ছোটগল্প - সুবীর বোস
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
মান সরোবর
সুবীর বোস
সেবার এলাহাবাদ যাচ্ছি অফিসের কাজে। সেবারই প্রথম। এর-ওর থেকে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম এলাহাবাদ যেতে হলে চম্বল এক্সপ্রেসই সবচেয়ে ভালো ট্রেন। অন্যদিকে চম্বল এক্সপ্রেস নামটাই দেহ-মনে বেশ একটা শিরশিরানির জন্ম দিল। তাই এক বিকেলে চড়ে বসলাম চম্বল এক্সপ্রেসে। ট্রেনে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, তারপর রাত্রি। আমিও বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া পরোটা আর আলুর তরকারী খেয়ে রাত ন-টা নাগাদ শুয়ে পড়লাম। পরদিন ভোর-ভোর নেমে পড়া গেল এলাহাবাদ স্টেশনে। আমার সহকর্মী সঞ্জয় বলে দিয়েছিল, স্টেশন থেকে রিক্সা নিয়ে “হোটেল রাজ”-এ গিয়ে উঠতে। ওই হোটেলটা নাকি সস্তা এবং খুব ভালো। সঞ্জয় এও বলেছিল, রিক্সাভাড়া যাবার সময় চার টাকা, ফেরার সময় আট টাকা। এমনতর ভাড়া বিন্যাসের কথা শুনে আমার চোখ-মুখে নিশ্চয় কিছু বদল এসেছিল, ফলে সঞ্জয় আরেকটু প্রাঞ্জল হয়, জানিস তো, এলাহাবাদ ইউ.পি-তে, আর ইউ.পি. মানেই তো উল্টো-পাল্টা। পরে বুঝেছিলাম, হোটেল থেকে একটা কমিশন পায় বলেই রিক্সাওয়ালারা যাবার সময় পারলে বিনে পয়সায় নিয়ে যেতে চায় যাত্রীদের। তো, স্টেশনে নেমে রিক্সা নিয়ে চললাম “হোটেল রাজ”-এ। বেশ ছিমছাম হোটেল, ভাড়া বেশ কমই মনে হল। আমার জন্যে বরাদ্দ হল রুম নাম্বার ছয়। কোণার দিকের ঘর, অ্যাটাচ্ড্ বাথ। বেশ পরিষ্কার পরিছন্ন। হাওয়া-বাতাস খেলে ভালো। ঘরে ঢুকে দেখলাম, খাট-বিছানা ছাড়া একটা টেবিল আর একটা চেয়ারও আছে, খাওয়া-দাওয়া বা লেখালিখির জন্যে। সব মিলিয়ে বেশ ভালো ব্যবস্থাপনা।
হোটেলটা যে অঞ্চলে অবস্থিত, সেখানে “মান সরোবর” নামে একটা সিনেমা হল আছে। ওই সিনেমা হলটার নামের জন্যেই কিনা জানি না, এলাকাটাও মান সরোবর নামে পরিচিত। বেলা সাড়ে ন-টা নাগাদ মান সরোবর থেকে “ভিকি” বা “ভিক্রম” (একটু বড় অটো আর কী) চড়ে চললাম নৈনী আই.টি.আই.তে, আমার আসল কাজ ওখানেই। নৈনী আই.টি.আই.তে দেখলাম প্রচুর বাঙালি অফিসার রয়েছেন। তাঁদেরই একজন মহিম হালদার প্রথম দিনেই আমার খুব প্রিয় হয়ে উঠলেন। ভদ্রলোক দীর্ঘদিন এলাহাবাদ বাসিন্দা, তবু হিন্দী বলেন বাঙাল টোনে। এমনকী ইংরেজীটাও, আমি যা শুনেছি, মনে হল বাঙাল টোনেই বলা। ওই প্রথম দিনেই তার এক অধস্তনকে অননুকরণীয় বাঙাল টোনে যখন বলছিলেন, “ওয়ান্স আই পুট মাই সিগনেচার...তুম জানতে হো”...খুব হাসি পেয়েছিল। বিশেষ করে ওনার “ওয়ান্স” এর “স” আর “সিগনেচার”এর “চ”এর উচ্চারণ, যেটা আসলে “স” আর “চ”এর মাঝামাঝি কিছু, যা শুনে খুব মজা পেয়েছিলাম। পরে আরেকজন বলেছিলেন, হালদারবাবুকে নাকি বাকিরা আড়ালে “হাবিলদার” বলে ডাকেন। এই হালদারবাবু তাঁর উচ্চারণে যথাসাধ্য ‘এ দেশ’ এনে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘তা, সুমিতবাবু, কোন হোটেলে ওঠা হয়েছে?’’ বললাম, ‘‘ভাববাচ্য ছাড়ুন, সরাসরি তুমি বলুন। চাইলে পরিষ্কার বাঙাল ভাষায় কথা বলতে পারেন, সমস্যা নেই।’’ মহিম হালদার খুব খুশি, বললেন, ‘‘হ, কোন হোটেলে উঠস?’’ হোটেলের নাম শুনে ওঁকে একটু চিন্তিত দেখাল, জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘রুম নাম্বার কও।’’ রুম নাম্বার শুনে মহিমদাকে একটু যেন আরও চিন্তিত মনে হল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘‘সাবধানে থাইকো।’’
আই.টি.আই.তে সারাদিন এ টেবিল থেকে সে টেবিল ঘোরাঘুরি করে ক্লান্ত আমি হোটেলে ফিরে রাতের খাবারটা হোটেলের ঘরে বসেই সেরে নিলাম। কিছুক্ষণ পর যখন বিছানায় আধশোয়া হয়ে সারাদিন কী কী কাজ করলাম তার একটা রিপোর্ট বানানোর চেষ্টা করছি, হঠাৎ মনে হল আশপাশ থেকে হাল্কা চুড়ির শব্দ ভেসে আসছে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলাম, কিছুই নেই, কেউ কোত্থাও নেই। মনের ভুল ভেবে আবার লেখায় মন দিয়েছি, ফের সেই চুড়ির শব্দ। যুক্তি বলল, দেয়ালের ও পাশের ঘর থেকে নির্ঘাত শব্দটা আসছে, মন বলল, এ অন্যকিছু। তবু বিছানা থেকে উঠে ঘরের এদিক-ওদিক একটু ঘুরে দেখে নিলাম। নাহ্, কিছু নেই। আবার খাতা-কলম নিয়ে বসে গেলাম। আর কোনও আওয়াজ নেই। রিপোর্ট শেষ করে শুয়ে পড়লাম। আগের রাতে ট্রেনে তেমন ঘুম হয়নি, এ ছাড়া সারাদিনের ক্লান্তি - ফলাফল, চোখ বোজা মাত্রই ঘুম।
পরদিন মহিমদার সঙ্গে দেখা হওয়া মাত্র প্রশ্ন ধেয়ে এল, ‘‘কাল হোটেলে কোনও সমস্য হয় নাই তো?’’ বললাম, ‘‘না, কোনও সমস্যা হয়নি। দারুণ ঘুমিয়েছি কাল রাতে।’’ মহিমদাকে বেশ খুশি মনে হল। ঠিক তখনই মনে পড়ল ওই চুড়ির শব্দের ব্যাপারটা। মহিমদাকে ব্যাপারটা বলতেই উনি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন, তারপর বললেন, ‘‘তুমি পারলে ওই রুমটা চেঞ্জ কইরা নাও।’’ বললাম, ‘‘কেন? ওই ঘরে কোনও সমস্যা আছে নাকি?’’ মহিমদা একটু আমতা-আমতা করছেন দেখে চেপে ধরলাম ওঁকে, ‘‘বলতেই হবে আপনাকে।’’ মহিমদা একটু গলা খাকারি দিয়ে বললেন, ‘‘আসলে হোটেলের ওই ঘরে একটা বাঙালি মাইয়া বিষ খাইয়া আত্মহত্যা করসিলো। সেই সময় ওই ঘটনাটা নিয়া এলাহাবাদে খুব হুলস্থুল হইসিলো, হোটেলটাও বন্ধ ছিলো কিসুদিন। সেও তো প্রায় দুই-বছর হইয়া গেল। যাউক গ্যা, তুমি রুম চেঞ্জ কইরা নিও।’’ সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হল, মহিমদার মুখে ওইসব শুনেও আমার তেমন কোনও প্রতিক্রিয়া হল না। রুমটা বেশ ভালো। মনে হল, সেই ক’বে, দু-বছর আগে কে আত্মহত্যা করেছে, তার জন্যে আমি অমন সুন্দর ঘরটা ছাড়তে যাব কেন? বললাম, ‘‘মহিমদা, আমি ওই ঘরেই থাকছি। যা হ্য় হবে। শুধু চুড়ির শব্দ শুনে অমন সুন্দর ঘরটা ছাড়া ঠিক হবে না।’’ মহিমদা এবার যেন মনে হল আমাকে একটু খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলেন। জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘মহিমদা কী দেখছেন অমন করে?’’
‘‘না, দেখতাসি, তোমার মাথায় জটা আছে নাকি।’’
‘‘সেকি! জটা দিয়ে কী হবে?’’
‘‘আসলে আমার বাবা কইতো, যার মাথায় জটা আছে, তারে ভূতেও ডরায়। বাবা সুমিত, তোমার জটা নাই, কিন্তু এইটা বুঝতে পারতাসি যে, তুমি খুব সাহসী। তবে একটা সুবিধা তুমি পাইবা।’’
‘‘সেটা কী? আমি জানতে চাই।’’
‘‘ভূত আইলে বাংলা ভাষায় কথা কইতে পারবা। বাঙালি ভূত তো...’’
‘‘মহিমদা, আপনি সত্যিই মজার মানুষ।’’
‘‘বাবা সুমিত, আবার কইতাসি একটু সাবধানে থাইকো।’’
মহিমদার কাছ থেকে একটু তাড়াতাড়ি বিদায় নিয়ে ইভনিং শো ঢুকে পড়লাম মান সরোবর সিনেমা হলে। সে এক ধুমধড়াক্কা হিন্দী সিনেমা। নায়ক সুনীল শেঠি, নায়িকা শিল্পা শেঠি। সব মিলিয়ে “টেল অফ টু শেঠিস” আর কী। একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখলাম, সিনেমা হলের ভিতরে বসেই লোকজন সিগারেট ফুঁকছেন। খুব খারাপ লাগছিল। সে যাক, জমিয়ে সিনেমা দেখে পাশের একটা রেস্তোরাঁতে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। তারপর সোজা হোটেলের ঘরে। আবার সেই রিপোর্ট লেখা, শুয়ে পড়া।
রাত তখন প্রায় দুটো। চুড়ির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। এবার শব্দটা বেশ জোরে জোরে হচ্ছিল। এর মধ্যেই মনে হল আমাকে বিছানা থেকে কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবার চেষ্টা করছে। ধুত্তেরি বলে উঠে বসলাম। লাইটটা জ্বালাতে যাবো, এ সময় একটা নারী কন্ঠ পরিষ্কার বাংলায় বলে উঠল, ‘‘আলো জ্বালাবেন না প্লীজ।’’ আমি অবাক। এ কে রে বাবা! ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। এ এলোই বা কী করে? তবে কি এই ঘরে আগে থেকেই কেউ ঢুকে বসেছিল। আমার মনে অনেক রকম অশুভ চিন্তা ভিড় করে এল। ভিতরে ভিতরে বেশ ঘাবড়ে গেলাম। খুব জড়সড় আমি প্রশ্ন করলাম, ‘‘আপনি কে? আর আলো জ্বালাবোনাই বা কেন?’’
‘‘আমি মন্দিরা, এই ঘরে আত্মহত্যা করেছিলাম বিষ খেয়ে। আলো জ্বালালে আপনি ভয় পেয়ে যাবেন।’’
মনে পড়ল, আরে এর কথাই তো মহিমদা বলছিল। কী ঝঞ্ঝাট রে বাবা! দিন কয়েকের কাজে এসেছি এলাহাবাদে, সেখানেও ভূতের উৎপাত। তবু অদেখা তাকে প্রশ্ন করলাম, ‘‘আপনাকে দেখে ভয় পেয়ে যাব কেন?’’
‘‘আমার দু-কষ বেয়ে এখনও সাদা ফেনা গড়াচ্ছে। এ ছাড়া প্রায় একদিন এই ঘরে মৃত পড়েছিলাম বলে, ইঁদুরে আমার একটা চোখ খুবলে নিয়েছে। সে এক বীভৎস অবস্থা, এ সব দেখলে আপনি ভয় পাবেন না?’’
‘‘না, ভয় পাব না। আপনি ঠিক কী চান বলুন তো?’’
আমার ভয় লাগছে না কেন, এটা ভেবে আমি নিজেও কিন্তু খুব আশ্চর্য হচ্ছিলাম।
‘‘আমি চাই আপনি কালকেই এ ঘর থেকে চলে যান।’’
আরে, এ তো মহা ঝামেলায় পড়া গেল! সবে দু-দিন হল এসেছি। পুরো ভাড়া দিয়ে আছি। কে না কে উনি, আমায় বলছেন চলে যেতে। বেশ রেগেই বললাম, ‘‘কেন? চলে যাব কেন? এ ঘরে যে আসে তাকেই কি আপনি এ ভাবে ভয় দেখিয়ে তাড়ান? তা নিশ্চয় করেন না। যদি তাই হত তো হোটেলের এ ঘর তো আর কাউকে ভাড়া দেওয়া হত না।’’
‘‘না, আমি সবাইকে এ ঘর থেকে তাড়াতে চাই না। গত দু-বছরে একজনকেও তাড়াইনি।’’
‘‘তবে আমাকে কেন তাড়াতে চাইছেন? বেশ ঝাঁঝাঁলো গলায় বললাম।’’
‘‘কারণ আপনি বাঙালি।’’
যা বাব্বা, আমি তো জানতাম পশ্চিম বঙ্গের বাইরে বাঙালির সবচেয়ে বড় বন্ধু বাঙালি। এ তো দেখি উলটো কথা কয়। ভাবলাম আমিও একটু অন্য কথা বলি, ‘‘আমি বাঙালি আপনাকে কে বলল? বাংলায় কথা বললেই বাঙালি হয় নাকি? আমি ইউ.পি, বেনারসের লোক। অফিসের কাজে অনেকদিন বাংলায় থাকতে হয়েছে বলে, বাংলাটা ভালো বলতে পারি।’’ আমি চেষ্টা করলাম ভূতরানীকে কনফিউজ করার।
‘‘ঠিকই বলেছেন, বাংলায় কথা বললেই বাঙালি হয় না। তবে প্রকৃত বাঙালি দুয়েকটা এমন শব্দ ব্যবহার করে, যেটা অন্যেরা বাংলা শিখেও পারবে না।’’
‘‘সেটা কী রকম?’’ কৌতুহলী আমি জানতে চাই।
‘‘কাল রাতেই দেখেছি আপনি বিড়বিড় করে কাকে যেন বলছেন, ব্যাটা, ঘাউড়া। ওই ‘ঘাউড়া’ শব্দটা প্রকৃত বাঙালি ছাড়া কেউ বলবে না।’’
ভূতরানীর চমকপ্রদ ব্যাখ্যা শুনে আমি অবাক। তারপর মনে হল, ধুর, এত কথা কে শুনবে, তাই আবার আলোটা জ্বালাতে যাই। উল্টোদিক থেকে আবার সাবধান বাণী ভেসে এল, ‘‘আলোটা জ্বালবেন না।’’ হঠাৎ মনে পড়ল, আরে আসল কথাটাই তো জানা হল না, তাই ফের প্রশ্নে ফিরে এলাম, ‘‘আমি বাঙালি আর সে জন্যেই আমাকে আপনি তাড়াতে চাইছেন। কিন্তু কেন? এর পিছনের কারণটা বুঝতে পারছি না।’’
‘‘যে হতচ্ছাড়ার জন্যে আমাকে আত্মহত্যা করতে হয়েছিল, সে ছিল বাঙালি। আমাকে অনেক ভালো ভালো কথা বলত এক সময়। তারপর... থাক, সে কথা। আপনি কাল এ ঘর ছেড়ে চলে যাবেন।’’
‘‘যদি না যাই?’’ ভয় দূরে থাক, আমার কেমন যেন মজা লাগছিল।
‘‘না গেলে, কালকেই আপনার শেষ রজনী, এটা মনে রাখবেন।’’
আশ্চর্য, ভূতরানীর অমন কথার পরেও আমার ভিতরে ভয়ের নাম গন্ধ নেই। সেটা বোধহয় আমার প্রতিপক্ষও টের পেয়েছিল। তাই আবার সে বলল, ‘‘ভাববেন না, ওটা কথার কথা। হয় এ ঘর ছাড়বেন, নইলে কালকেই...।’’
বললাম, ‘‘ঠিক আছে, কালকের কথা কাল ভাবা যাবে। আপাতত আপনি কেটে পড়ুন, আমি ঘুমোই।’’ মন্দিরা, থুড়ি ভূতরানী চলে গেল, আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম নিশ্চিন্তে।
সকালে উঠে রাতের কথাগুলো ভাবলাম। একবার মনে হল স্বপ্ন, একবার মনে হল সত্যি। ভাবলাম হোটেলের লোকজনকে বলি ব্যাপারটা। তারপর মনে হল, এসব শুনে আমাকে নির্ঘাত পাগল ভাববে ওরা। তবু ঘর তো বদলাতেই হবে, নইলে “অদ্য শেষ রজনী”। অবাক কাণ্ড, হোটেল কতৃপক্ষ বলল, সেদিন কোনও ঘর খালি নেই, পরদিন হয়ে যাবে। একবার ভাবলাম হোটেল ছেড়ে দিই। তারপর মনে হল, আজ রাতে ভূতরানী এলে, এক দিন সময় চেয়ে নেব। আফটার অল বাঙালি তো, এটুকু ছাড় নিশ্চয় দেবে।
বেলা দশটা নাগাদ মহিমদার কাছে পৌঁছতেই, উদ্বিগ্ন মহিমদার প্রথম প্রশ্ন, ‘‘কোনও প্রবলেম হয় নাই তো? রাত্রে ঠিকঠাক ঘুম হইসে তো?’ একবার ভাবলাম, মহিমদাকেও কিছু বলব না। তারপর মনে হল, ওঁকে বলা যায়। বললাম। আমার মুখ থেকে সব শুনে মহিমদা প্রায় মিনিট দুয়েক হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘‘তুমি তো বাবা ডেঞ্জারাস পোলা। তোমার ভয় লাগলো না? আমি তো শুইনাই কাঁপতাসি। মাথায় জটা নাই, তাতেই এই, থাকলে না জানি কী করতা। তুমি ভায়া ওই হোটেলটা ছাইড়া দাও। চল, আমি তোমার লগে যাইতাসি।’’ বললাম, মহিমদা, ‘‘অত চিন্তা করবেন না। আমি কাল বদলে নেব ঘর। একটা তো রাতের ব্যাপার।’’ মহিমদাকে দেখে মনে হচ্ছিল, উনি সন্দেহ করছেন, আমিই ভূত কিনা। শুধু বিড়বিড় করে বললেন, ‘‘আজকালকার পোলাপাইনগুলা...।’’
রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে, রিপোর্ট লিখতে একটু রাত হয়ে গেল। বালিশে মাথা দেবার আগে সময় দেখলাম রাত প্রায় একটা বাজে। লাইট নিভিয়েছি, সঙ্গে সঙ্গে আবার সেই মহিলা কন্ঠ, ‘‘আপনাকে বলেছিলাম, এ ঘর ছেড়ে দিতে।’’ আজ আমি আর অপরপক্ষকে সুযোগ না দিয়ে আলো জ্বেলে দিলাম। উফ্, কী বীভৎস এক মুখ। একটা চোখ আধ খাওয়া, অন্য চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বেরচ্ছে, ঠোঁটের কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ফেনা। এ সব দেখে আমি একটু যেন হোঁচট খেলাম, একটু যেন থমকে গেলাম। উল্টোদিকে তখন প্রবল হুঙ্কার, ‘‘তোকে বলেছিলাম আলো না জ্বালতে (বুঝলাম রাগের চোটে “আপনি” থেকে “তুই”তে নেমে এসেছি), তুই শুনিসনি। তোকে বলেছিলাম এ ঘর ছাড়তে, ছাড়িসনি। দেখি এবার তোকে কে বাঁচায়!’’
বললাম, ‘‘কী করব, আজ এ হোটেলে অন্য কোনও ঘর খালি নেই, কাল চলে যাব ঠিক।’’ এবার ভূতরানীর গলা আরো হিংস্র, ‘‘তুই এ হোটেল ছেড়ে দিলি না কেন?’’ বললাম, ‘‘আরে, আমি ভাবলাম, একদিনের তো ব্যাপার। তা ছাড়া আপনিও বাঙালি, আমিও...।’’ কথা শেষ হবার আগেই ও দিক থেকে হুঙ্কার, ‘‘তুই থামলি। বা-ঙা-লি। আজ তোর মৃত্যু আমার হাতে লেখা আছে। তোকে কাল বলেছিলাম আলো না জ্বালাতে, তুই সে কথাও শুনিসনি।’’ এবার দেখলাম সত্যিই ভূতরানী আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমিও বাঁচার জন্যে চীৎকার শুরু করলাম, ‘‘হেল্প, হেল্প!’’ সারা ঘর ভরে গেল ভূতরানীর অট্টহাস্যে। ‘‘কেউ শুনতে পাবে না। তুই চীৎকার কর, মনের সুখে চীৎকার কর।’’ ভূতরানীর কথা শেষ হবার পরে দেখি, এক জোড়া নোংরা হাত আমার গলার দিকে এগিয়ে আসছে। মানুষ যেমন বিপদে খড়কুটো আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়, আমিও উপায়ন্তর না দেখে মাথার বালিশের কাছে পড়ে থাকা কলমটা আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইলাম। কলমটা হাতে তুলে নিয়ে বললাম ‘‘এই কলমে তোর আত্মা আমি ভরলাম। এইবার ভাঙবো কলমটাকে। তুই টুকরো টুকরো হয়ে যাবি।’’ নিজের গলা শুনে আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। ওই কথাগুলোও কেন বললাম, তাও জানি না। কী সহজে তখন আমিও অপরপক্ষকে “তুই” সম্বোধন করছি।
‘‘তুই আমাকে টুকরো টুকরো করবি? কর, দেখি কী করতে পারিস।’’ ভূতরানী হাত আমার গলায় পৌঁছে গেছে ততক্ষণে।
আমি যন্ত্রচালিতের মতো কলমের মাথাটায় একটু চাপ দিতেই, উল্টোদিক থেকে আর্তনাদ ভেসে এল, ‘‘ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও!’’ আমি কলমে চাপ বাড়াচ্ছি, ভূতরানীর চীৎকার, আর্তনাদ বেড়ে যাচ্ছে। ‘‘আমাকে ছেড়ে দাও, আমার অন্যায় হয়ে গেছে, আমি ভুল জায়গায় হাত বাড়িয়েছি, আমি চলে যাচ্ছি।’’
অবাক আমার গলা দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘‘তুই এক্ষুণি এ ঘর ছেড়ে, এই শহর ছেড়ে বেড়িয়ে যাবি।’’ “হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনি যা বলবেন, তাই হবে”, ভূতরানী “আপনি”তে ফিরে এল। আমি কলমে চাপ দেওয়া বন্ধ করলাম। ভূতরানী তখনও হাঁপাচ্ছে। বললাম, ‘‘চলে যা। এক্ষুণি চলে যা।’’ আমি তখন একটা ঘোরের মধ্যে সব বলে যাচ্ছি। নিজের গলা নিজে চিনতে পারছি না। ভূতরানীও ‘‘আমার ভুল হয়ে গেছে, আমি যাচ্ছি’’ বলে পূবের জানালা খুলে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। তারপর আমার আর কিছু মনে নেই। সম্ভবত অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। সকালে জানালা দিয়ে চোখে আলো পড়তেই লাফিয়ে উঠলাম। ঘড়ি দেখলাম প্রায় ন’টা বাজে। একটু পরেই হোটেলের বেয়ারা এসে বলল, স্যর, আপনার জন্যে ২৫ নাম্বার ঘর দেওয়া হয়েছে। মনে পড়ল আগের রাতের কথা। জিনিসপত্র নিয়ে ঘর বদল করলাম। তখনও আগের রাতে কী করেছি, কী করে করেছি, এসব ভিড় করে আসছে মাথায়। বাথরুমে গিয়ে খুব করে স্নান করলাম। মনে হল, বেশ হাল্কা লাগছে, কিন্তু তবুও আগের রাতের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো কিছুতেই ভুলতে পারছিলাম না। শেষে একটা সিদ্ধান্তে এলাম, আগের রাতে যা ঘটেছে - তা আসলে স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়।
এরপর আরও দু-দিন ছিলাম এলাহাবাদে। মহিমদাকে সে রাতের কথা কিছুই বলিনি। শুধু বলেছিলাম হোটেলের ঘর বদলে নিয়েছি। মহিমদাও খুশি আর নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। এলাহাবাদ থেকে ফিরে বাড়ি-অফিস-বাড়ি করে দিনগুলো ভালোই কাটছিল। মাঝে মাঝে শুধু চিন্তায় উঁকি-ঝুঁকি মেরে যেত সে রাতের ঘটনা। মনে হত, অমনটা কি সত্যিই ঘটেছিল, নাকি গোটাটাই আমার কল্পনা। কিছুদিন পর, এবার অফিসের কাজে যেতে হল দুর্গাপুরে। দুর্গাপুরে আমার বড়মামার বাড়ি। বড় হওয়ার পর, তেমনভাবে ওমুখো হওয়া হয়নি। ভাবলাম, এবারে একদিন কাটিয়ে যাই বড়মামার বাড়ি। সারা সন্ধ্যা মামাতো ভাই-বোনদের সঙ্গে ব্যাপক হই-হুল্লোড় করে কাটানোর পর, বড়মামী একটা পুরোনো ছবি দেখালেন আমায়। সাদা-কালো ছবি। বড়মামার কোলে বছর তিনেকের আমি, হাসছি, মাথা ভর্তি জটা!
0 comments: