ধারাবাহিক - সোমঙ্কর লাহিড়ী
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
পায়ের শব্দ
সোমঙ্কর লাহিড়ী
১২
উত্তরগুলো টিভিতে আরো একজন দেখছিল। তার সামনে ছড়ান ছিটানো অনেক ইলেক্ট্রিকের আর ইলেকট্রনিক্সের কাজকর্ম করার জিনিসপত্র। একটা টুপির সামনের দিকের শেডের মতো অংশে আর কানের উপরে দুই পাশে গাঢ় নীল এল ই ডি লাগাবে বলে একটা মাপ মতো প্যানেলে এল ই ডি গুলোকে সাজাচ্ছিল আর টিভিতে সম্বিতের সাথে আনকাট অনুষ্ঠানে অ্যান্ডির ইন্টারভিউটা দেখছিল।
পাশের ঘর থেকে এক মহিলার কাঁপা কাঁপা গলা শোনা গেল,
খেতে দিবি না? অনেক তো রাত হল সেই কখন চা খেয়েছি, খিদে পেয়ে গেছে। খেতে দে না। কি রে বাবু, শুনতে পাচ্ছিস? অ বাবু খেতে দে না রে।
বাবু বিরক্ত হয়,
চেঁচিয়ে জবাব দেয় এখন সবে আটটা বাজে। নটা বাজুক খেতে দিয়ে দেবো। এখন টিভি দেখো একটু।
সিরিয়াল চালিয়ে দে তাহলে।
টিভিটার দিকে তাকিয়ে দেখ, সিরিয়ালই তো চলছে।
না, না এই সিরিয়াল্টা দেখব না, অন্যটা করে দে না।
হাতের কাছে রিমোট রয়েছে তো পালটে নিলেই পারো।
তুই আয়না, একটু এই ঘরে, তোকে দেখি একটু।
নিকুচি করেছে তোমার একটু দেখার। কাজকম্ম করতে দেবেনা না কি?
ক পয়সা রোজগার করিস, মুরোদ তো জানা আছে, খাস তো আমার বাপের পয়সায়, অত কাজ দেখাসনি আমাকে, নেহাত হাত পা চলে না তাই, নইলে তোর মতো কুলাঙ্গার ছেলের মুখে মুতে দিই রে আমি।
ছেলেটা উঠে দাঁড়ায় নিজের কাজের টেবিল চেয়ার ছেড়ে, বেশ লম্বা, রোগা, হাত দুটো সুগঠিত, আর তাতে ধরা একটা তাতাল, সেটাকে নিয়ে পাশের ঘরে ঢোকে। সেই মহিলার গলার শব্দে এবার কাঁপা ভাবটা আরো বেড়ে ওঠে,
তু তুই চলে যা, ছোটোলোকের বাচ্ছা। আমাকে ছ্যাঁকা দিবিনা বলে দিচ্ছি। কাছে আসবি না আমার। ও মা গো। আমায় মেরে ফেলল।
জীভ পুড়িয়ে দেবো একেবারে, সেই ছেলেটার হিংস্র গলা শোনা যায়।
মরো না কেন তুমি? জঞ্জাল কোথাকার। তুমি মরলে আমার হাড় জুড়োয়। দিনরাত্রি খালি খাইখাই। তা খাওয়ার জোগাড়টা করতে হবে তো? আর একবার খাওয়ার কথা বললে পরে না তোমার ঐ জীভ এই তাতাল দিয়ে পুড়িয়ে দেবো।
তা দিবি না, সব রোয়াব ছুটিয়ে দেবো। উকীল ডেকে বাড়ি, ব্যাঙ্কের সব টাকা দিয়ে দেবো রামকৃষ্ণ মিশনকে। আমি মরলে তোকে লাথি মেরে বাড়ি থেকে বার করে দেবে।
রামকৃষ্ণ মিশনের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই তোমার এই একটা পায়রার খোপ তারা নিতে আসবে। চুপ করো তো। নটা বাজলে তারপরে খেতে দেবো। তার আগে খাই খাই করে চ্যাচালে মুখ একেবারে পুড়িয়ে দেবো বলে দিলাম। বজ্জাত মেয়েমানুষ কোথাকার।
ছেলেটা ঘর থেকে বেরিয়ে আবার নিজের ঘরে কাজে বসে।
পাশের ঘর থেকে খেতে দে খেতে দে করে ঘ্যানঘ্যান চলতেই থাকে।
ছেলেটার রোজগার এখন স্মার্ট ফোন, কম্পিউটার, প্রিন্টার, ইত্যাদি সারিয়ে। ছোটবেলা থেকে হাতের কাজ তাকে টানত, আনন্দ দিত। আর বাড়ির টিভি, দেওয়াল ঘড়ি ইত্যাদির মেকানিজম জানার তাগিদে মারও জুটত কপালে।
জ্ঞান হয়ে ইস্তক দেখে এসেছে তার মা বসে বসে টিভি দেখছে, আর তার উপরে চ্যাঁচাচ্ছে। খাওয়ার আসত পাড়ার একটা হোম ডেলিভারী থেকে, অখাদ্য। সকাল বিকেল দু বেলা, সকালে দুধ মুড়ি খেয়ে আজীবন ইস্কুলে গেছে, ফিরে এসে ভাত খেয়ে থালা টিফিন ক্যারিয়ার মেজে ধুয়ে না রাখলে রাতের খাবার দিতে আসা বিশু মামা অবধি দুটো উড়ন চাঁটা দিয়ে দিত। পড়তে খুব একটা ভালো বা খারাপ কিছুই লাগত না। কারণ সারাদিন তার মায়ের চ্যাঁচানো তার চিন্তার অর্ধেক জুড়ে থাকত। আর বাকী অর্ধেক জুড়ে থাকত বিশুমামার মেয়ে মৌসুমি।
এইসব ছেলে সাধারনত ক্লাস টুয়েল্ভ ড্রপ আউট হয়, আর না হলে দাঁতে দাঁত চেপে এমন লেখাপড়া করে যে একেবারে ছাদ ফুঁড়ে আকাশে মাথা ঠেকায়।
ছেলেটা ক্লাস টুয়েলভ ড্রপ আউটই ছিল। কারণ বেশী নাটকীয় কিছু নয়। বিশুমামা তার মায়ের টাকাপয়সা ব্যাঙ্ক থেকে এনে দিত। একদিন বাড়ি ফিরে শুনল তার মা কেমন একটা কুঁই কুঁই করে শব্দ করছে আর বিশুমামার মাথাটা তার নাইটির ভেতর থেকে বার করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। খুব বেশী কিছু করেনি বিশু মামার মাথাটা মায়ের নাইটির ভেতর থেকে বার করে লোহার আলমারির দরজায় একটা প্রবল ধাক্কায় ঠুকে দেয়। আর ঐ ধাক্কাটা আসতে চলেছে এটা বুঝতে পারার পরেই বিশুমামার চোখের আতঙ্কটা ছেলেটা দেখতে পায় আলমারির গায়ে লাগানো আয়নাটায়। তারপরেই প্রচন্ড শব্দ, আলমারির গায়ের কাঁচ ভাঙার শব্দ, বিশুমামার ফাটা কপাল, ফাটা নাক থেকে বেরিয়ে আসা রক্তের ধারা, পিছনে মায়ের চিৎকার। সবমিলিয়ে একটা যাতা ব্যাপার। ঐ রক্তাক্ত ভীত মানুষটাকে দেখতে দেখতে ছেলেটা বুঝতে পারল তার কাঠিন্য। আর বিশুমামাকে ছেড়ে দেওয়ার পর মুহুর্তে সেই দৌড়ে পালানো দেখার পরে বুঝল এবারে তাকেও দৌড়াতে হবে স্নান ঘরের দিকে।
চুড়ান্ত সুখানুভুতির সময় অন্য কিছু চিন্তায় এলো না, শুধু ঐ ভয়ার্ত দুটো চোখ আর তারপরে ঐ রক্ত চোঁয়ানোর দৃশ্য দুটো ছাড়া।
তারপর থেকে বাড়িতেই বেশী সময় থাকত, রান্না বান্না থেকে ব্যাঙ্কের টাকা তোলা সব কিছু করে তারপরে দুপুরের দিকে মোবাইল সারান শেখা শুরু আর সেখান থেকে এই রোজগারে।
ঘটনাটা নিয়ে তারাও বেশী কিছু করেনি, আর বিশুমামাও কিছু করেনি। পাড়ার লোকে জেনেছিল পা পিছলে আলমারির দরজায় মাথা ঠুকে এটা হয়েছে। তবে জল গড়াতেই থাকে লোকের চোখের আড়ালে। রাতে ঘরে বসে যখন কাজ করছে এমন সময় দুটো ছেলে এলো, রাত তখন এগারটা সাড়ে এগারটা হবে,
মোবাইল সারাস?
হ্যাঁ,
এটা দেখতো।
মাথা তুলে দেখল একজনের হাতে একটা সরু ফলার ছুরি, আর অন্য জনের হাতে একটা ব্লেড লাগান ক্ষুর।
বাইরে আয়।
ছেলেটা বাইরে আসে। সাধারণত মস্তানিতে হাতেখড়ি হওয়ার কাজ হচ্ছে এইগুলো। আর তাদের দেখে বা তাদের হাতের অস্ত্র দেখে উল্টো দিকের লোকটা ভয় পাচ্ছে এটা সেই কুচে মস্তান গুলোর রোয়াব বাড়িয়ে দেয়। ছেলে দুটোর মধ্যে যেটার হাতে সরু ফলার ছুরিটা ছিল সে চোখে মুখে একটা হিংস্র ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে বলল,
বিশুদাকে কেলিয়েছিলিস? কেলাবে চল, ওস্তাদ ডেকেছে।
কে ওস্তাদ? বিশুমামা?
অত কথা বলতে হবে না, চল।
ছেলেদুটো প্রথম ও শেষ ভুলটা এক সাথে করল। দুজনেই অন্ধকার রাস্তায় তাদের শিকারকে পিছনে ফেলে আগে হাঁটা ধরল। মস্তানিতে নতুন তো।
বাড়ি ফিরে ছেলেটা স্নানে গেছিল, নিজে এতটা আরাম এর আগে পায়নি। শুধু মনে পড়ছিল দূর থেকে আসা রাস্তার আলোয় দেখা ছেলেদুটোর আতঙ্কিত চোখগুলো। আর ঐ খুলি ফাটার ভোঁতা ঠক ঠক দুটো শব্দ, কানে লেগেছিল, বাথরুমেও।
পরদিন পুলিস যখন দুটো বডি নিয়ে যায় তখন তারা অবাকই হয়েছিল, কারণ মালদুটো তো গণেশের হয়েই কাজ করে। গণেশ ও কিছু হদিশ দিতে পারল না। দুটোরই গলারটুঁটি কাটা, আর কপাল আর মুখ থ্যাঁতলানো। প্রায় কুড়ি ফুট আগে একটা পোস্টে রক্তের দাগ পাওয়া গেছে। আর কিছুই সেরকম নেই।
গণেশ এসেছিল দিন পনের পরে, সেই রাতের বেলায়, তবে দল চালায় তো সব ঘাঁতঘোঁত জানা, তাই সোজাসুজি কাজের কথায় গেল,
বাদল আর খেপুকে তুই টপকেছিস?
আমি ঐ নামে কারোকে চিনি না।
আমি বেশী ন্যাকামো করি ও না পছন্দও করি না, আমি খবর না নিয়ে এত রাতে তোর কাছে মাজাকি মারতে এসেছি?
তাহলে প্রশ্নটা করছেন কেন?
বিশুর সাথে তোর কি হয়েছিল?
কিছু না।
আবার?
আমার মায়ের সাথে জোর করে বাজে কাজ করছিল।
তুই কেলিয়ে ফাটিয়ে দিয়েছিস? গণেশের মুখ চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
ছেলেটা চুপ করে থাকে।
গণেশ মেশিনটা বাঁ হাতে নিয়ে ডান হাতটা কপালের সামনে স্যালুট করার মতো করে ঠেকিয়ে গর্বের সাথে বলে,
স্যালুট। যে ছেলে মায়ের ইজ্জতের জন্য জান লড়ায়, গণেশ তার কেনা গোলাম। তুই কিচ্ছু চিন্তা করিস না। আমি আছি। তোর নাম?
সঞ্জয়।
খুব সাবধানে গণেশ ওকে ব্যবহার করবে বলে চিন্তা করে নিল দালের কাউকে কিছু জানালই না। একরাতে ফোন করল,
সঞ্জয় একটা কাজ করে দিবি? ভালো টাকার খাপ।
কি কাজ?
সব কথা ফোনে হয় না, কাল দুপুরে একবার আসতে পারবি?
কোথায়?
গণেশ ঠিকানাটা বলল,
ঠিক আছে। গেলে আবার মার ধোর দেবে না তো?
দিলে সেদিনই দিতাম, টপকে।
পরদিন নির্দিষ্ট হোটেলে গণেশের সাথে সঞ্জয় মুখোমুখি বসল একটা ঘরে, গণেশ বলল বিয়ার টিয়ার কিছু খাবি?
খাইনা, কাজটা?
বলছি, বলছি
কর্পোরেশনের এক কাউন্সিলারের চামচাকে কড়কানোর একটা কাজ আছে। করবি?
মেরে ফেলতে হবে?
আরে না না, তাহলে তো টপকানর কাজ বলতাম, সুপারি। এটা একটু ধরে কেলিয়ে ফাটিয়ে ফুটিয়ে দিতে হবে, মালটা দুটো প্রোমোটারকে টাকা নিয়ে ল্যাজে খেলাচ্ছে।
পুরো খবর চাই যে, কোথায় থাকে কি করে, সাথে মেশিন রাখে কি না। সাথে বাউন্সার নিয়ে ঘোরে কি না?
গণেশ অবাক ও হয় আবার মনে মনে খুশীও হয়, একবারে পাকা প্লেয়ারদের মতো ভাঁজ মারছে। কে বলবে নতুন?
তুই জোগাড় করে নিবি?
টাকা লাগবে আর দিন পনের সময়।
কড়কাতে অতদিন? আর কত টাকা লাগবে?
খোঁজ খবরের জন্য ত্রিশ হাজার, আর কাজের জন্য পঞ্চাশ।
কেলিয়ে না পোঁদ দিয়ে আটা বার করে দেবো।
সেটা তুমি দিতেই পারো। তাহলে তোমার রেডী ছেলেদের পাঠাও, হ্যা হ্যা করতে করতে বাইক নিয়ে যাবে রুলিং পার্টির কাউন্সিলারের চামচাকে তার পার্টিঅফিসের সামনে রডের বাড়ি মারবে, মিডিয়া পুলিস সব করতে করতে তোমার প্রোমোটার ফাঁসবে, সে তোমায় টানবে, ব্যাস ব্যবসা চৌপট।
আর তুই কি করবি?
তুমি প্রোমোটার দুটোর থেকে টাকা নেওয়ার সময় কি আমার নাম ঠিকানা বলে নিয়েছিলে?
গণেশ হাসে, তারপরে সস্নেহে ওর হাতের উপরে নিজের হাত রেখে বলে,
তোর বুদ্ধির দামই লাখ টাকা, লেগে থাক তোর হবে। বলে টাকা বার করে দেয়।
সঞ্জয় প্রথমে লোকটার গতিবিধি জানার জন্য একটা ডিটেকটিভ এজেন্সির সাহায্য নিল। জানল লোকটা থাকে পিকনিক গার্ডেনের দিকে বটে, তবে ফুর্তি করতে যায় মুম্বাই রোডের একটা ডান্সবার কাম হোটেলে। বাঁধা ডান্সওয়লি আছে তার সাথে শোয়।
সঞ্জয় দিন দুই ঘুরে ঘুরে সব জায়গা রেকি করল। মেয়েটাকে চিনল। তারপরে সেই হোটেলের একটা বেয়ারাকে টাকা দিয়ে হাত করে তার একসেট পোষাক কিনে নিল। তারপরে বেয়ারার পোষাক পরে এক সন্ধ্যায় ডান্সবারের দোতলাটা ঘুরে দেখল ঐ বেয়ারাটার সাথে।
ফাইনাল দিনে লোকটা যখন তার বান্ধবীকে নিয়ে ঘরে ঢুকল সঙ্গে সঙ্গে একটা বেয়ারা হাতে একটা রুম ফ্রেসনার আর টয়লেট ক্লীনারের বোতল নিয়ে দরজায় নক করল, বিরক্ত মুখে দরজা খোলার সাথে সাথে সেই বেয়ারাটা বলল, সরি স্যার বাথরুমে একটু কমপ্লেন আছে, এখুনি হয়ে যাবে। এই বলে ঘরে ঢুকেই রুম ফ্রেসনারের বোতল থেকে সরাসরি সেই ডান্স বারের নর্তকীর চোখে মুখে স্প্রে করে দিল। চমকটা কাটার আগেই টয়লেট ক্লীনারের বোতল থেকে মিউরেটিক অ্যাসিড সোজা সেই লোকটার মুখে চোখের দিকে লক্ষ করে ছুঁড়ে দিল।
তারপরে নিজের পকেট থেকে একটা ক্লোরোফর্মের শিশি বার করে একটা রুমালে দিয়ে ছটফট করতে থাকা মেয়েটার আর লোকটার মুখে চেপে ধরল।
রুমের দরজা বন্ধ করে সোজা সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে হোটেলের গাড়ী রাখার জায়গাতে এসে নিজের গোঁফটা খুলে আর গ্লাভসটা খুলে পকেটে রাখল। সেখান থেকে মুম্বাই রোড। ভাড়া করা গাড়ি তাকে নিয়ে যখন তার বাড়ি ফিরে এলো তখন রাত মাত্র বারোটা।
0 comments: