1

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in

ধারাবাহিক


সোয়ানার রহস্যময় মানুষ 
নন্দিনী সেনগুপ্ত 


১ 

আল্পসের মন্টে জেনারাসো পাহাড়ের মাথায় পৌঁছাতে হলে ট্যুরিস্টরা বেশিরভাগ মেন্দ্রিসিও হয়ে যায়। কোপালাগো অবধি টয় ট্রেনে; মেলিডে থেকে সোয়ানা হয়েও যাওয়া যায়। তবে সেই পথটা বেশ দুর্গম। পুরো অঞ্চলটাই সুইজারল্যান্ডের টিসিনো প্রদেশের মধ্যে পড়ে; সেখানে জনসংখ্যার অধিকাংশই আবার ইতালিয়ান। সোয়ানা হয়ে ঐ কঠিন পথে উঁচুতে উঠবার সময়, অনেক পর্বতারোহী এক মেষপালককে দেখতে পেতো। তার চেহারাটা এমন, যে একবার দেখলে কেউ ভুলবে না। গায়ের রঙ রোদে পুড়ে চাষাভুষো মানুষদের মত তামাটে হয়ে গেলেও, মুখমণ্ডলে পরিশীলিত শিক্ষাদীক্ষার ছাপ। সিয়েনার গির্জায় দোনাতেলোর ভাস্কর্যে পাদ্রী জনের সেই বিখ্যাত ব্রোঞ্জমূর্তির কথা মনে পড়তে পারে লোকটাকে দেখবার পরে। লোকটার কালো, ঢেউ খেলানো চুলের গুচ্ছ নেমে এসেছে কাঁধ অবধি, পরনে ছাগলের চামড়ার পোশাক। 

নতুন ট্যুরিস্টদের দল এলাকায় গেলেই দেখতে পেতো যে গাইডরা সবাই ওকে চেনে। দেখা হলেই হেসে কথা বলে; ঠাট্টা-ইয়ার্কি করতে যায়। তবে লোকটা হেসে কথা বললেও কাউকেই সেরকম পাত্তা দেয়না। পাহাড়ের গাইডরা কেউ ওকে চটায়না। সব্বাই ভালো ব্যবহার করে। অনেকেই এদিকে এলে যেচে পড়ে ওর সঙ্গে দেখা করতে যায়; একান্তে দুচার কথা বলে। বাইরের লোক যদি সেই গাইডদের জিজ্ঞেস করে যে, লোকটা কি কোনো সাধু? গাইডরা ইশারায় মাথা নেড়ে সেকথায় সায় দেয়। লোকটা চোখের আড়াল না হওয়া অবধি জোরে চেঁচিয়ে কথা বলেনা। এক দু জন ট্যুরিস্ট, যারা খুব বেশি কৌতূহলী, তারা কীভাবে যেন এই খবরটা পেয়ে যায় যে লোকটার একটা রহস্যময় অন্ধকার অতীত আছে, এবং এই পাহাড়ের সবাই লোকটাকে ‘সোয়ানার রহস্যময় মানুষ’ বলে উল্লেখ করে। এই উচ্চারণের সঙ্গে একটা ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধা সবসময় লেগে থাকে। 

----------------- * ------------------ * --------------* 

আমার যখন অনেক অল্প বয়স, তখন বেশ কয়েক সপ্তাহ সোয়ানাতে থাকবার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেইসময় একদিন জেনারাসোতে যাবার পথে সাক্ষাৎ হয়েছিল সেই মানুষটির সঙ্গে। প্রথমবার দেখবার পরেই মনে হয়েছিল লোকটাকে আমি কোনোদিন ভুলবোনা। যদিও নানা অদ্ভুত পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা শুনেছিলাম লোকটা সম্পর্কে, তাও ঠিক করে ফেললাম যে নাহ, আরেকবার লোকটার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেই হবে আমাকে। যেন এক অদ্ভুত আকর্ষণী শক্তি আছে লোকটার ভেতরে। 

আমার ইচ্ছেতে আরও হাওয়া দিলেন এক ডাক্তার, সোয়ানায় আমার পাশের বাড়িতেই থাকতেন তিনি। ডাক্তার সুইস-জার্মান; তিনি বললেন যে লোকটা একটু অদ্ভুত হলেও লেখাপড়া জানা মানুষদের সবসময় স্বাগত জানায় তার কাছে। উনি বহুদিন আগে লোকটার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। 

‘আসলে লোকটার উপরে আমার রেগে যাওয়া উচিত ছিল।’- বললেন ডাক্তার... ‘খুব ভুগিয়েছিল আমায় সেবার! তবে’ ... ডাক্তার বোঝাতে থাকেন আমায়... ‘অত উঁচুতে থাকে লোকটা... আর ও ছাড়া ওইরকম দুর্গম জায়গায় আর কেউ নেই যে কোনো কথা বলবে তুমি, কিংবা কোনো সাহায্য চাইবে!’ ডাক্তার আরও বলেন, ‘কিন্তু কি জানো? সবাই বলে যে লোকটা শয়তান। সাক্ষাৎ শয়তানের প্রভাব আছে লোকটার উপরে এবং লোকটা নিজেই এর জন্য দায়ী। পাদ্রীরা সবাই সেরকমই বলেছিলেন। সামাজিক ধর্ম আচার বিচার কিছুই নেই লোকটার। আসলে অতীতে হয়তো এমন কিছু ঘটেছিল যে অমন হয়ে গিয়েছে। কেউ বলে শয়তান, কেউ বলে নানারকম জাদুবিদ্যা জানে। তবে আমায় যদি জিজ্ঞেস করো, নাহ, আমি ঐ লোকটার থাবা, নখ, শিং, ... মানে শয়তানের যেরকম থাকা সম্ভব, ওইরকম কিচ্ছু দেখিনি।’ 

----------------- * ------------------ * --------------* 

লোকটার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎটা বেশ অদ্ভুত ছিল, মনে আছে আমার। এমন একটা অদ্ভুত পরিস্থিতিতে আলাপ হয়েছিল যে কি বলব! পাহাড়ে চড়বার বেশ খাড়াই পথে যেতে যেতে একদিন দেখি এক মা ছাগল একটা বাচ্চা সবে প্রসব করেছে আর দ্বিতীয় বাচ্চাটা এখুনি প্রসব করবে। ছাগল মা একা, সে ভারি বিপন্ন; নির্ভয়ে করুণ চোখে আমার দিকে চেয়ে রইল। মনে হল, সে যেন আমার কাছে সাহায্য চাইছে। এই জনমানবহীন খাড়াই জঙ্গুলে পার্বত্য পথে প্রাণের আগমনবার্তা – অবলা জীবের প্রসব দেখে আমিও কেমন দিশেহারা হয়ে পড়লাম। ঐ পথে চলা অমনিতেই বিপদ; খাড়াই পথে খুব সতর্কভাবে চলতে হয়। তার মধ্যে এই প্রসূতি মা ছাগলের জন্য আমি কি করতে পারি, সেটাই ভেবে পাচ্ছিলাম না। 

হঠাৎ মনে হল সেই যে ‘রহস্যময়’ এক মেষপালকের গল্প শুনতে পাওয়া যায় সোয়ানায় কান পাতলে, এই ছাগল সেই মেষপালকের নয় তো? তাড়াতাড়ি এগিয়ে আরও কয়েক কদম উপরে উঠে দেখি, হ্যাঁ, বোধহয় সেই লোকটাই। বসে আছে একটা পাথরের উপরে, পাশে একচিলতে চাতালের মত মাঠে একদল ভেড়া আর ছাগল চড়ে বেড়াচ্ছে। তাড়াতাড়ি গিয়ে বললাম ব্যাপারটা। লোকটাকে নিয়ে আবার ফিরে এলাম সেখানে, এসে দেখি দ্বিতীয় ছানাটা বেরিয়ে এসেছে, রক্তে ভেজা, ঘাসের উপরে শুয়ে আছে। 

অভিজ্ঞ ডাক্তারের মত দক্ষতায়, মায়ের মত মমতায় লোকটা ছাগলটার সেবা করতে লাগলো। প্রসব শেষ হলে ছানাগুলিকে পরম আদরে সে হাতে তুলে নিয়ে চলতে লাগলো। মা ছাগলটা তার ভারি বাঁট নিয়ে ধীরে ধীরে চলতে লাগলো পিছন পিছনে। ধীরে ধীরে তাদের নিয়ে সে খোঁয়াড়ের দিকে যেতে লাগলো। লোকটা আমাকে বারবার ধন্যবাদ দিলো, তারপর ডাকতে লাগলো তার সঙ্গে যাবার জন্য। এই দুর্গম জায়গায় এমন অভ্যর্থনা পেয়ে, সঙ্গে না যাবার কোনো কারণ পেলাম না আমি। 

লোকটা আল্পসের এই দুর্গম উপত্যকায় বেশ কয়েকটা কুটির বানিয়ে রেখেছে দেখলাম। একটা কুটির দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন পাথরের স্তুপ। কিন্তু ভেতরে দেখলাম শুকনো আর বেশ উষ্ণ আস্তাবল। সেখানে মা ছাগল এবং তার সদ্য হওয়া ছানাগুলোর ঠাঁই হলো। আমাকে সে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলো আরও কয়েক ধাপ উপরে; সাদা রঙ করা একটা ছোট কেবিন টাইপের কুটির। জেনারাসো পাহাড়ের গায়ে ঠেসান দেওয়া কুটিরের পিছনের দেয়াল, সামনের চাতালে আঙ্গুরলতায় ঢাকা কুঞ্জ। পাশেই পাহাড়ের বুক ফেটে তীব্র গতিতে বেরিয়ে আসছে একটা ঝর্ণা। তার জল এসে ভর্তি হচ্ছে বিশাল একটা পাথরের গর্তে। পাশেই দেখলাম পাথরের একটা গুহার গায়ের লোহার দরজা, হঠাৎ দেখে মনে হল কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে ঐ গুহার ভেতরে। 


(চলবে) 

গেরহার্ট হাউপ্টমান রচিত ‘ড্যের কেৎজার ফন সোয়ানা’ অবলম্বনে লেখা

1 comment: