0

বইঘর - রঞ্জন রায়

Posted in


বইঘর
রঞ্জন রায়



নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা
— একটি পাঠ প্রতিক্রিয়া 

[এটি সন্মাত্রানন্দ রচিত “নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা- অতীশ দীপংকরের পৃথিবী” উপন্যাসটির পুস্তক সমালোচনা নয়, সে যোগ্যতা আমার নেই, -- বড়জোর এক মুগ্ধ পাঠকের প্রতিক্রিয়া বলা যেতে পারে। ] 

পাতা ওল্টাতেই বিস্ময়। দর্শনের গুঢ় এবং কূট প্রশ্ন ও কয়েক শতাব্দী আগে জন্মানো এক ক্ষণজন্মা বাঙালী মেধা অতীশ দীপংকরকে নিয়ে উপন্যাস লেখার কথা ভেবেছেন প্রথম জীবনে রামকৃষ্ণ মিশনে সেবাব্রতী এক সন্ন্যাসী! এই পাঠকের মিশনের সঙ্গে যতটুকু সম্পর্ক তাতে ওখানকার সন্ন্যাসীরা গৌতম বুদ্ধকে জয়দেব গোস্বামীকৃত দশাবতার স্তোত্রের বেঁধে দেয়া ভূমিকা অনুযায়ী বিষ্ণুর এক অবতার --‘নিন্দসি যজ্ঞবিধেয়রহযাতম, সদয়হৃদয়দর্শিতপশুঘাতম’ হিসেবে ভাবতেই অভ্যস্ত। 

কিন্তু ‘অনাত্মবাদীন’ ‘ক্ষণিকবাদীন’ বৌদ্ধদর্শন মিশনের জীবনে কোন অভিঘাত সৃষ্টি করে না। কারণ রামকৃষ্ণদেব ও বিবেকানন্দের আধ্যাত্মিক মানসভূমি বেদান্ত এবং ধর্মাচরণের বাহ্যিক দিকটি শাক্তমত ও তন্ত্র আশ্রিত। ঠাকুরের ভৈরবীসাধনা ও বেলুড়ে কালীপূজোর রাতে পশুবলি জনসাধারণের গোচরে। 

অথচ বইটি ইতিহাসের গবেষণাপত্র নয়, কোন দার্শনিক পাত্রাধার-কি-তৈল কিংবা তৈলাধার-কি-পাত্র বিচারে কণ্টকিত গ্রন্থ নয় । এটি আদ্যন্ত নিটোল একটি উপন্যাস। ইহাতে কল্পনার যাদুমিশ্রণ, প্রেম-প্রত্যাখ্যান-বিরহ-বলিদান-প্রতিহিংসা-জয়-পরাজয় সবই আছে। 

উপন্যাসটি লিখলেন সন্মাত্রানন্দ! প্রথমেই সংশয়। একজন গার্হস্থ্যজীবন পরিত্যাগী মানুষ কী করে ফুটিয়ে তুলবেন ষড়রিপুর তাড়নায় জ্বলেপুড়ে খাক হওয়া মানুষের ছবি? যিনি এই রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শের জগতকে অবিদ্যাজনিত মিথ্যাত্বের সাময়িক সৃষ্টি বলে মেনে নিয়েছেন তাঁর কলমে কী করে ফুটবে এর সৌন্দর্য ও কন্টকিত রূপ? এই পূর্বাগ্রহ নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। 

অবশ্য সন্ন্যাসীর সাহিত্যচর্চা একেবারে কালাপাহাড়ি কিছু নয়। স্বামী বিবেকানন্দ লিখেছেন ‘সখার প্রতি’ ও ‘দি কাপ’ এর মত কবিতা। আর রচেছেন অতি আধুনিক বাংলায় ছোট ছোট বাক্যবন্ধে ‘প্রবাসে’র মত জার্নাল। পণ্ডিচেরির নিশিকান্তের কবিতাও স্মরণীয়। তবে সেসব আধ্যাত্মিক বক্তব্যের কাব্যরূপ। কবিতার শৈলীর আবশ্যকীয় বিমূর্ত মাত্রা সেই স্পেস দেয় । কিন্তু গদ্যরচনা? বিশেষ করে উপন্যাস? এখানে তো চরিত্ররা রক্তমাংসের, সময় অতীতচারী হয়েও ছুঁয়ে যাবে সমকালের যন্ত্রণাকে, নইলে তা পর্যবসিত হয় জাদুঘরের দ্রষ্টব্যে। উপন্যাস লেখার এ’সব ঝামেলার সঙ্গে সন্মাত্রানন্দ সম্যক অবহিত। তাই বইটির প্রস্তাবনায় তিনি অকপট—“ – অতীশ দীপংকরের জীবনেতিহাস এ উপন্যাসের আশ্রয়, কিন্তু বিষয় নয়।– শাশ্বত মানবীসত্তাই ‘নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা’ উপন্যাসের বিষয়বস্তু। কখনও সে-নারীসত্তার নাম কুন্তলা, কখনও স্বয়ংবিদা, কখনো –বা জাহ্নবী”। 

গজব রে গজব! এই সংশয় শুধু আমার নয়। বইটি পড়ে জানতে পারলাম যে মিশন কর্তৃপক্ষ ও একই দোলাচলে ভুগেছেন সন্মাত্রানন্দের সাহিত্যকৃতি নিয়ে, অবশ্য আমার বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে। তাই একদিন তাঁকে নিজের ঝোলা কাঁধে তুলে মিশন থেকে বেরিয়ে আসতে হল। শ্রেয় ও প্রেয়র দ্বন্দ্বে উনি কলমকেই বেছে নিলেন আর আমরা পেলাম এই উপন্যাসটি। 

এই ঘটনাটি, এই কঠিন নির্ণয় তাঁর মানসে এক অমিট ছাপ ফেলেছে। তাই বইটির কথক হিসেবে নিজের জীবনের আদলে বর্ধমান থেকে কোলকাতায় এসে সোনারপুরের হোস্টেলে থেকে বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজে স্ট্যাটিস্টিক্সে এম এস সি করে সন্ন্যাসী হওয়া এবং সাহিত্যচর্চার তাগিদে মিশন থেকে বেরিয়ে এসে লেখক হওয়া শাওন বসু চরিত্রটির নির্মাণ। তাই ভিক্ষু মৈত্রীগুপ্ত বিক্রমশীলা বিহারে সঙ্ঘনির্দিষ্ট আচারবহির্ভূত আচরণের জন্যে অতীশ দীপংকরের আদেশে সঙ্ঘ থেকে বহিষ্কারের মুখোমুখি হয়েও অবিচলিত শান্ত ও নির্বিকার থেকে যান । 

এবার আসি মূল বইটির কথায়। এর ‘কথনশৈলী’ আদৌ একরৈখিক নয় । এতে সময় তিন খন্ডে বিভক্ত—দশম শতকের শেষ থেকে একাদশ শতক,ত্রয়োদশ শতক ও একবিংশ শতক। কিন্তু এই ত্রিস্তর কালখণ্ডগুলো বিচ্ছিন্ন (ডিস্ক্রিট) নয়; বরং ‘ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বস্তুত একই সমতলে অংকিত পরস্পরছেদী তিন বৃত্তের মতন। এর পর আরও জটিল গঠন চোখে পরে । যেমন, “ওই তিনটি বৃত্তের ছেদবিন্দুগুলোর মধ্য দিয়ে কোনো কোনো বিশেষ মুহূর্তে এক যুগের চরিত্রগুলোর সঙ্গে অন্য যুগের চরিত্রদের’ দেখা হয়ে যায়, বিনিময়ও হয়। 

একে কী বলব? বাঙলাভাষায় লেখা প্রথম জাদু-বাস্তবতার উপন্যাস? জানি না । সেই নান্দনিক বিচারের ধৃষ্টতা আমার নেই । তবে আমি বলব যে এই প্রচেষ্টায় লেখার প্রসাদগুণ, কালোপযোগী ভাষার পরিবর্তন ও লেখার টান আমাকে বাধ্য করেছে সারারাত জেগে একটানা পড়ে উপন্যাসটি শেষ করে পরের দিন দুপুরে পাঠ-প্রতিক্রিয়া লিখে ফেলতে। কারণ, দেরি করলে সেটা হবে সুচিন্তিত এক সমীক্ষা; আতসকাঁচে ধরা পড়া অনেক ফাঁকি-ফোকর। কিন্তু উপে যাবে আমার তাৎক্ষণিক ভালো লাগা, পূর্বাগ্রহ কাটিয়ে মুগ্ধতায় ভেসে যাওয়া। 

কেন মুগ্ধতা? 

প্রথম কারণটি সন্ন্যাসীর কলমে প্রকৃতি ও নারীর রূপবর্ণনা, তাও একজন সাধারণ পঞ্চেন্দ্রিয়তাড়িত পুরুষের রূপমুগ্ধতার দৃষ্টিতে। কোথাও কোথাও দুই এক হয়ে গেছে। 

কাহিনীর আশ্রয় বাঙ্গালাদেশের ঢাকা- বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে জন্মানো রাজপুত্র চন্দ্রপ্রভ কেমন করে সুবর্ণদ্বীপে (ইন্দোনেশিয়া) আচার্য ধর্মকীর্তির কাছে পাঠশেষ করে বিক্রমশীলা মহাবিহারের আচার্য অতীশ দীপংকর হয়ে উঠলেন। কিন্তু মূল সুরটি হল প্রতিবেশী কিশোরী কুন্তলার বিফল কামনা, ও তন্ত্রসাধনার মধ্য দিয়ে কখনো স্বয়ংবিদা কখনও অন্যরূপে অতীশকে পাওয়ার প্রয়াস। এইভাবে এবং একবিংশ দশকে সেই বজ্রযোগিনী গ্রামে কৃষক অনঙ্গ দাসের কন্যা জাহ্নবীর মধ্যেও সেই চিরন্তন নারী হৃদয়ের আকুতির প্রকাশ। আর কালচক্রের পরস্পরছেদী তিন বৃত্তের ঘুর্ণনে চিরন্তন নারী কখনও ইয়ংচুয়া, কখনও স্বয়ংবিদা, কখনও বা জাহ্নবী। বাৎসল্য, প্রেম ও দাম্পত্যের মধ্যে নারীর তিন রূপের প্রকাশ। তাই তারাদেবীর ও তিনটি মূর্তি,--কাঠের, পাথরের ও ব্রোঞ্জের। 

এবার একটু তিব্বতী শ্রমণ চাগ লোচাবার চোখে স্বয়ংবিদার রূপ দর্শন করা যাক। 

‘শ্বেত রাজহংসের মত দৃঢ়পিনদ্ধ শুভ্র কঞ্চুলিকা, সুনীল উত্তরী পীনোন্নত বক্ষদেশকে আবৃত করে স্কন্ধের উপর বিলম্বিত ও দীর্ঘিকার মন্দবাতাসে উড্ডীন। ----- 

‘স্বয়ংবিদা প্রশ্ন করলেন, “কী দেখছ লামা? একে রূপ কহে। এই রূপসমুদ্র অতিক্রম করতে পারলে সন্ন্যাসী হবে। আর যদি অতিক্রম করতে অসমর্থ হও, যদি এতে নিমজ্জিত হও , তবে কবি হবে”। (পৃ- ১২৭) 

‘অশ্রুর প্লাবনের ভিতর অপরূপা রমণীর দৃঢ় কুচাবরণ কঞ্চুলিকা শিথিল হ’ল। শিহরিত চাগ দেখলেন, সেই সুবিপুল কনককলসবৎ স্তনকুসুমের যুগ্ম কুচাগ্রচূড়া অনাবৃত বিস্ময়ে তাঁরই দিকে উন্মুখ হ’য়ে তাকিয়ে রয়েছে। --- আহ! এ কী জ্বালা! রমণীর চুম্বনে এত বিষ , এত ব্যথা! ‘(পৃ- ১৩৬) 

আর চুয়াল্লিশটি অধ্যায়ে বিবৃত ও প্রায় ৩৫০ পৃষ্ঠায় বিন্যস্ত এই উপন্যাসটিতে ধ্রুবপদের মত ঘুরেফিরে আসে একটি বৌদ্ধ তান্ত্রিক দোঁহা—‘ যখন বৃক্ষরাজির ভিতর দিয়ে বহে যাবে সমুষ্ণ বাতাস/ নদীর উপর ছায়া ফেলবে গোধুলিকালীন মেঘ/ পুষ্পরেণু ভেসে আসবে বাতাসে/ আর পালতোলা নৌকো ভেসে যাবে বিক্ষিপ্ত স্রোতোধারায়---/ সহসা অবলুপ্ত দৃষ্টি ফিরে পেয়ে তুমি দেখবে—আমার কেশপাশে বিজড়িত রয়েছে অস্থিনির্মিত মালা;/ তখন –কেবল তখনই আমি তোমার কাছে আসব ---‘। 

দ্বিতীয় মুগ্ধতা সন্ন্যাসী লেখকের সমকালের রাজনৈতিক ও সামাজিক পটপরিবর্তনের প্রতি সজগতা ও সংবেদনশীলতা। বিশ বছর পরে কলকাতায় ফিরে এসেছে স্বামী শুভব্রতানন্দ, পূর্বাশ্রমের শাওন বসু হয়ে। দেখছে এই কোলকাতাকে সে চিনতে পারছে না । 

‘উড়াল পুলের ঘোমটা আর বাইপাসের ওড়না পরেছে কল্লোলিনী।--- কলকাতার নিজস্ব সম্মান ছিল তার কৃষ্টিতে, তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে, এখন ব্যবসায়ীদের হাতে বিকিয়ে গেছে। ক্রমশঃ অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে মানুষ, কেমন খিঁচিয়ে কথা বলে আজকাল সবাই। কেউ কাউকে একটু সরে বসে জায়গা দিতে রাজি নয়’। 

আবার দেখুন রাজনীতির ক্ষেত্রে ‘ আদর্শ কিছু নয় ক্ষমতাই সব। --- কেন্দ্রে সমাসীন এই ধর্মধ্বজীরা যাকে হিন্দুধর্ম বলে মানে, সেটা পৌরাণিক হিন্দুধর্মেরও একটা অবক্ষয়িত রূপ। এবং তারা নিজেদের সবথেকে বড়ো দেশপ্রেমিক বলে মনে করে। অহিন্দুরা কি ভারতীয় নয়?’ 

জে এন ইউয়ের কানহাইয়া কুমারের ঘটনায় বিচলিত প্রাক্তন শিক্ষক সন্মাত্রানন্দ লেখেন—‘ গ্রেপ্তার হয়ে গেল ছাত্রটি। বিচারের আগেই দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের প্রাঙ্গণে আইনজীবীরা ছেলেটির ওপর প্রচণ্ড প্রহার চালাল। ---- 

‘ছাত্ররা কি রাজনীতি করবে? নাকি, ছাত্রাণাং অধ্যয়নং তপঃ? (আহা! কী অভিনব চিন্তা!)বিচারের আগেই আইনজীবীরা কি আইন নিজেদের হাতে তুলে নিতে পারেন? তাঁদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে না কেন কেউ? এসব বহু তাত্ত্বিক আলোচনার অন্তে ছাত্রটি যখন ছাড়া পেল, তখন রাজনৈতিক দলগুলি এই যুবক ছাত্রটির মধ্যে তাদের মেসায়াকে খুঁজে পেতে লাগল’।(পৃ-১৪৩)। 

তৃতীয় কারণ, পৃ-১৫৬তে মতবাদ ও সত্যের আপেক্ষিকতা নিয়ে প্রাঞ্জল ব্যাখ্যাটিঃ 

‘মানুষ সত্যের এক-একটি রূপ কল্পনা করে মাত্র। আর সত্যের উপর আরোপিত বা কল্পিত সেই সব রূপকেই ‘মতবাদ’ কহে। অধিকারীবিশেষে প্রতিটি মতবাদই প্রাথমিকভাবে উপকারী, কিন্তু কোনও মতবাদই সত্যকে সাক্ষাৎ দেখিয়ে দিতে পারে না । যুক্তি প্রয়োগ করলে সমস্ত মতই অন্তিমে খণ্ডিত হয়ে যায়’। 

বিতর্কসভায় দীপংকরের মুখে এই বাক্যটিতে এক লহমায় ধরা পরে সমস্ত ‘বাদ’, --হিতবাদ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, জাতীয়তাবাদ থেকে সমাজবাদ ও মার্ক্সবাদ—এর উপযোগিতা ও সীমাবদ্ধতা। জীবন চলমান আর সমস্ত ‘বাদ’ দেশ ও কালে আবদ্ধ। তাই স্থবির। 

মুগ্ধতার শেষ কারণটি একটু ব্যক্তিগত। পৃষ্ঠা ৮৬ থেকে পাচ্ছি অতীশ দীপংকরের ভাবনাবিশ্ব। এখানে পৌঁছে চমকে গেলাম। প্রাক্তন বৈদান্তিক সন্ন্যাসী কত সংক্ষেপে ও সহজ করে দীপংকরের অনুভবের মাধ্যমে আমাদের কাছে ব্যাখ্যা করছেন বৌদ্ধদর্শনের সার। বিশেষ করে এই দুটো তত্ত্ব--তার ‘ল অফ কজালিটি’ বা কার্য-কারণ সম্পর্ এবং নির্বাণ বলতে কী বোঝায়। আর বৌদ্ধদের মধ্যেও সেই ধারণাগুলির বিবর্তন। প্রতি বিষয়ে প্রাচীন সর্বাস্তিবাদী ও সৌত্রান্তিক( মোটা দাগে হীনযানী) এবং শূন্যবাদী ও বিজ্ঞানবাদীদের ( মহাযানী) মধ্যে কোথায় তফাৎ ইত্যাদি। এই প্রসঙ্গে তুলে ধরেছেন মহাযান ও হীনযান নামের উদ্ভব ও সার্থকতা। উঠে এসেছে আদি বুদ্ধিজম ও পরবর্তী সংশোধনের যাথার্থ্য নিয়ে বিতর্ক। অনেকটা যেন ক্যাথলিক ও প্রটেস্টান্ট প্রভেদ, বা কম্যুনিস্ট শিবিরের গোঁড়া মার্ক্সবাদী ও সংশোধনবাদীদের বিতণ্ডা। 

আমি কয়েকবছর আগে কাংড়ার ধর্মশালায় তিবেতান ইন্সটিট্যুট এর বারান্দায় এক তরুণ লামাকে চেপে ধরে বৌদ্ধদর্শনের কার্য-কারণ তত্ত্ব (পতীচ্চসমুৎপাদ) বোঝার চেষ্টা করি। এঁরা নাগার্জুনের মাধ্যমিক দর্শন বা শূন্যবাদের অনুগামী। তারপর দিল্লির টিবেট হাউসে অধ্যক্ষ লামার দর্শন ক্লাসে যাই ও ‘গতে গতে পারাগতে’র ব্যাখ্যা শুনি যা এই উপন্যাসে দীপংকরের ভারতে গুপ্তভাবে গ্রন্থ পাঠানোর প্রয়াসে কোড হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। তারপর মন না ভরায় কোলকাতায় থেরবাদীদের প্রধান ভিক্ষু সুমনপালের কাছে যাই। উনি মিলিন্দ-পঞহো অর্থাৎ রাজা মিনান্দার ও ভিক্ষু নাগসেনের মধ্যে প্রশ্নোত্তর পড়তে বলেন। 

কিন্তু এখানে এই বারো নম্বর অধ্যায়ে সন্মাত্রানন্দ সংক্ষেপে সুন্দর বুঝিয়েছেন। 

“ ইতি ইমস্মিং সতি, ইদং হোতি। ইমসসুপ্পাদা, ইদং উপজ্জতি।–যদি এই কারণটি উপস্থিত থাকে, তবে এই ফল হবে। কারণ উৎপন্ন হলে কার্যও উৎপন্ন হবে। ইতি ইমস্মিং অসতি, ইদং ঞ হোতি। ইমস্ম নিরোধা, ইদং নিরুজ্ঝতি। -- যদি এই কারণ না থাকে তাহলে এই ফলও থাকবে না । কারণটির নিরোধ হলে কার্যটিও নিরুদ্ধ হয়ে যাবে”। (এখানে কি লেখক এই ধারণাটির একটি প্রচলিত ব্যাখ্যা ‘ডিপেন্ডেন্ট অরিজিনেশনে’র পক্ষে?) 

তারপর এসেছে এই কার্য-কারণ শৃংখলার বারোটি কড়া বা নিদান; যথাক্রমে অবিদ্যা, সংস্কার, বিজ্ঞান, নামরূপ, ষড়ায়তন, স্পর্শ, বেদনা, তৃষ্ণা, উপাদান, ভব, জাতি ও দুঃখ। এর একটি থাকলেই অপরটি থাকবে, একটি চলে গেলেই অপরটিও নির্বাপিত হবে। আর এই চক্রাকারে আবরতনের নাভি হল তৃষ্ণা। তাই নির্বাণপ্রাপ্তির জন্যে জয় করতে হবে সমস্ত তৃষ্ণাকে, এমনকি নির্বাণের তৃষ্ণাকেও! কোথাও কি এলিয়টের নাটক ‘মার্ডার ইন ক্যাথিড্রাল’ এ রাজদন্ডে মৃত্যুর আগে বিশপ অফ ক্যান্টারবেরির কাছে শহীদ হওয়ার লোভ ত্যাগের প্রস্তাবের কথা মনে পড়ছে! 

তারপর এল পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মত করে এল এই নির্ণায়ক কথা যে রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান বা আত্মচেতনার প্রবাহ –এই পঞ্চস্কন্ধ মিলেই ‘আমি’। এর বাইরে আর কোন জ্ঞেয় বস্তু নেই । 

তারপর বিতর্কসভার মধ্য দিয়ে আমরা হীনযান ছেড়ে মহাযানে পৌঁছালাম, আরও বলতে গেলে অসঙ্গ –বসুবন্ধুর বিজ্ঞানবাদে। এখানে সন্মাত্রানন্দ কি মহাযানের পক্ষে একটু টেনে খেলিয়েছেন? কারণ আলয়বিজ্ঞান ও বিজ্ঞপ্তিমাত্রতার ধারণার সঙ্গে (জ্ঞাতা-জ্ঞেয় অভেদ) যে অদ্বৈত বেদান্তের (অহং ব্রহ্মোস্মি) বেশ মিল! আর উপন্যাসকারের সে স্বাধীনতা থাকে। কিন্তু সতর্ক লেখক ধরিয়ে দেন যে বৌদ্ধমতে সকলই ক্ষণিক, নিয়ত পরিবর্তনশীল। অন্যদিকে উপনিষদের কথিত ‘আত্মা’ জীবের অপরিবর্তনীয় সত্তা। 

আমার পরিচিত অনেকের কাছে এই অধ্যায়টি বাহুল্য এবং কাহিনীর গতিরোধক মনে হয়েছে। আমার তা মনে হয় নি। উপন্যাসে কাহিনীর চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ দেশ-কাল-চরিত্রকে এবং তাদের মধ্যের সংঘাতকে তুলে ধরা। তাই ভাল উপন্যাসে একটি ডিসকোর্স থাকবেই। আর এই দার্শনিক অভিঘাতের মধ্যেই রয়েছে দীপংকর চরিত্রের অনীহার বীজ যা তাকে সংসার , ঐশ্বর্য এবং নারীর প্রেমের আহবানকে প্রত্যাখ্যান করতে প্রেরিত করে। 

আমার মুগ্ধতার চতুর্থ কারণ, আচার্য ধর্মকীর্তির চরিত্রচিত্রণ ও তাঁর সঙ্গে অতীশ (চন্দ্রগর্ভ) এর আলোচনায় বৌদ্ধদর্শনের নির্বাণ ও বোধিলাভের সঙ্গে আপামর জনসাধারণের ব্যক্তিক ও সামাজিক জীবনে অবিচার ও অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার অনুসন্ধান করা। 

ধীমান আচার্য ধর্মকীর্তি বুদ্ধিষ্ট লজিকের বিরাট ব্যক্তিত্ব, ‘প্রমাণবার্তিকে’র মত গ্রন্থ লিখেছেন। আর একদিকে সহজ সরল ও বালকের মত কৌতুক ও পরিহাসপ্রিয়। ছবিটি মিলে যায় পঞ্চাশ বছর আগে কোলকাতায় প্রকাশিত অবন্তীকুমার সান্যাল ও জয়ন্তী সান্যাল সম্পাদিত ‘হাজার বছরের প্রেমের কবিতা’সংকলনে ধর্মকীর্তির রচনা বলে প্রকাশিত একটি চার লাইনের কবিতায়। যার সারাংশ হচ্ছেঃ 

নারীকে দেখেই আমি বুঝেছি ভগবান বুদ্ধের কথাটি যথার্থ যে এই বিশ্বের স্রষ্টা কোন ঈশ্বর হতে পারে না। কারণ, তাহলে নারীকেও ঈশ্বরই সৃষ্টি করতেন। তারপর কি তিনি তাঁর এই অপরূপ সৃষ্টিকে ছেড়ে দিতেন! 

উপন্যাসের ১১০ পাতায় সংশয়দীর্ণ ধর্মকীর্তি শিষ্য অতীশ দীপংকরকে প্রশ্ন করেনঃ 

পীড়িত জনতা আনন্দময় জীবনের স্বপ্ন দেখে। তারা নির্বাণ চায় না, বাঁচতে চায় । তারা চায় দূঃখ-অতিক্রমী আনন্দময় জীবনযাপনের কৌশল। তাদের এই চলমানতার দর্শন যদিও কী বৈদিক, কী শ্রামণিক শাস্ত্রদ্বারা সমর্থিত নয়, তবু আস্তিক, নাস্তিক, লোকায়ত, উপাসনাকেন্দ্রিক সকল প্রকার চিন্তাকেই তা আত্মস্থ করে নিয়ে সমাজজীবনে স্থান দিয়েছে। ‘আমি তাই ভাবি, বস্তুত আমাদের ধর্মদেশনা কি লোকসাধারণের উপকার করে? অথবা, আমরাই লোকসাধারণের দ্বারা উপকৃত হই?’ 

এ সংশয় একেবারেই ঘটমান বর্তমানের সংশয়। আমাদের সবার মনেই অহরহ এ প্রশ্ন ওঠে, নানাভাবে। 

আবার তরুণ অতীশ বলেন— যে কোনও যুগেই পরপীড়ক রাজশক্তি লোকসাধারণের ওই দারিদ্র্যবিজয়ী দুঃখজয়ী জীবনীশক্তি শোষণ করে নিতে চায়, কিন্তু তা নিবিয়ে দিতে পৃথিবীর তাবৎ নৃপতিই অসমর্থ। 

এ যেন রবীন্দ্রনাথের ‘ওরা কাজ করে’ পড়ছি বা শুনছি ‘জরুরী অবস্থার’ দিনে ফক্কড় কবি বাবা নাগার্জুনের লেখা দুটি লাইনঃ 

‘সুকখী ঠুট পর বৈঠ কর কোয়েলিয়া কর গই কুক, 

বাল বাঁকা না কর সকী শাসন কা বন্দুক।“ 

অস্যার্থঃ 

শুকনো ডালে বসেও কোয়েল দিচ্ছে কুক, 

ঠেকাতে পারল কই তাকে ক্ষমতার বন্দুক. 

তাহলে এই পরীক্ষামূলক আঙ্গিকে লেখা উপন্যাসটি কতদূর সার্থক? আমার কাছে এ প্রশ্ন অবান্তর। অনেক সমীক্ষকের মতে দার্শনিক বিতর্কের মধ্যে কোথাও মাঝখানে দাঁড়ি টেনে দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে ষড়দর্শনকে প্রতিযোগী করে না দেখিয়ে একই মননের বিভিন্ন ভাবের প্রকাশ হিসেবে দেখানো যেন একটু জোর করে হয়েছে। আর এক সমীক্ষকের মতে ভাষায় কোথাও কোথাও সমস্যা আছে। কিছু শব্দের তদ্ভবীকরণ যেন ঠিকমত দাঁড়ায়নি। 

এহ বাহ্য। চারদিকে সিরিয়াল-গন্ধী উপন্যাসের প্লাবনের মধ্যে এই আখ্যানটি এক আনন্দদায়ক ব্যতিক্রম। 

আজকের এই অসূয়া-হিংসা- অনাচার- মদগর্বী পশুতার দিনে ভারতে বুদ্ধের বাণী, মাত্র শান্তিজল ছিটানো নয়, হিংসার অসারতা, অনিত্যতা ও আত্মঘাতী প্রবণতাকে বোঝা একান্ত জরুরী হয়ে পড়েছে। চাইব, এই বইটি আরও লোকে পড়ুক, আলোচনা করুক।

0 comments: