গল্প - সনাতন
Posted in গল্প
গল্প
প্রতিমা বিসর্জন
সনাতন
(১)
সপ্তমীর রাত। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঠাসাঠাসি ভিড়। পায়ে পা, গায়ে গা। অল্প বয়সী ছেলেদের হুল্লোড়। ঠেলাঠেলি এবং সেই সুযোগে নারী শরীরের নরম স্পর্শ পাওয়ার জন্য আলাদা একটা প্রচেষ্টা। থেকে থেকে কাগুজে বাঁশির আওয়াজ। মাথার উপর টুনি লাইটের ছাউনি। পথের দুধারে নানান আলোকসজ্জা। রাস্তার উপর বাঁশের রেলিং। মাঝে মাঝে দড়ির ক্ষেপ। দোকানদারদের চিৎকার করা বিজ্ঞাপন। পুলিশের বাঁশি। ভলান্টিয়ারদের ঘোষণা...'দাঁড়াবেন না, এগিয়ে যান, এগিয়ে যান'।
মাইকে সানাই আর পুজো কর্তাদের ঘোষণা। খাবারের গন্ধ। এসবের মধ্যে আবার আটকে পড়লো অসিত। প্যান্ডেলে ঢুকতে এখনও প্রায় ত্রিশ ফুট। দড়ির বেড়ে আটকেই অসিত প্রতিমাকে জিজ্ঞেস করলো
...ওরা কোথায়?
...তোমার পিছনেই তো ছিলো! দেখা যাচ্ছে না তো!
মেজাজ হারিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে... দেখা যাচ্ছে না তো। খেয়াল রাখতে পারলে না?
...রেখেছিলাম তো!
...রেখেছিলাম তো! একসঙ্গে ফিরবো বলেই তো এলে। এখন নাও,
ওরা না থাকলে ওই ফাঁকা রাস্তা দিয়ে যাবো কি করে?
ফাঁকা রাস্তার কথা ভেবে কেমন যেন উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে অসিত।কোলে তার এক বছরের মেয়ে। সঙ্গে স্ত্রী, প্রতিমা। পুজো দেখার আবেগটা হঠাৎ যেন মিইয়ে গেলো।
প্রতিমা সেসব অনুধাবন না করেই তবুও বললো
...চলো না। আর একটা ঠাকুর দেখে চলে যাবো।
রেগে গিয়েই অসিত দাঁত খিঁচিয়ে বলে... তারপর গেলো। গিলে যেতে যেতে ওদিকে আবার ভ্যান পাবো কি না কে জানে!
এত লোকের মাঝে তার এমন ব্যবহার প্রতিমাকে কুঁচকে দিলো।
পাড়ার অনেকেই আসছে বলেই এক প্রকারে বায়না করেই শহরে ঠাকুর দেখতে আসা।নয়তো সেই ছোটোবেলার মতো দিনে ঠাকুর দেখা। আগে বাবার সাইকেলে চড়ে যেমন দেখতো, তেমন করে হয়তো এবারও হতো।
কিন্তু রাতের বেলায় প্যান্ডেল, ঠাকুর, রাস্তা আলোয় যেন অন্য রূপে সাজে...পরিচিত জগৎটাকে কেউ বুঝি আলোয় ডুবিয়ে রাখে।আলাদা করে দেয়। মায়াবিনী হয়ে ওঠে। আলোর ঝলকানি সাঁতরে সাঁতরে চোখকে মহাবিষ্ঠ করে। তখন নতুন পোষাকও কেমন যেন খিলখিল করে হাসে। আর আলোর উর্মিমালায় ভেসে ভেসে ঠাকুর দেখে সবাই। এসবের প্রতি প্রতিমার আকর্ষণ তার ছোটো থেকেই... বাবার অধীনে এগুলো অপূর্ণতায় অপুষ্টিতে এতদিন লালিত হচ্ছিল।বিয়ের পর অসিতের সঙ্গে এটাই তার প্রথম ঠাকুর দেখা... তাও আবার রাতে।
