0

ভৌতবাক - দীপারুণ ভট্টাচার্য

Posted in


ভৌতবাক


পদ্মার ফেরি
দীপারুণ ভট্টাচার্য


ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে স্থল পথের চেকপোস্ট গুলোর মধ্যে বেনাপোল বর্ডারটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক এই চেকপোস্টটি শুধুমাত্র দিনের বেলায় খোলা থাকে। সন্ধের পর বর্ডার সিল করে দেওয়া হয়। শেষ বেলায় খানিকটা হৈচৈ দেখা যায় প্রতিদিনই। তারপর ধীরে ধীরে নিশ্চুপ হয়ে আসে দুই দেশের চেকপোস্ট সংলগ্ন বাজার, দোকান, দালাল ঘর, মালপত্র ওঠা নামার শব্দ । কাস্টমস কর্তৃপক্ষ অফিস ছুটি করতেই অঞ্চলটা ঝুপ করে ঘুমিয়ে পড়ে। কোলকাতার শাড়ি ব্যবসায়ী বছর ত্রিশের পার্থ রায় এই পথে মাঝে মধ্যে ঢাকায় যায় জামদানি, টাঙ্গাইল আনতে। শিয়ালদহ থেকে দুপুরের লোকাল ট্রেন ধরে প্রতিবার সে শেষ বেলাতেই বর্ডার পার করে। তারপর বেনাপোল থেকে সন্ধে সাতটার শেষ বাসটা ধরলে ঢাকা পৌঁছে যায় ভোর বেলা। পরিকল্পনা মতই হয় প্রতিবার। তবে আজ হিসাবটা মিলবে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। প্রতিবার মাঝরাতের অন্ধকারে বাস ফেরিতে চড়ে পার হয় পদ্মা নদী। আজ বাস ফেরিতে উঠতেই পার্থ জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। মনে হচ্ছে একটা হালকা কুয়াশা বাইরে। দূরের প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। একটু পরে ফেরি ছাড়তেই একটা সিগারেট ধরিয়ে পার্থ সবচেয়ে উপরের ডেকে উঠে আসে। শেষ ডিসেম্বরের ঠান্ডায় উপরের এই ডেকটা আজ সম্পূর্ণ ফাঁকা। বাল্বের হলুদ আলোটা মিটমিট করে জ্বলছে। পার্থ চেয়ারে বসে ধোঁয়া ছাড়তে থাকে।


একটু দূরেই একজন লোক চেয়ারে বসে আছে। লোকটার সর্বাঙ্গ একটা চাদরে ঢাকা। মুখটাও অস্পষ্ট লাগছে এই হালকা আলোতে। ডেকের ঠিক মাঝখানের জায়গাটায় নামাজ পড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে কে যেন একজন লোক শুয়ে ঘুমাচ্ছে। এছাড়া আর কেউ নেই এখানে। একে ঠান্ডা তার উপর অমাবশ্যার রাত, পরিবেশটা কেমন যেন থমথমে। দুপুরে স্টেশন থেকে পার্থ একটা কাগজ কিনেছিল। রবিবাসরীয়তে আজ একটা ভুতের গল্প ছেপেছে। ভুতের গল্প পার্থকে খুব টানে। সিগারেট ফেলে দিয়ে সেই গল্পটাই পড়বে বলে কাগজটা খুলে ধরলো পার্থ। নাঃ এত কম আলোয় ছাপার ছোট অক্ষর গুলো পড়া সম্ভব নয়। কাগজটা আবার গুটিয়ে দূরের অন্ধকারের দিকে তাকাল পার্থ। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শুধুমাত্র অন্ধকার চিরে একটা একঘেয়ে ধাতব শব্দ ভেসে আসছে, একটানা। পদ্মা ব্রিজের কাজ চলছে। একদিন হয়তো এই ফেরি পারাপার বন্ধ হয়ে যাবে।


দুইবার হুইসেল দিয়ে ফেরিটা গতি বাড়াল। একটু পরে, সামান্য কেশে সেই চাদর জড়ানো লোকটা বলল, "দাদা কি ইন্ডিয়ার?" একটু আশ্চর্য হল পার্থ। তবে কি এই লোকটাও তারই বাসে এসেছে? কোনো উত্তর দিলো না পার্থ। খানিকটা পরে আবার প্রশ্ন এলো, "অন্ধকারে পড়লে চোখে চাপ পড়ে। তা, দাদা কি ভুতের গল্প পড়তে পছন্দ করেন?"
পার্থ নিশ্চিত হয় লোকটা তার সঙ্গে একই বাসে এসেছে। নাহলে আর সে জানবে কি করে যে পার্থ বাসের মধ্যে অন্ধকারে গল্পটা পড়তে পারেনি বলেই উপরের ডেকে উঠে এসেছে! পার্থ একটু হেসে বলল, "মন্দ কি!"
খুনখুন শব্দে একটা হাসি শোনা গেল। লোকটা বলল, "ভুত দেখেছেন কখনো? কিংবা দেখার ইচ্ছা আছে?" এমন একটা অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে পার্থ একটু অবাকই হল। তবে বাচাল লোক সে বড় একটা পছন্দ করে না। লোকটার কথায় এমন একটা ভাব যেন চাদরের তলায় সে ভুত ধরে রেখেছে, চাইলেই বার করে দেবে। কাজেই একটু কৌতুক করে পার্থ বলল, "সম্ভব হলে দেখান। ভুত দেখে চোখ দুটো সার্থক করি।"
তার কথা শুনে নড়ে বসল চাদর মুড়ি লোকটা। বলল, "বেশ সাহস দেখছি আপনার!" লোকটার ঘড়ঘড়ে গলার মধ্যে থেকে হাপানির টানের মতো একটা শব্দ বের হল।


পার্থ উত্তর না দেওয়ায় কথা এগোয় না আর। বেশ খানিকক্ষণ চুপচাপ কাটতে থাকে সময়। হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ফেরিটা থেমে যায়। ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়েছে চারিদিক। পাড়ের আলো, গ্রাম বা অপর দিকের ফেরি, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এমন হলে দাঁড়াতেই হয়। 
ডেকের মেঝেতে শুয়ে থাকা লোকটার দিকে এবার তাকায় পার্থ। অস্পষ্ট আলোয় মনে হচ্ছে কম্বল বা চাদরহীন গায়ে দিব্যি ঘুমাচ্ছে লোকটা। অথচ কি প্রবল ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে ডেকে। বেশ অবাক হয়ে পার্থ বলেই ফেলল "মানুষ, ঘুমোতে পারেও বটে!" তার কথাটা শুনে হালকা কেশে পাশের লোকটা ছড়া কেটে উঠল, "ঘুম মৃত্যুর জমজ ভাই/ তার সাথে ভাব করিস নে"। গলায় মাফলারটা শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে পার্থ বলল, "আপনি নিজে কখনও ভুত দেখেছেন?"


এবার যেন লোকটা ফিক করে একটু হাসল। তারপর বলল, "অনেকদিন ধরেই দেখছি তাকে। একবার ইদারায় প্রায় ঠেলেই ফেলে দিচ্ছিল আমাকে। আর সেবার পুকুরে সে আমারে টেনে নিয়ে যেতো; নেহাৎ ভাগ্য ভাল ছিলো! তখনই সাবধান করেছিল, পুকুরে পারলাম না, একদিন নদীতে…" কথাটা শেষ না করেই কেমন অদ্ভুত ভাবে হাসতে থাকে লোকটা। মুখ ফসকে একটা প্রশ্ন করে ফেলে পার্থ, "আচ্ছা, ভুতরা কি খুব বিচ্ছিরি দেখতে হয়?" প্রশ্ন শুনে লোকটা হিসহিসিয়ে বলে ওঠে, "মানুষের কল্পনায় ভুতের যে মুখ গুলো আসে, সত্যি বলতে আসল ভুতের চেহারার সঙ্গে তার কোন মিল নেই। অন্ততঃ আমি যাদের দেখেছি তারা সবাই ঐ সব ছবির থেকে সুন্দর।"


-"তার মানে আমাদের কল্পনা সম্পূর্ণই ভুল, তাই বলছেন কি?"


- "না তা নয়। তবে কিছু দেখে তবেই সেই রকম কিছুকে সঠিক ভাবে কল্পনা করা যায়! কিন্তু সমস্যা হল, যারা ভুতের গল্প লেখে তারা নিজেরাই ভুত দেখেনি। বিশ্বাস ও করে না। লিখতে হবে তাই লেখে। আর এই সব পড়েই আপনার মতো লোকেরা ভুতের চেহারা সম্পর্কে ধারনা করেন, তাই না?" কথাটা বলে একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে লোকটা আবার বলে, "আপনি দেখবেন নাকি? একটা আসল ভূত? ভুত দেখা কিন্তু ভাগ্যের ব্যাপার!"


ঝাঁকুনি দিয়ে আবার ফেরিটা চলতে শুরু করে। পূবদিকের আকাশটা একটু যেন হালকা হতে শুরু করেছে। ফজরের নামাজের সময় হয়ে আসছে। চুপ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে পার্থ। কোন উত্তর না পেয়ে লোকটা আবার বলে ওঠে, "ভুত দেখবেন কি না বললেন না তো। সময় কিন্তু খুব কমে আসছে।" লোকটার কথায় এবার একটু মজাই পায় পার্থ, "কে দেখাবে; আপনি?" লোকটা গম্ভীর গলায় খুকখুক করে দুবার কেশে নিয়ে বলে, "নিশ্চই। তবে, তার আগে তো জানতে হবে, ভুত কি জিনিস!"


একটু অবাক হয়ে পার্থ বলে, "মানে?"
লোকটার গলা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলে, "মৃত্যুর পর আত্মা ধীরে ধীরে অশরীরী হয়ে যায়। এই সময় কখনও কখনও সে অবলম্বন খোঁজে!"


- "অবলম্বন, মানে?" পার্থ কথার মাঝেই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয়। আর সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দেয় লোকটা, "এই যেমন, এখন আপনি! সবাই কি আর নিজে নিজে মুক্তি পায়!" 


ঠিক এমন সময় দুইজন নামাজী লোক ডেকে উঠে আসে। একজন নামাজী শুয়ে থাকা লোকটাকে দেখেই একটা দমফাটা চিৎকার করে ওঠে, "হে আল্লা, খুন"। চিৎকার শুনে তাকায় পার্থ। ডেকের মৃদু আলোয় এবারে শুয়ে থাকা লোকটাকে কিছুটা অস্পষ্ট হলেও দেখে বুঝতে পারে আর শরীরের মধ্যে কাঁপুনি অনুভব করে, লোকটার বুকে একটা ছুরি গাঁথা। পার্থ এবারে চিৎকার করে ওঠে, "আমি জানি খুনী কে?" তারপর তাকায় চাদর ঢাকা লোকটার দিকে , "খুনী …এ-এই যে"; বলে এক ঝটকায় চাদরে টান দিতেই দেখে চেয়ার সম্পূর্ণ শূণ্য। হঠাৎ মাথাটা ঘুরতে থাকে পার্থর। জ্ঞান হারাবার মুহূর্তে সে শুনতে পায় একজন নামাজী বলছেন, "ধরেন, ধরেন, লোকটারে ধরেন।"
----
(চিত্র: সোময়েত্রী ভট্টাচার্য)

0 comments: