ধারাবাহিক - স্বপন দেব
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
আমার বারুদ-বেলা—১৩
স্বপন দেব
দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্টের পতনের সঙ্গে সঙ্গেই সি পি আই এম সহ অন্যান্য বামপন্থী নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করা শুরু হয়ে গেল। কিন্তু যেহেতু তখন সি পি এম-নকশাল বিরোধ তুঙ্গে তাই তাদের আলাদা জেলে বা আলাদা ওয়ার্ডে রাখা হত। মার্চ মাসে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্টের পতন ঘটল, আর রাষ্ট্রপতি শাসন চলা কালেই তেসরা জুন, ১৯৭০ অমিতাভ সিনহা রয় নামে স্পেশ্যাল ব্র্যাঞ্চের এক নিষ্ঠুর এবং অত্যাচারী ইন্সপেক্টরকে অখিল মিস্ত্রি লেনে শহুরে গেরিলারা খতম করে দিল। এটাই শহর কলকাতায়প্রথম বড় ধরণের ব্যক্তিহত্যা বা খতম। প্রশাসন স্বাভাবিক ভাবেই ঝাঁপিয়ে পড়ল নকশালদের ওপর। ১১ই জুন, ১৯৭০ নিশীথ ভট্টাচার্যকে তাঁর গোপন আস্তানা বুদ্ধু ওস্তাগর লেন থেকে গ্রেফতার করা হয়, এবং চোদ্দ দিনের পুলিশী নৃশংসতার শিকার হয়ে শেষে তাঁকে বিচারাধীন বন্দী হিসেবে সাতখাতায় পাঠানো হয়। অধ্যাপক নিশীথ ভট্টাচার্য আসার পরে আমাদের জেল সংগঠন আরো মজবুত হয়। অধ্যাপক নিশীথ ভট্টাচার্যের কাছ থেকে জানা গেল যে, বাংলা-বিহার-ওড়িশার আঞ্চলিক কমিটি (B.B.O.B.R.C.) তৈরি হয়েছে ৬৯ সালের শেষেই এবং B.B.O.B.R.C. এর সদস্যরা ছিলেন –অসীম চ্যাটার্জি, ভবদেব মণ্ডল, সন্তোষ রানা, লেবাচাঁদ টুডু, প্রমুখেরা। এদের নেতৃত্বে তখন বাংলা-বিহার উড়িষ্যায় রীতিমতো অ্যাকশন শুরু হয়ে গেছে! সন্তোষ রানার কথায় সেই সময়ে গ্রামে নকশাল আন্দোলনের একটি পরিস্কার ছবি পাওয়া যায়। সন্তোষ রানার কথায় “B.B.O.B.R.C-র প্রথম সাকসেসফুল অ্যাকশন হয় সেপ্টেম্বর মাসের ২৭ তারিখে গোপীবল্লভপুর অঞ্চলে। এই লোকটি ছিল একজন জোতদার, মহাজনও বটে। এই লোকটির ঘরে সন্ধ্যের মুখে আমরা প্রায় তিরিশ-চল্লিশ জনের একটা স্কোয়াড গিয়ে তাকে খতম করে তার বন্দুক দখল করি। তার ঘর থেকে যে বন্ধকী জিনিসপত্র বেরোয় সেগুলি রাতের মধ্যেই আশেপাশের গ্রামে যাদের জিনিস তাদের বিলি করে দেওয়া হয়। এই ঘটনার পর ২৮ তারিখেবহড়াগুড়াতে অ্যাকশন হল। এই অ্যাকশনে অসীম চ্যাটার্জিরা নেতৃত্বে ছিল। জোতদার ভয়ে পালিয়ে যায় কিন্তু তার বন্দুক দখল করা হয়। এরপরেই মালগ্রাম অ্যাকশন। পরপর দুটো অ্যাকশন দুদিনে পাশাপাশি এলাকায় হওয়ায় গোটা এলাকায় জোতদারদের মধে এক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ২৭শে সেপ্টেম্বর হল নগেন সেনাপতি অ্যাকশন। এই অ্যাকশন টার পর থেকে সাঁওতালরা বড়ো আকারে আমাদের দলেযোগ দিতে লাগল। নভেম্বর মাসের সেকেন্ড উইকের মধ্যেই প্রায় ৫০ টি গ্রাম সংগঠিত হয়ে যায়। এই সময়ে সমস্ত জোতদারদের ধান আমরা কেটে নিলাম। সেটা একেবারে একটা অভ্যুত্থানের রূপ নিল। এতটা আমাদের হিসেবের মধ্যেও ছিলনা। যখন দেখছি যে লোকের উদ্যোগ বেড়ে যাচ্ছে, তখনই আমরা ডিসাইড করি, তাহলে বন্দুক ছাড়বো কেন? সেই সময় থেকেই বন্দুক সিজ করা শুরু হল। ‘এই তোমার ঘরে মুড়ি খাবো, মুড়ি দাও’। ‘এই তোমার বন্দুকটা আমাদের কাজে লাগবে, ওটা দাও’—জোতদাররা ভয়ে ঠকঠক করতে করতে দিয়ে দিত বন্দুক। কেউ বাধা দেয়নি। দুদিনেই নিয়ে এলাম এগারো খানা বন্দুক।”
এদিকে ১৯৭০ সাল থেকেই সি পি আই (এম এল) এর নেতা ও কর্মিদের প্রতি প্রচণ্ড দমন-পীড়ন নেমে আসে। সাধারণ ভাবে মিসা, ডি আই আর, পিডি অ্যাক্ট উপদ্রুত এলাকা ঘোষণা, ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা ছাড়াও মিথ্যা সংঘর্ষের নামে হত্যা, গণহত্যা, জেলহত্যা, গুম, খুন ইত্যাদি চলতে থাকল। ১৯৭০ সালের আগস্ট মাসে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী রাজ্যসভায় ঘোষণা করলেন---নকশালপন্থীদের শারীরিক ভাবে শেষ না করা পর্যন্ত লড়াই চলবে। ভাবুন একবার! একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী রাজ্যসভায় দাঁড়িয়ে একটি রাজনৈতিক ভাবে স্বীকৃত পার্টির সদস্যদের খুনের হুমকি দিচ্ছেন! প্রায় এক ই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি প্রধান উপদেষ্টা বি বি ঘোষ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দফতর কে নকশাল দমনের জন্যে প্রচলিত আইনের বাইরেও অধিক ক্ষমতার জন্যে আবেদন করলেন। ১৯৭০ এর ৯ ই অক্টোবর ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’ একটি দীর্ঘ প্রতিবেদনেজানাচ্ছে--- কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ, ‘র’( R.A.W.), ও প্রাদেশিক পুলিস কর্তাদের পরামর্শ মত নকশালপন্থীদের হত্যার জন্যে কতকগুলি খুনি স্কোয়াড গড়া হয়েছে এবং তাদের কিছু সাংকেতিক নাম দেওয়া হয়েছে। যেমন, ‘Ton TonMacaute’, ‘PapaDoc’ প্রভৃতি। পশ্চিমবঙ্গে তদানীন্তন পুলিসপ্রধান রঞ্জিত গুপ্ত, গোয়েন্দাপ্রধান দেবী রায়, অফিসার রুণু গুহনিয়োগী, তারাপদ বসু প্রমুখরনেতৃত্বে এই অভিযান চলতে থাকল। ১৯-০৮-৭০ এ সংঘটিত হল বারাসাত গণহত্যা। হাত বাঁধা ও অত্যাচারিত অবস্থায় বারাসাতের বড়ো রাস্তার ওপর পাওয়া গেল ৮ জন যুবকের মৃতদেহ। এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার আড়িয়াদহের বাসিন্দা। জানা যায়—কানাই ভট্টাচার্য, যতীন দাস, সমীর মিত্র, গণেশঘটক, শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, তরুণ দাস, সমরেন্দ্র দত্ত ও স্বপন পাল কে খুন করে বেলগাছিয়া দুগ্ধ প্রকল্প বা হরিণঘাটার ভ্যানে চাপিয়ে বারাসাতের রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়েছিল। ২০-০৮-৭০ এর বেলেঘাটায় সি আই টি কোয়ার্টার ও আশেপাশের এলাকা থেকে নকশালপন্থী যুবকদের ধরে এনে খালপাড়ে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে মারা হয়। ১৯শে নভেম্বর ১৯৭০ সালের গভীর রাতে ওই এলাকায় ঘটেছিল একটি মর্মন্তুদ ঘটনা। ওইদিন রাতে পুলিশ ও সি আর পি এর প্রায় ১৫০০ জনের একটি দল ৪০টি পুলিশ ভ্যানে করে বেলেঘাটা অঞ্চলে চিরুণি তল্লাসী বা কুম্বিং অপারেশনে যোগ দেয়। ডি সি ডি ডি দেবী রায়ের নেতৃত্বে এই পুলিশ দলটি ৫৫৬ টি ফ্ল্যাটে হামলা চালিয়ে ৫০ জন যুবক কে গ্রেফতার করে তাদের পুলিশ ভ্যানে তুলে ‘বালুচর’ নামে এক নির্জন জায়গায় নিয়ে যায়। দেবী রায় তাদের মধ্যে অশোক, সাবু ও হাত বাঁধা তিন যুবকসহ কয়েকজনকে হত্যা করে। ভি কৃষ্ণ মেনন, বদরুদ্দোজা, বকর আলি মির্জা, হীরেনমুখার্জি, অরুণ প্রকাশ চ্যাটার্জি, সুহৃদ মল্লিক চৌধুরী, সলিল গাঙ্গুলি, শিবচন্দ্র ঝা ও জ্যোতির্ময় বসুকে নিয়ে যে সংসদীয় তদন্তকমিটি তৈরী হয়েছিল---উপরের রিপোর্টটি হচ্ছে তাঁদের দেওয়া রিপোর্ট। ২৬-০১-৭১ এ ঘটল ২৪ পরগনায় ডায়মণ্ডহারবারের গণহত্যা। ০১-০৬-৭১ এ হুগলীর কোন্নগরের কাছে কানাইপুর গ্রামে পাওয়া গেল ৯ জন যুবকের বিকৃত মৃতদেহ। মজে যাওয়া সরস্বতী নদীর পাড়ের কাছাকাছি একটা গণ কবর খুঁড়ে পুলিশ এখান থেকে উদ্ধার করে—হাওড়ার সীতারাম বসু লেন এর বাসিন্দা বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়, পঞ্চানন তলার মৃণাল ঘোষ ও পঙ্কজ শীল, গোলাবাড়ির বিশু মুখোপাধ্যায়, হাওড়ার ব্যানার্জি বাগান লেনের সুকুমার রায়, উত্তর ব্যাঁটরার বিমান বড়াল, হাওড়ার প্রদীপ নিয়োগী, লেকটাউনের তরুণ বসু এবং শালকিয়ার অসিতকুমার দাস-----এদের মাথা কাটা লাশ। পুলিশ রিপোর্ট অনুযায়ী ---৩০শে মে, ১৯৭১ এই ৯ জন যুবক কোন্নগরে তাদের এক বন্ধুর বাড়িতে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছিল। নকশালপন্থী সন্দেহে, সি পি এম এর কর্মিরা এদের হত্যা ও মুণ্ডচ্ছেদ করে প্রতিটি লাশের ওপর অ্যাসিড ও চুন ছড়িয়ে দিয়েছিল, যাতে এই লাশ গুলোকে শনাক্ত করা না যায়। এরপর পুলিশ ও মস্তানদের যৌথ পরিচালনায় ঘটল নারকীয় বরানগর-কাশীপুর গণহত্যা। ১৯৭১ এর আগস্টের ১২, ১৩, ১৪ তারিখ জুড়ে সমগ্র এলাকায় চলল হত্যালীলা। পুলিশ প্রশাসন, কংগ্রেস মস্তান ও সি পি এম যে পরস্পর এই হত্যাকাণ্ডে সহযোগী ছিল তা পুলিশ অফিসার রুণু গুহ নিয়োগীর স্বীকারোক্তি( সাদা আমি কালো আমি) থেকে স্পষ্ট। যদিও নকশালপন্থী সংগঠন গুলি ঠিক এই বক্ত্যব্যইদীর্ঘদিন ধরে বলে এসেছে। ‘নয়া ইস্তাহার’ ও তাদের সহযোগী সংস্থার যৌথঅনুসন্ধানে এইরকম ২৬ জনের নাম পাওয়া গেছে, যারা ছিলেন এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের শিকার। ১৯৭১ সালের আগষ্ট মাসের ৫ তারিখের মাঝরাতে পুলিশ দক্ষিণ কোলকাতার ৯বি, রাজা বসন্ত রায় রোডের বাসিন্দা অধ্যাপক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে সি পি আই (এম এল) এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাসক ও পার্টি মুখপত্র ‘দেশব্রতী’র মুখ্য সংগঠক, সাংবাদিক ও কবি সরোজ দত্তকে গ্রেফতার করে। সেই দিন ই ভোর রাতে তাঁকে হত্যা করে মুণ্ডহীন অবস্থায় ময়দানে ফেলে আসে। মানবাধিকার সংগঠন Amnesty International এর হিসাব অনুযায়ী একমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই ১৫০০০ থেকে ২০০০০ হাজার মানুষকে জেলে বন্দি করা হয়েছিল। তাছাড়া ৩০০০০ থেকে ৪০০০০ হাজার জনের মতো ব্যক্তির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা রুজু করা হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধান সভায় রাজ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি বিবৃতি থেকে জানা যায় তখন পর্যন্ত ১৭ হাজার সাত শো সাতাশি জন নকশালপন্থীকে জেলে আটক রাখা হয়েছে ( আনন্দবাজার, ১৭মার্চ, ১৯৭৩)। এছাড়া D.I.R. ও MISA তে ২০০০ জনকে আটক রাখা হয়েছে আর ১৭,৮০০ জনকে বিচারাধীন বন্দি হিসেবে আটকে রাখা হয়েছে ( The Statesman 1st January, 1973)। বাইরে যখন এইসব অত্যাচার আর তা রোখার পালা চলছে, তখন আমরা বরং আরেকবার জেলের ভেতরটা দেখেনি। তবে সেটা পরের কিস্তিতে (চলবে )।
চমৎকার!! রহস্য আর রোমাঞ্চে টৈ টম্বুর!!
ReplyDeleteক্রমশ ছড়াচ্ছে রহস্যের জাল! খুব ভালো লাগে আপনার এই ধারাবাহিক টা পড়তে!
ReplyDeleteখুব কষ্ট লাগছে....
ReplyDeleteঅসাধারণ উপস্থাপনা! প্রতিটি কিস্তিতে একটি রহস্যের উন্মোচন ভালো লাগছে!
ReplyDeleteকল্পকথাকেও হার মানায় এই গল্প কথা!
ReplyDeleteভীষণ জমজমাট লেখা!
ReplyDeleteরোমাঞ্চ কাহিনীও এর কাছে তুচ্ছ।
ReplyDeleteঅসাধারণ !
ReplyDeleteতথ্য সমৃদ্ধ লেখা!
ReplyDeleteএর থেকে আগের পর্ব গুলি অনেক আকর্ষনীয় ছিল কিন্তু!!
ReplyDeleteতথ্য সমৃদ্ধ লেখা। একটি ঐতিহাসিক দলিল পড়ছি যেন!
ReplyDeleteসুন্দর সচ্ছন্দ
ReplyDeleteতথ্যে ভরা এক নিটোল উপন্যাস।
ReplyDelete১৯৭২... ৭৩...৭৫...বরানগর তখন আগ্নেয়গিরি। খুব ছোট ছিলাম। তবু, মনের উপর জলচাপ কিছু রয়েই গেছে। বরানগরের কথা আর একটু বলবে?
ReplyDeleteমর্মস্পর্শী
ReplyDelete