তাই তার শরীর, মন উচ্ছ্বাসে ও পুজো দেখার উদ্দীপনায় যেন উড়ে বেড়াচ্ছে। ফেলে আসা শৈশবের অপূর্ণতা আজ সে চেখে চেখে দেখছে এক প্যান্ডেল থেকে আর এক প্যান্ডেলে। অনাবিল আনন্দ তার চোখের কোণে, ঠোঁটের কোণে ঠিকরে ঠিকরে বেরচ্ছে। হঠাৎ অসিতের এমন দাঁত খিঁচুনি মুচড়ে দিলো তাকে।
পাড়ার লোকগুলো কোথায় হারিয়ে গেলো তারা ঠাওর করতে পারলো না। কি জানি তারা আগে চলে গেল কিনা! প্যান্ডেল থেকে বেরিয়ে রেস্টুরেন্টে খেতে খেতে অসিত তাড়া দিতে লাগলো। নাকে-মুখে গেলার মতো করে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরলো। মেয়েকে কোলে নিয়ে দুজনেই ভ্যান ধরার জন্য স্টেশন-মোড়ের দিকে এগিয়ে গেলো।
রাস্তায় ভিড় এদিক ওদিক যাচ্ছে। ভ্যান অটো পরষ্পরকে মুখ দেখিয়ে চলে যাচ্ছে নিজের অগোছালো ছন্দে। লাস্ট ট্রেন বেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। স্টেশন মোড়। প্রায় ফাঁকা। তাদের রুটে দুটো ভ্যান এখনও আছে। রাস্তায় অনেক লোকজন কিন্তু তাদের রুটে প্যাসেঞ্জার কোথায়? তাদের নিয়ে চার জন। কমপক্ষে আট জন না হলে ড্রাইভার ভ্যান ছাড়বে না। তাই গোঁ ধরে বসে আছে। পুজোর সময়ে একটু বেশি কামানোর জায়গায় এ ক'জনকে নিয়ে যেতে তার মন উঠছে না। আর আটজনের বেশি হলে তো কোনও কথাই নেই। কিন্তু এখন বেশি কথা খরচ করতে হচ্ছে প্যাসেঞ্জারদের। সঙ্গে অনুরোধ ও ডবল ভাড়া দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও। কিছুতেই তার মন গলছে না। হয়তো শেষ ট্রিপে দাঁও মারার অপেক্ষায় ড্রাইভার প্রহর গুনছে। কিন্তু সেই প্রহর কখন?
এদিকে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে রাত যত বাড়ছে ততই ভয় ও অনিশ্চয়তা অসিত ও প্রতিমার শরীরের জাঁকিয়ে বসছে। ভ্যান থেকে নেমে, গ্রামে যাওয়ার পথের নির্জনতা, ভয়ের পেনসিল নিয়ে দাগ কাটছে তার মনের গায়ে। যুক্তিবাদী মন ভেতরে ভেতরে জানান দিচ্ছে ওই ফাঁকা, নির্জন পথে না যাওয়াই ভালো। একা পুরুষ মানুষ তার উপরে কোলের বাচ্চা সঙ্গে আবার প্রতিমা। না গেলে তারা এই রাতে করবেটা কী? রাতটা কি ঘুরে ঘুুরে কাটিয়ে দেবে? ঘুুমন্ত বাচ্চা
নিয়ে এভাবে কতক্ষণ আর ঘুরবে!
মেয়েটা কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ।বাঁ হাত টনটন করছে।ভাবতেই সব কেমন খেই হারিয়ে যাচ্ছে।
প্রতিমা চুপ করে আছে আর ভাবছে
...কিছু জিগ্যেস করলে যদি আবার খেঁকিয়ে ওঠে।
অন্যরা অপেক্ষা করছে কখন থেকে কে জানে! তারাও স্বামী-স্ত্রী।হঠাৎ অন্য মহিলা জানতে চাইল
...কোথায় যাবে গো তোমরা?
প্রতিমা অনিচ্ছা সত্ত্বেও আস্তে করে বলে...মুরারীপুর।
... ওরে বাবা! ভ্যান থেকে নেমে সে তো অনেক দূর। ফাঁকা রাস্তা! রাস্তায় গাছ আর গাছ! গত বছর ওই রাস্তায় কাকে একটা মেরে ফেলে দিয়ে গিয়েছিলো! যাবে কি করে?
মহিলার শেষের কথাগুলো তার গায়ে কাঁটা দিতে লাগলো। অজানা একটা শীত শিরশির করে সারা শরীরে কাঁপুনি দিয়ে গেলো। আঁচলটা গায়ে ভালো করে ঢেকে নিয়ে অসিতের গায়ে ঘেঁষে গেলো।
এমন সময় উল্টো দিকের রাস্তা ধরে তিনজন এসে হাজির।
...ও দাদা যাবে গো?
ভাঙা পোস্টারের উপর গামছা গায়ে দিয়ে বসে লোকটা বিড়ি টানতে টানতে বললো
...হুঁ।
সকলে অনুরোধ করে... এবার চলুন না দাদা।
... এখনও একজন বাকি। ভাড়া ডবল দিলে যাবো।
অসিত বললো
...কেন আবার ডবল দেবো?
...ফিরে আসার সময় ওদিক থেকে প্যাসেঞ্জার পাবো না। দিলে যাবো। দেবে কি?
অগত্যা সবাই রাজি হলো।
(২)
শহরের আলো গায়ে মেখে ভ্যান চলেছে গ্রামের দিকে। মিনিট পাঁচেক যেতেই পিচের রাস্তার দুধারে বাবলা গাছের সারি। ফাঁকা মাঠ। কোথাও কোথাও ধানের খেত। মাঠে কোথাও বা আধ হাঁটু জল। দু একটা জিওল মাছের আওয়াজ জলের নীরবতা ভঙ্গ করছে। সুনসান রাস্তা। গাছের ফাঁক থেকে বাঁকা চাঁদের আলো ঝরে পড়ছে। হিমের রাত। একটা ঠাণ্ডা হাওয়া গায়ে লাগছে। নীরবতার অবিমিশ্র জ্যোৎস্না প্লাবিত হয়ে চলেছে দূর দূরন্ত। অনাবিল স্নিগ্ধতা যেন তার বন্দনা করেছে...
... ওঁ যো দেবা অগ্নৌ, যো বিশ্বং ভুবনং আবিনিবেশ।
যঃ ওযধিষু যো বনস্পতিষু, দেবায় নমনমোঃ।
তিন মাথার মোড়।ভ্যান একটা ঝাউগাছের তলায় এসে দাঁড়ালো।
একপাশে বড়ো পুকুর। উল্টোদিকে সুতির খালের উপর ঢালাই ব্রিজ। তার একটু দূর থেকেই গাছের সারি যেন গুহাপথ রচনা করে অপেক্ষা করছে অনন্তকাল ধরে।
এখানে গাছের তলায় বাঁশের মাচা। কেউ কোথাও নেই। নিস্তব্ধতাকে কেউ যেন জিইয়ে রেখে গেছে। কয়েকটা দোকান হিমের মিয়ানো জ্যোৎস্নায় চুপ করে আছে।
... নামো নামো। বলেই ড্রাইভার সিটে বসে হাঁপাচ্ছে। আর গামছা দিয়ে ঘাম মুছছে। ওদের ভাড়া নিয়ে ভ্যান চললো আরও দূরের গ্রামে। ভ্যান থেকে কে যেন বলে উঠলো
...দুগ্গা, দুগ্গা।
সেই শব্দ অনুসরণ করে প্রতিমা কপালে হাত ঠেকালো কয়েকবার। ব্রিজ টপকে দুজনে নামলো মাটির রাস্তায়। অসিতের মনে হলো সে একা হাঁটছে। কয়েক পা গিয়েই থমকে গেলো। পিছনে তাকিয়ে দেখে প্রতিমা কাঠ হয়ে ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে আছে।
...কি হলো এসো। নেমে আবার ওখানে গেলে কেন?
প্রতিমা গুটি গুটি করে নেমে এলো। এসেই ভয়ার্ত গলায় বললো
...মেয়ের হাতটা দাও তো।
হাতটা এগিয়ে দিতেই তিনবার আলতো কামড় দিয়ে গায়ে থুতু ছিটিয়ে আবার বললো
...তাড়াতাড়ি চলো! আমার খুব ভয় করছে।
অসিত বাম কাঁধে মেয়েকে নিয়ে, ডান হাতে প্রতিমাকে ধরে এগিয়ে চললো।
সুতির খাল লম্বা হয়ে চলে গেছে দুদিকের মাঠের বুক চিরে। লোক চলাচলের দিকটায় কোথাও কোথাও ঝাউ, আকাশবাণী, ইউক্যালিপটাস, কাঁটা বাবলা সার বেঁধে আছে। পাতার ফাঁক থেকে জ্যোৎস্না টুকরো টুকরো হয়ে নেমে এসেছে পথে। আবছা আলো মাঠে, খেতে, জলের উপর গা ভাসিয়ে দিয়েছে। অন্য পাড়ে কাশের মাথা সাদা মেঘ হয়ে যেন মাটিতে নেমে এসেছে। পায়ের জুতোর আওয়াজ, পোশাকের খসখস আর তাদের নিঃশ্বাসের শব্দই এখন রাতের হৃদপিণ্ডকে যেন সচল করে রেখেছে। থেকে থেকে শিয়ালের উউউ উউউ ডাক ছড়িয়ে পড়ছে রাতের শরীর চিরে। গায়ে কাঁটা হয়ে উঠছে সেই ডাকে।
রাস্তার বটগাছ আর ছেলেপোতাটা যত এগিয়ে আসছে ভয় সেঁধিয়ে যাচ্ছে তাদের শরীরে শরীরে, রক্তে রক্তে, শিরায় শিরায়। তখনই মনে পড়ছে, ঐ গাছের তলায় ঘটে যাওয়া কয়েকটা ছিনতাইয়ের খবর।
চোখের সামনে উঠে আসছে সেইসব পরিচিত ছবি...বটের তলায় মদের বোতল, চোলাই মদের প্লাস্টিক, গ্লাস ইত্যাদি। গাছটা ঝুরি নামিয়ে নামিয়ে চাষের মাঠও দখল করে চলেছে। তার গায়ে কোথাও কোথাও সিঁদুর লেপা।
নুড়ি-সুতো বাঁধা। প্রাচীনত্বের গাম্ভীর্য নিয়ে বিরাজ করছে কবে থেকে কে জানে !
তার একটু দূরেই ওই পোতা, আশেপাশের গ্রামের লোকেরা মরা ছেলেমেয়েদের ওখানে পুতে দিয়ে যায়। শিয়াল-কুকুরে তাদের টেনে টেনে বের করে আর খুবলে খুবলে খায়। কখনও কখনও নাড়ি, ভুঁড়ি, জামা-কাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে।
আর মিনিট কুড়ি যেতে পারলেই তাদের গ্রাম।
রাতে পথ হয়তো আরও লম্বা হয়ে যায়! তাই বুঝি, তাদের পথ যেন আর শেষ হচ্ছে না। গাছের তলা দিয়ে তারা আতঙ্কে পথ মাড়িয়ে চলেছে।
বটের তলায় কয়েকটা কালো কালো মূর্তি দেখা যাচ্ছে। অশরীরী আত্মা নয়তো?গা পাঁজা দিয়ে উঠলো।
অসিত মনে মনে আওড়াতে থাকে
... রাম, রাম, রাম...
প্রতিমার পা যেন মাটিতে আটকে যাচ্ছে। টেনে টেনে তুলছে হচ্ছে পা দুটোকে।একটু কাছে আসতেই তাদের কথা কানে আসছে। সঙ্গে দু-একটা কদর্য গালাগাল।
এগোলে বা পিছলেও রক্ষে নেই।
আর এগোবে কি এগোবে না!
ভাবতে ভাবতে তাদের কুঁকড়ে যাওয়া শরীর দুটোকে তাদের পা যেন টেনে নিয়ে চলল সেদিকেই। বটের ছায়া থেকে সেই মূর্তিগুলো আবছা আলোয় বেরিয়ে আসছে একে একে। তারা পালাবে কি পালাবে না ঠিক করেই উঠতে পারছে না। পা যেন আরও ভারি হয়ে উঠেছে। মাটিতে পড়ে আর উঠতে চাইছে না। তবু গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চললো। পায়ে পা যেন আটকে আটকে যাচ্ছে। প্রতিমার বাম হাতটা এখন অসিতের কোমরের বেল্টে যেন সজোরে কামড় দিচ্ছে। কালো কালো মূর্তিগুলো দাঁড়িয়ে আছে ওতপেতে। তাদের পাশ কাটিয়ে বটের তলা অতিক্রম করছে এমন সময় গাছের থেকে কি একটা উড়ে যাওয়ার আওয়াজে প্রতিমা চাপা গলায় 'মাগো বলে' অসিতকে জড়িয়ে ধরে। অসিত প্রতিমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে ফিস ফিসিয়ে শোনায়
...ওটা পাখি।চলো। জোরে পা চালাও।
দুজনে জোরে জোরে পা ফেলতে থাকে। এখন পা যেন মাটিতে পড়ছে না। একটু এগোতেই কয়েকটা পায়ের শব্দ যেন তাদের পিছু নিয়েছে বলে মনে হলো।অসিত ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে মূর্তিগুলো দ্রুত পায়ে টলতে টলতে তাদের দিকে আসছে। অসিত মনে মনে ভগবানকে বলে
...হে ভগবান, তুমি রক্ষে করো। কিছু করলে ওদের সঙ্গে একা পেরে উঠবো না। বাঁচাও।
প্রতিমার হাতটা শক্ত করে ধরে বলে
... দৌড়াও।
সঙ্গে সঙ্গে দুজনে দৌড়তে লাগে। পিছন থেকে কালো কালো শরীরগুলো দৌড়ে আসছে আর বলছে
...খা_কির ছেলে, পালাচ্ছে রে।
...ধর মাগীটাকে।
...শালী, পালাবি কোথায়? একবার ধরতে দে, দেবো রাম চো_ _।
...মালটাকে ধরেই কেলাবো।
আবছা রাতে চলল সম্মান রক্ষার আর সম্মানহানির অসম প্রচেষ্টা।দৌড় আর দৌড়
(৩)
অসিত মেয়েকে কোলে নিয়ে দৌড়াতে পারছে না। দুজনে হাঁপিয়ে উঠছে। কালো শরীরগুলো আরও কাছে এগিয়ে এসেছে। দৌড়তে দৌড়তে শাড়ি পায়ে জড়িয়ে আছড়ে পড়লো প্রতিমা।অসিতের হাত থেকে তার হাত গেলো ফসকে। ভয়ে, আতঙ্কে কঁকিয়ে উঠলো প্রতিমা... আঁআঁআঁ...
মেয়েকে বুকে চেপে ধরে হাত বাড়িয়ে তাকে ধরে তুলছে যাচ্ছে।এমন সময় দুজন এসে ধরলো অসিতকে। তারাও হাঁপাচ্ছে। তাদের মুখ থেকে মদের গন্ধ ভুরভুর করে বেরিয়ে আসছে
...শালা, শুয়োরের বাচ্চা।মাগী নিয়ে পালাচ্ছিলি?
...আমাদের ছেড়ে দাও, দাদা।আমাদের টাকা, গয়না সব দিচ্ছি।
...এবার দেব শালা মায়ের ভোগে?
মেয়ে কাঁদছে কোলে। প্রতিমার আত্মরক্ষার আর্তনাদ কানে আসছে।সে একহাতে তাদের পা জড়িয়ে ধরছে আর বলছে
... আমাদের ছেড়ে দাও। ছেড়ে দাও।
... মালটাকে রেখে তুই ভাগ। আমাদের একটু চেখে দেখতে দে। যা, ফিরে এসে নিয়ে যাস।
কোলে মেয়ে আরও চিৎকার করে কাঁদছে। টানাটানি, ধস্তাধস্তির অসম লড়াইয়ে গাছেরা নীরব দর্শক হয়ে অসহায়ভাবে চুপ করে আছে। ততক্ষণে দুজনে পাঁজাকোলা করে প্রতিমাকে নিয়ে গেলো গাছের তলায়। দুজনে মিলে শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ টেনে হিঁচড়ে খুলছে।
প্রতিমা মরিয়া হয়ে আটকানোর চেষ্ঠা করছে। কাঁদছে। আর তাদের বলছে... তোমাদের হাতে ধরছি, পায়ে পড়ছি। আমাদের ছেড়ে দাও।
সেই অদম্য পাশবিক শক্তির কাছে সে যতবার হার মানছে তত চেঁচাচ্ছে... অসিত, অসিত, অসিতততত.....
স্ত্রীর বেদনদীর্ণ আকুতি, মেয়ের ভয়ার্ত কান্না, লম্পটদের পীড়ন অসিতকে টুকরো টুকরো করে ফেলছে। অসহায়তায় তার বুক ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে অসিত লাথি মারলো একজনকে। সে ছিটকে পড়লো খালের জলে। সঙ্গে সঙ্গে অন্য দুজন প্রতিমাকে ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে এলো অসিতের কাছে। ধস্তাধস্তি করে মেয়েটাকে কেড়ে নিয়ে একজন দূরে সরে গিয়ে বললো
...মার শালাকে। মার।
...শালা, বেশি টেরিমেরি করলে বাচ্চাটাকে দেবো খালের জলে ফেলে।
মরিয়া হয়ে উঠেছে তারা। অনবরত কিল, ঘুসি,লাথি পড়ছে অসিতের শরীরে। কাতরাচ্ছে অসিত। প্রতিমা দৌড়ে এসে ঠেকাচ্ছে
...ওদের ছেড়ে দাও। ওদের ছেড়ে দাও। তোমাদের পায়ে পড়ি। ওদের ছেড়ে দাও।
একজন তার চুলের মুঠি ধরে বলে
...তবে তুই চল, মাগী। তোর ভাতারকে বল, পরে এসে তোকে নিয়ে যেতে।
বুকফাটা কান্নায় স্বামীর বিদ্ধস্ত শরীরে শুয়ে পড়ে প্রতিমা বলে... ওগো, তুমি ওকে নিয়ে বাড়ি যাও।
অসিত অবসন্ন শরীর নিয়ে পড়ে থেকে দেখছে ...মেয়েটাকে তার কাছে রেখে তারা প্রতিমার উলঙ্গ শরীরটাকে টানতে টানতে নিয়ে চলেছে সেই গাছের তলায়। প্রতিমার আর তার মেয়ের কান্নার রোল এই আবছা আলোর হিমের রাতের শীতল বাতাসকে অসহায় করে তুলছে। হাহাকারে তা ছড়িয়ে পড়ছে খালে, জলে, খেতে শিশির কণায়।
টলতে টলতে বাড়ি ফেরে অসিত। মেয়েকে মার কাছে রেখে ভাইকে ডেকে নেয়। সঙ্গে টর্চ আর লাঠি। পড়িমরি করে গেলো সেদিকে। লজ্জার হাত থেকে বাঁচতে পাড়ার আর কাউকে ডাকতেও পারলো না।
বাঁকা চাঁদ ডুবে গেছে আগেই। অন্ধকার আরও গভীর হয়ে উঠেছে খালপাড়ে-গাছের তলায়। নীরবতা চেপে বসেছে রাতের অস্তি-মজ্জায়।
সেই গাছের কাছে এগোতেই টর্চের আলোয় চমকে ওঠে দুজন।দেখে রক্তমাখা নাড়ি ধুলো মেখে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে টুকরো টুকরো হয়ে। রক্তের ছোপ যেখানে সেখানে। কয়েকটা শিয়াল মাংসের টুকরো নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে।
কাপড় পড়ে রাস্তায়, ছেঁড়া ব্লাউজের টুকরো বাবলা গাছে। বড়ো গাছটার তলায় একপাল শিয়াল কামড়া কামড়ি করছে। টর্চের আলো পড়তে তাদের চোখগুলো জ্বলজ্বল করে উঠল।মুখে কাঁচা রক্ত।মাংসের টুকরো নিয়ে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। তাদের ফাঁক থেকে আলো পড়লো প্রতিমার উপর। শিউরে ওঠে দুজন। গাছের গোড়ায় ওটা কি? ক্ষত বিক্ষত শরীর, খুবলে খুবলে খাওয়া। নখের আঁচড়ে মাংস চিরে চিরে গেছে। চোখ দুটো কামড়ে তুলে নিয়েছে। রক্ত গড়াচ্ছে। পেটটা কামড়ে কামড়ে ভোগলা করে দিয়েছে। প্রতিমার শরীরটা চেনা যাচ্ছে না!
অসিত লাঠি উঁচিয়ে পাগলের মতো দৌড়ে গেলো প্রতিমার দিকে ভয়ে শিয়ালগুলো শরীর টেনে নিয়ে পালাতে গেলো...
শরীরটা গড়িয়ে পড়লো খালের জলে।
এবাবের প্রতিমা জলে পড়লো সপ্তমীর রাতে।
0 comments: