undefined
undefined
undefined
ছোটগল্প - মনোজিৎকুমার দাস
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
ইলুরে অবশ্যই আসছি
মূল কাহিনী: গুদিপতি ভেঙ্কাটাচলম
অনুবাদ: মনোজিৎকুমার দাস
ট্রেনের ছোট একটা কম্পার্টমেন্টের আপার বার্থে আমি আমার বিছানা পেতে ব্যাগটা মাথার নিচে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। এগারোটা কিংবা বারোটা হবে হয়তো তখন, কে যেন আমাকে ঠেলা দিয়ে জাগিয়ে দিলে চোখ খুললাম, একজন অপরিচিত বিধবা মহিলা নিচে দাঁড়িয়ে; বয়স চল্লিশের বেশি, দেখতে অপূর্ব সুন্দরী। মাথার এলোমেলো চুলগুলোর অর্ধেকেরই রঙ ধূসর।
আমি এক ধরণের ঘোরের মাঝে উঠে বসলাম। কম্পার্টমেন্টে আমরা দু’জন ছাড়া অন্য কেউ নেই। আমি বাইরের দিকে তাকালাম।; চোখে পড়লো নিছাদাভেলি স্টেশন। ‘‘আপনি কে দয়া করে বলুন!’’ আমি মহিলাটিকে বললাম। তাঁর মুখটাতে হাসি হাসি ভাব।
‘‘আগে নেমে আসুন।’’ মহিলাটির কন্ঠস্বরে পরিচিতজনের আভাস। কম্পার্টমেন্টের ল্যাম্পের আলো তাঁর মুখের উপর পড়ে অবর্ণণীয় সৌন্দর্যের বিচ্ছুরণ ঘটেছে বলে আমার মনে হল। কথা বলার সময় তাঁর গোলাপী গাল দুটোয় টোল পড়তে দেখলাম। তাঁর চোখ দুটো মোহনীয়। ঠোঁটদুটো পেলব, আর লালচে, দাঁতগুলো মুক্তোর মতো ঝকঝকে।
‘‘আপনি কে, অনুগ্রহ করে বলুন।’’ আমি আবার তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম।
‘‘আমি বলছি, আপনি নেমে আসুন।’’ তিনি একই কথা পুনরায় অন্তরঙ্গ কন্ঠে বললেন।
লাফ দিয়ে উপর থেকে নামতে গিয়ে আমার পরনের ধুতি ঢিলা হয়ে প্রায় খুলে যাবার অবস্থা হল। মহিলাটি হেসে উঠে আমার ধুতির এক প্রান্ত ধরে লজ্জার হাত থেতে আমাকে বাঁচালেন। পেছন ফিরে আমি তাঁর হাত থেকে ধুতির প্রান্তটা কেড়ে নিলাম। ধুতিটা ঠিকঠাক করে আবার তাঁর দিকে তাকালাম। মহিলাটির পরনে মহীশুরের সিল্কের ধুতি, বিধবা মহিলারা এ ধরনের ধুতি শাড়ির মতো করে পরে। ধুতির কালচে পাড় জরির সুতোর তৈরি। প্রায় পাঁচ ফুট লম্বা দেহে ধুতিটা শাড়ির মতো করে পরায় মহিলাটিকে সুন্দর লাগছে।
মহিলাটি এবার আমাকে তুমি বলে সম্বোধন করায় আমি হতবাক। তিনি বললেন, ‘‘তোমাকে অনেকদিন ধরে খুঁজছি, কিন্তু দেখছি তুমি আমাকে ভুলে গেছ!’’ আমি তাঁর কথায় হতবিহ্বল হয়ে পড়লাম। আমি এ ধরণের কোনও বিধবার কথা স্মরণ করতে পারছি না, আমার আত্মীয়-স্বজনের মাঝে এমন কোনও মহিলাকে চিনি বলে আমার মনে পড়ছে না। আমি মহিলাটির দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম।
‘‘তোমার ছেলে বুফে কারে খানাপিনা করতে গেছে। তোমাকে বিষণ্ন দেখাচ্ছে কেন?’’ তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন।
ইনি কে হতে পারেন? আমার ছেলে বুফে কারে খানাপিনা করতে গেছে তার অর্থ কী? আমার তো একমাত্র ছেলে। তার মাত্র তিন মাস বয়স। আমার স্ত্রী ছেলে হতে বাপের বাড়ি গেছে। সে এখনও সেখানেই আছে। কোনও স্বর্গীয় চেহারার শয়তানী ভেবে আমি সাবধান হলাম।
‘‘আমার কপালে এটা ঘটার পর তোমার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটেনি। সত্যি তো। তুমি আমাকে এতদিন পরে চিনবে কীভাবে? ন’বছর আগে তোমার সঙ্গে আমার শেষ দেখা। সে সময় আমি দেখতে অন্য রকম ছিলাম।’’ তিনি কথা শেষ করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন।
‘‘একটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে এর মাঝে অবশ্যই। আপনি আমাকে অন্য কেউ ভেবে ভুল করছেন।’’ আমি বললাম।
‘‘আমি ভুল করছি? তুমি ভিজিয়ানা গ্রামের স্কুলে পড়তে না?’’
‘‘হ্যাঁ পড়তাম।’’
‘‘তোমার নাম পুরুষোত্তম না?’’
‘‘হ্যাঁ, আমি পুরুষোত্তম।’’
‘‘এখন তুমি আমাকে চিনতে পেরেছো?’’
আমি স্মরণ করতে চেষ্টা করলাম কিন্তু তাঁকে স্মরণ করতে পারছি না। এর মাঝে মহিলাটি বলে উঠলেন, ‘‘হ্যাঁ, পুরুষ মানুষের হৃদয় পাথর দিয়ে গড়া, সেখানে প্রেম নেই। তারা নির্দিষ্ট ঘটনাকেও মনে রাখতে পারে না। মহিলারা তাদের হৃদয়ে ওগুলোকে গেঁথে রাখতে পারে। ঈশ্বরের কৃপায় কোনও কোনও মহিলা তা স্মরণে রাখতে পারে। অন্য যাত্রী আসার আগে তুমি কি আমার পাশে বসে আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ করবে?’’
‘‘আপনার পদবী কী?’’
‘‘আসল কথায় এসো। এখন আমাকে আমার সম্প্রদায় এবং গোত্র বলতে হবে। ঈশ্বরের দয়ায় আমরা অনেক বছর পরে একত্রে মিলিত হয়েছি। তোমার সাথে সাক্ষাৎ হওয়ায় আমি খুবই খুশি। এমন একটা দিনও নেই যে তোমার কথা আমি ভাবিনি। তুমি আমাকে ছোট একটা উপহার দিয়েছিলে, যা আমার কাছে ছিল মহামূল্যবান, অথচ, তুমি এখনও আমাকে চিনতে পারছো না।’’ মহিলাটি কথাগুলো বলে আবারও কাঁদতে শুরু করলেন। ভালো একটা ঝামেলা। তাঁর কান্না দেখে আমি তাঁর সামনে জড়ভরতের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। তিনি কান্নার মাঝেই আবার বলতে শুরু করলেন, ‘‘আমি তোমার মুখটা দেখেই তোমাকে চিনে ফেলেছিলাম, তোমার বাক্সে টি. পুরুষোত্তম বি. এ. লেখা দেখে আমি তোমার সম্বন্ধে পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম। তুমি বি. এ. পাশ করেছো জেনে আনন্দ পেলাম। তুমি কি আমাকে সত্যি সত্যি ভুলে গেছো? তোমার প্রতিবেশী অডিটরের কথা কি তোমার মনে পড়ে না?’’
মহিলাটির এ কথা শুনে আমার মনটা অতীত দিনে ফিরে গেল। ‘‘মাণিক্কাম্মা গারু। তোমার এতটা পরিবর্তন হয়েছে।’’ আমি আমার কপালে করাঘাত করে বলে উঠলাম। সে সময় আমি তাকে তুমি বলে সম্বোধন করতাম।
সে সময় আমার বয়স আঠারো বছর। আমি কলেজে ইন্টারের ছাত্র। ষাট বছর বয়সী অডিটর গারু আমাদের বাড়ির উপর তলায় বসবাস করতেন। মাণিক্কাম্মা বিপত্নীক অডিটরকে বিয়ে করে। মাণিক্কাম্মা’র বয়স তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে। তার কোনও ছেলেপিলে না হওয়ায় তার ফিগার স্লিম, এক কথায় তাকে দেখতে পোরসেলেইনের পুতুলের মতো সুন্দর। আমাদের দু’পরিবারের মধ্যে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
তার বৈধব্য, শরীর স্বাস্থ্যের অবনতি, মাথার অর্ধেক চুল পেকে যাওয়া সহ অনেক কিছু পরবর্তীতে ঘটে।
একদিন আমি দুটোর দিকে কলেজ থেকে ফিরছিলাম। মাণিক্কাম্মা গারু আমাকে থামাল, আমি তাদের বাড়িতে গেলাম। সে ফোল্ডিং চেয়ারটা দেখিয়ে আমাকে বলল, ‘‘তুমি আরাম করে বসো।’’ দিনটা ছিল গ্রীষ্মের, গরমটাও বেশ, আমি তালপাখাটা হাতে নিলাম। ‘‘আমাকে বাতাস করতে দাও,’’ সে আমার হাত থেকে হাত পাখাটা ছিনিয়ে নিয়ে বলল। ‘‘না , না আমি নিজেই বাতাস খাচ্ছি।’’ আমি প্রতিবাদ করলাম। ‘‘এতে দোষ নেই।’’ সে আমাকে বাতাস করতে লাগল। আমি চেয়ার থেকে উঠে বললাম, ‘‘আমি কফি খেয়ে আবার কলেজে যাব।’’ ‘‘একটু দাঁড়াও।’’ সে বলল। সে ভেতরে গিয়ে একটা প্লেটে দুটো রসগোল্লা ও জল নিয়ে এলো।
‘‘এগুলো হোটেল থেকে আনা?’’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
‘‘আমি নিজেই বানিয়েছি।’’ সে জবাবে বলল। আমি কখনোই কল্পনা করিনি আমাদের বাড়িঘরের মহিলারা এ ধরনের সুস্বাদু মিষ্টি বানাতে পারে। সে আমাকে বাতাস করতে করতে বলল, ‘‘তোমার মুখ শেভ করার বয়স হয়েছে।’’ আমার মুখে নরম কেশ দেখা দিয়েছে। আমি লজ্জায় নাপিতের দোকানে যাই না।
‘‘তুমি বড় হয়ে গেছ। আমরা অবশ্যই তোমার বিয়ের বয়সী একট কনে খোঁজ করব।’’ সে বলল।
আমি মন্ত্রমুগ্ধ হলাম। গোগ্রাসে খেতে শুরু করলাম। দ্বিতীয় রসগোল্লাটাও খেয়ে ফেললাম। সে দ্রুত ভেতরে গিয়ে আমের চাটনি ও কফি নিয়ে এলো। আমি সেগুলো খেয়ে চলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। ‘‘আমি অস্বস্তির মাঝে আছি। তুমি আমার সঙ্গে কিছু সময় থাক দয়া করে।’’ সে আমাকে বলল। ‘‘কিন্তু কলেজ?’’
‘‘বিকেলে কলেজে গিয়ে কী হবে?’’
‘‘না না এখন আমার অপশনাল ক্লাস আছে।’’
সে আমার হাতটা আঁকড়ে ধরে তার রুমে নিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘‘তুমি একটা ভালো ছেলে! পান খাবে?’’
প্রথম দিনের ঘটনা আমার মনের কোণে ভেসে উঠল। আমি তার সঙ্গে সারাক্ষণ ছিলাম। তার ঠাট্টা-তামাশায় প্রথম দিন আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। আমি মুখে পান পুরে দিয়ে উঠে পড়ার জন্য রেডি হলাম। ‘‘আজ আর কলেজে গিয়ে কাজ নেই।’’ সে আমার গাল দুটোতে টোকা দিয়ে বলল। সে তার হাত দু’খানা আমার কাঁধ দুটোর রাখল। সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বিছানার উপর বসাল।
হঠাৎ করে আমার সারা শরীর গরম হয়ে উঠল। সে আমাকে নিয়ে যা করতে লাগল, তাতে আমার মধ্যেও উত্তেজনা দেখা দিল। এক পর্যায়ে তা আমাকে বজ্রের মতো আঘাত হানল। অবশ্যই আমার বয়স অনুযায়ী আমার এ বিষয়ে স্বাভাবিক উপলব্ধি বোধ বর্তমান ছিল। কিন্তু আমি কখনো মাণিক্কাম্মা গারুকে ওই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখি নি। তখন আমার বয়স আঠারো বছর; তার বয়স আমার প্রায় দ্বিগুণ। আমি তা বুঝতে পারলেও সে মুহূর্তে আমার পক্ষে রুম থেকে বের বাইরে যাওয়া সহজ ছিল না। আমি যেন বাসর রাতে কনের পাশে বসে আছি, এমনটাই আমার বোধ হচ্ছিল।
‘‘আগামীকাল তোমার প্রথম কাজ সেভ করানো। তোমার মুখটা ফুলের মতো পেলব থাকবে, মুখে এক রাশ দাড়ি গোঁফের জঙ্গল বাঁধিয়ে রাখলে তোমার মানায় না।’’ মহিলাটি আমার মুখের দাড়ি গোঁফকে পছন্দ করে না। সে আবার বলতে শুরু করলো, ‘‘প্রথম গজানো দাড়ি নরম থাকে।’’ সে আমার মুখটা তার মুখের দিকে তুলে ধরে তার দুটো বিস্ফারিত চোখ দিয়ে আমাকে দৃষ্টিপাত করল।
‘‘আমি যা করলাম তা কাউকে বলবে না, আমাকে খারাপ ভেব না। আমরা পরস্পর অন্তরঙ্গ, সেজন্যই আমি আমার অধিকার ভোগ করছি- অন্য কিছু কিন্তু ভেব না।’’ সে বলল, ‘‘তোমাকে আমি একটা বাইসাইকেল কিনে দেব। একটা সোনার আংটি তুমি পাবে।’’ সে আমার মুখে একটার পর একটা চুমো দিতে লাগল।
অডিটর গারু এ শহরে পাঁচ মাসের কিছু বেশি ছিলেন। এ সময়ের মধ্যে আমি এক দীর্ঘ আদি রসাত্মক মহাকাব্য রচনা করলাম। ওই মহাকাব্যে একশ’ পঞ্চাশ দিনের একশ পঞ্চাশটা সোনালি পত্র সন্নিবেশিত হল। প্রতিটি মুহূর্ত পরিপূর্ণ ছিল স্বর্গীয় অমৃত ধারায়। তার সুর লয় ছিল শিল্পকলায় ঋদ্ধ। যদিও আমার জীবন ছিল দুর্দশাগ্রস্ত, আমি যেন বেতগাছের মতো নুয়ে পড়তে থাকলাম। ওই পাঁচ মাসে গাছের ডালের মৌচাকের মধু নিঃশেষ হয়ে যেতে লাগল।
আমাদের বিচ্ছেদকে একটা ট্রাজেডি হিসেবে ধরা যেতে পারে। কলেজ ছুটি হলে আমি গ্রামের বাড়ি গেলাম। কলেজ পুনরায় খুললে আমি ফিরে এসে দেখলাম যে তারা বদলী হয়ে অন্য স্থানে চলে গেছে। তারপর থেকে তাদের সম্বন্ধে কিংবা তারা কোথায় আছে সে সম্বন্ধে একটা শব্দও ব্যক্ত হল না। তার ভালোবাসার কাঙাল হবার কারণে এই বিচ্ছেদে আমি মহাকাব্য রচনা করতে পারলে তা হতো রোমান্টিক বিচ্ছেদের মহাকাব্য। বি.এ. পাশ করে আমি সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা দিয়ে একটা সরকারী চাকরী পেয়ে আমার পছন্দের একটি মেয়েকে বিয়ে করলাম। বাসরঘরে কনের দিকে এক নজর তাকালে তার মুখটা লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল। সে সময় আমার মনে পড়ল মাণিক্কাম্মা গারুর সঙ্গে আমার মিলিত হবার কথা। আমি দু’ হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম, তখনো কিন্তু মাণিক্কাম্মা গারুর কথা আমার মানস পটে ভেসে উঠেছিল।
আমার মাঝে একটা অস্বস্তি দেখা দিল। এত বছর পরে তার সঙ্গে আমার সাক্ষাতে আমি তাকে চিনতে পারছিলাম না। ‘‘তোমার কত পরিবর্তন হয়েছে!’’ আমি বললাম। ‘‘নয় বছর হতে চলল। সব কিছুই বদলে গেছে। ঈশ্বরের ইচ্ছায় এতদিন পর আবার আমাদের সাক্ষাৎ ঘটল। তুমি কোথায় যাচ্ছ?’’ ‘‘বেজওয়াদা।’’ ‘‘কেন?’’ ‘‘আমি সেখানে কাজ করি।’’ ‘‘ভালোই হল। তুমি তো আমাদের কাছাকাছি থাকছো, তা তুমি বিয়ে করেছো?’’ সে জিজ্ঞাসা করল। ‘‘আমার দুই সন্তান। দেড় বছরের একটা মেয়ে আর তিন মাসের একটা ছেলে।’’ ‘‘তাহলে তোমার দুই সন্তান। প্রকৃতপক্ষে তোমার কিন্তু সব মিলে তিন সন্তান।’’ ‘‘তিন সন্তান?’’ ‘‘হ্যাঁ, তুমি আমাকে একটা সন্তান উপহার দিয়েছ।’’ তার কথাটা শুনে আমি রোমাঞ্চিত হলাম। ‘‘এখন ওর বয়স নয় বছর। পুরোপুরি তোমার মতো দেখতে। সে ফিরে এলে দেখতে পাবে। যাই হোক, তুমি আমার রক্ষাকর্তা। তোমার দানে আমার স্বামীর উপার্জ্জিত টাকা পয়সা ও সহায় সম্মতির উত্তরাধিকারী হয়েছে সে। তা নাইলে আমার দেওররা সব কিছু দখল করে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতো।’ ’
‘‘তোমরা এখন কোথায় বসবাস করছো?’’ ‘‘ইলুরি আমাদের দেশের গ্রাম। আমি সেখানে দেতলা একটা বিল্ডিং বানিয়েছি। দশ হাজার রৌপ্য মুদ্রা আছে। প্রতি বছর পনের হাজার নারকেল পাই। আমাদের বাড়ি এসে নিজ চোখে দেখে যাও।’’
ছেলেটি ফিরে এলো। ‘‘মা, তুমি ফলটল খাবে না?’’ সে তার মাযের কোলে বসে মাকে জিজ্ঞেস করল। নিঃসন্দেহে আমার ছেলে পুরোপুরি আমার মতো দেখতে, আমার ঔরসজাত সন্তান। আমার তখন আঠারো বছর, আর মহিলাটি আমার চেয়ে আঠারো বছরের মতো বড়। আমার অজান্তেই ছেলেটির জন্ম। তার পিতা কে জানার কোনও উপায় নেই। আমার সন্তানটি ইলুরে গত নয় বছরে বেড়ে উঠেছে। ‘‘আমার ছেলেটাকে দেখেছ?’’ সে বলল। ‘‘অবশ্যই দেখেছি।’’ আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমি আমার পুত্রের দিকে স্নেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আবেগাপ্লুত হলাম। ‘‘এখানে এসো, বাবা।’’ আমি তাকে আপ্লুত কন্ঠে বলে উঠলাম। সে কোনও প্রকার ওজর আপত্তি না করে আমার কাছে এলো। আমি আনন্দের সঙ্গে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করলাম। মাণিক্কাম্মা গারু তার মুখ তার শাড়ির আঁচল ঢেকে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। ‘‘তুমি কোন ক্লাসে পড়?’’ আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম। ‘‘সেকেন্ড ফরমে,” ছেলেটি জবাবে বলল। ‘‘তুমি ওর সঙ্গে ইংরেজিতে আলাপ করতে পার?’ মাণিক্কাম্মা ওকে জিজ্ঞেস করল। তারপর আমায় বলল ‘‘আমি ওকে ইংরেজী শেখানোর জন্য তিন বছর একজন খ্রিষ্টান শিক্ষক রেখেছিলাম।’’ ‘‘আই অ্যাম বিলো টেন। এটা কি ঠিক না ভুল হলো?’’ ছেলেটি জিজ্ঞেস করলো। আমি সত্যি সত্যি সমস্যায় পড়লাম। তার বাক্য শুদ্ধ; আমি ভাবলাম, বিএ পাস করার সার্থকতা কোথায়? আমাদের প্রফেসররা কি আমাদের কলেজে ভালো করে শিখিয়েছিলেন? আমি মনে মনে ভাবলাম। ‘‘তুমি আমাকে বল।’’ আমি বললাম। ‘‘ভুল। আপনার বলা উচিত আই অ্যাম আন্ডার টেন। আমার টিউটর এর বেশি জানতেন না।’’ সে খিলখিল করে হেসে বললো।
‘‘আগামীকাল আমাকে অফিসে যেতে হবে। আমি রোববার আসছি।’’ ‘‘আমি ষ্টেশনে আসব!’’ ছেলেটি বলল। ‘‘অবশ্যই এসো!’’ ছেলেটি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ার অবস্থা হলে আমি উপরের বার্থ থেকে বিছানাটা নিচের বার্থে পেতে দিয়ে তাকে তার উপর শুইয়ে দিলাম। আমি পাশে বসে আমার হাত তার গায়ে রাখলাম।
আমরা এটা ওটা বিষয়ে আলাপ করলাম। এ মুহূর্তটা আমাদের জন্য উপভোগ্য ছিল। পরের ষ্টেশন পুল্লা। ছেলেটি নাক ডাকতে শুরু করল। তারপর ট্রেন দেলদুলুর পৌঁছল। ‘‘আমরা প্রায় এসে গেছি। তুমি তাহলে রোববার আসছ?’’ মাণিক্কাম্মা জিজ্ঞেস করলো। তার চোখ দুটোতে আলোর ছটা, তার পুরো মুখটা আনন্দে উদ্ভাসিত। সাত মিনিটের মধ্যে আমরা ইলুরে পৌঁছালাম। আমি তাদের গেটের বাইরে নিয়ে গাড়িতে তুলে দিলাম। ‘‘মনে থাকে যেন।’’ ছেলেটির মা বললো। ‘‘আপনি রোববার আসছেন তো?’’ ছেলেটি জিজ্ঞেস করল। ‘‘ইলুরে অবশ্যই আসছি।’’ আমি জবাবে বললাম।
0 comments: