অণুগল্প - আইভি চট্টোপাধ্যায়
Posted in অণুগল্প
অণুগল্প
ঠাঁই
আইভি চট্টোপাধ্যায়
‘‘আবার ওকে নিয়ে এসেছিস কেন?’’
‘‘কি করব বৌদি? আমাকে দেখলেই পেছন পেছন চলে আসে। এই, ঘরে ঢুকবি না। সিঁড়িতে বসে থাক।’’
‘‘সিঁড়িতে বসবে না, একদম না। ওপরের ফ্ল্যাটের সবাই রাগ করে। ওকে ঢোকাতে বারণ করেছে।’’
‘‘ও কিছু করবে না বৌদি। চুপ করে বসে থাকবে।’’
‘‘না না। শুধু শুধু লোকে কথা শোনাবে... রোজ সকাল সকাল এই ঝামেলা... ভাল্লাগে না।’’
‘‘আচ্ছা, আমি ওকে রেখে আসছি’’, বাইরে বেরিয়ে চটিতে পা রেখেছে কেবল, বৌদি ছুটে এলেন। ‘‘তুই আবার কোথায় যাচ্ছিস? এই তো আধঘণ্টা দেরি করে এলি।’’
‘‘ওকে রেখে আসি। একা একা বেরোলে... এত গাড়ি... ব্যস্ত রাস্তা...’’
‘‘ব্যস, হয়ে গেল। আচ্ছা উমা, গরজ কি শুধু আমার? তোর কাজের দরকার নেই? মাইনে নিয়েই তো কাজ করিস, নাকি?’’
‘‘কাজই করি বৌদি, তা বলে তো সব বিকিয়ে দিই নি। ওইটুকু ছেলে, এক কোনায় একটু বসে থাকবে... তা যখন হবে না, ওকে রেখে আসছি। কাজ করব না তো বলি নি।’’
নিত্যি ঝামেলা। নিজের তিন ছেলেমেয়ে, মাথার ওপর ছাদ বলতে রেললাইনের ধারে একখানা ঘর। বরটা রাজমিস্ত্রীর কাজ করত, ভারা থেকে পড়ে পা ভেঙেছিল, ঠিকমতো চিকিত্সা হয় নি, এখনো পা টেনে টেনে হাঁটে। রোজ কাজেও যায় না। উমারানীই ভরসা। তবু... কথায় বলে না “আপনি খেতে পায় না, শঙ্করাকে ডাকে!” উমারানীর সেই দশা। রাস্তার একটা ঘেয়ো কুকুর,পা-ভাঙা একটা শালিক, একটা বুড়ো কাক। কাজের বাড়ির বাসি রুটি, পাঊঁরুটি, বিস্কুট। চলে যাচ্ছিল। এবার আস্ত একটা ছেলে। কোথা থেকে এসে ফুটপাতে শুয়েছিল, উমারানীকে দেখেই নাকি সঙ্গে সঙ্গে চলা শুরু করেছে। রোজ কাজে আসার সময় সঙ্গ ধরে।
‘‘কি করব? একটা ছানা মানুষ তো! কিন্তু অত্তটুক মাথায় কত বুদ্ধি, জানো? কিছুতেই আমার সঙ্গে বাড়ি যায় না।’’
বলতে বলতে চোখে জল এলো উমারাণীর। ওইটুকু আস্তানা, বাড়ি কোথায়? রেললাইনের ধারে একখানা ঝুপড়ি ঘর। পাকা ইঁট সিমেণ্টের ঘর নয়, কোনরকমে ঠেকা-জোড়া দেওয়া ঘর। প্রথমদিন পিছু পিছু এসেছিল তো ছেলেটা। লক্ষ্মীর বাপ দেখতে পেয়ে তাড়া দিয়েছিল, ‘‘এই যা ভাগ!’’ ব্যস, সেই যে দাঁড়িয়ে পড়ল। আর এগোয় না।
সারাদিন কোথায় কোথায় ঘোরে কে জানে। রাত হলে ফুটপাথে এসে ঘুম। সেখানেও জায়গা ভাগ করা। যে যার নিজের পরিবারের জায়গা সামলাতে ব্যস্ত। ছেলেটা বারবার ঠাঁইনাড়া। ওই ছেলের জন্যেই রোজ ঘরে ফিরতে দেরি। সন্ধেবেলা মিত্তিরবাড়ি রুটি করে দেয় উমারাণী। চারটে করে রুটি পাওনা। ফুটপাথে ছেলেকে দিয়ে তবে ঘরে ফেরা।
একদিক দিয়ে ভালো হয়েছে। রুটি নেবার জন্যেই ছেলে ফিরে আসে। নইলে প্রথম প্রথম ঘরে ফিরেও কি অশান্তি! ছেলেটাকে দেখে আসতে না পারলেই অশান্তি। কে জানে কোথায় চলে গেল, নাকি গাড়ি চাপা পড়ল।
আহারে, একটা মানুষের বাচ্চা তো বটে। কেমন নিঠুর বাপ-মা, বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে নাকি জন্মের পরই ফেলে দিয়েছে কে জানে। ‘‘তাতে তোর কি? এমন কত বাচ্চা ঘুরছে ফুটপাতে রাস্তায়। স্টেশনে গেলে তো দাঁড়ানো যায় না ওদের জন্যে।’’
এত বড় বড় বাড়ি, কেউ যদি একটু ঠাঁই দিত ছেলেটাকে! মিত্তিরদের ফ্ল্যাটের লাগোয়া কাজের লোকের ঘর। খালিই পড়ে আছে। মল্লিকবাড়িতে অতবড় গাড়ি রাখার গ্যারেজ, পিকলুদের বাড়িতে বাগানের পাশের ঘরটা, পূরবীবৌদির বাড়িতে তো একাই থাকে বৌদি... সবাইকে বলে দেখেছে উমারাণী।
আজ ষষ্ঠীপুজো। উমারাণী কাজে আসে নি। তবে বুঝদার আছে, নিজে না এলেও মেয়েকে পাঠিয়ে দিয়েছে। ‘‘মা বলল, পুজোর দিন সব বাড়িতে অনেক কাজ। তুই যা লক্ষ্মী।’’
‘‘কেন? তোর মা কি রাজকার্যে ব্যস্ত?’’
‘‘আর বোলো না। ওই ভুলুকে ঘরে এনে তুলেছে না? সেই নিয়ে বাপের সাথে ঝামেলা। আর একটুক ঘর বানাতে হবে যে।’’
‘‘ভুলু? ভুলু আবার কে?’’
‘‘ওই যে গো, মায়ের পুষ্যি। ফুটপাতে থাকত, কাল পুলিশের গাড়ি এসে ফুটপাত থেকে সব তুলে দিয়েছে না? মা বলল, আর উপায় নেই, এমনি এমনি তো ছেড়ে দেওয়া যায় না। এত্তবড় দুনিয়ায় একটু জায়গা পাবে না ছেলেটা? একটুখানি ঠাঁই? তাই ভুলুকে আমাদের ঘরেই নিয়ে এসেছে।’’
এক মানবীর গল্প.....
ReplyDeleteশেষ হয়েও হইলনা শেষ............ দারুন লাগল
ReplyDelete