রম্যরচনা - পিনাকী চক্রবর্তী
Posted in রম্যরচনা
যাদব চক্কোত্তির ইতিকথা
পিনাকী চক্রবর্তী
ডিমের নীচের পাটীর সামনের একটা দাঁত দুইদিন ধরে নড়ছে। ব্যাটা আমাদের আগে বলেনি। বললে কিছু করে দেখা যেত, দু’একটা ঘুঁসি মারলে পড়বে না – এমন দুধের দাঁত আমাদের অন্তত দেখা নেই। তবে কিনা, আমাদের দুধের দাঁতের কারবার চুকেবুকে গেছে অনেকদিন আগেই। ডিম ব্যাটা দেখতেও ছোটখাট, আর ওর ধরণধারণও বাচ্চাসুলভ। ওই জন্যেই ওর নাম ডিম, মানে এখনও ডিম ফুটে বেরোয়ই নি। আর তাই বোধহয় ওর এতদিন পরে দুধের দাঁত নড়ছে। তাও সবে নড়ছে, কিন্তু পড়ছে না!
যাই হোক, সেদিন সকাল থেকে ডিম একমনে জিভ দিয়ে ঠেলে যাচ্ছে দাঁতটাকে। সকালবেলা ক্লাস টীচার, ফাদার ওয়াভরেইল, ইংরিজী পড়ালেন, বেঁটে মস্তান ফিজিক্সের ক্লাস নিয়ে গেলেন, সান্যাল স্যার বাঙলা না পড়িয়ে ট্র্যান্সলেশন করালেন – ডিমের ধ্যান জ্ঞান সব ওই দাঁতেই আটকে থাকলো। কিন্তু দুঃখের কথাটা হল, এত চেষ্টা চরিত্র করে অনেকটা বেরিয়ে এলেও পুরোটা উপড়ানো হল না ওর সেই ইনসাইজর না কি যেন বিটকেল নামের দাঁতটাকে।
ওর পাশে বসতো শুভঙ্কর, আর একটা ছোটখাটো ছেলে, ফার্স্ট বেঞ্চে। আমাদের স্কুলের নিয়মে হাইট অনুযায়ী ছেলেদের বসানো হত ক্লাসে। আমাদের মতো তেঢ্যাঙ্গা লম্বুদের জায়গা ছিলো লাস্ট বেঞ্চ, তা সে বাপু তুমি যতই ভালো স্টুডেন্ট হও না কেন। আর আমার পাশে বসতো সব মার্কামারা ত্যাঁদড় পার্টী, টিপিকাল লাস্ট বেঞ্চার। আমি নিজে কেমন ছিলাম, সে কথা আর নিজের মুখে নাই বা বললাম।
তা, সেদিন টিফিনের সময় শুভঙ্কর আমাদের জানালো ব্যাপারটা। আমরা সোৎসাহে ডিমকে খুঁজতে বেরোলাম, ওর সব দাঁত আমরাই পারি সেরেফ খালি হাতে উপড়ে দিতে। কিন্তু সেই ভয়েই বোধহয় ব্যাটা বাথরুমে বা অন্য কোথাও লুকিয়ে কাটিয়ে দিলো পুরো টিফিন টাইমটা। ওর টিকির দেখাও পেলাম না আমরা। পরে আফসোস হল কম না, ওর ইঁদুরে দাঁতের জন্যে আমাদের একদিনের বাস্কেটবল খেলাটা বাদ পড়ে গেল। এতটা বন্ধুবৎসলতা মাঠেই মারা গেল। ধূরররর...
টিফিনের পরের ক্লাসটাই ছিলো অঙ্কের। পড়াতেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ এস পি বি। কাঠ বাঙাল ভদ্রলোক, প্রচণ্ড অ্যাকসেন্টেড ইংরিজীতে পড়াতেন... ‘‘ল্যাট অ্যা পইন্ট পি মুভ টু দ্যি পইন্ট পি ডেশ, শাচ দেট ইটশ ডিশটানশ ফ্রম দি পইন্ট অ্যা রিমেইনশ কনোশট্যান্ট... এ্যই যে ছুকরা, তুমার মিক্ক্যানিকশ পড়া অইত না, তুমি বিওলজি পড়গা যাও...’’ ইত্যাদি। ফাদারেরা কি করে ওনার কথা বুঝতেন কে জানে ? ওঁর ভয়ে বাঘে গোরুতে এক ঘাটে জল খেত। অল্পেতেই রেগে যেতেন, ক্ষেপে গেলে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতেন। হাতের কাছে যা পেতেন তাই দিয়ে পিটতেন। মেজাজ খারাপ থাকলে বোর্ডে অঙ্ক কষতে গিয়ে গুলিয়ে ফেলতেন, এবং যেদিন এই ঘটনা ঘটতো, সেদিন কেউ না কেউ অনিবার্য ভাবে ঠ্যাঙ্গানি খেত। শোনা যায়, ইনি বাড়ীতে পুরোদস্তুর মেনী বিড়ালের রূপ ধারণ করে থাকতেন, এবং আমাদের ওপর ব্যাঘ্রঝম্পনটা নাকি ওঁর এই জবরদস্তি মেকুড়িপনার রিকয়েল এফেক্ট। স্কুলের কাছেই থাকতেন বলে অনেক ছাত্র ওঁকে পাড়াতুতো ভাবেও জানতো, আর তাই আমাদের ওঁর পারিবারিক অনেক কথাই জানা ছিলো, যদিও সেগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতার ব্যাপারে প্রশ্ন উঠতেই পারে। একটা প্রচলিত কাহিনী ছিলো এইরকম, আমাদের গুরুমাতা, যাঁর নাম কমলা, তিনিও নাকি অঙ্কের ছাত্রী ছিলেন এবং স্যারের থেকে অনেক ভালো ছাত্রী ছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকারী অফিসার ছিলেন, তা থাকুন। কিন্তু স্যারের না পারা অঙ্কগুলো নাকি ম্যাডাম বাড়ীতে সলভ করে দিতেন। কি কারবার, দেখুন দেখি...!!!
যাই হোক, সেদিন স্যারের মেজাজটা দারুণ খারাপ। একটা অঙ্ক বোর্ডে তিনবার সলভ করার চেষ্টা করলেন, তিনবারই ঘষ ঘষ করে মুছে ফেললেন। শেষবার চেষ্টা করতে করতে আবার মুছবেন কিনা ভাবছেন, ডানহাতে যাদব চক্কোত্তির গাব্দা পাটিগণিত বইটা ধরা, বাঁ হাতে টেবিল থেকে ডাস্টারটা তুলে নিয়ে গভীর চিন্তার সাথে বোর্ডের দিকে ফিরে তাকিয়ে দেখছেন অঙ্কটাকে আপাদমস্তক। এর মধ্যে হঠাৎ ঢ্যাঙ্গা পার্থ (একটা বেঁটে পার্থও ছিলো, তাই এরকম নামকরণ) হুবহু স্যারের গলা নকল করে বলে উঠলো, “...ইশশশ, অখন কি অইবো কও দেহি, কোমোলা...?”
ক্লাসের মধ্যে দিয়ে একটা হাসির হররা একটা ঝোড়ো হাওয়ার মতো হুশ করে বয়ে গেল। পরমুহূর্তেই সব চুপচাপ, একটা পালক পড়লে শব্দ শোনা যাবে – এমন নিস্তব্ধতা। স্যার বোঁ করে ঘুরলেন...
...এবং তাঁর চোখে পড়ল ডিমের হাসিমুখ। ডিম কিন্তু হাসছিলো না। আপনারা জানেন, আমরাও জানতাম যে ডিম প্রাণপণে তার নীচের পাটীর ইনসাইজরের গোড়ায় জিভ দিয়ে ঠেলছিলো। কিন্তু স্যার এটা জানতেন না। এই জিভ দিয়ে দাঁত ঠেলাঠেলির সময়ে দন্তপাটী বিকশিত করে রাখতে হয়। নাহলে দাঁতের ফ্রিডম অফ মুভমেন্ট ব্যাহত হয় – তখন ঠেলাঠেলিতে কোন কাজ হয় না। কিন্তু ওই বিকশিত দন্তরুচী দেখলে যাঁরা ওয়াকিফ-এ-হাল নন, তাঁরা পষ্ট দেখবেন দাঁত কেলানে হাসি। স্যার তাই দেখলেন...
একটা জান্তব হুঙ্কার শোনা গেল ... তার পরেই একটা প্রশ্ন ... “এত হাসি ... হাসি ... হাসো কেনো?” এবং জবাবের জন্য বিন্দুমাত্র সময় না দিয়ে ডানহাতে ধরা যাদব চক্কোত্তির পাটিগণিত বইটা স্যার ছুঁড়ে মারলেন ডিমের দিকে।
ডিম অবশ্য এত কিছু জানতো না, বুঝতেও পারে নি যে কি ঘটতে চলেছে। স্যারের অঙ্ক আটকানো, ঢ্যাঙ্গা পার্থের কমেন্ট, ওর হাসিমুখ ... এইসব কথা বোধহয় ও আজও জানে না। যদি আমার এই লেখাটা পড়ে, তবে হয়তো বুঝবে। সেদিন সকাল থেকে ও ওর মনপ্রাণ নিয়ে ওর পড়েও না পড়া দাঁতের মধ্যে ঢুকে ছিলো। দাঁত ছাড়া প্রথম যে বস্তুটি ওর মাথায় সেদিন ঢুকেছিলো, মানে ঠিক না ঢুকলেও... ঢোকার চেষ্টা করেছিলো, সেটি হল যাদব চন্দ্র চক্রবর্তীর পাটিগণিত বইটা।
যাদব চক্কোত্তির পাটিগণিত বইটার ওড়ার ক্ষমতা সাধারণ ভাবে একটা থান ইঁটের সমান। কিন্তু বইটার শিরদাঁড়া বরাবর পাকড়ে ধরে সীম বোলারের মত ছুঁড়লে এর ব্যবহারটা একটু অন্যরকম হয়। একটু উড়েই বইয়ের হার্ড কভারের মলাট দুটো ডানার মতো খুলে যায়, আর বাকী বইয়ের পাতাগুলো লতপত করে ওড়াউড়ি করে এয়ার স্পীডটা অনেকটা কমিয়ে আনে। নয়তো ওইদিন ডিম ভেঙ্গে যেত। ওর কপালজোরে, সেই লতপত করা অংশটা ওর টেবিলে পড়ে সামান্য লাফিয়ে ওর পতনোন্মুখ দাঁতের গোড়ায় সরাসরি আক্রমণ করে। আর ওর দু’তিনদিনের চেষ্টায় যা হয় নি, সেই দাঁত কোন এক অদ্ভুত কায়দায় নাটকীয় ভাবে টেবিলের সামনে এসে পড়লো (ভেতরদিকে গিয়ে, গলা হয়ে পেটে চলে যাওয়া উচিৎ ছিলো, আমার মতে, যাই হোক...)। কিছুটা কাঁচা ছিলো বলে খানিকটা রক্তও বেরিয়েছিলো, তবে একটা স্ট্যান্ডার্ড দাঁত ফেলতে যতটা রক্ত বেরোয়, তার থেকে বেশী না ... ডিম যাদব চক্কোত্তির ওপর মাথা রেখে পতন ও মূর্ছা গেল ... না, না, পতন না, তবে খানিকটা ঢপের মূর্ছা গেল ...
মিশনারী স্কুলে যা সাধারণত হয় না, এর পর আমাদের ক্লাসে তাই হল। প্রথম থেকে শেষ বেঞ্চের ছাত্রের দল সবাই সীট ছেড়ে উঠে উঠে ডিমকে দেখতে এল। সবচেয়ে আগে এলো বসন্ত কুমার, আপনার আমার থেকে বেশী তুখোড় বাঙলা বলা মারোয়াড়ী। ছিপছিপে, শ্যামলা বরণের ছটফটে ছোকরা, টিপিক্যাল মারোয়াড়ীর টোটাল অ্যান্টিথিসিস। শুধু সেই বয়েসেই সমস্ত দাঁত আর ঠোঁট পানের ছোপধরা। এসেই চিল চীৎকার ছাড়লো, ‘‘স্যার, কি করলেন স্যার, ছেলেটাকে মেরে ফেললেন ? কি রক্ত, স্যার, কি রক্ত! মেরে দাঁত ভেঙ্গে দিয়েছেন স্যার, ও আর বাঁচবে না!!!’’
স্যারের অবস্থা দর্শনীয়! পোডিয়াম থেকে নেমে ভীড় ঠেলে ডিমের কাছে পৌঁছে ওকে তুললেন যাদব চক্কোত্তির কোল থেকে। তার পর মনিটরকে বললেন জল আনতে। তারপর ডিমের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলতে লাগলেন, ‘‘এতো হাসো কেনো বোলোতো, ক্লেশের মধ্যে...?’’ ডিম বোঝাতে গেল যে ও হাসছিলো না আদৌ, এ বাবদে ওর কোন দোষ নেই, কিন্তু দন্তবর্ণগুলো সব ফসকে যেতে লাগলো সদ্য ভাঙ্গা দাঁতের ফাঁক দিয়ে। বসন্ত এর মাঝে ডিমের পিঠে এক মোক্ষম চিমটি কেটে ইশারায় ওকে চুপ করতে বললো। আর, জীবনে অন্তত একবার বসন্ত আর স্যার একমত হলেন। ডিমের মাথায় হাত বুলিয়ে স্যার বললেন, ‘‘কোথা বোলো না, কোথা বোলো না, কোষ্টো বাড়বে...’’
এরপর মনিটরকে সাথে দিয়ে ডিমকে পাঠানো হল ইনফারমারি (মিনি ফার্স্ট এইড কেন্দ্র বলতে পারেন)। স্যারের সাময়িক অসহায়তার সুযোগ নিয়ে বসন্তও গেল ডিমের সাথে সাথে। ডিমকে বাড়ী পাঠিয়ে দেওয়া হবে, এটা ধরে নিয়ে বসন্ত হিসেব কষে ফেলেছিলো, ও আর ডিম একই পাড়ায় থাকে, সুতরাং ওর ওপর ডিমকে বাড়ী পৌঁছে দেবার দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। সে কথাটা ও ফাদার প্রিফেক্ট-কে জানিয়েওছিলো (ফাদার প্রিফেক্ট ডিসিপ্লিন মেন্টেইন করার ভারপ্রাপ্ত পাদরীবাবার পদ)। ফাদার বলেছিলেন অফিসের থেকে একজন করণিক গিয়ে ডিমকে পৌঁছে দিয়ে আসবে। বসন্ত ক্ষীণ আপত্তি জানিয়ে বলেছিলো, যিনি যাবেন, তিনি তো ডিমের বাড়ী চিনবেন না। ফাদারের বক্তব্য, ডিম নিশ্চয়ই চিনবে নিজের বাড়ী, ঠিক যেমন বসন্তের এখন চিনে ফেলা উচিৎ তার ক্লাসের রাস্তা। যাই হোক, ডিম গেল ট্যাক্সি চড়ে বাড়ী। বসন্ত ফিরলো ক্লাসে।
ডিমের এই অসাধারণ স্বার্থত্যাগের (দন্তত্যাগের?) ফলে আমাদের সে বছরটা অঙ্ক ক্লাসগুলো কেটেছিলো তুলনামূলকভাবে নিরুপদ্রবে। কিন্তু তাও আমি বলি কি, শিক্ষকদের স্কুলের পাড়ায় বাড়ী ভাড়া করে থাকা উচিৎ নয়... নিজেদের স্বার্থেই। নিজগুণে বুঝে নিন আপনারা, কেন আমি বললাম এ কথাটা...
0 comments: