0

স্মৃতির সরণী - জয়ন্ত প্রসাদ গুপ্ত

Posted in






স্মৃতির সরণী


পূর্ণের পদপরশ তাদের পরে
জয়ন্ত প্রসাদ গুপ্ত



জীবনের অন্তবেলায় পিছনের পানে তাকালে চোখে পড়ে কত না ছবি... তার কোনওটি আনন্দে উচ্ছল, কোনওটি বেদনায় বিধূর। প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা, হিংসা-দ্বেষ... এক কথায় যে বৈপরীত্যের সমন্বয়ে এই জীবন ও জগৎ, ব্যক্তিজীবন তো তারই একটি খণ্ড প্রকাশ... সিনেমার রীলে যেন একটি একটি করে ছবি ফুটে ওঠে। মানুষের জীবনের বেশীর ভাগটাই তো জুড়ে থাকে তার কর্মজীবন। সেই কর্মের সূত্রে বি. ই. কলেজ মডেল স্কুলের সঙ্গে আমার সম্পর্কের যে সূচনা, তার কাহিনীই আজ শোনাবো। আজ পশ্চিম দিগন্তের পথে পাড়ি দিয়ে পূবের দিগন্তকে বড় মায়াময়, স্বপ্নময় বোধ হয়...

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রমথ বিশী, জনার্দন চক্রবর্তী, জগদীশ ভট্টাচার্য, সাধন ভট্টাচার্যের মতো আরও অনেক পূজ্যপাদ অধ্যাপকের ছাত্র হওয়ার সুবাদে শিক্ষাব্রতকেই বৃত্তি হিসাবে গ্রহণ করবার বাসনার অঙ্কুর জেগে উঠেছিলো সেই তরুণ বয়সেই। তারও কিছু পরে আরও একটি ইচ্ছা তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলো। মনে মনে স্থির করেছিলাম, একেকটা গ্রামে যাবো, সেখানকার একেকটা স্কুলে কাজ করবো কয়েক বছর ধরে। ধীরে ধীরে আমার সাধ্যমতো বেশ কয়েকটা গ্রামকে জাগিয়ে দিয়ে যাবো। আজকের অবস্থা কী, তা আমার জানা নেই। কিন্তু সে সময় প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলে শিক্ষার যে কী করুণ অবস্থা ছিলো, বেঁচে থাকলে পরে এক সময় অন্যত্র সেটা লিপিবদ্ধ করে যাবো।

বড় ছেলের স্কুলে যাবার বয়স হতে তার মা বেঁকে বসলেন। এসব জায়গায় থাকলে ছেলের পড়াশোনা ঠিক মতো হবে না। ওই আমাদের পুরনো জায়গা কলকাতা বা তার আশপাশে যেতে হবে। পুত্রের কল্যাণের জন্য পত্নীর ফরমান অগ্রাহ্য করে, কোন পতির স্কন্ধে ক’টা মুণ্ড! অতএব স্টেটসম্যান-এর সঙ্গে এক কপি অমৃত বাজার বিক্রীর সামান্য একটু অতিরিক্ত লাভেরও ব্যবস্থা হলো আমাদের কাগজওয়ালার। সেই অমৃত বাজারেরই এক কোণে অসংখ্য ‘শিক্ষক চাই’-এর ভীড়ে বি. ই. কলেজ মডেল স্কুলের আহ্বান। সাড়া দেবার একটুও আকাঙ্খা ছিলো না। সহধর্মিনীর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে তাঁকে পরিষ্কার বললাম, ‘‘আরে বুঝতে পারছো না, একটা বিখ্যাত ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের ভেতরে স্কুল, ওখানে definitely একটা science-bias থাকবেই। ওখানে আমাদের মতো সাহিত্যের লোক কোনও মর্যাদা পাবে না। আত্মমর্যাদাটা খোয়াতে আমি রাজি নই...।’’ ক’দিন ধরে যুক্তিতর্কের ধ্বস্তাধ্বস্তি। স্ত্রীর একটি কথায় শেষ পর্যন্ত একটা খাম ছাড়লাম মডেল স্কুলের উদ্দেশ্যে একটি জৈব-তথ্য, অর্থাৎ bio-data ভিত্তিক দরখাস্ত দিয়ে। বেশ কায়দা করে কথার খোঁটাটা দিয়েছিলো বটে... ‘‘আরে, একটা দরখাস্ত দিলেই যে ওরা তোমাকে chance দেবে, এমনটা ধরে নিচ্ছো কেন? ওরা তো তোমাকে select না করতেও পারে। Select যদি করে, তখন না হয় সেটা ভেবে দেখো...।’’

শীতের সকাল। সকালও নয়, ভোর রাত্রি। আধা মফস্বল শহর (টেকনিকালি শহর, নইলে...) থেকে জাব্বা-জোব্বায় শরীর মুড়ে ট্রেনে উঠলাম। হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে কাছের একটা হোটেলে ঢুকে মাথায় একটু জল দেবার পরে ‘মীল’ হিসেবে যা হোক খেয়ে নিলাম। অচেনা জায়গা, হাতে একটু বেশী সময় নিয়ে রওয়ানা দেওয়া ভালো। সঠিক স্টপেজ না বুঝে কলেজের সেকেণ্ড গেটে নামলাম। ডান হাতে ব্যাগ, বাঁ হাতে কোটটা ঝুলিয়ে গেটের ভিতর দিয়ে এগোচ্ছি... কলকল করে কতগুলি মেয়ে বাইরে যাবার জন্য দল বেঁধে এগিয়ে আসছে। হঠাৎ কানে এলো একটি তির্যক মন্তব্য, ‘‘ওঃ! কি শীত!’’ বলার সঙ্গে সঙ্গে এ ওকে একটু টিপুনি দিলো, ও তার গায়ে একটু ঢলে পড়লো, তারপর কাচ ভাঙার আওয়াজ তুলে আমার পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেলো। বুঝলাম, এই স্কুলেরই উঁচু ক্লাসের ছাত্রী। তারা কী করে জানবে শেষ রাতে মফস্বল জায়গাতে কিরকম শীত!

ছেলের দঙ্গল অনেক সময় মেয়েদের টিটকিরি দেয় জানতাম। কিন্তু বাগে পেলে কোনও কোনও মেয়েও যে এরকমটা করতে পারে, সেটা সেদিন জানলাম। মনে মনে ভাবলাম, বাহ রে দুনিয়া! দু’দিন বাদে আমি হয়তো তোমাদেরই টীচার হবো। আজ তাহলে ভালোই আপ্যায়ন হলো। ঠিক হ্যায়! আগে তো স্কুলে জয়েন করি, তারপর সেরকম প্রসঙ্গের সুযোগ পেলে কিরকম খোরানো‌-জড়ানো ভাষার আবরণে মার্জিত থাপ্পড়টি দিই, তখন টের পাবে। 

পরে স্কুলে তো যোগ দিয়েছি। কিন্তু সেই প্রতিশোধস্পৃহা কোথায় গেলো? আসলে ওটা ছিলো এক তরুণের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। একজন শিক্ষক কি কখনও পারে তার ছাত্রের মন্দ ব্যবহারের বদলা নিতে? ছাত্র ও শিক্ষকের সম্পর্ক যে সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রার। সেখানে অনেক সময়েই তৃতীয় কারও অনুপ্রবেশের সুযোগ থাকে না। এমন কি কোনও কোনও ক্ষেত্রে সেই তৃতীয় জন যদি ছাত্রের বাবা বা মা-ও হন। তাই আজকাল সংবাদপত্রে, টিভিতে অনেকসময় যা দেখি, হিসাব মেলাতে পারি না। বড় কষ্ট হয়। কখনও কখনও মনে হয়, অনেক তো বয়স হলো, এইসব দৃশ্য দেখার জন্য না বাঁচলেই কি চলছিলো না...?

যাই হোক, সেই কম্পাউণ্ডের ভেতর এগোতেই দেখি সুন্দর একটা মাঠ (ওভাল, কিন্তু তখন নামটা জানা ছিলো না),‍ সেখানে ক্রিকেট চলছে। হাতে বেশ খানিকটা সময় আছে। বসে পড়লাম গ্যালারিতে। বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে লাগলাম শীতের রোদ। তখন ওই ক্রিকেট আমার কাছে একটা উপলক্ষ্য। আমি চারিদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দৃশ্য দেখছিলাম। কী সুন্দর মাঠ, যেন সবুজ ভেলভেটে মোড়া। চারদিক ঘিরে দেবদারু গাছ। তাদের পাতাগুলি শীতের মৃদু বাতাসে ঝিরঝির করে কাঁপছে। ওই মাঠের বাইরে রাস্তার ওপারে দেখা যাচ্ছে বিস্তীর্ণ দীঘি। কী সুন্দর মনোরম পরিবেশ। নাঃ! স্ত্রীর জেদাজেদির জন্য নয়, এঁরা যদি আমাকে সুযোগ দেন, আমি চলে আসবো।

যথাসময়ে বি. ই. কলেজের মেকানিকাল ইঞ্জিনীয়ারিং-এর হেড ডিপ-এর চেম্বারের পাশের ঘরে উপস্থিত হলাম। সব মিলিয়ে বোধহয় দশ-বারোজন ছিলো। ইন্টারভিউ শুরু হলো। একেকজন বের হচ্ছে তো কয়েকজন গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে... কী জিজ্ঞেস করলো? কী জিজ্ঞেস করলো? মনে মনে ভাবলাম, এদের teacher like attitudeই তৈরি হয়নি, তো এরা কি টীচারি করবে? তাছাড়া কী এদের বুদ্ধি! এই পদ পাবার জন্য যারা ইন্টারভিউ দিতে এসেছে, তারা কখনও প্রতিদ্বন্দ্বীদের সুবিধা পাইয়ে দেবার জন্য মুখ খোলে? এরই মধ্যে সিঁড়ির মুখে একজন প্রার্থীর কাছ থেকে কয়েকজন রসদ সংগ্রহ করে আনলো। কী ব্যাপার, তাকে নাকি ‘মধুসূদন’ বানান জিজ্ঞেস করেছে। কথাটা কানে যেতেই ব্রহ্মতালু পর্যন্ত জ্বলে গেলো। কী? শিক্ষিত লোকেদের ডেকে এনে এইরকম অপমান? উঠে দাঁড়াই। পায়ে পায়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাই। নাঃ! এখানে আর এক দণ্ডও নয়। হঠাৎ পরমুহূর্তে মনে হলো, আমি নিজেও তো কম ‘ইডিয়ট’ নই! কান নিয়ে গেছে চিলে, ব্যাস, ছোটো চিলের পিছনে। কানে হাত দিয়ে দেখার দরকার নেই? সত্যি-মিথ্যের যাচাই হলো না। তারপর এমনও হতে পারে যে ‘স্যাম্পল’ দেখেই এরকম প্রশ্ন। ঠিক আছে, চলে তো যেতেই পারি। আগে আমকে ওরকম কিছু জিজ্ঞেস করুক, তখন না হয় বেরিয়ে আসতে আসতে বলা যাবে, আমার স্কুলের কোনও ক্লাস ফাই্ভের ছেলেকে পাঠিয়ে দেবো আপনার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য।

ডাক পড়লো। ইন্টারভিউ বোর্ডকে অভিবাদন জানিয়ে আমার নির্দিষ্ট চেয়ারে বসলাম। প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি, হেডমাস্টার, ট্রেজারার (অন্য স্কুলে এ পোস্ট দেখিনি, কিন্তু এখানে তখন ছিলো), এক্সপার্ট একজন তো ছিলেনই। আর কেউ ছিলেন কি না, মনে করতে পারছি না (এঁদের পরিচয় অবশ্য ইন্টারভিউ শেষেই জেনেছিলাম)। প্রাথমিক ফর্মালিটির পর শুরু হলো প্রশ্নোত্তরের পালা। কই, সেরকম তো কিছু নয়। বরং সকলের আচরণে বেশ একটা self-possessed ভাব, অভিজাত, উচ্চশিক্ষিত মানুষের স্বাভাবিক ব্যবহার। এরকম জায়গায় তো সেটাই প্রত্যাশিত। এ তো আলু বা ধানের জমির দৌলতে বা রাজনৈতিক দলের মদতে ক্লাস এইট পাশ বা অংজংবং মার্কা প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি বা মেম্বর দিয়ে গঠিত ইন্টারভিউ বোর্ড নয়। 

নানান কথার পর এসে পড়লো সেই কথাটা – আমি আগের দিন শেষ ক্লাসটাতে কী পড়িয়েছি? ‘প্রতিভা’ প্রবন্ধটির নাম বললাম। সেটি কিভাবে ক্লাসে পড়িয়েছি, তাও ব্যাখ্যা করে বলতে হলো। লেখকের সঙ্গে আমি একমত কি না, অর্থাৎ প্রতিভা সম্বন্ধে আমার নিজস্ব মতটাও জানতে চাইলেন। মাঝে ফাঁকে ফাঁকে আমিও তাঁদের প্রশ্ন করতে ছাড়িনি। স্কুলের ছাত্রসংখ্যা কিরকম, রেজাল্ট কিরকম, তারপর বেতন সম্পর্কেও একটা প্রশ্ন সুকৌশলে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম। শেষ প্রশ্নটির উত্তরে তাঁরা দু’জন সহাস্যে যে জবাব দিয়েছিলেন, তাতে আমি অবশ্য মনে মনে কষ্ট পেয়েছিলাম। একজন বলেছিলেন, ‘‘হ্যাঁ, D.I. বা high ranking অনেক education officer তো আমাদের বন্ধুবান্ধব আছেন। তাঁদের কাছে শুনি, অনেক স্কুল scale-এ মাইনে দেয়না। Poorly paid teacherদেরও ওই ২০০/২৫০ টাকা থেকেও ২৫/৩০ টাকা কেটে নিয়ে স্কুলের কর্তৃপক্ষ নিজেদের পকেটে পোরেন – একথা জানার পর উচ্চপদে আসীন উচ্চশিক্ষিত মানুষদের সেই নিয়ে হাসি আসে? চোখ দিয়ে ঝরা উচিত তো হয় জল নয়তো আগুন। আর স্কুল যাতে সঠিক নিয়মে চলে তা দেখার দায়িত্বই কি ওই D.I, D.P.I, D.D.P.I-এর মতো পদের লোকেদের...? কথা ঘুরিয়ে বললাম, ‘‘ছি ছি! এরকম renowned educational institute-এর আওতায় যে স্কুল, সেখানে এ কথা কল্পনাও করা যায় না। আমি বলছিলাম, বেতনটা নিয়মিত সময়ে পাওয়া যায় কি না।’’

সকলেই সমস্বরে বলে উঠলেন, ‘‘হ্যাঁ হ্যাঁ। আমাদের প্রতি মাসের পয়লা তারিখেই বেতন হয়। স্কুলের fund ভালো, সেখান থেকেই দিয়ে দেওয়া হয়। পরে adjust করা হয় সরকারী টাকা এলে।’’ পুরো মাস ধরে কেউ খাটলে মাসের শেষে সে সেজন্য বেতন পাবে, এ তো স্বতঃসিদ্ধ কথা। না, অন্য সকলের ক্ষেত্রে হলেও শিক্ষকের ক্ষেত্রে নয়। সে যুগের ভাবনায় তাঁরা মানুষ গড়ার কারিগর হিসাবে গণ্য হতে পারেন, তাই বলে তাঁদেরও যে মানুষ বলে ধরে নিতে হবে, এমন কি কথা আছে...? দু’এক সময় ভাবি, বর্তমান সমাজ কি তার পুরনো পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে চলেছে?

শেষ লগ্নে একটা ভালো প্রশ্ন এলো। ‘‘আচ্ছা, আপনি এই যে B. Ed পড়েছেন, এই ট্রেনিং-এর কি সত্যি কোনও সার্থকতা আছে?’’ এই ট্রেনিং সম্পর্কে শিক্ষিত মহলে, এমনকি শিক্ষক মহলেও একটা অদ্ভুত ধারণা আছে। তখন ট্রেনিংটা এক বছরের হলেও মেরেকেটে দশমাসে দাঁড়াতো, তাই অনেককেই বলতে শুনেছি, ওটা একটা দশমাসের গর্ভযন্ত্রণা। নেহাৎ increment আটকে যাবে ওই ট্রেনিং না নিলে, তাই বাধ্য হয়ে নেওয়া। আমারও বিশ্বাস অন্যান্য ক্ষেত্রের মতোই এখানেও ঘষেমেজে অনেক দূর যাওয়া যেতে পারে, কিন্তু সহজাত প্রতিভা বীজাকারে কারও মধ্যে না থাকলে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা পাওয়া বোধ হয় অসম্ভব। কিন্তু পক্ষান্তরে এটাও বিশ্বাস করি, সদর্থক মনোভাব নিয়ে যদি শিক্ষকরা ট্রেনিং নেন, তবে তাঁদের শিক্ষকতার ক্ষেত্রে প্রভূত পরিমাণে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। কিন্তু দুঃখের কথা, B. Ed কলেজে ছাত্রদের motivate করার জন্য তাঁরা এত কিছু পড়ে আসেন, অথচ ইতিবাচক দিকে তাঁরা নিজেরাই অনেকে তেমন motivated নন। 

ওঁদের প্রশ্নের উত্তরে দৃঢ়তার সঙ্গে জবাব দিলাম, ‘‘নিশ্চয়ই আছে।’’ পরমুহূর্তে ওঁদের চোখের সামনেই হাতের কব্জিতে মোচড় দিয়ে হাতঘড়িটা দেখে বললাম, ‘‘আমি next ট্রেনটা fail করতে চাই না, তাই সব বাদ দিয়ে একটা salient point কেবল উল্লেখ করছি: ‘The teacher teaches John Latin’ – আমাদের অধিকাংশের ধারণা, শিক্ষকের যদি ওই Latin, অর্থাৎ বিষয়টির উপর ভালো দখল থাকে, তা হলেই তিনি ভালো শিক্ষক হতে পারবেন। প্রকৃতপক্ষে তা কিন্তু নয়। ‘Teach’ verbটির দু’টি object-এর অন্যতরটি যে John, অর্থাৎ শিক্ষার্থী, তার সম্পর্কেও গভীর জ্ঞান থাকা দরকার। আমার তো মনে হয়, B. Ed কলেজ থেকে পাওয়া এটিই হচ্ছে প্রথম এবং প্রধান শিক্ষা।’’ একটু থেমে তারপর বললাম, ‘‘কিন্তু B. Ed কলেজের কিছু কিছু শিক্ষা আমি একেবারেই গ্রহণযোগ্য বলে মনে করি না। Teacherকে সব সময় দাঁড়িয়ে পড়াতে হবে, যাঁরা এরকম preach করেন, তাঁরা তো demonstration-এর জন্য একটি ক্লাস করেই খালাস। করুন তো দেখি দিনে অন্তত পাঁচ‍/ছ’খানা পিরিয়ড আমাদের মতো। তারপর দিন ওরকম উপদেশ। ক্লাস ফাইভে পড়া-না-পারা ছাত্রের মতো দাঁড়িয়ে থেকে অতগুলো ক্লাস করতে পারবো না। আমার সাধ্যমতো যত্ন করে পড়াবো – বসে কি দাঁড়িয়ে, সেটা ঠিক করার স্বাধীনতা আমার।’’

সেক্রেটারি Dr. P. N. Chatterjee নমস্কারের ভঙ্গিমায় হাত দু’টো জড়ো করে বললেন, ‘‘Well, Mr. Gupta…’’ অর্থাৎ কিনা আপনার ইন্টারভিউ শেষ। এবার আপনি আসতে পারেন। বেরিয়ে যাবার জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠে প্রতিনমস্কারের ভঙ্গিতে আমি বললাম, ‘‘Don’t mind, আমার পরিচয় তো আপনারা সবিস্তারে নিলেন, আপনাদের পরিচয়টা তো জানা হলো না।’’ Dr. Chatterjee-র দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিলো বলে অন্যদের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করতে পারিনি। কিন্তু দেখলাম Dr. Chatterjee-র মুখে এবং শরীরের উর্ধ্ধাংশে পলকে একটা মৃদু তরঙ্গ খেলে গেলো। এক এক করে পরিচয় করিয়ে দিলেন... ‘‘আমি Dr. P. N. Chatterjee, এই স্কুলের সেক্রেটারি, বি. ই. কলেজের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং-এর হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট, ইনি ডঃ বরদানন্দ চ্যাটার্জী, স্কুলের প্রেসিডেন্ট, বি. ই. কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল, ইনি...।’’ সবাইকে হাত জোড় করে নমস্কার জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

কিছুদিন বাদে appointment letter পৌঁছলো ডাকযোগে। কিন্তু তাতে কী হলো? কেউ কেউ যেমন ভারতীয় হয়েও একজন ইংরেজের চেয়ে বেশী ইংরেজ বা হিন্দু হয়েও একজন মুসলমানের চেয়ে বেশী মুসলমান, তেমনি আমার আগের স্কুলের হেডমাস্টার মশাই আইনজীবী না হয়েও একজন আইনজীবীর থেকে বড় আইনজীবী। ওই পদে বৃত থেকে তিনি তাঁর ‘ল’ ডিগ্রির সমগ্র জ্ঞান উজাড় করে দিয়েছিলেন সমস্ত শিক্ষকদের ‘টাইট’ দেবার জন্য (বলা বাহুল্য, স্তাবকদের বাদ দিয়ে)। পুরো এক মাসের নোটিস চাই, সে কথা জানিয়ে মডেল স্কুলের কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি লিখলাম। তাঁরা একমাসের time extend করে চিঠি পাঠালেন। কিন্তু দুঃখের কথা, ডাকে যাবার সময়টুকুর জন্য যে allowance রাখা দরকার, তা তাঁরা রাখেননি। কাজেই আমি যে তিমিরে, সেই তিমিরেই। তখন এখানে আসার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছি। তা ছাড়া সকলে জেনে গেছে যে আমি চলে যাচ্ছি। তারপর যদি কোনও কারণে থেকে যাই, সেটা হয়ে যাবে একটা মর্যাদা নিয়ে টানাটানির ব্যাপার। অতএব স্বামী-স্ত্রী পরস্পরে আলোচনা-পরামর্শ করে আমি শেষ পর্যন্ত এসে সেক্রেটারির সঙ্গে দেখা করলাম তাঁর বি. ই. কলেজের চেম্বারে। সৌজন্য দেখিয়ে তিনি যা বলার তা বললেন। তারপর বললেন, কিন্তু এ ব্যাপারে হেডমাস্টারের সঙ্গে কথা বলা দরকার, কারণ স্কুল তো চালান তিনিই। স্কুলে প্রধান শিক্ষকের কাছে গেলাম। কিছুক্ষণ বাদে সেক্রেটারিও এলেন। এটা সেটা একটু সংক্ষিপ্ত আলোচনা করে তিনি বললেন, ‘‘এরকম অবস্থায় যাতে উনি clear এক মাসের নোটিস দিতে পারেন, আমরা অগত্যা সেটাই করি, কি বলেন, মিস্টার রক্ষিত? সেটাই ভালো হবে তো? তবে হ্যাঁ, এর পর আমাদের পক্ষে আর সময় বাড়ানো সম্ভব হবে না।’’ আমার দিকে তাকিয়ে জানালেন স্কুলের এই বিষয় নিয়ে সমস্যার কথা। দীর্ঘদিন এই বিষয়ের দু্’টি পদ খালি পড়ে আছে, ছেলেমেয়েরা suffer করছে। আমি সহানুভূতি জানালাম। এই পরিস্থিতির জন্য আমার যে কোনও দায়িত্ব নেই, সে কথা তিনি অবশ্য তাঁর চেম্বারেই বুঝে গিয়েছিলেন। এটাই শেষবার, এর পর আর সময় বাড়ানো যাবে না, প্রধান শিক্ষককে সে কথাটা চিঠিতে উল্লেখ করে দিতে বললেন। চিঠি টাইপ হলো। উনি সই করলেন। আমাকে সে চিঠি দেওয়া হলো। আমি তা নিয়ে ফিরে গেলাম আমার জায়গায়। তারপর যোগ দিলাম বি. ই. কলেজ মডেল স্কুলে নববর্ষের ছুটির পরের দিন – খ্রীস্টাব্দ ১৯৬৭, ইংরেজি তারিখটা বোধহয় ১৭ই এপ্রিল।

সেদিন আমার যোগদানের দিনটি সম্পর্কে সেক্রেটারি হিসেবে ডঃ চ্যাটার্জী নিজেই যা করার করে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি প্রধান শিক্ষককে সঙ্গে নিয়ে যে কাজটি করলেন, তাতে ওই চেয়ারকে মর্যাদা দেবার সৌজন্যই প্রকাশ পেয়েছিলো। পরে তাঁকে আমার যতটুকু দেখার সুযোগ হয়েছিলো, তাতে সবার ক্ষেত্রেই তাঁকে এই সৌজন্যপূর্ণ আচরণ করতে দেখেছি। তাঁর আরেকটা আশ্চর্য গুণ দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যেতাম। চলিত একটি কথা আছে, সংসারে হাঁড়ি-কলসী পাশাপাশি থাকে বলে একটু ঠোকাঠুকি, একটু শব্দ হয়। একটা পরিবারের মানুষজন সম্পর্কেও সে কথা খাটে। স্কুলও তো এক অর্থে একটি পরিবারের মতোই। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনও শিক্ষকের হোক বা কোনও শিক্ষকের সঙ্গে অপর একজন শিক্ষকের হোক, যে কোনও বিরোধের ক্ষেত্রে, এমনকি সেই বিরোধে যদি ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকরাও জড়িয়ে যেতেন, সব ক্ষেত্রে আমি তাঁকে আশ্চর্য নৈপুণ্যে সব কিছু মিটমাট করতে দেখেছি। সমস্যা সামাল দিতে অন্যের দোষ নিজের ঘাড়ে নিতে কখনোই পিছপা হতেন না। 

একবার বি. ই. কলেজের স্টুডেন্টস্ হলে স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং শিক্ষকদের পক্ষ থেকে কিছু আলোচনা করার জন্য অভিভাবকদের আমন্ত্রণ করে আনা হয়েছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা ছিলো। কিন্তু একজন অভিভাবক যেন মহা উৎসাহে হঠাৎ লাফিয়ে উঠে বলতে চাইলেন, ‘‘ইউরেকা! ইউরেকা! কী পেয়েছেন?’’ আমন্ত্রণের কার্ডে একটা ভুল ছিলো, যাকে বলা হয় slip of the pen। তাই নিয়েই ধুন্ধুমার কাণ্ডের আয়োজন, আর কি! শিক্ষকরা যদি এমনি ভুল করে তাহলে ছাত্ররা কী শিখবে? বলা বাহুল্য, সেক্রেটারির জবানীতে প্রধান শিক্ষক বা সিনিয়র শিক্ষকদের কেউ একজন ওটা লিখে কোথায় কোন অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে যাবেন। 

শিক্ষকদের মুখে একটা অপ্রস্তুত ভাব। নিমেষে ডঃ চ্যাটার্জী উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘‘না না, ওটা আমারই ভুল হয়েছে। ছাপা হয়ে যাবার পর চোখে পড়েছে। একটু ক্ষমা ঘেন্না করে নিন, কী আর করা যাবে? আমারই ভুল, আমারই ভুল...’’ মুহূর্তে সমস্ত সমস্যার মেঘ উধাও। ব্যাপারটা সকলেই বুঝলেন, কিন্তু লেবু কচলাবার সুযোগ আর কেউ পেলেন না।

এখানে আরেকটা জিনিস বিশ্লেষণের আছে। তিনি নিজের কাঁধে দোষটা চাপিয়ে নিলেন ঠিকই, কিন্তু হাতের বিচিত্র মুদ্রায়, মুখের বিশিষ্ট ভঙ্গিমায় চোখের সামনে যেটা ফুটে উঠলো, তা হলো যেন কোনও বাচ্চা ছেলে হাত-পা ছুঁড়ে অভিযোগ করছে... ‘‘অ্যাঁ, তুমি আমায় এই বলেছো, অ্যাঁ, তুমি আমার এটা ভেঙেছো’’, আর অভিভাবক কেউ একজন তার পিঠ চাপড়াতে চাপড়াতে বলছেন, ‘‘হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা, আমি করেছি, আমি ভেঙেছি। অন্যায় হয়ে গেছে।’’ অভিযোগকারী অভিভাবককে hurt করা হলো না কোনওমতেই। কিন্তু উপস্থিত সকলের মনের ফ্রেমে বাঁধা হয়ে রইলো একটি অসাধারণ ছবি। A whining child and a loving father figure। নিজেকে নত করেই তাঁর class যে কত উন্নত, তা তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তিনি যেটা করেছিলেন সেটা সচেতনভাবে নিজের মর্যাদা বাড়ানোর জন্য নয় আদৌ, একান্তভাবেই ওই প্রতিকূল পরিস্থিতিকে সামাল দিতে।

দুই বিরোধী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের মীমাংসায় তাঁর সালিশীতে একটা জিনিস আমি বারবার লক্ষ্য করেছি এবং বিস্ময়-বিমুগ্ধ শ্রদ্ধায় স্তব্ধ হয়ে গেছি। ওঁর সালিশীতে কেউ বিজয়ীর গর্ব বা উল্লাস নিয়ে বাড়ী ফিরতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু বিরোধী দুই পক্ষের কারও চোখে মুখে লেখা দেখিনি পরাজয়ের বিন্দুমাত্র গ্লানি বা বেদনা। অনেক সময় ভেবেছি, আদর্শ অনুসরণের rigidityতে কিছু সংখ্যক মানুষের স্নেহ-শ্রদ্ধা-ভালোবাসা পেয়েছি, সন্দেহ নেই। কিন্তু ওই rigidity এবং শাণিত বাক্যবাণের জন্য সারাজীবন কত না শত্রু সৃষ্টি করেছি। এই মানুষটির ওই অসামান্য গুণের যদি একটি কণাও পেতাম, তাহলে জীবনটা আমার হয়তো এতটা সংক্ষুব্ধ হতো না।

একটি কাহিনীর মধ্যে অন্য একটি বিষয়ের (যেটি নিজেই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রবন্ধ হতে পারে) প্রক্ষেপণ ঠিক নয়, বুঝতে পারছি। তবু যেহেতু my days are numbered, তাই ত্রুটির অমর্যাদাকে বরণ করে নিয়েও অনেকগুলির মধ্যে শেষে একটিমাত্র প্রসঙ্গের উল্লেখ করে করে উপসংহার টানবো।

কোনও এক মাসের পয়লা তারিখ। সন মনে নেই। বেতন পাবার দিন। কিন্তু স্কুলে এসেই শুনলাম দুঃসংবাদ, ডঃ চ্যাটার্জীর খুব নিকট একজন (সম্ভবত বাবা, এতদিন বাদে ঠিক মনে করতে পারছি না) মারা গেছেন। আসল শোকসংবাদ এটাই। কিন্তু এই ঘটনার corollary আরেকটি ঘটনা এবং সেটাও কম দুঃসংবাদ নয়, অনেকেরই চোখে মুখে নির্বাক ভাষায় যেন সেরকম একটা ভাবই ফুটে উঠছিলো। ব্যাপারটা হলো বেতনের দিন, কিন্তু বেতন হবে না। তখনকার system-এ স্কুল থেকে সেক্রেটারি ও প্রধান শিক্ষক মহাশয়রা তাঁদের সই করা চেক পাঠাতেন ব্যাঙ্কে। চেক ভাঙিয়ে টাকা তুলে এনে তবে সকলকে pay করা হতো।

কিন্তু এ কী দেখছি! কি বিস্ময়! সেক্রেটারি ডঃ চ্যাটার্জী শ্মশান থেকে সরাসরি স্কুলে চলে এসেছেন। আরও হয়তো আধ ঘন্টার মধ্যে গেলে ব্যাঙ্ক থেকে চেক পেমেন্ট করবে। ডঃ চ্যাটার্জী তাগাদা দিলেন, ‘‘নিন, বার করুন, বার করুন, কোথায় কী সই করতে হবে। মিস্টার রক্ষিত, একটু দেখে শুনে দিন, কিছু বাদ পড়লো না তো? আমি সব কিছু দেখে উঠতে পারছি না। সব ঠিক আছে তো?’’

আবেগে আপ্লুত শিক্ষকরা অগোছালো ভাষায় তঁদের বিস্ময় ও কৃতজ্ঞতার কথা প্রকাশ করলেন। তিনি বললেন, ‘‘না না। ঠিক আছে, ঠিক আছে। আপনারা বেতন পাবেন বলে আশা করে আজ স্কুলে এসেছেন। হঠাৎ করে এরকম না পাবার ব্যাপার ঘটলে কোথায় কোন অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে যাবেন!’’

তাঁর এই অসামান্য কর্তব্যনিষ্ঠার এরকম উদাহরণ চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করে নিজের অজান্তেই চোখের কোল আমার কখন ভিজে গিয়েছিলো।

0 comments: