0

প্রবন্ধ - অমৃত অধিকারী

Posted in


প্রবন্ধ


যদিদং হৃদয়ং...
অমৃত অধিকারী



পুরাণ বলে, মহর্ষি উদ্দালকের পুত্র শ্বেতকেতুই নাকি বিবাহ নামক সামাজিক প্রতিষ্ঠানটির উদ্ভাবক। তার পূর্বে নাকি নারীরা ‘গাভীর ন্যায় স্বাধীন’ ছিলেন, অর্থাৎ নিজেদের পছন্দমতন পুরুষের সঙ্গে ইচ্ছামতন উপগতা হতে পারতেন। পুরাণের বক্তব্য অনুযায়ী, শ্বেতকেতু আপন জননীর এই জাতীয় কোনও স্বেচ্ছাচারে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে বিবাহস্বরূপ সমাজবন্ধনটি রূপায়িত এবং বেদে সংযুক্ত করেন, যেটি অনতিবিলম্বে সমাজব্যবস্থায় বলবৎ হয়।

কারণ যাই ঘটে থাক না কেন, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে ভারতীয় সমাজ শ্বেতকেতুর এই উদ্যোগের কাছে গভীরভাবে ঋণী। বিবাহ আধুনিক সমাজবিন্যাসের দৃঢ়তম বন্ধন; পরিবার, আত্মীয়তা ও গোষ্ঠীস্বরূপ তিনটি উত্তরাধিকার সূত্রের মূল প্রতিষ্ঠান, এবং নিঃসন্দেহে ভালোবাসা নামক স্বর্গীয় অনুভূতিটির অন্যতম প্রধান এবং পরিপূর্ণ অভিব্যক্তি।

কিন্তু বিবাহ যে সভ্যতার থেকে প্রাচীন নয়, সে কথা স্বতঃসিদ্ধ। তাই স্বভাবতই এ প্রশ্ন মনে জাগে যে, প্রাকবৈবাহিক যুগের সামাজিক গঠন ঠিক কিরকম ছিলো? কিসের ভিত্তিতে প্রাচীন গোষ্ঠীগুলি গড়ে উঠতো এবং পৃথকভাবে চিহ্নিত হতো? কিরকম ছিলো সভ্যতার প্রাক্কালের সমাজজীবন?

ইতিহাস বলে, আজ থেকে কমপক্ষে ছয়-সাত হাজার বছর আগে এক ভ্রাম্যমান জনজাতি হিমালয়-হিন্দুকুশের পর্বতপ্রাচীর লঙ্ঘন করে এসে সিন্ধুনদের অববাহিকায় বসতিস্থাপন করেছিলো।পশুপালন এবং শিকার ছিলো সেই ঐক্যবদ্ধ জাতির প্রধান জীবিকা। সিন্ধুনদ-ধৌত সুবিস্তৃত উর্বর ভূমি সেই জনজাতিকে ছোট ছোট গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ার স্বাধীনতা দিয়েছিলো। কালক্রমে তারা কৃষিকর্ম শেখে এবং জমির মালিকানা সম্বন্ধে সচেতন হয়। সেই সঙ্গে উদ্ভূত হয় সে মালিকানার উত্তরাধিকার নির্ণয় করার প্রয়োজন। কিন্তু সেই প্রাচীন সমাজে সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্দিষ্ট করার জন্য উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান ছিলো না। তাদের আদিম, উন্মুক্ত জীবনযাত্রায় সন্তানের পিতৃত্ব নির্ধারণ করা ছিলো কার্যত অসম্ভব।

তাই তাদের সামনে ছিলো আর একটি মাত্র বিকল্প –উত্তরাধিকার নির্ধারণের মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা। সেটিই ছিলো সহজ প্রাকৃতিক ব্যবস্থা। প্রতিটি গোষ্ঠীর প্রধান হতেন একজন করে নারী। গোষ্ঠীর বাকি সদস্যরা তাঁর সন্তান-সন্ততি।তাঁরাই সে গোষ্ঠীর জমি ও পশুসম্পদের উত্তরাধিকারী হতেন এবং সচল রাখতেন গোষ্ঠীর বংশক্রম।

কিন্তু এই সমাজব্যবস্থা ক্রমে বিবর্তিত হলো। সে বিবর্তনের প্রধান কারণ পর্বতপ্রাচীর পেরিয়ে আসা নতুন জাতির আক্রমণ। সে আক্রমণের তীব্রতায় এবং তীক্ষ্ণতায় সেই প্রাচীন মাতৃতান্ত্রিক জাতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং বাধ্য হয় সিন্ধুর অববাহিকা ছেড়ে ভারতীয় ভূখণ্ডের নানান অংশে ছড়িয়ে পড়তে। উত্তর ভারতে স্থাপিত হয় সেই আগন্তুক জাতির উপনিবেশ, যা কালক্রমে রূপ নেয় আর্যসভ্যতার।

ইতিহাস বলে, এই আগন্তুকরা প্রাথমিক পর্যায়ে ছিলো বর্বর, সমরস্পৃহ, পুরুষপ্রধান জাতি।কিন্তু তাদের সমাজও ছিলো আদিম, শৃঙ্খলাহীন, এবং তাদের পুরুষরা প্রাকৃতিক নিয়মেই প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে যুদ্ধ করতো নারীর অধিকারের জন্য। তাদের নারীরাও সেই একই নিয়মে মনোনীত করতে পারতো নিজেদের পছন্দের পুরুষকে, যখন যেমন খুশী। ঋষি শ্বেতকেতু সম্ভবত এইরকমই এক আদিম সমাজের প্রতিভূছিলেন। যে উদ্দেশ্যেই হোক, তিনি সেই সমাজকে নারী-পুরুষের নির্দিষ্ট সম্পর্কের একটি বন্ধনে বাঁধতে চেয়েছিলেন, এবং সফলও হয়েছিলেন। না হলে পুরাণ তাঁর নাম বিবাহপ্রথার প্রবর্তক হিসেবে স্মরণে রাখতো না।

বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটির কিন্তু আজকের সংস্থিতিতেএসে পৌঁছতে বহু বছর লেগেছে। বহুবিবাহের নানান পর্যায় পার হয়ে বিবর্তিত হতে হতে এই অসাধারণ প্রথাটি এসে আজকের সুসভ্য সমাজের মানবিক সম্পর্কের প্রধান যোগতন্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের পুরাণ, আরণ্যক, ব্রাহ্মণ, মহাকাব্য জাতীয় প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে তার প্রচুর সাক্ষ্য জাজ্বল্যমান। পুরুষের বহুবিবাহের ঘটনাই সেই সব সাক্ষ্যে অধিকাংশ হলেও নারীর একাধিক পতির নিদর্শনও কিন্তু দুষ্প্রাপ্য নয়। তবে একথা অনস্বীকার্য যে পুরুষের বহুদারগমন প্রথা ভারতীয় সমাজে বহুকাল অবধি বিদ্যমান ছিলো।

চিত্তাকর্ষক বিষয় হলো এই যে, বীর্যশুল্কে নারীকে জয় করার প্রথাটি কিন্তু অনেকদিন অবধি সমাজসিদ্ধ ছিলো। বিশেষত ক্ষত্রিয়দের মতন যোদ্ধৃজাতির সমাজে। স্বয়ম্বরা রাজকন্যাকে বাহুবলে জিতে নিয়ে যাওয়ার ভূরি ভূরি নিদর্শন রামায়ণ-মহাভারত জুড়ে। এইসব ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজা বা রাজপুত্রদের সঙ্গে সংঘর্ষ ছিলো অবধারিত, যদিও সেই সংঘাতগুলি প্রাণনাশক হতো বলে মনে হয় না। বিবাহ করতে গিয়ে রাজা বা রাজপুত্রের প্রাণ হারানোর ঘটনা পুরাণ সাহিত্যে বিরল। 

সাধারণত স্বয়ম্বরগুলিতে রাজকন্যা উপস্থিত রাজন্যবর্গের মধ্যে থেকে ইপ্সিত পতিটিকে বরণ করে নিতেন। কিন্তু এ ছাড়াও কোনও কোনও ক্ষেত্রে স্বয়ম্বর সভায় আয়োজন থাকতো বীরত্বের প্রতিযোগিতার, যেটি আপন বাহুবলে জয় করলে তবেই পাওয়া যেতো রাজকন্যার বরমাল্য। আমাদের দুই মহাকাব্যের দুই নায়ক রামচন্দ্র ও অর্জুন এইভাবেই যথাক্রমে মিথিলা ও পাঞ্চাল দেশের স্বয়ম্বর সভা থেকে লাভ করেছিলেন সীতা ও দ্রৌপদীকে।

প্রসঙ্গত, রাজকীয় বৈবাহিক সম্পর্কগুলি সেযুগে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সম্বন্ধস্থাপকের কাজ করতো। বিবাহের মাধ্যমে সূচিত আত্মীয়তা দু’টি রাজ্যকে মৈত্রীবদ্ধ করে তুলতো, যাতে বৃদ্ধি পেতো উভয়ের রাজনৈতিক এবং সামরিক শক্তি। এই বিবাহগুলি অনক ক্ষেত্রেই হতো সম্ভাব্য শত্রুকে মিত্রে পরিবর্তিত করার মোক্ষম কূটনৈতিক চাল। এরও বহু উদাহরণ ভারতবর্ষের প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে বিদ্যমান। স্বয়ং কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে এই জাতীয় কূটনীতিকে সপ্রশংস অনুমোদন দিয়েছেন।

সাধারণ বিবাহের ক্ষেত্রে স্বীকৃতি ছিলো অসবর্ণ এবং অসাজাত্য বিবাহেরও। বহুলচর্চিত গ্রন্থ মনুসংহিতা, প্রচুর সমালোচনা সত্ত্বেও যা অনস্বীকার্যভাবে প্রাচীন ভারতীয় সমাজনীতির একটি প্রামাণ্য দলিল, বিবাহকে আটটি প্রকারে ভাগ করেছে - ব্রহ্ম, দৈব, আর্শ, প্রজাপত্য, গান্ধর্ব, আসুর, রাক্ষস এবং পৈশাচ। এর মধ্যে শেষের চারটি, অর্থাৎ গান্ধর্ব, আসুর, রাক্ষস, এবং পৈশাচ স্পষ্টতই অনার্য বিবাহের প্রকার। প্রাগার্য, আর্যেতর এবং ভারতীয় ভূখণ্ডের যে প্রাচীন অধিবাসীদের আজ আমরা আদিবাসী নামে অভিহিত করি, তাদের সামাজিক প্রথাগুলির এই স্বীকৃতি অবশ্যই প্রভূত সংখ্যায় অসবর্ণ ও অসাজাত্য বিবাহের প্রমাণ। অতি প্রাচীন কাল থেকে আবহমান এই জাতি-বর্ণ-সাংকর্যই জন্ম দিয়েছে আজকের ভারতীয় জনসংখ্যার, নৃতাত্ত্বিক বিচারে যা নিঃসন্দেহে সমগ্র বিশ্বে জটিলতম।

আজকের পরিস্থিতি আলাদা। বিবাহের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে বহু সময় লেগেছে আমাদের। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এসে বিধবাবিবাহ আইন প্রণীত হয়েছে ভারতবর্ষে, এবং তাও বিদেশী শাসকের আনুকূল্যে। বিবাহবিচ্ছেদ আইনত অনুমোদিত হয়েছে আরও অনেক পরে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির মূল উদ্দেশ্য এবং কাঠামো আজও একই আছে। সমাজবদ্ধ মানুষেরজীবন ও মননে ভারসাম্য নিয়ে আসাই সেই উদ্দেশ্য, যার ফলস্বরূপ জন্ম নেয় সুস্থ, আনন্দময় পরবর্তী প্রজন্ম। সন্তানের বিবাহ সমাজজীবনের একটি প্রতিষ্ঠা, একটি সাফল্য, যা গর্বিত করে প্রত্যেক জনক-জননীকে। বৈবাহিকী অনুষ্ঠানগুলি পারিবারিক আনন্দ সম্মেলনের একেকটি অত্যুৎকৃষ্ট অবকাশ। বিবাহবার্ষিকীগুলিও তাই। এই সব অনুষ্ঠান অর্থনৈতিক ভাবেও আধুনিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ। অসংখ্য ব্যবসায়িক সংস্থা আজ এই অনুষ্ঠানগুলিকে সুচারুরূপে নির্বাহ করার কাজে ব্যাপৃত, এবং সামগ্রিকভাবে এই ব্যবসা ক্রমশ একটি সংগঠিত শিল্পে রূপান্তরিত হচ্ছে।

কিন্তু এই সবকিছুর বাইরেও বিবাহ মানবজীবনের এমন একটি অপরিহার্য অঙ্গ, যা স্মরণাতীত কাল ধরে সমাজকে নিয়ত দিয়ে চলেছে তার ভিত্তির দৃঢ়তম প্রতিষ্ঠা, মানবিক সম্পর্কের অখণ্ড পরিকাঠামো, এবং সবকিছুর উপরে যা জীবনের প্রধান পরিপূরক, সেই অবিমিশ্র আনন্দ ও ভালোবাসার পরিপূর্ণ অবকাশ।





0 comments: