প্রচ্ছদ নিবন্ধ - পলাশ কুমার পাল
Posted in প্রচ্ছদ নিবন্ধ
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
ভোট চিত্র
পলাশ কুমার পাল
এখন বসন্ত ও গ্রীষ্মের সন্ধিক্ষণ বলা যায়। ক'দিন আগের বসন্তের প্রকৃতির রঙ ক্রমশ ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। রঙের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতির কাঠামোও পাল্টে যাচ্ছে। বসন্তোত্সবের মঞ্চকে নগ্নকরে বাঁশ, কাপড় খোলা হচ্ছে আর এক উৎসবের তাগিদে। এটাও এক রঙের উৎসব। তবে মঞ্চ দুটো আলাদা; অনুষ্ঠানের ধরণ বা সূচীও আলাদা।
বসন্তোৎসবের মতো নিত্যবছর না এলেও, যখন আসে তখন বসন্তোৎসবের চেয়েও বেশি আবীর নিয়ে আসে। রাজার মতো আভিজাত্য নিয়ে আসে তো, তাই তার আসার পথে দেয়ালে দেয়ালে রঙে ভরে যায়, ভরে যায় রঙীন প্রতীকে... আসলে উৎসবটা রাজার লড়াইয়ের। প্রত্যেক রাজ্যেই এই রাজার লড়াই চলে মূল সিংহাসনের অধিকারের দাবীতে। আর সেখানেপ্রজাদের অধিকারটা কেবল হাততালির। হাততালি হলেও অন্তরঙ্গে ক্ষুদ্র মৌলিকতা দর্শকসম। প্রতীক ও রঙের মাঝে শুয়ে থাকা লাশের মতো; এক দিগন্ত আশা নীল আকাশে উড়িয়ে দিয়ে মাটিতে পিঠ ঠেকিয়ে থাকা নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাসে- যাদের উপর দিয়ে রাজা হেঁটে যায়...
আদিম, প্রাচীন, মধ্যম যুগ থেকে বড়াই করা সভ্য ভারতের মূল ভিতে এই প্রতীকগুলির অবস্থান। বৈচিত্র্যময় সংবিধানের এও এক বৈচিত্র্য। এই প্রতীকগুলিই যে সংবিধান শুধরে দেয়।আর প্রতীকের ভিতগুলির পাশে জনগণ ইঁটরূপে দেয়াল হয়। তৈরি হয় বাড়ি। প্রশাসন প্লাস্টার হয়ে যায় সিমেণ্ট ও বালিতে। তারপরে রঙ। কোন রঙ উঠবে দেয়ালে?
এই প্রশ্নের উত্তরের জন্যই উৎসবের ঘোষণা। প্রত্যেক রাজা সেই মঞ্চে উঠে নিজেদের performance দেখায়- প্রতিশ্রুতি, কথন, জনগণের প্রতি হৃদয়গলা ব্যবহারের প্লাবনে। যে performance-এ বেশি হাততালি জোটে সেই প্রতীক ও রঙের রাজা জয়ী হয়। তারপরে নির্দিষ্ট চুক্তিতে সে রঙ ওঠে বাড়ির দেয়ালে।
উৎসব শেষে নির্বাচিত রাজা সিংহাসনে বসতে রাজপ্রাসাদের দিকে ছোটে। বাকি রাজারা ব্যর্থ মনরথে চড়ে আগামী উৎসবে সফল হওয়ার পরিকল্পনা করতে করতে ফেরে। চক্রান্তও বলাযেতে পারে। কারণ এই উৎসব যে প্রতিযোগিতা- রাজপথে দৌড়ের। যেখানে প্রতি পদক্ষেপে সাধারণত আলোকবাতি পার হতে হয়। তাই চক্রান্ত ছাড়া এদিকে এড়িয়ে জয়ী হওয়া অসম্ভবপ্রায়। শেষ সিদ্ধান্তে এইটুকুই বলা যায় যে এই চক্রান্তই হল রাজার নীতির রঙ।
হাততালি দেওয়া শেষ হলে কিছু এলোপাথাড়ি দেহ বা রক্তের ঢেলা অবশেষরূপে পরে থাকে উৎসবের অঙ্কে ভাগ প্রক্রিয়ার সমাপ্তে। প্রজারা ঘরে ফেরে। দেয়ালে দেয়ালে তখনও উৎসবেররঙ জ্বলজ্বল করে। নির্বাচিত রাজার অ-সমর্থকরা আতঙ্কিত হয় রাজার ভবিষ্যৎ নীতির রহস্যে। আর জয়ীরা জয়োল্লাসে বারবার ডোবে স্বপ্নের দরিয়ায়। বসন্তের কিশলয় চিকচিক করেগ্রীষ্মের রোদে। কিশলয় কি বোঝে এটা খুশি না দহন?
রাজা রথ নিয়ে ছোটে। উৎসবের দিন প্রায় ফুরিয়ে যায় পশ্চিমাকাশে। প্রজারা দূর থেকে দেখে রাজার ঘোড়া ছুটছে আর ছুটছে বসতি পশ্চাতে ফেলে সূর্যের পানে... যত এগোয় রাজার পোষাকের রঙ অস্পষ্ট হতে হতে কালো হয়... স্বপ্ন রক্তিম হয় আকাশে।
তারপর কালো রাত নামে। সংস্কারে তুলসী মণ্ডপে জ্বালা প্রদীপ তেলের অভাবে ক্ষণেকেই নেভে। হাতড়ে হাতড়ে রাত কেটে যায় আরও এক সূর্যের প্রতীক্ষায়। এবারে তারা ঠিকঠাক হাততালি দেবে বলে নতুন উৎসবকে আহ্বান জানাই। দিন আসে, আবারও ফুরায় অস্তে, রাজা আসে, রাজাও ঢুবে যায় সূর্যের এপিঠে কালো রঙ হয়ে।
স্বপ্নকে ধর্ষিত হতে দেখতে দেখতে বয়স বেড়ে যায়। ওই ভিতগুলিকে নড়াতে পিঠকে সোজা করে ভিত হয় না কেউ! শুধু ইঁট, ভিত, প্লাস্টারের স্বপ্ন ও অপেক্ষার রঙ বদলে যায়।কোলাহলে শত আহ্নিক ফুরায়, ফুরায় বার্ষিক। রঙ বদলের এরূপ কত উৎসব আসে, চলে যায়... লাশের মতো শুয়ে থাকা এবং হাততালি দেওয়ার রীতি পাল্টায় না। শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসবে যেমন 'রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও...' গানের শেষে আবীর মাখার রীতি কখনো পাল্টায় না। উৎসব শেষে কেবল রাঙা হওয়াই রীতি... হয় রঙ না হয় রক্ত। অথবা নির্বাকভাবে কুঁজো হয়ে সরে যাওয়া 'কিছুই হয়নি, কিছুই দেখিনি' এই অজুহাতে।
0 comments: