ভৌতবাক - দীপারুণ ভট্টাচার্য
Posted in ভৌতবাক
ভৌতবাক
রঞ্জন ডাক্তার
দীপারুণ ভট্টাচার্য
গ্রামের নাম কবিরহাট। সেযুগে কি কবিগানের লড়াই হতো এখানে! রঞ্জন ডাক্তার এসব জানে না। মাস কয়েক হল ডাক্তার রঞ্জন রায় শহর ছেড়ে এই গণ্ড গ্রামে এসেছেন ডাক্তারী করতে। মেডিকেল কলেজ থেকে ডিগ্রি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে অবশ্য শহরের বড় হাসপাতালে কাজ পেয়েছিল। বহু কষ্টে মাস ছয়েক কাজ করেও ছিল সে। কিন্তু আর পারলো না। রোগীদেরকে অকারণে এক গাদা টাকার ওষুধ দেওয়া বা দামি দামি টেস্ট করানো তার অদৌ পছন্দ নয়। সে কিভাবে জানবে যে এই স্বভাবটাই তার বিরুদ্ধে যাবে। একদিন তাকে আলাদা ঘরে ডেকে হাসপাতালের কিছু প্রবীণ ডাক্তাররা বলে দিল, "আমাদের কথা মতো যদি কাজ করো তো ভালো নইলে, রুগীর আত্মীয় স্বজন সাজিয়ে গুণ্ডা লেলিয়ে তোমার হাড় মাংস এক করে ছাড়বো।" এরপরই সে আবেদন করে গ্রামের হাসপাতালের জন্য। লোকে গ্রাম থেকে শহরে যায় আর রঞ্জন চলল গ্রামে! খবরটা জানাজানি হতেই বন্ধু আর পরিচিত মহলে একটা ডাক নাম পেলো সে, "বোকা রঞ্জন"। অবশ্য এতে রঞ্জন চিন্তিত নয়।
গ্রামে অবশ্য মাসখানেকের মধ্যেই বেশ জমিয়ে নিয়েছে রঞ্জন। এখানে তেমন ওষুধপত্র নেই, নেই যন্ত্রপাতিও। তবুও রঞ্জন তার সেবা দিয়ে গ্রামের মানুষের মন জয় করেছে। গ্রাম প্রধান সুকুমার মন্ডল তো সেদিন বলেই ফেলল, "ডাক্তার সাহেব, গেরামে অনেক সমস্যা। তাই কেউ থাকতে চায় না। সব ডাক্তাররাই পাইলে যায়। আপনি থাকেন, আমরা বুক দিয়া আপনারে আগলামু।" বিষয়টা সেদিন ঠিক বুঝতে পারেনি রঞ্জন তবে সরল মানুষদের জন্য কাজ করতে তার ভালো লাগছে। হাসপাতালে যতক্ষন রোগী থাকে সে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের চিকিৎসা দেয়া। এক এক দিন ঘরে ফিরতে অনেক রাত হয় তার। তারপর ও রাত বিরাতে ডাক পড়ে। গত দুই সপ্তাহে মাঝরাতে খবর পেয়ে সে তিন তিনটে রোগীকে বাঁচিয়েছে। একজন বিষ খেয়েছিল অন্য দুজনের সাপের কামড়। এক এক সময় তার মনে হয় সে আসার আগে কিভাবে চলতো কবিরহাটের চিকিৎসা ব্যবস্থা!
আজ সন্ধে থেকে বেশ বৃষ্টি হচ্ছে। গ্রামের পথ ঘাট খুবই নির্জন। একটু তাড়তাড়ি ঘরে এসে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে রঞ্জন সবে খেতে বসেছে এমন সময় টেলিফোনটা বেজে উঠলো। সে খেতে খেতেই ফোন ধরলো, "কি হয়েছে ... বিষ খেয়েছে ... নিয়ে আসুন না… কি, আনার কোন ব্যবস্থা নেই ... হাসপাতালে আনতে পারবেন… আচ্ছা আচ্ছা, আমি আসছি…কি ঠিকানা…ও আচ্ছা ঠিক আছে…এই মিনিট দশেক!" টেলিফোন রেখেই রঞ্জন উঠে হাত ধুয়ে আবার জামা কাপড় পরে মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যায়।
বড় রাস্তা দিয়ে কিছুটা পথ যাওয়ার পরই রঞ্জন বাদিকের একটা কাঁচা পথে ঢুকে পড়ে। মোটরসাইকেলের আলোয় যা দেখা যাচ্ছে সেই টুকুই যেন সত্যি। বাকি সবটাই যেন অন্ধকার। হালকা হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। এদিক ওদিক থেকে ডাকছে হাজারো কোলাব্যাঙ। মোটরসাইকেলের চাকা চলেছে কাদা ভরা রাস্তা দিয়ে। মাঝে মাঝেই সে রাস্তায় খানা খন্দ। পড়ি কি মরি করে রঞ্জন চলেছে কোনো এক বিষ খাওয়া রোগীকে বাঁচাতে। দুইদিকের ধান ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে রাস্তা সরু থেকে আরও সরু হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ রাস্তায় একটা সাদা চাদর উড়তে দেখে রীতিমতো অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে যাচ্ছিল রঞ্জন। কোন রকমে নিজেকে আর মোটরসাইকেল সামলে সে দাঁড়ায় রাস্তার উপর। চাদর নড়া বন্ধ হলে রঞ্জন দেখে লুঙ্গী পরা একটা লোক রাস্তার কাঁদায় দাঁড়িয়ে আছে। তার খালি গা। মাথার চুল এলোমেলো। আর চোখ দুটো যেন জ্বলন্ত কয়লার মতো লাল হয়ে আছে।
রঞ্জন দাঁড়িয়ে যেতেই লোকটা বলল, "মোটরসাইকেল আর যাবে না…" বলেই সে তার ডান হাতটা তুলে দূরের কি যেন একটা দেখায়। সেদিকে তাকিয়ে রঞ্জন দেখে দূরে বাগান ঘেরা একটা বেশ বড় বাড়ি দেখা যাচ্ছে। তার মনে পড়ল টেলিফোনে লোকটা বলেছিল পথে একজন লোক থাকবে। যাক, ভালোই হয়েছে। মোটর সাইকেলটাকে রাস্তায় রেখে রঞ্জন তার ওষুধের ব্যাগটা নিয়ে সরু আলের উপর দিয়ে ছুটতে লাগলো ওই বাড়িটার দিকে। তার হঠাৎ মনে হল ওই লোকটা কেন আসছেনা! চিন্তাটা আসতেই পেছন ফিরে দেখলো রঞ্জন, কই লোকটা কে তো দেখা যাচ্ছে না!
বাড়িটার ভিতরে খুব সামান্য একটা আলো জ্বলছিলো। টেলিফোনে লোকটা নাম বলেছিল, মিজান। উঠানে পৌঁছে রঞ্জন ডাক দিল, "মিজান, মিজান আছো নাকি।" হঠাৎ কে যেন কেঁদে উঠলো ঘরের মধ্যে। মনে হল যেন মহিলা কন্ঠ। তবে কি দেরি হয়ে গেল। রোগী কি আর বেঁচে নেই! ভাবতে ভাবতে রঞ্জন নিজেই গিয়ে ঢুকলো ঘরের মধ্যে। একবার যেন তার মনে হলো, বাড়িটার দরজা জালনায় কোন পাল্লা নেই। ভালো মতো কিছু বোঝার আগেই সে লক্ষ্য করলো একজন খাটে শুয়ে আছে। শরীরটা সম্পূর্ণ চাদরে ঢাকা। ঘরের কোনায় একটা হালকা আলো জ্বলছে। তাতে ঘরের পুরোটা দেখা যাচ্ছে না। তবু যেন মনে হচ্ছে দেওয়ালটা নোনা ধরা। নাকে একটা বোটকা গন্ধ আসছে রঞ্জনের। যে কাঁদছিলো তাকে কোথাও দেখতে পায়না রঞ্জন। মোবাইলের আলো জ্বেলে এদিক ওদিক তাকাতেই রঞ্জন দেখে ঘরের কোনায় একজন মহিলা মাটিতে বসে আছে। তার উপর আলো ফেলতে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে মহিলাটি। কেঁদে কেঁদে সে বলে, "সে আর নেই ডাক্তার সাহেব…সব শেষ!"
নিজেকে অপরাধী মনে হয় রঞ্জনের। হয়তো আর একটু দ্রুত এসে লোকটাকে বাঁচানো যেত! তবুও সে মৃত রোগীর কাছে এগিয়ে যায়। হঠাৎ বাইরে ঝমঝম শব্দে বৃষ্টি পড়তে শুরু করে। তার সঙ্গে তুমুল ঝড়। রঞ্জন মৃত রোগীর মুখের চাদর সরিয়ে দিতেই তার বুক শিউরে ওঠে। কুৎসিত দেখতে লোকটা বীভৎস মুখ করে মরে আছে। তার লাল জিভটা মুখের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসেছে। জিভের উপর শক্ত করে বসেছে দুটো দাঁত। আর রক্তে ভেসে গেছে বিছানা। এমন মৃত্যু রঞ্জন কোনদিন দেখেনি। নাড়ি দেখবে বলে হাত বাড়িয়ে দিল রঞ্জন। হঠাৎ দপ করে ঘরের ছোট্ট আলোটা নিভে গেল। মৃতের হাত অনুমান করে চাদরের তলায় হাত দেয় রঞ্জন। এমন সময় সেই মৃত রোগীটা একটা দম ফাটা চিৎকার করে ওঠে। রঞ্জন হঠাৎ ঘাবড়ে গিয়ে কয়েক হাত দূরে ছিটকে পড়ে। আর তখনই তার গায়ের উপর কি যেন একটা পড়ে কিলবিল করতে থাকে। রঞ্জন বুঝতে পারে সেটি একটি বিষধর সাপ। তাড়াতাড়ি গা ঝাড়া দিয়ে উঠতেই সাপটা মেঝেতে পড়ে কোথায় যেন চলে যায়।
মৃত রোগী ততক্ষণে খাটের উপর উঠে বসেছে। তার মুখ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। চোখ দুটো জ্বলছে লাল হয়ে। তার দমফাটা চিৎকারে চমকে গিয়ে রঞ্জন পিছু হাটতে শুরু করে। একটু পরে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তার। সেই মৃত রোগী ততক্ষণে খাট ছেড়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসেছে রঞ্জনের দিকে। তার দুই হাত দিয়ে সে চেপে ধরেছে রঞ্জনের গলা। বহু চেষ্টা করেও রঞ্জন তাকে আটকাতে পারছে না। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। একম অমানুষিক শক্তির মুখোমুখি সে কখনও হয়নি। চিৎকার করতে চায় রঞ্জন। কিন্তু মুখ দিয়ে একটুও আওয়াজ করতে পারে না সে। এমন সময় এক প্রবল শব্দে কোথায় যেন ঘন্টা বাজতে আরম্ভ করে। রঞ্জন বুঝতে পারে তার শেষ ঘন্টা বেজে গেছে। তবুও প্রাণপনে সে তার গলার বাঁধন খুলতে চায়। এমন সময় তার তলপেটে আছড়ে পড়ে এক নির্মম আঘাত। কেউ যেন লাথি মারছে, একের পর এক।
প্রায় শ্বাস বন্ধ হয়ে অজ্ঞান হওয়ার আগের মুহূর্তে রঞ্জন শুনতে পায় বাইরে কয়েকজন লোকের চিৎকার। হঠাৎ তার গলার থেকে সেই হাতটা সরে যায়। তারপরই কয়েক জনের দৌড়ে যাওয়ার শব্দ শোনে রঞ্জন। এর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ঘরে কারা যেন প্রবেশ করে। একজন চার ব্যাটারির টর্চের আলো ফেলে রঞ্জনের মুখে। অন্যজন চিৎকার করে ওঠে, "এইতো ডাক্তার সাহেব।" বাকিরা রঞ্জনের অবস্থা দেখে আঁতকে ওঠে। অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগের মুহূর্তে রঞ্জনের যেন মনে হয় সুকুমার মন্ডল তার পা জড়িয়ে ধরে বলছে, "আমাদের ভুল বুইঝো না ডাক্তার।"
গ্রামের লোকের নিরলস সেবায় দিন কতক বাদে সুস্থ হয়ে ওঠে রঞ্জন। সকলের সঙ্গে কথা বলে সে বুঝতে পারে, গ্রামের হাসপাতালে তার আসার ফলে এলাকার হাতুড়ে ডাক্তারের ভাত মারা যাচ্ছিলো। এর আগের এক ডাক্তারকেও তারা এভাবেই ওই ভাঙা বাড়িতে ডেকে নিয়ে ভয় দেখায়। ডাক্তারটি সেখানেই হার্টফেল করেছিল। রাতের রাস্তার সেদিন রঞ্জনের মোটরসাইকেল দেখতে পেয়ে হারান মোল্লা গ্রামের লোকদের খবর দেয়। দুইজন অভিযুক্ত হাতুড়ে ডাক্তার ইতিমধ্যেই পুলিশের হাতে পড়েছে। বাকি অভিযুক্তরা পালিয়েছে গ্রাম ছেড়ে।
0 comments: