0

গল্প - রঞ্জন রায়

Posted in

গল্প


ভ্যালেন্টাইন দিবস --একটি রহস্য গল্প 
রঞ্জন রায়


ঘড়ির কাঁটা বোধহয় সাড়ে আটটার ঘর ছাড়িয়েছে। ভাবতে ভাবতে সুপ্রকাশ হিরো হোন্ডার অ্যাকসিলেটর সামান্য কমিয়ে বাঁহাতের কব্জি মুড়ে ঘড়ি দেখার চেষ্টা করলো।
হ্যাঁ, আটটা বেয়াল্লিশ, আর দুটো মোড় পেরোলেই---।
পিলে-চমকানো প্রেসার হর্ন বাজিয়ে গা ঘেঁষে বেরিয়ে গেলো দুটো বাইক আর বিচ্ছিরি ব্রেক কষে পাশে থামলো এক মারুতি সুইফ্‌ট।
---- ক্যা আংকল, তব সে সাইড মাংগ রহা হুঁ, কান পে জু নহী রেঙ্গা? বাদ মে শিকায়ত করোগে কি পিছেসে ঠোক দিয়া!
সুপ্রকাশ কিছু বলার আগেই পেছনে বসা চৌহান বলে উঠলো--- সরি বেটে! গলতী হো গয়ী। অব জানে দো। চলিয়ে রায় সাব্‌, অব গাড়ি আগে বঢ়াইয়ে।
এবার ও নীচু গলায় সুপ্রকাশকে বোঝাতে লাগলো।
---- কিঁউ ফালতু পঙ্গা লেনা? অব হম কালেজ কী স্টুডেন্ট থোড়ে হী হ্যায়?
অরে বাবা, ভাইজাগ- কোরবা লিংক এক্স্‌প্রেস এতক্ষণে একনম্বর প্ল্যাটফর্মে এসে গেছে, এখানে ছেলে- ছোকরার সঙ্গে মুহ্‌ লাগলে ট্রেন মিস হয়ে যাবে। আমার কাছে ব্যাংকের ক্যাশের চাবি। দেরি হলে কেউ না কেউ ঠিক কমপ্লেন করে দেবে।
গাড়ি সাঁইমন্দিরের গায়ে লাগা সাইকেল স্ট্যান্ডে রেখে ওরা লাগেজরুমের পাশ দিয়ে স্টেশনে ঢুকে দেখলো-- গাড়ি আসবে দু'নম্বরে। ওভারব্রিজ পেরুনোর সময় মহা ঝামেলা। তিননম্বরে থামা লোক্যাল ট্রেন থেকে পিলপিল করে নামছে অসংখ্য যাত্রী। আর তারা ওভারব্রিজের ওপর ঠ্যালাঠেলি করতে করতে বানিয়ে ফেলেছে অন্তত: চার-চারটে লাইন। ছেলে-মেয়ে-বুড়ো- বুড়ি--আন্ডাবাচ্চা, কুলির মাথায় লাগেজ। রেলিংয়ের গায়ে পানের পিকের দাগ। তার স্পর্শ বাঁচাতে গিয়ে ধাক্কা খেতে হল একটি বেঢপ টিনের তোরঙ্গের সঙ্গে।
কনুইয়ের কাছটা ছিঁড়ে গেছে। আরে বাক্স বইতে থাকা কুলি না হোক ওর মালিক তো সরি বলতে পারতো, কিন্তু বলেনি। আজকাল লোকজনের সামান্য সৌজন্যবোধও ভোঁতা হয়ে গেছে।
সুপ্রকাশ ভাবলো মালিককে আচ্ছা করে দু'কথা শোনাবে। কিন্তু মালিক কোন লোকটা? সামনের জিনসের প্যান্ট আর স্প্যাঘেট্টি স্ট্র্যাপ দেয়া টপ পরা ঐ অহংকারী কিশোরি? নাকি তোরঙ্গের পেছন হেঁটে চলা বীর সাভারকরমার্কা কালো টুপি পরা আধবুড়ো মারাঠি? অথবা বৌ-বাচ্চা শুদ্ধু একগাদা মাল নিয়ে ব্যতিবস্ত ছত্তিশগড়ি নওজোয়ান? ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। না:, কুলিকেই জিজ্ঞেস করতে হবে।
--- এ কুলি, তেরা মালিক কিধর? আবে কৌন হ্যায় তেরা শেঠ?
কিন্তু কুলি কোথায়? তোরঙ্গ শুদ্ধু সক্কাল পৌনে নটায় আগস্ট মাসের এই চড়া ঝলমলে রোদ্দূরে লোকটা কি করে স্রেফ হাওয়া হয়ে গেল? কোনদিকে গেল?
এ যেন "কোথায় বা কি, ভূতের ফাঁকি, মিলিয়ে গেল চট করে।" 


তাড়াহুড়োতে ছয় নম্বর কোচ ছাড়িয়ে প্রায় চার নম্বরের সামনে এসে গেছে ওরা। এমন সময় পেছন থেকে ডাক—এই যে রায়দা, হন্‌হনিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন যে বড়! বলি আজ কি ইঞ্জিনড্রাইভারের পাশে বসে যাওয়ার প্ল্যান নাকি?
ব্যাক্‌ গীয়ার মারুন, আপনার জন্যে জায়গা ঠিক করা আছে। হেঁড়ে মাথা
অশোক সোনীর হাসি হাসি মুখ ফোকাসে এল।
সুপ্রকাশ ফিরল ছয় নম্বর কোচের দিকে।
আসলে এক্স্‌প্রেস ট্রেনের অন্য কোচগুলোতে মান্থলি পাস ওলা ডেইলি প্যাসেঞ্জারের ওঠার পারমিশন নেই। না মানলে কড়া ফাইন। কিন্তু দৈনিক রেল যাত্রী সংঘের চেঁচামেচিতে রফা হয়েছে যে শুধু ৬নং কোচে ওরা কোরবা অব্দি ট্র্যভেল করতে পারবে, অন্য কোচে চড়লে আগের মতই পেনাল্টি লাগবে।
উঠতেই আগে থেকে বসা ক'জন হৈ-হৈ করে উঠলো-- এদিকে এদিকে ! আপনার জন্যে আজকে স্পেশাল বন্দোবস্ত।
--- মানে?
-- মানে আজ দাদা-দিদি পাশাপাশি।
অশোক ফিস্‌ফিস্‌ করে-- চাইনিজ খাওয়াতে হবে কিন্তু! আমিই আপনার জায়গা দিদির পাশে ফিট করলাম।
সুরেন চন্দ্রা ব্যাখ্যা করে--- আসলে আজকে দিদি সাউথ বিহার এক্সপ্রেস মিস্‌ করেছে। অগত্যা আমাদের লিংক একস্‌প্রেস ভরসা। আমাদের রিকোয়েস্ট করলো বসার জন্যে একটু জায়গা ম্যানেজ করতে। আমরা একেবারে আপনার পাশে ফিট করেছি। আপনার কি? দিদির পাশে বসে বিদেশি সেন্টের গন্ধ নিন, বাংলায় যতখুশি বকবক বা বকবকম যা ইচ্ছে করুন, আমরা কানে তুলো দিয়ে থাকবো।
-- এই বয়সে এছাড়া আর কি করতে পারে দাদা? খালি পিলী "আভি তো ম্যয় জোয়ান হুঁ'' গাইলেই কি বয়েস লুকোনো যায়?
মণীন্দ্র ফুট কাটে।
চৌহান সায় দেয়—আরে কখন যে একঘন্টা কেটে গিয়ে চাঁপা স্টেশন এসে গেছে টের পাবেন না। কফি আর সামোসা আমরাই সাপ্লাই দেবো। কিন্তু ছোটভাইদের ভুলে যাবেন না যেন!
অস্বস্তি এড়াতে ও ভদ্রমহিলাটির পাশে খালি জায়গায় বসে পড়ে।
মহিলাটি হেসে বাংলায় বল্লেন-- অনেকদিন পরে, তাই না? ভালো আছেন তো? আর বৌদি? মেয়েরা?
সুপ্রকাশ সদর্থক মাথা নাড়ে। স্টেটব্যাংকের অফিসার মাঝবয়েসী এই বাঙালী মহিলার জন্যে সুপ্রকাশের সামান্য দুর্বলতা আছে। এটা নিত্যযাত্রীদের ছোট্ট গ্রুপে অনেকেই জানে। ভদ্রমহিলা বিয়ে-থা করেন নি। ঝাড়া হাত পা'। একসময় অনেক গুণমুগ্‌ধ ঘিরে থাকতো, বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাদের সংখ্যাও হাতে গোণায় দাঁড়িয়েছে। কাছাকাছি বয়সের এই গপ্পবাজ দাদাটির মুগ্ধতা মহিলার ভালই লাগে। একটু যেন প্রশ্রয়ের ছোঁয়া।
--- কি হলো? আজ চুপচাপ যে! মনমেজাজ ভালো নেই? নাকি বৌদি বাপের বাড়ি গেছে? চৌহান কিছু জান নাকি?
--- মত বোলিয়ে দিদি। আজতো দাদা অ্যাক্সিডেন্ট করনেওয়ালে থে। থোড়ি সি চুক হোনেপর আর-পার মামলা থা।
--- সেকি? ব্যাপারটা কী? অন্যমনস্ক ছিলেন? খুলে বলুন তো?
--- আর বলবেন না। আমার ছোটোমেয়ে এসেছে দিল্লি থেকে, দিনদশেকের ছুটি নিয়ে। আর জানেন তো, ওর সঙ্গে আমার প্রায় বন্ধুর মত রিলেশন। আমরা নতুন কোন বই পড়লে এক্সচেন্‌জ করি, অফিসের গসিপ জোকস্‌ - সব একজন আরেকজনকে শোনাই। ওর বয়ফ্রেন্ডের সব কথা, সব সমস্যা ও মাকে ছেড়ে আমার সঙ্গেই শেয়র করে। এনিয়ে ওর মার একটু হিংসে মত আছে।
-- তা এর মধ্যে সমস্যা কিসের! ও এসেছে এ তো সুখের কথা।
-- তাতো বটেই! কিন্তু সমস্যাটা হল আসার পর থেকেই মেয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে মার ঘরে শুয়ে আছে। আমি উঁকি দিলেই গিন্নির দাবড়ানি---- ওকে বিরক্ত কোরো না। ওর শরীর খুব খারাপ, রেস্ট চাই।
হয়েছে কি জিজ্ঞেস করেও কোন লাভ হল না। ওসব গাইনি প্রবলেম, তুমি পুরুষমানুষ, জেনে কি করবে?
বল্লাম, --আমার চেনা ভাল ডাক্তার আছে, দেখিয়ে নিয়ে আসি।
-- না, তোমাকে অযথা অফিস কামাই করতে হবে না। আমি ফিলোমেন সিস্টারের সঙ্গে গিয়ে দেখিয়ে আনবো।
ফিলোমেন সিস্টার হলেন আমাদের পাড়ার কাছের একটি নার্সিং হোমে হেড নার্স। গিন্নির সঙ্গে বেশ ভাব। আমার একটু গায়ে পড়া মনে হয়। সব মিলিয়ে মেজাজটা খিঁচড়ে আছে।
ইতিমধ্যে রোজকার ঝালমুড়িবাদাম বিক্রেতা মেয়েটি এসে বাঁধা মাপে ক'টি প্যাকেট আর আলাদা করে কাঁচালংকা সাজিয়ে দিচ্ছে। চ্যাংড়াদের আপাত ভব্যতার মোড়কে মোড়া হটাৎ লাফিয়ে ওঠা আদিরসের বাউন্সারগুলো হাসিনুখে ডাক্‌ করছে।
এবার কফি আসার পালা। কিন্তু ভবানী আর ল্যাকড়ার বেসুরো চিৎকারে মস্তির আমেজ কেটে গেল।
-- আবে, কৌন শালা গাড়ি কে অন্দর পানি ফেক রহা হ্যায়? শালেলোগ বাথরুম নহী যা সকতে?
-- নহী ইয়ার! কিসি কী সুরাই ফুট গয়ী, পানী বহ রহী।
- সবাই পা' তুলে বসুন। ও দিদি আপনিও। জলটায় কেমন গন্ধ, আঁশটে।
-- এ চৌহান, যাকে দেখকে আ, কোন শালা মছলি লেকে তো নহী জা রহে?
কিন্তু আড্ডা জমলো না। জলের ধারা কমছে না। আর সত্যি বিচ্ছিরি বোঁটকা গন্ধে ভরে যাচ্ছে কামরাটা।
বিশেসর দেখে এসে বল্লো-- আমাদের দুই সারি পেছনে স্লীপারের তলায় কেউ একটা বাক্সো রেখেছে। তার থেকে চোঁয়াচ্ছে ঐ আঁশটে জল। বাক্সের মালিককে ট্রেস করা যাচ্ছে না। চৌহান হাঁফ ছাড়লো- কেউ বম্ব বা এক্সপ্লোসিভ রাখেনি।
দিদি গো, এসব আপনার কোন বেরাদরের কাণ্ড হবে। কালোকোটের ভয়ে মাছের প্যাকিং এভাবে কোলকাতায় চালান করছে।
-- ধ্যেৎ, আকল বড়ী, কি ভ্যঁইস বড়ী? কোলকাতায় মাছ চালান তো রাত্তিরের এক্সপ্রেসে ভেন্ডার কোচে যায়। অন্য কিছু।
উগ্র কটু গন্ধ আস্তে আস্তে যেন গোটা কামরাটাকে গিলে নেবে।
অতুল অনেকক্ষণ ধরে কি সব ভাবছিলো। ওকে নিয়মিত সাইকিয়াট্রিস্টের দেয়া ক্যাপসুল খেতে হয়। এ নাকি সারাজীবন চলবে! এমন সময়ে মাঝে মাঝে অদ্ভূত কিছু বলে ওঠে।
--- রায়দা, একটা কথা। মাছের ব্যবসা নয়, ধরুন যদি অন্য কিছু হয়?
--- কী অন্য কিছু?
-- না মানে ধরুন যদি কেউ--, আচ্ছা ছাড়ুন ওসব। গন্ধটা খেয়াল করুন। আপনাদের চেনা চেনা লাগছে না? কেউ চিনতে পারছেন না? আশ্চর্য?
--- হ্যাঁ, চেনা চেনা তো বটেই, কিন্তু ঠিক--।
-- এটা রক্তের গন্ধ।
--- দুর ব্যাটা বেড়ালের হাগু! রক্তের গন্ধ এমন বোঁটকা হয় না।
--- তাজা রক্তের গন্ধ নয়, বাসী--, ক'দিনের বাসী রক্তের। ইন ফ্যাক্ট, এই গন্ধ আপনার-আমার সবার পরিচিত। আপনারা খেয়াল করেন না। সমস্ত নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে একটাই বাথরুম। ঘরে জোয়ান মেয়ে। মাসিক স্রাবের সময় বাথরুমে প্যাকেটে করে রাখা স্যানিটারী ন্যাপকিন বা শুকোতে দেয়া কাপড়ের ফালিতে এই গন্ধ আমরা পেয়ে থাকি!
--- অ্যাই! কি হচ্ছে কি? দিদি বসে আছে খেয়াল নেই? শালা পাগলাটার যত্তো উদ্ভুতুড়ে থিওরি। আজকে ওষুধ খেতে ভুলে গেছে নাকি?
অতুল গুমসুম হয়ে জানলার বাইরে আকাশ দেখতে থাকে। চাঁপা স্টেশন আসতে মিনিট কুড়ি বাকি।
-- দাদা, পাগলার থিওরির সবটা উড়িয়ে দেবেন না। ধরুন যদি বাক্সের মধ্যে কোন ডেডবডি থাকে?
--- ফোট্‌ বে! তিন বাই চারের প্যাঁটরার মধ্যে শুয়ে মরা মানুষ?
-- কেন? যদি কুচি কুচি করে? বা ধরো যদি ছোট বাচ্চা হয়? তিনবছর আগে রায়পুরের নীলেশ রাঠোর হত্যাকান্ড ভুলে গেলে?
এবার সবাই চুপ মেরে যায়। একটা অস্বস্তি সবার মনে। সেবার নীলেশ নামে গুজরাটি বাচ্চাটার গুমখুন হওয়া লাশ ছত্তিশগড় এক্সপ্রেসের খালি কামরায় একটা বাক্সের মধ্যে পাওয়া গেছিল। পুলিশের হাতে ধরা পড়ে বাচ্চাটার আপন কাকিমা। কিন্তু আদালতে কেসটা দাঁড়ায় নি। ভদ্রমহিলা বেকসুর খালাস পেয়ে যান। 

ট্রেন চাঁপা স্টেশনের সাইডিংয়ের কাছে, বাক্সরহস্যের কোন কিনারা হয়নি।
চৌহান বলে-- দাদা, চলুন আপনি-আমি মিলে বাক্সটা দেখি। যদি গড়বড় কিছু হয়, স্টেশনমাস্টার এবং রেলপুলিশকে খবর দিতে হবে। আর যদি মাছের বেওয়ারিস পেটি হয় তাহলে আজ ফিস্টি। আমরা সোজা বাক্স নামিয়ে আপনার অফিসে। আর দিদি নেবেন একদিনের ক্যাজুয়াল লীভ। অফিস ক্যান্টিনে মাছভাত দিদিই রাঁধবেন। না দিদি, ছোটভাই দের নিরাশ করবেন না। আপনি একদিন ছুটি নিলে ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাবে না।
দিদি হাসিমুখে বল্লেন --- আগে দেখি তো কি ব্যাপার। তাড়াতাড়ি কর, স্টেশন আসছে।
না, এখনও মালিকের কোন হদিস পাওয়া গেল না। বাংকের ওপর শুয়ে থাকা এক বিহারী দম্পতি জানালেন বিলাসপুর স্টেশনে এক কুলি এসে বাক্সটি সীটের নীচে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু সঙ্গে আর কেউ ছিল না। পরেও আর কেউ আসেনি।
সুপ্রকাশ নীচু হয়ে সীটের নীচে উঁকি মারে। গ্যালভানাইজড্‌ শীটের তিন বাই চারের একটি বাক্সো, বিলাসপুরের মুসলমান পাড়ায় কারিগররা এমন বাক্স শ'য়ে শ'য়ে বানায়।
উঁহু, নাক লাগিয়ে ও গন্ধের কারণ বোঝা গেল না। তবে মাছের পরিচিত আঁশটে গন্ধ তো অবিশ্যি নয়। 



এমন বাক্স আকছার চোখে পড়ে। ইন ফ্যাকট্‌, ওর নিজের ঘরেও এমনি একটা পুরোনো বাক্স আছে, কবে বাথরুমের ওপর লফটে তুলে দেয়া হয়েছে।
তবে এটা বোধহয় খুব পুরনো নয়। এর তলাটা গেঁয়ো কায়দায় সবুজ রঙ করা। কিন্তু কি একটা খটকা থেকেই যাচ্ছে।
হটাৎ যেন চোখের সামনে থেকে একটা পরদা সরে গেল। গন্ধটা আসলে একটা অবিমিশ্র কিছু নয়। তার্পিন তেল ও আরেকটা কিছু আধপচা গোছের। কিন্তু খটকাটা অন্য। বাক্সের কোণায় একটা ছোট্ট পদ্মফুল আঁকা।
এই পদ্মফুল বাক্সটি ও দেখেছে, দেখেছে ঘন্টা খানেক আগে। বিলাসপুর স্টেশনে ওভারব্রিজ দিয়ে নামার সময় ঠিক সামনে কুলির মাথায় বাক্স । সুপ্রকাশ কিছুতেই পাশ কাটিয়ে এগুতে পারছে না। তাড়াহুড়ো করার সময় বাক্সের কোণায় খোঁচা লেগে হাতের নুনছাল উঠে যাওয়া এবং বাক্সটির কোণায় ছোট পদ্মফুল।।
অজানা মালিকের বিরুদ্ধে পুরোনো রাগ ফিরে আসে।
বলে-- চৌহান, আমার সঙ্গে দু'জন চল। আগে রেলপুলিশের অফিসে গিয়ে কমপ্লেন লেখাব। আমাদের একটা দায়িত্ব আছে।
অতুল বলে ওঠে-- আমাদের মান্থলি পাস, আইডেনটিটি কার্ড সব দেখাতে হবে, তাহলে কমপ্লেন গুরুত্ব পাবে।
-- ঠিক বলেছিস, পাগলে তো ভারী আকলমন্দ্‌ হ্যায়! জিও রাজা!
সুপ্রকাশের কালচে মুখ পাঁশুটে হয়ে যায়।-- আমার বোধহয় রেলপুলিশের কাছে না যাওয়াই উচিৎ।
-- কেন ? কি হল?
--- ব্লান্ডার! আজ জামাকাপড় বদলানোর সময় মান্থলি পাস, আইডেনটিটি সব বাড়িতে ফেলে এসেছি। তোরাই যা!
-- না দাদা, তোমাকে না নিয়ে নরকেও যাচ্ছি নে। অন্য কিছু ভাব। রেলপুলিশে নালিশ করা ক্যানসেল।
ট্রেন চাঁপা স্টেশনে একনম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
-- আচ্ছা, আমরা যে যার অফিসে গিয়ে হাজিরি লাগিয়ে পনেরো মিনিট পরে পেট্রোল পাম্পের পাশের পিসিও তে মিট করব। তারপর পালা করে কোরবা পুলিশ, কোরবা-স্টেশন মাস্টার সবাইকে ফোন করবো। ওরা খালি কামরা থেকে বাক্স নামিয়ে নেবে। ফরেনসিক টেস্ট করবে। ফিংগারপ্রিন্ট দেখবে। আর খবরটা কাল সমস্ত স্থানীয় খবরের কাগজে বড় করে বেরোবে।
--ইয়েস্‌,ও ইয়েস্‌। কফি হয়ে যাক।
অশোকের ফুর্তি বীকন স্কুলের ফুটবল মাঠ।
সবকিছু ঠিক ঠাক উৎরে গেল। কিন্তু যখন থানা থেকে নাম জানতে চাওয়া হল তখন সবাই আগের প্ল্যনমাফিক লাইন কেটে দিল, বড় অনিচ্ছায়। খবরের কাগজে ওদের নাম ছাপা সম্ভব হবে না যে!
পরের দিন সুপ্রকাশ সক্কালে ঊঠে নবভারত, ভাস্কর, দেশবন্ধু, অমৃত সন্দেশ, অর্থাৎ নামকরা সবগুলো স্থানীয় পত্রিকা কিনে আনলো।
কিন্তু লিংক এক্সপ্রেসের কোচ নং ৬ নিয়ে বা তাতে বেওয়ারিশ কোন বাক্স পাওয়া নিয়ে কোথাও একটা লাইনও ছাপা হয়নি।



হপ্তাখানিক কেটে গেছে। লিংক একস্‌প্রেসের বাক্সরহস্যের আজও কোন সমাধান হয় নি।
সুপ্রকাশ ও তার নিত্যযাত্রী দলম্‌ এর কাছে ব্যাপারটা ক্রমশ: উৎকন্ঠা, তারপর টাইম পাস জোকস্‌ হয়ে এখন একটু ফিকে হয়ে এসেছে।
তাস শাফল করতে করতে অশোক বলে-- আচ্ছা, আমরা বাক্সটা খুলে দেখলাম না কেন?
---হ্যাঁ, হ্যাঁ, হয় চোরাই সোনার নয় চালানি মাছের কনসাইনমেন্ট নিশ্চয়ই পেয়ে যেতিস্‌। দেবাংগন ফুট কাঠে।
-- কিন্তু পুলিস কেন পাত্তা দিল না? যা দিনকাল, ওতে করে নক্সালদের গোলাবারুদ বস্তারে যাচ্ছিল কি না কে বলতে পারে?
নরেশের মন্তব্য।
--- আবে আকল কে অন্ধে! জলগড়ানো বাক্সতে গোলাবারুদ? ভাগ্যিস পুলিশ তরে জিগায় নাই!
অতুল যেন ঘুম থেকে জেগে উঠলো।--- সবই সম্ভব, যদি ঐ সব এয়ারটাইট্‌ পলিথিনের প্যাকেটে ভাল করে র‌্যাপ করা থাকে।
এহেন ফান্ডার সামনে সবাই একটু ভেবড়ে গেল।
--- কিন্তু বাক্সটা আসলে গেল কোথায়?
-- আরে দাদা! পোলিসওয়ালে কো তো আপ জানতে হো। নিঘ্‌ঘাৎ ঘুষ খেয়ে বাক্সের মালিককেই সুপুর্দ করেছে।
--- বা, মালিক পাশের কামরায় ঘাপটি মেরে ছিল। ট্রেন কোরবায় খালি হবার পর পুলিস আসার আগেই নিয়ে নেমে পড়েছে।
--বা, ওটা এখন কোরবা স্টেশনের আনক্লেইমড্‌ লাগেজঘরে এক কোণায় পরে আছে। কওনো দাবেদার নাহী।


মেয়ের শরীর সেরে উঠছে। সন্ধ্যেয় একসঙ্গে চা খাবার সময় সুপ্রকাশ এইসব অল্টারনেটিভ হাইপোথিসিস বৌকে শোনাচ্ছিল। ও বিরক্ত হয়ে বল্লো-- তোমাদের কি কোন কাজকম্মো নেই? ব্যাংকের লোকজনের মত আড্ডাবাজ আর ফালতু টাইমপাস করা পাব্লিক আর কোথাও নেই। সুপ্রকাশ একটু দমে যায়।
আবার বাক্সের কথা তুলতেই বৌ খিঁচিয়ে ওঠে। যাও ,টুলে চড়ে লফটের ওপর তোমার বাক্সোটার খোঁজ কর। দেখ, চোর বোধহয় তোমারটাই নিয়ে গেছে। বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা। 


পরের সপ্তাহে ইন্টার্নাল অডিটের কাজে সুপ্রকাশকে তিনদিন বাইরে থাকতে হবে।
ঠিক হল ফিরে আসলে রোববারে "কানন পেন্ডারী''তে পিকনিক হবে।
-- শুধু আমরা তিনজন। আর সন্ধ্যেতে ঘরে ফিরে ডিভিডিতে ‘ স্লামডগ মিলিওনেয়ার' আর "মনোরমা সিক্স ফিট আন্ডার''।
এবার দিল্লি ফিরে গেলে মামণি আবার কবে আসবে কে জানে? ভাবছি, এরপর দিনতিনেক ক্যাজুয়াল নিয়ে নেব। 

সেদিন সুপ্রকাশ সন্ধ্যেয় বাড়ি ফিরলো লাফাতে লাফাতে।
-- হুর্‌রে! ছুটি স্যাংশন হয়ে গেছে। মামণি দ্যাখ তোর জন্যে কি এনেছি? সাদা বাঘ! আরে আডিগা'র বুকার্স পাওয়া বইটা। তুই আজ রাতে পড়ে নে। তারপর কাল আমরা কানন পেন্ডারীতে সাদাবাঘ দেখতে যাবো। দু'মাস আগে রেওয়ার জঙ্গল থেকে আনা হয়েছে।
কিন্তু কারও সাড়া শব্দ নেই কেন? সবাই গেছে কোথায়? বাড়িতে কোন আলো জ্বালা হয়নি!
সারা ঘর আঁতিপাঁতি করে খুঁজলো, না:। তবে কি মামণির শরীর খারাপ হলো? মায়ের সঙ্গে আবার ডাক্তারের কাছে গেছে বোধহয়।


সিঁড়িতে পায়ের শব্দ, ছাদের থেকে বৌ নেমে আসছে মনে হয়। 

--কতক্ষণ এসেছ? চা খাবে?ঁ 

--'মামণি কোথায়? ওকে ডাক তো!
-- ও গতকাল দিল্লি ফিরে গেছে। আমিই মানা এয়ারপোর্টে গিয়ে তুলে দিয়ে এসেছি।
--- এর মানে কী? অসুস্থ মেয়েটা, শরীর পুরো সারেনি। তোমাদের কি মাথাখারাপ? 

--জল খাও, চেঁচিয়ো না। রাত হয়েছে। সব বলছি। 

-- আগে তোমাকে বলতে হবে!
-- ওর অফিস থেকে আর্জেন্ট কল এসেছিলো। এক ইম্পর্ট্যান্ট ক্লায়েন্টের সঙ্গে আজ মিটিং। পুরো ফাইলটা ও নিজে বানিয়ে ছিল, ওর ল্যাপটপে আছে। কোম্পানি চায় ডিসকাসনে ও পার্টিসিপেট করুক।
-- ফাক্‌ ইয়োর কোম্পানি! ওর কিছু হলে কোম্পানি সামলাবে?
--- খামোখা মুখ খারাপ কর না। আমি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে সব প্রিকশান জেনে নিয়ে তবে প্লেনে তুলে দিয়েছি। তুমি মন দিয়ে আমার কথা শোন । বিপদের সময় মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। রাগারাগি করে কোন লাভ নেই। ও এই জবটা আর এই কোম্পানিটা ছাড়তে চায় না। তুমি বরং এটিএম থেকে কিছু টাকা তুলে নাও, আমার লাগবে।
আমি কাল রাজধানী ধরে দিল্লি রওনা দিচ্ছি। মামণির এই সময় ভাল নার্সিং দরকার। আমি ছাড়া আর কে---? 


সুপ্রকাশ থতমত খেয়ে আমতা-আমতা করে বল্লো--- এমন একটা ব্যাপার, আমাকে একটু জানানোর প্রয়োজনও বোধ করলে না।
--- কেন করবো না! বেশ কয়েক বার চেষ্টা করলাম। তোমার মোবাইল আউট অফ কভারেজ এরিয়ায় ছিল। তুমি বোধহয় খুব ইন্টেরিয়র ব্রাঞ্চে অডিট করছিলে। তাই আর--।
পরদিন সকাল সাড়ে আটটায় ট্রেন।
ভোর পাঁচটা থেকে বাঁধাছাঁদা করে তৈরি হওয়া। এজেন্সির গাড়ি বুক করা আছে। একটা ক্যাব স্টেশনে পৌঁছে দেবে। প্রায় আটটা বাজে। গেটের সামনে গাড়ি থামার শব্দ।
---এল বোধহয়। গ্যাসটা চেক করে নাও। রুম গুলো লক্‌ হয়েছে কি না দেখে নাও।


দরজা খুলে সুপ্রকাশ একটু অবাক হল। ক্যাব তো নয়, রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে দুটো গাড়ি। একটা কালো গাড়ি, পুলিসের। তার থেকে নেমেছে জনা চারেক সেপাই, জনা দুই মেয়েপুলিশ। আর সাদা জিপ্‌সি থেকে নেমে এগিয়ে আসছেন জনা তিনেক মাঝবয়েসি ভদ্রপুরুষ, কেতাদুরস্ত পোশাক।
চশমা পরা মাঝবয়েসি বল্লেন-- ভেতরে আসতে পারি কি?
উত্তরের অপেক্ষা না করেই ওরা তিনজন ভেতরে ঢুকে পড়লেন। মেয়ে পুলিসরা দরজায় দাঁড়িয়ে ইতিউতি চাইতে লাগলো আর কনস্টেবলরা বারান্দায় নির্বিকার ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে রইলো। 

সুপ্রকাশের গলায় স্বাভাবিক "আপনারা?'' প্রশ্নটা গলার থেকে ঠোঁটে এসে আটকে রইলো। তাই দেখে দয়াপরবশ হয়ে টাকমাথা ভদ্রলোক বললেন--- আমি শ্রীবাস্তব, ইন্স্‌পেক্টর ক্রাইম ব্রাঞ্চ, ইনি শিরপুরকর, ডিএসপি, কোরবা। 

চশমাপরা ভদ্রলোকের পরিচয় কেউ দিলেন না।
সুপ্রকাশ কিছু জিগ্যেস করার আগেই চশমাধারী বাকিদের বল্লেন---- ঠিক খবরই পেয়েছিলাম। একটু দেরি করলেই "চিড়িয়া ভাগলবা'' হয়েছিল।
কথাটার মধ্যে নিহিত অভব্য ইঙ্গিতে ওর ব্রহ্মতালু জ্বলে যায়।
--- আপনারা কি সব বলছেন? ব্যাপারটা কী?
--- সব জানতে পারবেন, ধীরে বন্ধু ধীরে।
-- আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে, পাঁচমিনিটের মধ্যে না বেরুলে রাজধানী মিস্‌ করব।
--- তাড়া কিসের? দরকার হলে আমার গাড়িতে পৌঁছে দেব। জলদ্‌বাজি শয়তান কা কাম হ্যায়, মিস্টার রায়। অউর আপতো জেন্টেলম্যান হ্যায়।


আর রাগ লুকনো গেলো না।
--- হেঁয়ালি ছাড়ুন, ঝেড়ে কাসুন তো!
টাকমাথা এগিয়ে আসেন।-- বেশ, আপনার যখন এতই তাড়া। আপনারা যাচ্ছেন কোথায়?
--- বল্লাম তো, দিল্লিতে। আর "আপনারা'' নয়, শুধু "উনি''।
-- বটেই তো, বটেই তো, আমারই ভুল । শুধু উনি। তা উনি আজ দিল্লি যাচ্ছেন কেন?
--- কী জ্বালাতন! দিল্লিতে আমার একমাত্র মেয়ে অসুস্থ, তাই মা' যাচ্ছে নার্সিং করতে। তাতে আপনাদের কিসের মাথাব্যথা?
-- আহাহা, রাগেন কেন মি: রায়? বেশ, তা ওনার দিল্লি যাওয়ার টিকিটটা দেখেছেন কি?
বিমূঢ় সুপ্রকাশ আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে।
--জানতাম, দেখেননি। আপনি যে ভদ্রলোক। তা এবার দেখেই ফেলুন।
ও বৌয়ের দিকে তাকাতেই পার্সের থেকে টিকিট বিনা বাক্যব্যয়ে সুপ্রকাশের হাতে তুলে দেয়।
ও নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। টিকিটে লেখা বিলাসপুর থেকে ভোপাল।
--মিসেস রায়, কিছু বলবেন?
--- ভোপাল আমার বাপের বাড়ি। একদিন বাবামাকে দেখে পরের দিন শতাব্দীতে দিল্লি যাবো, মেয়ের কাছে-- এতে অবাক হওয়ার কি আছে?
--না না, কিচ্ছু না। তা মেয়ে আপনার দিল্লিতে কি করছে? মানে আজকে কি করছে?
এবার সুপ্রকাশ এগিয়ে আসে।
অহংকারী গলায় বলে,--- অফিসার,ও একটি নামকরা সিএ ফার্মে কাজ করে।
--- একদম ঠিক বলেছেন। এবার আমার হাতের এই কাগজটা দেখুন তো। এই ফ্যাক্সটি মাত্র একঘন্টা আগে এসেছে। ঐ ফার্মের এইচ আর থেকে। ওরা বলছে মিস্‌ রায় একমাস ধরে সিক লিভ্‌ নিয়ে আছেন। এখনও কোন ডিউটি জয়েন করেন নি। আর অফিস ওকে একমাস ধরে কোন কনট্যাক্ট করছে না।
সুপ্রকাশের মাথাটা হটাৎ ঘুরে ওঠে। অপেক্ষাকৃত কমবয়েসি অফিসারটি লাফিয়ে এসে ওকে ধরে সোফায় আধশোয়া করে বসান। ইশারায় সিপাহীকে জল আনতে বলেন। একজন মেয়ে পুলিস রান্নাঘরের দিকে দৌড়ে গিয়ে একগ্লাস জল নিয়ে আসে।
জল খেয়ে ও বলে--- আমি যে কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।
-- পারবেন, পারবেন। এখানে নয়, আমাদের সদর কোতয়ালি থানায় গিয়ে। আপনাদের দুজনকেই একটু আসতে হবে যে!
-- আমি কী করেছি?
চশমাওলা বলে-- কিস্যু করেন নি। সেটাই আপনার অপরাধ। সময় থাকতে কিছু করার ছিল।
-- আর ও?
-- মিসেস রায়কে আমরা এখনও ফর্মালি গ্রেফতার করিনি। থানায় কথাবার্তা বলার পর দেখা যাবে। সেক্ষেত্রে উনি কাল বেলা এগারটার পরে ওনার উকিলের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারবেন।
--অপরাধ?
----অপরাধ গুরুতর। হত্যার ষড়যন্ত্র, সাক্ষ্যলোপাট করা, এভিডেন্সের সাথে ছেড়ছাড় করা --আপাতত: এই।
সুপ্রকাশ কষ্ট করে বৌয়ের দিকে তাকায়। ওর চোখের মণি দেখতে পায় না। চেহারায় এক কাঠিন্য। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বলে-রজ্জুভাইয়াকে খবর দাও। আর বিজয়কে। জামিনের জন্যে চেষ্টা করতে বল।
টাকমাথা হাসেন।
--উঁহু, আপনার নাগরিক অধিকার- হেবিয়াস কর্পাসের রিট-- সব আগামী চব্বিশ ঘন্টার জন্যে মূলতুবী থাকবে। আগে আমরা ভাল করে জিগ্যেস-টিগ্যেস করে নি, তারপর কাল আপনার উকিল রজ্জুভাইয়া বা রাজীব বর্মার সঙ্গে কথা বলতে পারবেন।



বিলাসপুর সদর থানা দোতলা, একতলায় পাশের একটা উইংয়ে মহিলাথানা। জিপসি ও কালো ডগ্গা ওদিকের প্রাঙ্গণেই পার্ক করলো। বেলা এগারটা। 

মহিলা থানা ইন্‌চার্জ দয়া পান্ডে আজ বেশ ফর্মে আছেন। ওনার টেবিলের সামনে এক মোটামত মহিলাকে দুপাশ থেকে ধরে রেখেছে দুই মহিলা পুলিশ। আর তার মুখ থেকে ঝরে পড়ছে অশ্রাব্য গালাগাল। সুশ্রী একহারা চেহারার দয়া পান্ডের বয়েস চল্লিশ ছোঁয়- ছোঁয়। কিন্তু এই মুহুর্তে উনি চেয়ারে বসে তীব্র দৃষ্টিতে দেখছেন ঐ স্থুলাঙ্গী কালোকোলো তেলকুচকুচে প্রৌঢ়ার গালাগালির বহর। যেন কোন মনোযোগী ছাত্র বোর্ডের ওপর কষা কোন ইকোয়েশন বোঝার চেষ্টা করছে।
হঠাৎ তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে উনি তারসপ্তকে গলা ছাড়লেন---আবে মালতী, নালায়েক! ই মোটল্লি ক্যা তোর দাঈ লাগতী হ্যায়? ইয়ে ক্যা শরাফতসে বাজ আয়েগী? ডাল দে, ডাল দে ডান্ডা হারামজাদী কী চুতর্‌ মেঁ!
আর মুখের কথা না খসতেই ঘরের কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়ে পুলিস পেছন থেকে মারলো ওর পাছায় বাড়ি!
মোটা মহিলা আগে থেকে টের পায়নি। ওর চিলচিৎকারে ঘরের ছাদ ফেটে গেল।
--- ইয়ে সব ক্যা হো রহা হ্যায়?
এবার ম্যাডাম পান্ডের নজর ফিরলো সদ্য ঘরে ঢোকা আগন্তুক দলটির দিকে।
চশমা পরা প্রৌঢ়ের দিকে চোখ পড়তেই পান্ডে সোজা দাঁড়িয়ে স্যালুট মারলেন।
--- স্যার, আপ কব সে? পহলে কোই খবর নহী আয়া?
এঁরা পান্ডেকে সসম্মানে রিজার্ভ বেঞ্চে বসিয়ে দিয়ে ওর টেবল দখল করলেন। গোটা কয়েক চেয়ারও এসে গেল। সুপ্রকাশ জানতে পারলো চশমা পরা ভদ্রলোক শহরের নতুন সি এস পি ,দীনেশ পরিহার। অর্থাৎ, সিটি সুপারিন্টেন্ডেন্ট অফ পুলিস।
দয়া শর্মা এগিয়ে এসে বৌকে কুরিয়ে কুরিয়ে দেখলো। তারপর বল্লো-- এহি হ্যায় ও হত্যারিন? স্যার, ইসকো মেরে পাস ছোড় দিজিয়ে। ইসসে কবুলানা ? ইঁয়ু, এক চুটকি সে।
সুপ্রকাশ কেঁপে উঠলো। তবে কি ওরা বৌকে থার্ড ডিগ্রি দেবে? পুলিসকে বিশ্বেস নেই।
পরিহার যেন থট রীডিং জানেন--- না না, মি: রায়, অযথা ভয় পাবেন না। আমরা শুধু ওনাকে কিছু কথা জিগ্যেস করবো, আপনার সামনে। উত্তর দেয়া না দেয়া ওনার ইচ্ছে। আমরা সবই জানি। শুধু ওনার সহযোগিতা পেলে লিংক গুলো জুড়তে সুবিধে হবে। আমাদেরও দিনদুইয়ের অতিরিক্ত পরিশ্রম বাঁচবে। ফলে আমরা ভারতীয় দন্ডবিধির ধারা ৩০২, ৩০৪ এর জায়গায় অনেক নরম ধারা লাগাব। এই আর কি?
ইতিমধ্যে আগের মোটা মহিলাকে থানার মহিলা লক আপে পুরে দেয়া হয়ে গেছে। টাকমাথা অফিসারের চোখের ইশারায় দয়া পান্ডে অন্য কামরায় চলে গেছেন।
টাকমাথা বল্লেন--স্যার, এবার আমরা শুরু করতে পারি।
ইতিমধ্যে সবার জন্যে ছোট কাপে দোকানের চা এসে গেছে। সুপ্রকাশ এক ঢোঁক খেয়ে নামিয়ে রাখল। ওর বৌ চা ছুঁল না। সুপ্রকাশ দেখলো ওর মুখের চেহারা যেন আস্তে আস্তে ত্রি-মাত্রিক জ্যামিতির ছবি হয়ে যাচ্ছে।
চশমাওলা এবার গলা খাঁকরে বল্লেন-- মিসেস রায়, আপনার কতখানি কো অপারেশন আশা করতে পারি?
বৌ চুপ। সুপ্রকাশ উসখুস করে।
--- মিসেস রায়, বলুন, হমলোগ ইন্তেজার মেঁ।
--- আমি আমার পারিবারিক অ্যাডভোকেট রাজীব বর্মার প্রেজেন্স ছড়া কোন স্টেটমেন্ট দেব না।
সবাই চুপ। একটা ফোন বেজে ওঠে টাকমাথা উঠে যান। ফোন ধরে শ্রীবাস্তবকে নিয়ে ঘরের কোণায় গিয়ে কিসব গুজগুজ করেন। তারপর ফিরে এসে পরিহারের দিকে তাকিয়ে প্রায় অলক্ষ্যে আস্তে করে মাথা নাড়েন।
এবার পরিহার সুপ্রকাশের দিকে তাকিয়ে বল্লেন- মি: রায়, আপনি একজন ল-অ্যাবাইডিং সিটিজেন। আপনি চাইলে আমাদের অনেক হেল্প করতে পারেন।
--- বলুন, আমাকে কি করতে হবে?
-- কিছু না, শুধু যা যা প্রশ্ন করবো তার ঠিক ঠিক উত্তর দেবেন, নিজে যতটুকু জানেন।
এবার টাকমাথা একজন সেপাইকে বল্লেন--- লে আও।
সেপাই মালখানা থেকে হাজির করলো একটি বড়সড় প্যাকিং বাক্স। বেরুলো পলিথিনের র‌্যাপার দিয়ে মোড়া এক প্যাকেট-তার গায়ে একটা কার্ড লাগিয়ে এগজিবিট নম্বর লেখা।
--- দেখুন, রায়বাবু, ভাল করে দেখুন।

ইতিমধ্যে কনস্টেবলের গ্লাভস পরা হাত দক্ষতার সঙ্গে প্যাকেট থেকে বের করেছে একটি তোরঙ্গ।
হ্যাঁ, সুপ্রকাশ চেনে বৈকি! এত সেই লিংক একসপ্রেসের কোচ নং ৬ এর বেঞ্চের নীচে রাখা রঙ করা বাক্সটি, যার কোণায় আঁকা ফুল।
---না মি: রায়, আপনি ঠিকই বলেছেন, কিন্তু এই বাক্সটি আপনি আরও আগে দেখেছেন। আপনাদের বাড়ির লফটে রাখা ছিল।
তবে রঙটা নতুন করা হয়েছে। অনেক ভেবে, এবং মিসেস রায়ের নিজের হাতে।
কি, ঠিক বল্লাম তো?

সুপ্রকাশ স্ত্রীর দিকে তাকায়। মহিলাকে কেমন অচেনা লাগছে। এর সঙ্গেই প্রায় তিরিশ বছর ঘর করেছে? নাকি সে ছিল অন্য কেউ?
মহিলাটি জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছেন বাইরে--- সেখানে দুটো জীপ, বাজেয়াপ্ত করা দুটো ট্রাক, কিছু মোটরবাইক। গাছের তলায় ক'জন দেহাতি মানুষের জটলা। দুটো গরু কখন মনের আনন্দে ঢুকে পড়ে প্রাঙ্গণের টুকরোটাকরা সবুজকে চেটেপুটে নিচ্ছে।
ও কি এইসবই দেখছে মন দিয়ে? এইসব নিত্যনৈমিত্তিক তুচ্ছ জিনিস?
আসলে ও বোধহয় কিছুই দেখছে না।
বেলা সাড়ে দশটা, কিন্তু সুপ্রকাশের কেমন শীত-শীত করতে লাগলো।
ইতিমধ্যে পাশের বিল্ডিংয়ের অর্থাৎ, মূল সদরথানা থেকে একজন ওয়ান- স্টার সেপাই এসে একটা ফ্যাক্স টাকমাথা অফিসারের হাতে ধরিয়ে দিল। উনি চোখ বুলিয়েই এগিয়ে দিলেন সি এস পি পরিহারের দিকে। এরপর তিনজনের চোখে চোখে কিছু কথা হল।
পরিহার চেয়ার ঘুরিয়ে মুখোমুখি হলেন মিসেস রায়ের দিকে। ওনার চোখ চক্‌চক্‌ করছে। উত্তেজনা লুকোতে গিয়ে গলার স্বর এক পর্দা চড়ানো।
--- মিসেস রায়, আপনার সহায়তা হয়তো আর আমাদের খুব একটা দরকার হবে না।
এই সমস্যার চাবিকাঠি প্রায় আমাদের হাতের মুঠোয়।
এরপর শুধু বলতে হবে "খুল যা সিম্‌ সিম্‌''।
তবে একটা কথা বলি-- আপনার ভোপালের টিকেটটা খামোকা নষ্ট হল। আপনার মেয়ে আর ভোপালে নেই। মামাবাড়ি থেকে ও শেলটার বদলেছে গত পরশুই। ছিল এক বন্ধুর বাড়িতে। আধঘন্টা আগে আমাদের লোক ভোপাল পুলিশের হেল্প নিয়ে সেখানে রেইড্‌ করে।
মাত্র একঘন্টা আগে ঐ বাড়ি থেকে দুটো গাড়ি বেরিয়েছে। একটা গেছে জবলপুরের দিকে , আর একটা নাগপুর। এরই কোন একটায় আপনার কন্যারত্নটি সওয়ার হয়েছে।
তবে কি জানেন? কোথায় যাবে? ওর সম্ভাব্য শেল্টারগুলোর লিস্ট আমরা বানিয়ে ফেলেছি। সব জায়গায় লোক লাগানো হয়েছে। জাল ছড়ানো হয়েছে। এখন শুধু খেলিয়ে গুটিয়ে তোলা । ওর ধরা পরা এখন শুধু ম্যাটার অব ডেজ্‌, ইফ নট আওয়ার্স।
এবার সুপ্রকাশের চেঁচানোর পালা।
-- আপনারা এসব কি শুরু করেছেন? কেন আমার পরিবারের পেছনে লেগেছেন? প্রথমে আমার স্ত্রী, তারপর আমার মেয়ে? আমি আপনাদের কাছে হাতজোড় করছি, ও বাচ্চা, অত্যন্ত অসুস্থ। এ'কদিন আমার ঘরেই ছিলো। আপনারা গাইনির সার্টিফিকেট দেখতে পারেন।
প্লীজ ওকে রেহাই দিন।
-- কি করে রেহাই দেব মি: রায়? আরে, ওই তো বাক্সরহস্যের মিসিং লিংক।
--- কি যা তা বলছেন? কেন আমাকে নিয়ে ইঁদুর-বেড়াল খেলছেন। কেন বলছেন না ও কী করেছে? আমি জানি আমার মামণি কোন বেআইনি কাজ করতে পারে না। আমি ওকে ভালো করে জানি।
এবার মুখ খুলেছেন শ্রীবস্তব।
--- আপনি কিছুই জানেন না মি: রায়। নিজের স্ত্রীকেও না, নিজের মেয়েকেও না। গাইনির রিপোর্ট দেখাচ্ছিলেন? নিজে একবারও দেখেছেন সেটা?
-- না, দেখিনি, তবে আমার স্ত্রী---।
--- কেন দেখেন নি? কেমন বাবা আপনি?
প্রায় গর্জে উঠেছেন পরিহার।
--- সময় পান নি? অফিস নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলেন?
হঠাৎ যেন লজ্জা পেয়ে গলা নামিয়ে বললেন।
-- সরি! আমরা সবাই তাই।
আফিস-চাকর--প্রমোশন- গসিপ- ভোট-বাজারদর এইসব নিয়ে ব্যস্ত থাকি। খেয়াল রাখি না আমার ঘরের লোকজন কি করছে, কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে।
যদি আপনি নিজে গাইনির সঙ্গে দেখা করতেন বা মন দিয়ে ওর মেডিক্যাল রিপোর্ট পড়তেন তাহলে জানতে পারতেন আপনার মামণিটি এবার অ্যাডভান্‌স্‌ড্‌ প্রেগনান্সি নিয়ে আপনার বাড়িতে এসেছিল।
কয়েক সপ্তাহ আগে সে আপনার স্ত্রীর বান্ধবীর চেনা নার্সিং হোমে একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দেয়।
ঠিক দু'দিন পরে কোরবাগামী লিংক একস্‌প্রেসের কোচ নং ৬ য়ের মধ্যে একটি বার্থের নীচে রাকা বাক্সে ঐ শিশুটির নিষ্প্রাণ বডি পাওয়া যায়। পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট থেকে মনে হচ্ছে বাচ্চাটাকে সম্ভবত: বালিশ দিয়ে চেপে ধরা হয়েছিলো।

আর বাক্সটি আপনার লফট থেকে নামানো। সদ্য সদ্য রঙ করা।
এর পর বাকি শুধু মেয়েকে এনে মার সামনে দাঁড় করানো। তারপর দেখি মিসেস রায় কি বলেন!
ওর গালের চামড়ায় কি একটু কাঁপন দেখা গেল?
সুপ্রকাশ মেসমেরাইজড্‌ হয়ে নিজের বৌকে দেখতে লাগলো।
সেই চেনা চির পরিচিত বড় প্রিয় মুখ, মুখের ডোল, রোমন নাক, দৃঢ় চিবুক। মুখটা পাশ ফেরানো। কলেজে পড়ার সময় একবার মিস ক্যাম্পাস, সেকন্ড রানার্স আপ হয়েছিল।
আহা! এবার একটু পাশ ফিরুক, ফিরে তাকাক। বৌ পাশ ফিরছে।
কিন্তু কোথায় বৌ? এ কে? এ যেন র‌্যামসে ব্রাদার্স এর হরর ফিল্ম! একটা চোখ বন্ধ, আর একটা চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসা, তাত্থেকে রক্ত ঝরছে।
সুপ্রকাশ চোখ বুঁজলো।




না:, আবার সব স্পষ্ট হয়ে গেছে। সব ঠিক ঠাক ফোকাস হচ্ছে। সদর কোতয়ালির লাগোয়া মহিলা থানার একটি কামরা। তিন প্রৌঢ় অফিসার। তাঁতের শাড়িপরা ওর বৌ। দেয়ালে টিকটিকি। ঘড়ির টিকটক, টিকটক। সব।
হ্যাঁ, পরিহার কিছু বলছিলেন। বলছিলেন--- একটা কথা বুঝতে পারছি না। সকাল আটটা থেকে মিসেস রায় আমাদের কাস্টডিতে। ওনার মোবাইল ব্যবহারের কোন সুযোগ নেই। তাহলে ভোপালে ওর শেল্টার রেড্‌ হওয়ার সামান্য আগে ও কেন বাড়ি ছাড়লো?
-- কে ওকে এই খবরটা দিল, মিসেস রায়? হতে পারে আপনার এমন কোন বন্ধু যে আপনার পাড়াতেই থাকে, সকালে পুলিশের কালো গাড়ি দেখে আপনার মেয়েকে মোবাইলে খবর পাঠিয়ে দিয়েছে।
--- একটু কঠিন স্যার। মেয়েটি ওর পুরনো মোবাইল ব্যবহার করছে না। সম্ভবত: কোন বন্ধুর মোবাইল ইউজ করছে। সেক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে মিসেস রায়ের ওয়েলউইশার ওনার মেয়ের নতুন নম্বরটা জানে। এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে।
--- আরেকটা সম্ভাবনা আছে স্যার। মিসেস রায় মেয়েকে বিলাসপুর থেকে হাপিস করার আগে নিজেদের মধ্যে প্ল্যান এ, প্ল্যান বি, তৈরি করে রেখেছেন। ধরুন যে শেলটারগুলোর খবর আমরা পেয়েছি তাতে প্রায়োরিটির অর্ডারে এ, বি, সি ট্যাগিং করা আছে। আর মনিটরিং এর জন্যে নিজেদের মধ্যে কোন কোড করা আছে। ধরুন, রোজ সকাল আটটায় মা মেয়েকে নির্দিষ্ট নাম্বারে ফোন করে। আজ সেই ফোন যায় নি। মানেই রেড অ্যালার্ট! শেলটার পাল্টাও।
-- ভেরি ইন্টারেস্টিং পসিবিলিটি শ্রীবাস্তব। আই মাস্ট অ্যাড্‌মিট।
-- থ্যাংক য়ু স্যার!
---- একটা থার্ড পসিবিলিটি ও আছে, অফিসার। সেটা ভেবে দেখেছেন কি?
-- ইয়েস্‌ মিসেস রায়! বলুন, বলুন।
-- সেটা হল আপনাদের কোন একটা শহরে রেইড করা আর সেখান থেকে কারও মেয়ের অল্প আগে বেরিয়ে যওয়ার মধ্যে কোন কার্যকারণ সম্পর্ক নেই। নেহাৎই কাকতালীয় ব্যাপার।
সুপ্রকাশ অবাক হয়ে দেখল বৌয়ের মুখে একচিলতে হাসি।
পরিহারের মুখে কি একটা ছায়া খেলে গেল?
--- থ্যাংকু মিসেস রায়। এই তো কোঅপারেশন শুরু করেছেন। ব্যস, আর কটা প্রশ্নের উত্তর দিন।
এক, লিংক একসপ্রেসের কোচ নম্বর ৬কেই বাক্স রাখার জন্যে কেন বেছে নিলেন?
দুই, মি: রায়কে আপনি যাই বলুন, মেয়েকে তো প্লেনে দিল্লি পাঠান নি। প্রথমে কোথায় পাঠালেন?
তিন, আপনার বন্ধু ঐ ক্রিশ্চান সিস্টারকে গোপন রেখে ডেলিভারি করার ব্যবস্থার জন্যে কত টাকা দিয়েছেন?
চার, আপনার মেয়ের এই অবস্থার জন্যে দায়ী যে ছেলেটি তার নাম-ঠিকানা? 


-- বল্লাম তো, আমি আমার উকিলের প্রেজেন্স ছাড়া কোন স্টেটমেন্ট দেব না।
--মিসেস রায় , আপনার মেয়ে সামনে এসে দাঁড়ালেও কি আপনি একই কথা বলবেন? ভেবে দেখুন। আমাদের হাতে আরও অপ্‌শন আছে যে!
মার্ডার কেস, ফলে আপনারা কেউই কেস ডায়েরি জমা না হওয়া পর্যন্ত জামানত পাবেন না। আর আমি সে চেষ্টাও করব না। তে'রাত্তির আপনার মামণি জেল কাস্টডিতে থাকবে। আর আমরা সে ব্যাপারে কোর্ট অর্ডারের জেরক্স কপি ওর চাকরির জায়গায় পাঠিয়ে দেব। ফলে ও প্রথমে সাসপেন্ড হবে, তারপরে চাকরিটি খোয়াবে। তারপর ?
--- তারপর আমরা আদালতে প্রমাণ করবো যে আপনাদের যা অ্যালিগেশন তা একটি মনগড়া থিওরি মাত্র। আর এসব আপনি আউট অফ ম্যালিস করেছেন। ফলে চাকরি ও ক্ষতিপূর্তি দুইই আদালতের আদেশে ফেরৎ পাওয়া যাবে। 


--সো শিওর! আপনি পুলিসকে কতটুকু জানেন?
হটাৎ ঘরের তাপমান বেড়ে গেছে। সবার চেহারাতে তার আঁচ লেগেছে।
-- না পুলিসকে বেশি জানিনা। জানবার ইচ্ছেও নেই। কিন্তু আইনের ব্যাপারটা একটু একটু জানি। বিয়ের আগে ল' গ্র্যাজুয়েট হয়ে কোর্টে ক্লার্কের জব করেছিলাম।
আপনারা কেসের কিনারা না করতে পারলে নিজেদের অসফলতাকে ঢাকতে হরদম মূর্গা খোঁজেন। এটিও তার একটি। কী নিয়ে কোর্টে দাঁড়াবেন?
ঐ একটা নেহাৎ গাঁজাখুরি গল্প নিয়ে? যার আদ্দেকটা কিছু কাকতালীয় ঘটনা আর বাকিটা সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স?
আমার অ্যাড্‌ভোকেট রাজীব বর্মা আপনাদের ঐ থিওরিকে ফালাফালা করে কাটবে।
যেমন, ঐ রকম সবুজরঙা তিনটে বাক্স কোর্টে আমার স্বামীকে দেখানো হবে। আর সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে উনি বলবেন, মানে বলতে বাধ্য হবেন যে সবগুলিই প্রায় একই রকম দেখতে। এর যে কোন একটাই সেই বাক্স হতে পারে।
আর মেয়ের মেডিক্যাল রিপোর্ট?
সেটা আপনিও ভাল করে পড়েন নি অফিসার। কারণ আপনি প্রেজুডিসড্‌।
আমার মেয়ের অপারেশন হয়েছিল ডি এন সি। ও ভুগছিলো অনিয়মিত মাসিক স্রাবের কষ্টে। ডিসমেনোরিয়া ও মেনোরজৈয়া--- দুটোই।
যদি কোন ট্রেনে কোন একদিন কোন একটি কামরায় একটি বাক্সে একটি শিশুর শব পাওয়া গিয়ে থাকে তার সঙ্গে আমাদের মা-মেয়ের কি সম্পর্ক?
আপনারা শিক্ষিত ভদ্রলোক। কিন্তু বোধহয় মেয়ের বাবা ন'ন। তাহলে বুঝতেন। মেয়েদের সম্মান নিয়ে এত সহজে খেলা করতেন না।
এত কথা বলে বৌ হাঁফাতে থাকে। একটু যেন গলাটা ধরা। 

সুপ্রকাশ বলে--একটু জল খাবে কি?
ও মাথা নাড়ে। মেয়ে পুলিস গ্লাস এগিয়ে দেয়। চোঁ-চোঁ করে সবটা শেষ করে ও শিরপুরকরকে জিগ্যেস করে লেডিজ টয়লেট কোন দিকে?
দুজন মহিলা পুলিস ওকে ধরে নিয়ে যায়।



সিএসপি পরিহার খানিকক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন। তারপর সুপ্রকাশের দিকে ফিরলেন।
-- মি: রায়, আমি মিসেস রায়কে বুঝতে পারছি। কারণ আমিও মেয়ের বাবা। একটিই মেয়ে ছিল।
-- ছিল মানে? কি হয়েছিলো ওর?
--- না, বেঁচে আছে, কিন্তু আমাদের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। আমার চোখে ও ডেড্‌।
জানলার কাঁচে একটা বোলতা বারবার আছড়ে পড়ছে।
পরিহার যেন অন্য কারও গল্প বলছেন।
আমার মেয়েকে যত্ন করে প্রাইম ইনি্‌স্‌টউটে পড়িয়েছিলাম। চোখের মণির মত আগলে রাখতাম।
দিল্লিতে জে এন উ তে মাস্টার্স করছিলো। সেটাই কাল হল। ওখানের পরিবেশ আমাদের দেশের হিসেবে টূ লিবারেল। যখন ওর বিয়ের কথাবার্তা চলছে তখন হটাৎ মেয়ে ফোন করে ওর মাকে জানাল যে ওর এক সহপাঠির সঙ্গে রেজিস্ট্রি করে ফেলেছে। এখন বাবা-মায়ের আশীর্বাদ চায়। আমার অনুমতি পেলে জোড়ে আসবে বিলাসপুরের বাড়িতে।
সে অনুমতি আমি দিতে পারিনি। ছেলেটি মুসলমান। আমরা আলোয়ারের খানদানী রাজপুত। আমার কাছে বংশমর্য্যাদা সবচেয়ে বড়।
আপনার স্ত্রী যা করেছেন তা হল কিলিং ফর অনার। ওনার ভাবনাকে বোধহয় আমি আপনার চাইতেও ভাল বুঝতে পারছি। কিন্তু মেয়ের সম্মান বাঁচাতে একটি নিষ্পাপ শিশুর প্রাণ নেয়া? না, মানতে পারছি না।
আজ ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ভ্যালেন্টাইন ডে। কয় শতাব্দী আগে ভালোবাসার অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করতে উনি প্রাণ দিলেন, শহীদ হয়ে সন্তের সম্মান পেলেন। কিন্তু কখনও কি ভেবে দেখেছেন রায়, যে এতে শুধু প্রেমিক-প্রেমিকা নয় অন্যেরাও মরে। কেন মরবে?
এখানে ওই শিশুটি কি অপরাধ করেছিল? 


ইতিমধ্যে বৌ ফিরে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। বলল-- আপনি কি আইপিএস হওয়ার আগে কলেজে লেকচারার ছিলেন?
পরিহার জবাব দিলেন না। বল্লেন--বসুন, মিসেস রায়। আমি আর বেশিক্ষণ আপনার সময় নেব না। খালি এইটুকু বলবো---পুলিশের বুদ্ধির ওপর আরও একটু ভরসা করলে ভাল করতেন।
মি: রায়, আপনার স্ত্রী যাই বলুন আমরা এতটা কাঁচা নই। আটঘাট না বেঁধে আপনার বাড়ি যাইনি। হাতে তুরুপের টেক্কা না থাকলে কি এভাবে খেলি? মিসেস রায় আমাকে শো' করতে বাধ্য করলেন যে!
--- লে আও।
পাশের মূল কোতয়ালির লক্‌ আপ থেকে দু'জন সিপাহী হাতকড়া পরানো যে লোকটাকে নিয়ে হলের মাঝখানে দাঁড় করালো তাকে দেখে বৌ চমকে উঠলো। পায়জামা আর ময়লা শার্ট পরা বছর তিরিশের লোকটার গালে সাতদিনের না-কামানো দাড়ি, উস্কোখুস্কো চুল। ভ্যাবাচাকা খেয়ে সে হাতকড়াবাঁধা হাত তুলেই চারদিকে সবাইকে একবার নমস্তে করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।
-- কি, একে চিনতে পারছেন? মি: রায়, আপনি একে চিনবেন না। কিন্তু আপনার স্ত্রী একে ভাল করে চেনেন। আসলে সমস্ত রহস্যের চাবিকাঠি হল এই লোকটি, আপনার মেয়ে নয়। মেয়েটি তো ভিকটিম। ভালবাসায় প্রতারিত হয়েছে, পেটের সন্তানকে মারতে চায়নি, জন্ম দিয়েছে। সারা দুনিয়া থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
কিন্তু মিসেস রায় এতটা রোমান্টিক ন'ন। তিনি আপনার রোজকার ডেইলি প্যাসেঞ্জারির খাট্টা-মিঠা গল্প শুনে জেনেছিলেন যে লিংক একসপ্রেসের কোচ নং-৬ হল বিলাসপুর কোটা। ফলে অধিকাংশ লংজার্নি করা যাত্রী বিলাসপুরে নেমে যায়। এর পর কোন রিজার্ভেশন নেই। ওঠে শুধু ক'জন আপনাদের মত শর্ট ডিস্ট্যান্সের কম্যুটার। ফলে অনায়াসে কোন লাগেজ রেখে নেমে যাওয়া যায়।
এই লোকটি হল ওনার বান্ধবী সিস্টার ফিলোমেনার মালী-কাম-সার্ভেন্ট সম্পতলাল সাহু। কুলির বদলে ওই মাথায় করে বাক্সটি নিয়ে ৬নং কোচে রেখে আসে।
এখন সিস্টার ফিলোমেনা মাঝেমাঝেই গাঁয়ের দিকের মেয়েদের কিছু অবৈধ গর্ভপাত করান। তাতেই ওনার বাড়ি-গাড়ি। আমরা খবর রাখি, কিন্তু এগুলোতে খুব কিছু করতে পারিনে। সাহু কেস আনার ব্যাপারে টাউটের কাজ করে। সব জানে।
কিন্তু এবার গড়বড় হয়ে গেল। আপনার মামণি অ্যাবরশন করাতে রাজি হল না। অ্যাডভানস্‌ড স্টেজ, লাইফ রিস্ক, তাই মা মেয়ের কথায় সায় দিল।
সাহু রং কিনে আনল, মাথায় করে বাক্স বয়ে কামরায় সীটের নীচে রেখে এলো। কিন্তু টাকার লোভ মাথা চাড়া দিয়েছে, ও জমি কিনতে চায়। শহরের বাইরে রাস্তার ওপর দো-ফসলী জমি। অনেক টাকা দরকার। কাজেই ভাগের কমিশন ছাড়া বোনাস। তাও পেল সিস্টারের কাছে। লোভ বাড়ল, সাহস বাড়ল।
আপনার বাড়ি গিয়ে মিসেস রায়কে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করল। উনি হাঁকিয়ে দিলেন। বান্ধবী সিস্টারের কাছে কমপ্লেন করলেন। সিস্টার সাহুকে তাড়িয়ে দিলেন, কিছু টাকা দিয়ে বল্লেন-- গাঁয়ে গিয়ে চাষবাস কর, আর এ'মুখো হয়ো না।
সাহু গাঁয়ে ফিরবে কেন? ও ভাবলো-হম ডুবেঙ্গে তো তুমকো ভী লে ডুবেঙ্গে সনম্‌।
এরপরের ঘটনা অনুমান করতেই পারছেন। কীরে সাহু, ঠিক বলছি তো?
সাহুর মাথা সামনে ঝুঁকে পড়ে।
আসলে কি জানেন মি: রায়, পুলিসের কাছে কোন জাদুদন্ড নেই। আমাদের সম্বল কিছু সিস্টেম্যাটিক ইন্‌ভেস্টিগেশন। তারও লিমিট আছে। ফলে অনেক ফাইল আনসলভড্‌ থেকে যায়। অনেক ক্ষেত্রেই ভেতর থেকে খবর পেয়ে তবে পুলিস সফল হয়। শার্লক হোমস্‌ বা পোয়ারোর দল বইয়ের পাতাতেই বেঁচে থাকেন। যত নামকরা সাংবাদিকের স্কূপ পড়েন সব জানবেন ভেতর থেকে লিক করা। ওদের সম্বল শুধু ভালো কনট্যাক্‌ট্‌স্‌।
কোরবা পুলিস কিছু অজ্ঞাতপরিচয় যাত্রীদের ফোন থেকে সন্দেহজনক বাক্স পড়ে থাকার খবরটা পায়।
সুপ্রকাশ বিষম খেল।



ট্রেনে তখন কোন টিটি ছিল না। ওরা চাঁপাতেই নেমে গেছল। ফলে বাক্সটা উদ্ধার করতে সময় লেগে যায়। তারপর তালা ভেঙ্গে দেখে এই কান্ড। কিন্তু বাসের ডালায় ছিল বক্সমেকার বিলাসপুরের তালাপাড়ার হাবিবুরের নাম। সত্যিই অমনি বাক্স গন্ডায় গন্ডায় পাওয়া যায়। তবে পুলিস বোঝে ঘটনার জড় বিলাসপুরেই। খোঁজ চলতে থাকে বাক্সবিক্রেতার দোকানে, প্রাইভেট নার্সিং হোমে,-- কিন্তু কোন সূত্র পাওয়া যায়নি।
এমনসময় এলো ফোন। সম্পতলাল সাহুর। ও নিজের নাম আড়াল করে শুধু বদলা নিতে চেয়েছিল। কিন্তু গেঁয়ো মানুষ। মোবাইলটা ছিল ফিলোমেনা সিস্টারের দেয়া। ফোন করার পর সাহু ওটা ফেলে দেয়। কিন্তু নম্বর ধরে লোকেশন ট্রেস করে ফিলোমেনা সিস্টারের কাছে পৌঁছই, তার থেকে সাহুর গাঁয়ে পৌঁছিয়ে ওকে গ্রেফতার করা, যাকে বলে এলিমেন্টারি।
আমাদের কাছে সিস্টার ফিলোমেনা ও সাহুর কনফেসন আছে। ওনাকে কাল রাতেই নাইট ডিউটির সময় গ্রেফতার করা হয়েছে, তাই আপনারা জানেন না। খালি একটা ব্যাপার নিয়ে একটু ফাঁক রয়ে গেছে; ডার্টি কাজটা আসলে কে করেছিল? সাহু? সিস্টার না অন্য কেউ? সে পরে দেখে নেয়া যাবে।
কি, মিসেস রায়? এবারও কি বলবেন যে পুলিসের থিওরিকে আপনার উকিল কোর্টে কাঁটাছেড়া করতে পারবে? প্ল্যানটা ভালই করেছিলেন, কিন্তু কি জানেন, পারফেক্ট ক্রাইম বলে কিছু হয় না।
সুপ্রকাশ এবার বৌয়ের দিকে তাকায়।
ও বসেছে পিছন ফিরে, বাঁকা পিঠ কান্নার দমকে কেঁপে কেঁপে উঠছে।
এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়ায় সুপ্রকাশের শরীর জুড়িয়ে যায়।
এই তো সেই চেনা মেয়েটা!তিরিশ বছর আগে ভোপাল থেকে বিয়ে করে নিয়ে আসার সময় যে কিছুতেই ট্রেনে উঠতে চাইছিল না, মায়ের শাড়ির খুঁট চেপে ধরে এমনি করে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলো। ওর বড়ো ইচ্ছে হল কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, রুমাল দিয়ে চোখ মুছিয়ে দেয়। কিন্তু পারলো না। সেবারেও পারেনি, এখনও না।
--- আমি স্টেটমেন্ট সাইন করে দেব। কিন্তু আপনাদের কাছে একটা অনুরোধ ছিল।
-- বলুন, মিসেস রায়।
--আপনারা তো জেনে গেছেন মামণি পুরোপুরি নির্দোষ। দেখবেন যেন ও বেইল পায়, মুচলেকা দিয়ে ওর কাজের জগতে ফিরে যেতে পারে। সব দোষ আমার। কিন্তু আমি কি করতে পারতাম? আপনি মেয়ের বাবা, মা ন'ন। আমাদের মেয়ে সেলিব্রিটি নয়, নীনা গুপ্তা হতে পারে না।
ওর আজ নয় কাল চাকরি যাবে, নতুন চাকরি খুঁজতে হবে। এই ঘটনার জন্যে দায়ী যে সে ওর অফিসেরই প্রভাবশালী লোক। সে দেখবে যাতে চাকরিটা কোন বাহানায় চলে যায়। কোন বাড়িওয়ালা আন-ওয়েড মাদারকে ভাড়া দেবেনা। আর চারদিক থেকে এগিয়ে আসবে লোভের হাত,নানা অছিলায়।
আপনারা পুরুষেরা আমাদের জন্যে আর কোন অপ্‌শন খোলা রাখেন নি।
প্রেমের স্বাধীনতার জন্যে ভ্যালেন্টাইন শহীদ হয়েছিলেন। কয়েক শতাব্দী আগে; মনে করুন ওই বাচ্চাটিই আজকের ভ্যালেন্টাইন।



(সমাপ্ত)

0 comments: