রম্যরচনা - গৌতম দত্ত
Posted in রম্যরচনা
রম্যরচনা
কৌণ্ডৈ
গৌতম দত্ত
কর্মজীবনের শেষ দিকে দাঁড়িয়ে অনেক কথাই মনে পড়ে যায়।
কত রকম আলোচনা, গল্প-কথায় কেটে যেতো সেই প্রথম জীবনের দিনগুলো। দাদাদের সস্নেহ প্রশ্রয়ে একটু একটু করে সিনিয়র হচ্ছিলাম। বস্তুতপক্ষে, আমার জীবনের দোলাচলে এই অধ্যায়টুকু না থাকলে জীবন হয়তো অন্যরকম হতো। প্রায় আটত্রিশ বছরের টানা কর্মজীবনশেষ হতে চলেছে। এর মধ্যেই আমায় ঘুরতে হয়েছে আমাদের কলকাতার নানা অফিসে। কিন্তু আমার প্রথম জীবনের সেই “ডিভিশন এইট” এর স্মৃতিগুলো চিরটাকাল আচ্ছন্ন করে রাখবেই আমার মানসপট। আমাদের ইন্স্যুরেন্সে’র অফিসগুলো মূলত ডিভিশন আর ব্রাঞ্চেই পরিব্যপ্ত। এছাড়া রয়েছে রিজিওনাল অফিস আর ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’র মতো এইচ ও বা হেড অফিস।
তা আমার চাকরীজীবনের প্রথম বিশ বছর কেটেছে ওই ডিভিশন আটেই। আগেই বলেছি, সেটা ছিল সেটা বার্ড কোম্পানীর প্রাক্তন ইন্স্যুরেন্স সেকশন। ডালহাউসি এলাকার একটি প্রাচীন স্থাপত্যের বাড়ি, নাম ‘চার্টাড ব্যাঙ্ক বিল্ডিং’।
কত দাদা তখন। সে অবসরের কাছাকাছি বয়স হলেও দাদা। আর আমার সৌভাগ্য এই যে এই সব দাদাদের অকুন্ঠ ভালবাসায় ঋদ্ধ হয়েছি বারংবার যা এখনো অটুট রয়েছে। কিন্তু সেইদিনগুলোর মতো আড্ডা আর তো ফিরে আসবে না কোনোদিন। তাই আমার স্মৃতির ঝুলি থেকে কিছু বেড়াল না হয় বারই করে, আপনাদের শোনাই।
এ ঘটনাটা যাঁর মুখ থেকে শোনা, ধরে নিন তার নাম অমল বা বিমল অথবা কমল কিংবা ইন্দ্রজিৎ। একটা নাম খুব কমন ছিল আমাদের অফিসে, আর তা ছিল হারাধন। হারাধন এক, হারাধন দুই, হারাধন তিন এইভাবে সিনিয়রিটি অনুযায়ী ছিল দাদাদের নাম। বলা বাহুল্য তখনো সেই রক্তকরবীর মতো “৬৯ এর ঙ”-র কোড আমাদের আসে নি। সেটা এসেছে অনেক পরে, এমপ্লয়ী নাম্বার হিসেবে। আবার কখনো কখনো ঐ হারাধন এক হয়ে যেতেন কালীঘাটের হারু’দা বা বড়বাবু হারু’দা। স্যালারী শীটে কিন্তু ওই এক, দুই, তিনই লেখা হতো। এছাড়া অনেকেরই ডাকনামও আমরা জেনে গেছিলাম আমাদের মেলামেশার সূত্রে। তেমনই এক দাদা ছিলেন আমাদের গল্পের ভাঁড়ার। তিনি ছিলেন আমাদের বাচ্চুদা।
যাই হোক, এবার আসল কথাটা, মানে গপ্পোটা শোনাই। এটা ওই বাচ্চুদার মুখ থেকেই শোনা। বলি আমার জবানীতে। তা না হলে ঠিক জমবে না।
সেবার বেড়াতে গেলাম কন্যাকুমারী। সেটা ছিল সত্তরের কোনো একটা বছর, আর আমার জন্য তিন বারের বার। ঐ সঙ্গ দিতে যাওয়া আর কি!
যাঁরা গেছেন কন্যাকুমারী তাঁরা নিশ্চই বোটে করে গেছেন বিবেকানন্দ রক। আর তাঁরা অবশ্যই দেখেছেন যে, এটি একটি দ্বীপ আমাদের ভারত ভূখণ্ড থেকে অনতিদূরে। স্বামী বিবেকানন্দ এই ভারতের শেষ ভূখণ্ড থেকেই বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউ সাঁতরে গিয়ে উঠেছিলেন এই দ্বীপে। পরবর্তী কালে এই দ্বীপে গড়ে ওঠে একটি স্মারক মন্দির, একটি ধ্যানগৃহ ইত্যাদি। এই দ্বীপে যেতে হলে মোটরবোটে করে ঐ উত্তাল সমুদ্রের ওপর দিয়েই পৌঁছতে হয়। ভারতের ম্যাপে যেমনটি দেখেন, তেমনই দেখা যায় ঐ শেষ ত্রিভুজাকৃতি জায়গাটা, যদি একটু পিছিয়ে দাঁড়ান। বাঁ দিকে বঙ্গোপসাগর, যেখানে ভোরে দেখা যায় সূর্যোদয়। আর ডান দিকে অপরূপ আরব সাগরের বিস্তার। সূর্যাস্ত দেখতে গেলে তাকাতে হয় এই দিকেই। সূর্যাস্তের কিছু আগেই ওই জলের ধারে পড়ে থাকা বিভিন্ন আকৃতির বোল্ডারগুলো ভরে ওঠে মানুষের ভীড়ে। সবাই খুঁজে নেয় কোনো না কোনো একটা বোল্ডার,একটু আয়েস করে বসে সূর্যাস্ত দেখবার জন্য। ফ্ল্যাশের ঝলক আর ক্যামেরার ক্লিকে রোজই এমন সময়ে মুখরিত হয়ে ওঠে ভারতের শেষ প্রান্তের এই নিস্তব্ধপাথুরে সাগরবেলা। এখানেই সূর্যদেব তাঁর লাল গোলাকার শরীরটা আস্তে আস্তে ডুবিয়ে দেন আরব সাগরের লোনা জলে।
এমনই এক বিকেলে আমরা গিয়ে একটু উঁচু বোল্ডারে বসে গল্প করছিলাম। সূর্যাস্তের রঙ তখনো ছড়ায়নি পশ্চিম আকাশে।
ঘড়ির কাঁটা তার নিয়মেই এগোতে থাকে। আর এগিয়ে আসতে থাকে সূর্যাস্তের সময়। ভীড় বাড়তেই থাকে। আর স্পন্দিত হতে থাকে শব্দের ডেসিবল। সারা ভারতের কত রকম ভাষায় কত রকমের যে আবাহনের ডাক হতে পারে, তা এমন কিছু কিছু জায়গায় বেশ কানে বাজে।
আগেই বলেছি, আমরা ছিলাম বেশ একটা উঁচু বোল্ডারের ওপরে বসে। পিছনে বঙ্গোপসাগরের গর্জন বেজেই চলছিল তানপুরার মতো। আর ঠিক মাঝামাঝি - যেখানে বঙ্গোপসাগর এসে গলা মেলাচ্ছে আরব সাগরের জলে, সেখানে উঠছিল তুমুল জলোচ্ছ্বাস দুই সাগরের ঢেউগুলোর পারস্পরিক সংঘর্ষে। অপরূপ সে দৃশ্য !
জলের হাল্কা ঝাপ্টা সহ্য করেই বসে থাকতে হচ্ছিল সবাইকেই। পশ্চিম আকাশ ধীরে ধীরে সাজছিল রাঙা আলোয়। নববিবাহিতা বধূটির মতো। উজ্জ্বল সেই লাল রঙ পরিবর্তিত হচ্ছিল কমলায়। ক্ষণে ক্ষণে পাল্টাচ্ছিল পশ্চিমের দিগন্ত।
আমার চোখ তখন ঘুরছিল বিভিন্ন মানুষের অদ্ভুত আচরনের দৃশ্যে। যেহেতু এর আগে দুবার দেখেছি এই সূর্যাস্ত, তাই আমি দেখছিলাম সমস্ত প্রদেশের মানুষজনকে পিছন দিক থেকে। সিনেমা হলের মতো। সামনে সূর্যাস্তের দিগন্ত বিস্তৃত স্ক্রীন। আর এই অগণিত মানুষ জন অপেক্ষা করছে সেই মাহেন্দ্রক্ষণের। আমার মনে গুনগুন করছিল –
“সূর্য ডোবার পালা আসে যদি আসুক বেশ তো
গোধূলির রঙে হবে এ ধরণী স্বপ্নের দেশ তো
তারপরে পৃথিবীতে আঁধারের ধূপছায়া নামবেই
মৌমাছি ফিরে গেলে জানি তার গুঞ্জন থামবেই
সে আঁধার নামুক না, গুঞ্জন থামুক না
কানে তবু রবে তার রেশ তো...”
প্যান্ট, শার্ট, লুঙ্গি, ধুতি, শাড়ি, সালোয়ার ইত্যাদির কত বাহার! দক্ষিণী মহিলাদের পিছন থেকে চেনা যায় তাদের মাথায় দুরঙা কবরী দেখে। তামিল ভাষায় এই কবরী কে বলা হয় ‘কৌণ্ডৈ’। সাধারণত একটা সাদা আর একটা অন্য রঙের মালায় সজ্জিত করেন দক্ষিণী মহিলারা তাঁদের খোঁপা।
মিষ্টি ফুলের গন্ধ ছড়াচ্ছিল তাঁদের মাথায় গোঁজা ওই যুঁই কিংবা বেলীর কৌণ্ডৈ থেকে। আমার চোখদুটো খুঁজতে চাইছিল সুন্দরীদের, কিন্তু তার বদলে হঠাৎ করে চোখে পড়লো এক নধর ছাগল। খুব সম্ভবত পাঁঠাই হবে। সে খুঁজে চলেছে ঐ বোল্ডারের খাঁজে খোঁজে যদি কিছু খাবার মেলে, এই আশায়।
এদিকে সময় এগিয়ে আসছিল। এক ঝলক সূর্যদেব কে দেখে নিয়েই চোখের তারা সার্চলাইটের মতো ঘুরছিল আমার। জনসমাগমে তখন পরিপূর্ণ আরব সাগরের দিকে সব বোল্ডারগুলো। রঙবেরঙের পোষাকে রঙিন তখন গোটা জায়গাটা।
আস্তে আস্তে ডুবছে সূর্য। জলে ঠেকলো লাল গোলার তলার অংশটুকু। তার পর ক্রমশডুবতেথাকলো সাগরের জলের ভেতর। গনগনে সূয্যিঠাকুর তখন জলের ছোঁয়ায় নিস্তেজ হচ্ছেন আস্তে আস্তে। একবারের জন্যে নিস্তব্ধতা সারা জায়গা জুড়ে। যেন ইডেন গার্ডেনে আর এক রান করলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত জিতবে, তার প্রতীক্ষায় সবার ঠোঁটদুটো মিশে আছে পরস্পরের সাথে। প্রহর গোনার পালা বার্স্ট হবার। চীৎকারে গ্যালারী মাতিয়ে তোলার অপেক্ষা যেন, সারা ইডেন জুড়ে।
অবশেষে এল সেই প্রহর। চারদিকে আলো কমে এসেছে। দূর আকাশে অল্প আলো থাকলেও বেশ অন্ধকার অন্ধকার ভাব আমাদের চারপাশে। কথাবার্তা থেমে গেছে চোখের দৃষ্টিতে। পলক পড়ে না কারো। ক্যামেরার শাটারে আঙুলের অপেক্ষা। ঝুপ করে ডুবে গেল সূর্য সাগরের জলে, আর তখনি এক মিশ্র ধ্বনি উঠলো যার যার ভাষায়। ধ্যান ভাঙলো এত মানুষের।
হঠাৎ এক চিল চিৎকার। ভাষাটা দক্ষিণের। সূর্যাস্তের আবেশ ছেড়ে সবার চোখ তখন সেই দিকে। একটি মেয়ে কিছুতেই ছাড়াতে পারছে না তার খোঁপায় আটকানো ফুলের মালা, সেই পাঁঠাটার মুখ থেকে। সে টেনেই চলেছে ঐ মেয়েটির মাথায় গোঁজা মালা,পেছন থেকে একটা উঁচু বোল্ডারের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে। ছাড়ায় কার সাধ্যি!
মদের নেশা ছূটে যাবার মতো সূর্যাস্তের আবেশ গেল হারিয়ে। জনগনের সমবেত চেষ্টায় অবশেষে মুক্তি পেল সেই দক্ষিণী মেয়েটি।
0 comments: