ধারাবাহিক - ফাল্গুনি ঘোষ
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
বইপাড়ার তন্ত্রধারক
ফাল্গুনি ঘোষ
বন্ধুকে এ'কথা বলার কিছুদিনের মধ্যেই জাপানে মারা যান তিনি। এই 'অদের' হচ্ছেন বন্ধুটির সন্তানরা। বক্তা পি. সি. সরকার (সিনিয়র)। আর বন্ধুটি হলেন হাবু দত্ত। 'উল্টোরথ'-এর মতোই আরেক জনপ্রিয় বাংলা চলচ্চিত্র পত্রিকা 'মৌসুমী'র সম্পাদক হাবু দত্ত। বইপাড়ার বুকে তাঁর বাড়িকে কেন্দ্র করে আড্ডা ছিল সংস্কৃতিজগতের নানা দিকপালের। মূলত গানবাজনায় ঘেরা ছিল তাঁর বাড়ির পরিবেশ। বহু বিখ্যাত উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পীর প্রথম দিকের অনুষ্ঠান কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয়েছে তাঁর উদ্যোগেই। সাংস্কৃতিক ঘরানার টানেই তাঁর কাছে এসেছেন সাহিত্যজগতের অনেক দিকপালও। আর এই সরগরম পরিবেশের এক কোণে বসে এই প্রবাহকে শরীরে মনে মেখে ফেলতে থেকেছেন সেদিনের শিশু-কিশোর সৌমেন দত্ত- হাবু দত্তের পুত্র। এখনও বইপাড়ার আলো-আঁধারি রাস্তায় ভেসে আসে নানা গল্প। "বই বেরোলে প্রথম কপিটি দিয়ে তিনি লিখে দিতেন- বাবাজীকে দিলাম।" এই উপহারদাতা মানুষটি ধুতির কোঁচা লুটিয়ে হেঁটে যেতেন বইপাড়ার রাস্তায়। কপালে এক মস্ত আব। শিবরাম চক্রবর্তী। কখনো নিমন্ত্রণ বাড়িতে সেই কিশোরকে বলতেন তার বাবা- "জ্যেঠু আসছেন।" কেমন ভাবে একথা শুনে সসম্ভ্রম দাঁড়াতেন তিনি, আজও হাতদুটিকে পেটের কাছে জড়ো করে দেখান। চোখেমুখে আজও ফুটে ওঠে কৈশোরের সম্ভ্রম। সেই নিমন্ত্রণ বাড়িতে প্রবেশ করেন সন্তোষ দত্ত। কখনও সন্তোষ ঘোষ আড্ডা মারতে আসেন বাবা হাবু দত্তের সঙ্গে। আজও চোখ বুজলেই দেখতে পান তিনি। ছোটোবেলার সেই 'বাবাজী' একটু একটু করে বড়ো হন। স্কুলজীবনেই এসে পড়ে সত্তরের দশক। যুক্ত হয়ে পড়েন রাজনৈতিক প্রবাহে। পরিচিতি বাড়ে। কিন্তু মমত্বহীন ক্ষমতায়নের বাঁধাগতে না থেকে যথাসম্ভব পাশে থাকার চেষ্টা করেন প্রকাশকদের। সমসাময়িক বংশানুক্রমিক প্রকাশকদের বাবারা তো তাঁর কাকু জ্যেঠু। হাবু দত্তের সাংস্কৃতিক পরিসর জীবনের নানা বিচলনের মধ্যেও তাঁর ভিতরে কয়েকটি তার বেঁধে রাখে। মণিলাল নাগের শিষ্য সৌমেনের হাতে আজও সেতারে বেজে ওঠে সেই তার ক'টি। বইপাড়ার এক চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতে হঠাৎই অভিমানী হয়ে ওঠেন সেদিনের 'বাবাজী', আজকের ভাইয়াদা - "আমার কথা কাউকে বলতে হবে না। আমি কে? বাবার কথা কেউ বলে?" একদিন শক্তি চট্টোপাধ্যায় হাত ধরে যাঁকে টেনে নিয়ে গিয়ে সঙ্গী করেছিলেন আপন আড্ডার, সেই মানুষটি বইপাড়ার সরু গলির অন্ধকারে এক প্রবল অভিমানী মন নিয়ে ভিড়ে মিশে হেঁটে চলেন। হঠাৎ কোনো এক রন্ধ্রের অবকাশে বেরিয়ে আসে বইপাড়ার বুকে বিচিত্র মানুষের আনাগোনার বিচিত্র অধ্যায়- যাদের পরতে পরতে নানা বয়সের তিনি মিশে আছেন। এমন করে মাঝেমাঝেই দাঁড়িয়ে পোড়ো ভাইয়াদা। অভিমানের আড়াল ভেঙে খুলে দিও ইতিহাসের স্রোত। তোমার গল্পের হাত ধরে হাবু দত্তের আসর, কফিহাউসের আড্ডা কিম্বা বইপাড়ার অলিগলির নানা জমায়েতে পৌঁছে যাব আমরা। আর জাদু-সাহিত্য-সংগীত-আড্ডার আশ্চর্য ঘূর্ণিতে ডুবতে থাকব বইপাড়ার আরও ভিতরে। ডুবতেই থাকব। তুমি তো সেই জাদুকর। তাই না ?
0 comments: