি ওঁকে গতকাল। ওই রকম ধনুক ছাড়া এ তীর এত জোরে, এত দূরে নিক্ষেপ করা সম্ভব নয়। তীরটা আরেকটু লক্ষভ্রষ্ট হলে...

তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে নিরাপদ দূরত্বে সরে এলাম। কিন্তু যুদ্ধ দেখার লোভ ছাড়তে পারলাম না। এ এক অদ্ভূত জিনিস। এত নিষ্ঠুর, এত বীভৎস... কিন্তু একবার এর নেশা ধরে গেলে আর ছাড়ে না। কথাটা করন্দ নেশার ঘোরে বলেছিলো একবার।তখন বুঝিনি। এখন বুঝতে পারছি... 

একটু দূরে কড়াক করে একটা শব্দ হলো। ও শব্দ আমি চিনে গেছি। ভারী অস্ত্রের আঘাতে মাথার খুলি ফাটার শব্দ। প্রথম প্রথম বীভৎস লাগতো, গা গুলোতো। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। তাই যেদিক থেকে শব্দটা এলো, সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম, কিষ্কিন্ধ্যার এক সৈনিকের ভিন্দিপাল, অর্থাৎ ছোট, ভারী গদার মতন যে অস্ত্র এরা ব্যবহার করে, তার আঘাতে এক লঙ্কার সৈনিকের মাথা ফেটে চৌচির হলো, এবং সে কাটা কলাগাছের মতন ধপাস করে পড়লো মাটিতে। অভ্যস্ত দৃশ্য।

প্রভার ভাইয়েরও এই অবস্থাই হয়েছিলো। তিন রাত ধরে খোঁজার পর গতকাল পাওয়া গেছে তার মৃতদেহ। মুখ দেখে চেনার উপায় ছিলো না। তবু প্রভা চিনতে পারলো। কি করে, আমি জানি না। প্রশ্ন করিনি। করার পরিস্থিতিও ছিলো না। একমাত্র আপনার জনকে চিনতে বোধহয় মুখ দেখতে লাগে না।

একটা মৃতদেহের স্তূপের উপর থেকে দু’তিনটে শরীর সরিয়েপ্রায় দলা পাকানো দেহটার দিকে তাকিয়ে থমকে গেছিলো মেয়েটা। সেইভাবেই দাঁড়িয়েছিলো অনেকক্ষণ। আমিও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম ওর পিছনে। তারপর একসময়ে আস্তে আস্তে ঘুরলো আমার দিকে। ওরকম মুখ আমি কখনও দেখিনি। কোনওদিন আর দেখতে চাইও না...

...দূরে যেখানে মেঘনাদের সঙ্গে রাম-লক্ষ্মণের যুদ্ধ হচ্ছিলো, সেখান থেকে একটা হর্ষধ্বনির মতন শব্দ ভেসে এলো। এ শব্দও আমার পরিচিত। লঙ্কাবাহিনীর হর্ষনাদ। কি হয়েছে ওখানে? রাম বা লক্ষ্মণের কিছু হয়েছে কি? বা সুগ্রীবের? দু’দিন আগে অবধিও আমি ও শব্দে উতলা হতাম, উদ্বিগ্ন হতাম। কিন্তু এখন... কেমন যেন একটা নির্লিপ্তি...

...পরশু রাতে প্রভা বলছিলো ওর জীবনের কথা। আমার মতনই, মাকে ও দেখেনি কোনওদিন। ও জন্মানোর সময়েই ওর মা মারা যান। বাবা, বড় ভাই আর ও – এই তিনজনের ছোট্ট সংসার ছিলো ওদের। ওর বাবার একটা পাঠশালা ছিলো শহরের এক কোণে। পড়াতেন ছোট ছোট বাচ্চাদের। বাবার কাছেই শোনা ওর এই দেশের বিগত পঞ্চাশ বছরের ইতিহাস... কুবেরের রাজত্বের কথা... অর্থলোলুপ বিদেশী রাজশক্তিরঅসহনীয় অত্যাচারের কথা... দাসব্যবসার বিভীষিকার কথা...

এই গত এক বছরের অভিজ্ঞতায় যা যা নতুন জিনিসশিখলাম আমি, তার মধ্যে সব থেকে আশ্চর্য, সব থেকে ভয়াবহ বোধহয় এই দাসব্যবসা। মানুষকে যে অর্থমূল্যে কেনা যায়, যেতে পারে, সেটা আমার মতন জংলীর কাছে অভাবনীয়। একজন মানুষের উপর যে আরেকজন মানুষের কোনওরকম অধিকার থাকতে পারে, সেটা বুঝতেই আমার বেশ খানিকটা সময় লেগেছিলো। তারপর দু’দিন আগে গভীর রাতে যুদ্ধক্ষেত্রে বসে প্রভার কাছে শুনলাম দাসব্যবসার কথা। মানুষ কেনাবেচা! লঙ্কায় উপনিবেশ স্থাপন করার পিছনে কুবেরের অন্যতমপ্রধান উদ্দেশ্য!

আজ থেকে অর্ধ শতাব্দী আগের লঙ্কা ছিলো আমাদের দেশের মতন, শান্ত, সন্তুষ্ট, ছোট ছোট গ্রামে বিভক্ত এক ছায়াসুনিবিড় অরণ্যসঙ্কুল দেশ। প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য ছিলো। গ্রামবাসীরা আমাদের মতনই প্রধানত শিকার এবং একটু আধটু চাষবাস করে জীবিকানির্বাহ করতো। তারপর একদিন কতগুলো জাহাজ এসে ভিড়লো তাদের উপকূলে। সেই জাহাজ থেকে নামলো একদল সাদা চামড়ার মানুষ, এবং কিছুদিনের মধ্যেই জাঁকিয়ে বসলো তাদের দ্বীপের বুকে। তাদের নেতা কুবেরের জন্য দ্বীপের সুরক্ষিত মধ্যভাগে তৈরি হলো বিশাল দুর্গপ্রাসাদ। সেখান থেকে কুবের নিয়ন্ত্রণ করতে লাগলেন দ্বীপরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা, বাণিজ্য, সবকিছু।

দ্বীপবাসী আরণ্যক মানুষগুলোর কাছে ‘রাষ্ট্র’ শব্দটাই ছিলো নতুন। আমাদেরই মতন, কাছাকাছি অবস্থিত পাঁচ-ছ’টা গ্রাম নিয়ে একেকটা ‘মণ্ডল’ই ছিলো এদের ধারণায় শাসনব্যবস্থার সব থেকে বড় পর্ষদ। তাদের কাজ ছিলো বিবাদ-বিসংবাদের মীমাংসা করা, ছোটখাটো অপরাধের শাস্তি দেওয়া, উৎসবে পার্বনে সমবেত আমোদপ্রমোদ, খেলাধুলোর ব্যবস্থা করা, প্রয়োজনে একসঙ্গে শিকার করা, ইত্যাদি। রাষ্ট্রকে যে কর দিতে হয়, না দিলে যে শাস্তি পেতে হয়, সে কথা এরা প্রথম জানতে পারে যখন কুবেরের সশস্ত্র বাহিনী এসে এদের গ্রামে আগুন লাগিয়ে দেয়, নির্বিচারে হত্যা করে পুরুষদের, টেনে নিয়ে যায় নারীদের... তাদের কোলের শিশুগুলিকে আছড়ে ফেলে!

সেই শুরু। অত্যাচার বাড়তে থাকে ক্রমশ। প্রথম প্রথম কর না দিলে পুরুষদের মেরে নারীদের নিয়ে যেতো। তারপর এক সময় দলে দলে পুরুষদেরও হাতে পায়ে শিকল বেঁধে নিয়ে যাওয়া শুরু হয়। প্রথম প্রথম এরা বুঝতো না, কোথায় নিয়ে যায়। তারপর একসময় দাসব্যবসার ব্যাপারটা এদের কাছে পরিস্কার হলো।জাহাজে করে এদের চালান দেওয়া হয় দেশ-দেশান্তরে এবং বিক্রী করা হয় অর্থমূল্যে। সেখানে এদের পরিচয়, এরা ক্রীতদাস, যাদের কাজ নিঃশর্তে শ্রমদান করা... যাদের বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারটুকু পর্যন্ত মনিবেরহাতে!

এই ভাবেই চলেছিলো প্রায় কুড়ি বছর।লঙ্কার প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে সমুদ্রবাণিজ্য আর দাসব্যবসার মুনাফায় কুবেরের ভাণ্ডার ফুলে ফেঁপে উঠেছিলো... আর উজাড় হয়ে গেছিলো লঙ্কার একটার পর একটা গ্রাম। যারা গভীর জঙ্গলে পালিয়ে যেতে পেরেছিলো, তারা বেঁচে গেছিলো। বাকিরা হয় ক্রীতদাস হয়ে বিদেশে চালান গেছিলো, নয়তো বিদেশী ঔপনিবেশিকদের অস্ত্রে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে থেকেছিলো নিজের দেশের মাটিতে। তাদের রক্ত, হতাশা আর নিষ্ফল ক্রোধ মিশে গেছিলো লঙ্কার উর্বর মাটিতে... আর তারপর একসময় সেই মাটি জন্ম দিয়েছিলো বিদ্রোহের।

সে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন রাবণ। তাঁর জীবনের ইতিহাস চমকপ্রদ। তাঁর জন্মদাতা পিতা লঙ্কার মানুষ ছিলেন না। আর্যাবর্ত থেকে এসেছিলেন। বিবাহ করেছিলেন রাবণের মা কৈকেসীকে। জন্ম দিয়েছিলেন রাবণ, কুম্ভকর্ণ, বিভীষণ ও তাঁদের বোন সূর্পনখার। তারপর একদিন চলে গিয়েছিলেন লঙ্কা ছেড়ে। আর ফিরে আসেননি। রাবণ ও তাঁর ভাইবোনরা বড় হয়েছিলেন মাতামহ সুমালীর তত্ত্বাবধানে। সুমালী ছিলেন একজন বড় মাপের মণ্ডলপ্রধান। ঔপনিবেশিক অত্যাচারের প্রচণ্ড বিরোধিতা করেছিলেন তিনি, যার ফলস্বরূপ তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হয় কুবেরবাহিনীর হাতে। 

রাবণ তখন সদ্যকিশোর। বাকিরা নিতান্তই বালক-বালিকা। মা-ভাইবোনদের নিয়ে বহু বিপদের মধ্যে দিয়ে পালাতে সক্ষম হন রাবণ। কোথায় যান, তার পরের দু’দশক কোথায় কিভাবে কাটান, সে ইতিহাস সাধারণের অজানা। প্রভার বাবার মতন কারও কারও একটা অস্পষ্ট ধারণা ছিলো, লঙ্কা ছেড়ে মূল ভূখণ্ডে চলে যান এবং আর্যাবর্তে কোথাও যুদ্ধনীতি এবং রাজনীতিতে প্রশিক্ষণ লাভ করেন রাবণ। দীর্ঘ দু’দশক পর ফিরে আসেন লঙ্কায়। অত্যন্ত গোপনে, আপন শক্তিমত্তায় পরম নিশ্চিন্ত ঔপনিবেশিকদের চোখের আড়ালে ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন বিদ্রোহ। সে বিদ্রোহে সহায়তা করেন তাঁর দুই ভাই এবং প্রহস্ত, মহাপার্শ্ব, মহোদয়দের মতন কয়েকজন অসামান্য সাহসী যোদ্ধা। তাঁরা তৈরি করেন একটি ছোট, অথচ অসম্ভব দক্ষতাসম্পন্ন বাহিনী, যাদের দীর্ঘ প্রশিক্ষণ হয় অতর্কিতে দুর্গ আক্রমণে। কারণ রাবণ ও তাঁর সহায়করা জানতেন, সম্মুখসমরে ঔপনিবেশিক বাহিনীর মহড়া নেওয়ার মতন ক্ষমতা তাঁদের কখনোই হবে না। 

তবু, এই বাহিনী নিয়েও কুবেরের প্রাসাদের নিশ্ছিদ্ররক্ষণ ভেদ করা ছিলো কার্যত অসম্ভব। তাই রাবণকে আশ্রয় নিতে হয় বিশ্বাসঘাতকতার। কুবেরের এক ঘনিষ্ঠ আপ্তসহায়ক করেন সেই বিশ্বাসঘাতকতা।আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগের এক গভীর রাতেসেই বিশ্বাসঘাতকতার সুযোগ নিয়ে রাবণ তাঁর বাহিনী নিয়েঅতর্কিতে আক্রমণ করেন কুবেরের নিদ্রামগ্ন দুর্গ। সে আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে যায় অপ্রস্তুত দুর্গবাসীরা। বেশির ভাগ মারা যায়। বিশ্বস্ত অনুচরদের সাহায্যে গুপ্তপথে প্রাণ নিয়ে পালাতে সক্ষম হন কুবের। কিন্তু লঙ্কা এবং এতদিন ধরে অর্জিত অতুল সম্পদ হাতছাড়া হয় তাঁর। সে সম্পদ রাতারাতি করতলগত হয় রাবণের।

তারপরের ইতিহাস সর্বজনবিদিত। অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি হিসেবে লঙ্কার উত্থান আজ প্রায় প্রাবাদিক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। দাক্ষিণাত্যে বা আর্যাবর্তে অত্যাচারী, নারীলোলুপ বলে রাবণের যতই দুর্নাম থাক না কেন, প্রভার কথা শুনে বুঝলাম, লঙ্কাবাসীর চোখে রাবণ আজও নায়ক, ত্রাণকর্তা। ঔপনিবেশিকদের অসহনীয় অত্যাচার থেকে তাদের মুক্তিদাতা...

...একটা সোরগোলের শব্দে আমার চমক ভাঙলো। কাকে যেন ধরাধরি করে চিকিৎসাশিবিরের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। লক্ষ্মণ না? কি হয়েছে তাঁর? 

আমিও তাড়াতাড়ি এগোলাম শিবিরের দিকে।



0 comments: