0

ছোটগল্প - সুমিত নাগ

Posted in



ছোটগল্প


বার্থডে উইশ
সুমিত নাগ



আমি এমন এক গল্প বলতে যাচ্ছি যা একদমই বিশ্বাসযোগ্য নয়।

আমি প্রতিদিন রাতে নিয়ম করে কিছুক্ষণ ফেসবুকে ঘোরা ফেরা করি। চ্যাট অফ রেখে কারো সঙ্গে কোনও আদান-প্রদানহীন অবস্থায় স্রেফ দেখে বেড়াই।

গল্পের শুরু সেখানে যেদিন আমি ফেসবুকে একটি নোটিফিকেশন দেখি। আপনারা যাঁরা ফেসবুকে অভ্যস্ত(যাঁরা নন তাদের জন্য গল্পটি না), তাঁরা নিশ্চয় এই নোটিফিকেশন শব্দটি বুঝে থাকবেন। একটি জন্মদিনের নোটিফিকেশন দেখে আমরা কি করে থাকি? উইশ করি বা করি না। আমি করেছিলাম। এই নয় যে আমি এই কাজটি নিয়মিত করে থাকি, অর্থাৎ এই ধরনের উইশ, ইত্যাদি... বরং এ ধরনের উইশ অন্য কারো ক্ষেত্রে আমি করিই না বিশেষ। তবে আমার এক অনেক পুরনো বন্ধুর জন্মদিন দেখে (হয়তো) উইশ করে থাকব। পুরনো বন্ধু! 

আমরা কিসব হারিয়ে ফেলি জীবনে এগিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে... আমার চিরকালই মনে হয় এই জীবন কেবলই হারিয়ে ফেলার। ভারী ভাল কথা। কি আশ্চর্য লাগে শুনতে! কেবলই ফেলে চলে আসছি, যা ভবিষ্যৎ তাই অতীত... আমার এই বিশ্বাস থেমে যায় ফেসবুক করতে এলে...। কিছু হারাব না, পুরনো স্মৃতি, পুরনো বন্ধুর মুখ, পুরনো জীবন...। দূরে চলে যাবে তবু কারো কাল্পনিক ওয়ালে থেকে যাবে সব ছবি অতীত জীবনের; যে হাত ছেড়ে গেছে, যে জীবন ছেড়ে গেছে তা চিরকাল থেকে যাবে এক আশ্চর্য দুনিয়ায় চিরকাল, কিছু ভুলবো তবু কিছু ভুলবো না আর সবচেয়ে বেশি স্মৃতি চোখের সামনে থেকে রূপকথা না, বাস্তব হয়ে যাবে।

সেরকমই হল। পুরনো বন্ধু পুরনো ছিল। বহুদিন দেখা নেই, জানা নেই, কোনও খবর নেই মাত্র...। তাকে আমি ইনবক্সে উইশ করেছিলাম আর যোগাযোগ রাখতে বলেছিলাম। যা আমরা সকলেই করে থাকি।

সে আমার কথা রেখেছিল। কথায় তো আমরা কত কিছু বলি... কিন্তু ক’জন তা মন থেকে বলি? আমিও বলিনি। তবু সে যোগাযোগ রেখেছিল। আমরা প্রায়ই কথা বলতাম। কি নিয়ে এখন ভালো মনে নেই। সে থাকে অনেক দূরে, এটুকু দেখেছিলাম তার প্রোফাইল থেকে। কাজ করে যা আমাদের হিসেবে বড়সড়। মাঝে বহুদিন দেখা নেই, তাই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। ফেসবুক হারাতে দেয় না কিছুই- ফ্রেন্ডলিস্ট সে আগের মতই থেকে গিয়েছিল। তা কোনও কথা হোক আর নাই হোক। আর কেই বা কার সাথে অপ্রয়োজনে যোগাযোগ রাখতে চাই? যতদূর মনে পড়ে, সে আমাদের বাড়ির কাছে একটা বাড়িতে ভাড়া থাকত। আমি তাকে যদিও একদম ছোট থেকেই চিনতাম কিন্তু তার এত উন্নতি হবে জীবনে কখনও ভাবিনি। একথা আমি(হয়তো) তাকে বলেছিলাম। সে শুনে হেসেছিল। স্মাইলি পাঠিয়ে। আমি তাকে বলেছিলাম, সে যদি কখনও এই দেশে আসে, যেন দেখা করে আমার সাথে। এও হয়তো কথার কথা ছিল। তবে সে ‘হ্যাঁ’ বলেছিল।

এক্ষেত্রেও সে কথা রাখে এবং আমার সাথে দেখা করে যখন দেশে ফিরেছিল। এদেশে তার কেউই নেই খুব কাছের। অফিসের কোনও কাজে সে এদেশে আসে আর আমার সঙ্গে দেখা করতেই সে একদিন এদেশে বেশি থাকবে ভেবেছিল। একথা সে-ই আমায় জানায়। আর সেটা আমায় খুব অবাক করেছিল। কিন্তু কাজের চাপে সেটা তার পক্ষে আর সম্ভব হয়নি। সে তারপর ফিরে যায় আর ডাকে আমায় একটি উপহার পাঠায়। দুঃখের বিষয়, কি উপহার তা আমার এখন আর মনে নেই। তবে আমি ফেসবুকে তাকে আমার মেয়ের অন্নপ্রাশনে নিমন্ত্রণ করেছিলাম, এটা মনে আছে। সে এসে উঠতে পারবেনা বলে দুঃখ প্রকাশ করেছিল। তার ব্যস্ত জীবনে এটা যে সম্ভব না তা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা না। তারপর সে এদেশে আর আসেনি। 

আমি এই ঘটনার কথা অনেক বার আমার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব কাছে বলেছি। সে কারো সাথেই যোগাযোগ রাখেনি, দেখেছি। অন্তত আমার চেনা পরিচিতদের মধ্যে কেউই তার কথা আমার বলার আগে জানত না। ওদেশে ফেরার পরও সে আমার সঙ্গে একই ভাবে যোগাযোগ রেখেছিল। ছেলেবেলায় তত ভাব থাকে না যার সাথে সে বড় হলে বন্ধু হতেই পারে- এ আমি জীবনে বহুবার দেখেছি, তাই অবাক করার কিছু ছিল না। ছোটবেলার বহু স্মৃতি সে মাঝে মাঝে আমায় মনে করিয়ে দিত যা আমার কোনোদিন মনেছিল না। সে আমার পাড়ায় থাকতোই না শুধু, আমার স্কুলেও পড়ত। যতদূর মনে পড়ে এক ক্লাস সিনিয়র ছিল আমার থেকে। ফলে এই স্বল্প পরিচিতির মধ্যে যা স্মৃতি ছিল তা আমায় এমন ভাবে বলত যা আমায় অবাক করে দিত। আমি কখনও একটা ঘটনাও তার বলা মনে করতে পারিনি। আমি ভাবি কি ভাবে তার পক্ষে এগুলো বলা সম্ভব, কারণ আমরা সে ভাবে কখনই মিশিনি ছেলেবেলায়। কিন্তু এমন ভাবে সে বলত আমার মনে হত সবই ঘটেছে, আমার হয়ত কিছু মনে নেই, কিছুই না। পরে ভেবে দেখেছি তার একটাও ভুল না। কোনও না কোন ভাবে সেগুলো সব মিলে গেছে।

বহুদিন পর আমার এক পরিচিতের সঙ্গে দেখা হয় যিনি ওদেশে থাকেন। আমি কথায় কথায় তার কথা জানাই। তিনি ওকে চিনতেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি জানান যে সে আমার সাথে যোগাযোগ হবার মাস পাঁচেক আগেই মারা গিয়েছিল। গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে।

জীবনে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যা আশ্চর্য আর অভাবনীয়। আমি একে তাই বলে জেনেছিলাম। এর পর যখন আমি তার সাথে চ্যাট করি তখন এই ব্যাপারে তাকে কিছুই বলিনি। সে আজও আমার সাথে একই ভাবে যোগাযোগ রাখে। আমার ছেলেবেলা নিয়ে এমন সব কথা বলে যা আমি অনেক ভাবার পর মনে করতে পারি। এ তো সে-ই, নাহলে কে? যদিও তার মৃত্যুর কথা যে মিথ্যে নয় তা আমি অনেকের কাছ থেকে খবর নিয়ে জেনেছি। তাতে আর কি বা এসে গেল?

এ এমন জগত যেখানে কিছুই হারায় না। হারাতে চাই যদি তবুও হারায় না। মৃত জেগে থাকে অনন্ত কাল, কালের শক্তি নিঃশেষ হয় এখানে। তার কথাই ধরা যাক । কোন জগতে আছে সে? কি ভাবে বেঁচে আছে? কেউ বলতে পারবে? এমনই থাকবে সকলে যারা আজ আছে, যারা কাল থাকবে, তারা সবাই চিরকাল থাকবে। 


পুনশ্চঃ আমি তার দেওয়া উপহারটা আর কখনও খুঁজেই পাই নি। আমার মনে হয় সে উপহার আমি মৃত্যুর খবরটা পাবার সাথে সাথেই খুলে দেখতে গিয়েছিলাম। খুঁজে পাইনি। তাই আগেই বলেছি কি উপহার ছিল তা একদমই মনে নেই।

0 comments: