0

গল্প - সনাতন সিংহ

Posted in


গল্প


শেষ রাগিনীর বীন
সনাতন সিংহ 

ঝমঝম করে বৃষ্টি সুরু হল।ট্রেনের ভেতরটা অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে। সব জানালা বন্ধ। কাচের গা বেয়ে জল নামছে গলগল করে।মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলক বাইরেরটা হঠাৎ আলোকিত করে আবার গভীর অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে। বাজ পড়ার শব্দ হৃদপিণ্ডের কম্পনকে চাপিয়ে উঠছে। বাতাসের কাছে গাছপালা মাথা নোয়াচ্ছে। দমকা হওয়া আজ যেন পাগল হয়ে উঠেছে।

কেউ কেউ আবার বাজ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কপালে হাত ঠেকাচ্ছে বারবার।

এদিকে কপালে ঘাম জমে উঠছে পুরবীর। কলিগদের সঙ্গে কথা বললেও সে মনে মনে ভাবছে...
ছাতায় এই মুষলধারা আটকাবে না কিছুতেই। ভিজেই বাড়ি ফিরতে হবে। নৌকা পাওয়া যাবে কিনা কী জানি !

এমন দিনগুলোতে কার প্রাণের মায়া নেই? এমন দুর্যোগে নৌকা থাকে না বললেও হয়। মাঝে মাঝে সে ওই পথেই ফেরে ।

কি করে বাড়ি ফিরবে ভাবতে ভাবতে ট্রেন চুপিসাড়ে প্লাটফর্মে এসে দাঁড়াল।
হুড়মুড়িয়ে নামতে গিয়ে খানিকটা ভিজেই গেল সে।

নৈহাটি জংশন। ছাতা ভেঙ্গে শেডের তলায়। গা গলানো কঠিন।জল ঝড় থেকে বাঁচার জন্য বিভিন্ন ট্রেনের যাত্রী গাদাগাদি করে শেডের তলায়।কিন্তু এই সময় তো আপ ব্যান্ডেল লোকাল থাকে।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ট্রেন আসতে তো দেরি আছে।মাইকের ঘোষণা কানে আসে... ব্যান্ডেল লাইনে গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়ায় আপাতত ব্যান্ডেল লাইনে আপ ডাউন কোনো ট্রেন চালানো সম্ভব নয়।

আধঘন্টা হলো ট্রেন চলাচল বন্ধ। না আর সে বসে থাকতে পারবে না। লাস্ট নৌকা এখনও ছাড়তে দেরি আছে। কখন ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হবে কে জানে। বাড়ির সবাই চিন্তা করবে।

কলিগরা বলেছিলেন তাদের সঙ্গে যেতে, এই দুর্যোগের রাতে নাই বা সে বাড়ি ফিরল।তার বাবা মাকে ফোন করে জানিয়ে দিলেই হতো।এখন নেমেও দিপদ বাড়ল আরো বুঝি। এদিকে ডাউন ট্রেনটা ও ছেড়ে চলে গেছে।আর কোনো ট্রেন ও আসছে না যে কোনো দিকে দিকে কলিগদের বাড়ি সে চলে যাবে। রাস্তায় ও বিপদের সম্ভবনা কম নয়। গাড়ি করেও যে যাবে তাতে রাস্তাও যদি এরকম বন্ধ হয়ে যায়!মাথা কাজ করছে না তার।

কিছুক্ষণ পরে আবার ঘোষণা হয়... ওভার হেডের তার ছিঁড়ে যাওয়ায় সমস্ত রুটে ট্রেন চলাচল আপাতত বন্ধ আছে।

না আর অপেক্ষা নয়। পূরবী পা বাড়াল রাস্তার দিকে।

বৃষ্টির সঙ্গে ঝড়টাও কমেছে খানিকটা। রাস্তায় লোকজন কম। রিকশাও গোটা তিনেক দাঁড়িয়ে আছে। নৌকা থাকলে চলতে পারে বোধহয়।একটা রিকশা নিয়ে ঘাটের দিকে এগিয়ে চলল।

আজ আর সেই কুকুরগুলোকে সে দেখতে পাচ্ছে না। প্রায় দিন এপথে ফেরার সময় সে তাদের বিস্কুট খাইয়ে ঘাটের দিকে যায়। তাদের সঙ্গে তার কোথায় একটা সখ্যতা গড়ে উঠেছে।
কিন্তু এখন তাদের কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। অবশ্য অন্য দিন হেঁটে যায়।কিন্তু আজ বিপদ মাথায় নিয়ে কে বা হেঁটে যাবে।
পেটের থেকে প্রাণের মায়াও কম নয়!
তাই তারাও আজ কোথাও মাথা গুঁজে আছে।


এদিকে রাস্তায় আলো কম বটে। কিন্তু লোকের আনাগোনা অন্য দিনের তুলনায় খুব কম।দু একজন ছাতা মাথায় যাতায়াত করছে ঠিকই। কিন্তু ভয়টা বেশ জাঁকিয়ে বসেছে তার মনে।নৌকা পাবে তো?
....দিদি নামুন।
.....কত দেব?
.....ত্রিশ টাকা।
অন্য দিন দশ টাকা নেয়।পূরবী কোনো কথা না বলে টাকা দিয়ে দেয়।
এক পা,দু পা করে ঘাটের দিকে এগিয়ে যায়।
......হা। নৌকা বাঁধা আছে।ঘাটের ছাউনি নীচে জনা পাঁচেক কালো কালো মূর্তি দেখাও যাচ্ছে। একটু ভরসা জাগে তার মনে।সেখানে পৌঁছাতেই এক মাঝ বয়সী মহিলা বলেই ওঠে কাতর স্বরে ...
এবার ছাড়ুন না দাদা।
আমরা আর কতক্ষণ বসে থাকব ?চলুন না দাদা ,ঝড় বৃষ্টি দুইই তো কমে গেছে।মনে হয় আর বিপদের ভয় নেই।

সবাই অনুনয় বিনয় করতে মাঝির কেমন একটা মনে হল। ওপারে যাবে না বলে বসে ছিল।তার বাড়িও ওপারে। কিন্তু উত্তাল নদীর বুকে প্রাণ দিতে হবে?এই ভয়ে বসেই ছিল।

আজ আর কোনো লাস্ট নৌকা নয়।লাস্ট নৌকা যার এখান থেকে যাওয়ার কথা সে এপারে এসেই পৌঁছায় নি।সে কি তবে আসার সময় মাঝ নদীতে ...
ভাবতেই তার গলা শুকিয়ে এল। সেই ভয়ও তাকে এতক্ষণ
আষ্টে পিষ্ঠে চেপে ধরে ছিল।

...উঠে পড় গো সবাই। জয় মা ভবানী।
কয়েকবার প্রণাম ঠুকেই দড়ি খুলেই মোটর চালিয়ে দিল। কিন্তু গতি কমিয়ে ভেসে চলল ওপারের দিকে।

নৈহাটির এই ঘাট থেকে ওপরে যেতে খুব বেশি সময় লাগে না। কিন্তু ঝড়ের প্রভাবে নদীর উত্তাল জলরাশি প্ৰতি মুহূর্তে বাধা দিতে থাকে।ঝড়ের গতিবেগ মাঝে মাঝে কমে আবার দমকা মোচড় দিলেও আগের মত ভয়ঙ্কর নয়।
পূরবী একহাতে নৌকার কাঠ চেপে ধরে বসে। অন্য হাতে ওই মহিলার হাত ধরে।
ছাইনি ভেতরে বসেছে সবাই।থেকে থেকে একটা শক্ত হাত ওর পিঠে ওঠা নামা করছে।থেকে থেকে বিদ্যুৎ ঝলকে পূরবী সেই মুখের দিকে তাকিয়ে আড়ষ্ঠ হয়ে উঠছে।মহিলার দিকে ও আরোও সরে সরে বসছে।

চেঁচিয়ে বা কিছু বলে লাভ হবে না ওরা মাত্র দুজন মেয়ে বাদ বাকি পুরুষ। আর এটুকু পার হলেই হয়। 
না আর ওই শক্ত হাত ওঠা নামা করছে না।কিন্তু ঝড়ের গতিবেগ বেশ বেড়েছে।না যে যাত্রায় হয়তো আর বেঁচে ফিরবে না কেউ।
নৌকা দুলতে দুলতে শুরু করেছে ভয়ঙ্কর ভাবে। হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টির ফোঁটা এসে তীরের মতো বিঁধেছে গায়ে। 
মহিলাও তাকে সজোরে চেপে ধরে আছে।ভয় আর ভাবনা কেমন আসছে আর যাচ্ছে।মাত্র কয়েক মাস হল্র স্কুলের চাকরি পেয়েছে।বাড়িতে বাবা আর মা। দিদির বিয়ে হয়ে গেছে বছর পাঁচেক। তার একটা ছোট্ট ফুটফুটে সাত মাসের মেয়ে আছে। সবার মুখগুলো খুব এখন বেশি বেশি করে মনে পড়ছে। কাল থেকে আর হয়তো দেখতে পাবে না সে। চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে তার চিবুক বেয়ে।ওড়না দিয়ে মুছে নিচ্ছে নিলেও তবু বাধ মানছে না।মাঝি ভয়ে বিক্রমে আরো আরো জোরে জোরে প্রার্থনা করতে লাগলো....জয় মা ভবানী।জয় মা ভবানী। জয় মা ভবা...
সহযাত্রী অন্য পুরুষরাও তার সাথে গলা মেলাল.....জয় না ভবানী।জয় মা ভবানী....

হঠাৎ ভয়ে কেউ আর কারো সাথে কথা কইছে না। এমনকি গা ঘেঁষে বসা মহিলাটিও মুখ দিয়ে কোনো কথা সরল না।

এখন প্রায় মাঝ নদী ছাড়িয়ে এসছে। ওপারে পৌঁছবে কিনা তা মা গঙ্গাই জানে।
এই কয়েক মাসে স্কুলের ছাত্রদের সাথে, কলিগদের সাথে, এমনকি একজনের সাথে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
চোখের সামনে সেই সেদিনের ছবিটা ভেসে উঠছে......ব্যারাকপুরের এক ট্রেনের সহযাত্রীর বাড়ি।তাঁর ছেলের জন্মদিনের অনুষ্ঠান। জনা সতেরো হবে ওই কম্পার্টমেন্টের সহযাত্রী সবাই এসেছে। হাসি হুল্লোড় জমে উঠেছে। 
অন্য স্কুলের এক ম্যাডাম হঠাৎ গান ধরলেন।
অনুষ্ঠানের রং বদলে গেল।
অন্য এক সহযাত্রী পেশাগত ব্যাংককর্মী সেই পরিচিত হকারের গলা নকল করে চেঁচিয়ে উঠল...
দড়ি । এ সেইইই দড়ি।
হাসির ফোয়ারায় মুখিরিত হতে লাগলো আলো ঝলমল সন্ধ্যা।
একজন শুরু করলো আবৃত্তি... 'কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি'...
এমন আনন্দঘন মুহূর্তে পূরবী নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি ।গেয়ে উঠলো...
এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু।
এভাবে কতক্ষণ কাটলো তা কেউ খেয়াল করেনি।
কিন্তু সবাইকে ফিরতে হবে।খেয়ে বাড়ি ফেরার পথে পূরবী তার সেই বিশেষ জনকে প্রথম তার মনের কথা জানায়।প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করে লজ্জ্বায় অন্য সহযাত্রী ম্যাডামদের কাছে দৌঁড়ে গিয়েছিল।
সেই না ফোটা কুঁড়ির আজ বুঝি সলিল সমাধি হবে।


...ঝড় থেমেছে!ঝড় থেমেছে।
সবাই আবার জোরে চেঁচিয়ে ওঠে ... জয় মা ভবানী। জয় মা ভবানী।
ওই তো ঘাট দেখা যাচ্ছে। আর ফুট পঞ্চাশ গেলেই তারা এ যাত্রায় বেঁচে যাবে।

তীরে এসে নৌকা ভিড়লো। সভাই নেমে পড়ল।
প্রাণ ফিরল।

কেউ আর দাঁড়াল না।শুধু ওই মহিলা একবার পুরবীর হাত দুটো ধরে বলল...... সাবধানে যাস মা।
কি জানি তিনি হয়তো কিছু অনুমান করেছিলেন কিনা!
ঘাটে ছাউনির আলোটার করুন অবস্থা।নিজেই যেন ঘুমিয়ে আছে। মুখগুলো ভালো করে দেখাও গেল না।
রাস্তায় উঠে সে থমকে গেল। একটা কিছু নেই যে যাতে করে সে বাড়ি ফিরবে। প্রায় তিন কিমি রাস্তা। রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের আলো কোনোটা আছে। কোনোটা নেই।নদীর গা ধরে প্রায় দেড় কিমি রাস্তা। একা মেয়ে সে যাবে কি করে ? ভয়ে শরীর শীতল হয়ে উঠছে।সঙ্গে নৌকার সেই লোকটার শক্ত হাতের.....ভাবতেই গা ঘিনিয়ে উঠে।

ঘাটের কাছাকাছি কয়েকটা বাড়ি আছে বটে।কিন্তু একটু এগোলেই প্রায় নেই বলে হয়। কিছুটা দূরেই একটা বাগান আছে। তার গা'টা ভয়ে কাঁটা দিচ্ছে,সঙ্গে ভিজে জামার শিরসিরানী যেন সহচর হয়ে তা আরো বাড়িয়ে তুলল।
আর নয়। ওড়না কোমরে গিট দিয়ে ছাতা খাটিয়ে নামল রাস্তায়।

বৃষ্টি পড়ছে টিপ টিপ করে। ঝড় প্রায় থেমে গেছে।মেঘের ডাক এদিকে আরো বেশি বেশি যেন শুরু হয়েছে।

নদীর জলের ঠান্ডা হাওয়া বাঁধানো পাড়ে ধাক্কা দিয়ে ভিজে কাপড়ে কামড় দিচ্ছে।
ব্যাগটা বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে দ্রুত পায়ে পা চালালো।বড় নির্জন রাস্তা ।ব্যাগের মোবাইলটা বেজে বেজে থেমে গেল।বেশ কিছুটা এগিয়েও এসেছে।রাস্তার গর্তে জমা জলে ঝপাস করে মাঝে মাঝে পা পড়ছে।
বাগানটার কাছে এসেই গা টা ছমছম করছে। ভয়ে পা কেঁপে কেঁপে মাটি ছুঁয়েই যেন আতঙ্কে থাকতে চাইছে না।মোবাইলটা আবার বাজতে শুরু করেছে।
জোরে জোরে বাজ পড়ার আলোয় চারিদিক মাঝে মাঝে আলোকিত হচ্ছে। তার মনে হল কেউ যেন তার পিছু পিছু আসছে।
ঠিক তাই। হাতের ছাতা ভয়ে গেল খসে।ব্যাগটা জাপ্টে ধরে দৌড় দিতে শুরু করল। হা , লোকটাও তার পিছু পিছু দৌড়তে শুরু করেছে।
পূরবীর পা কোথায় পড়ছে কে জানে। দৌড় আরো জোরে দৌড়।
বাগানের ভেতর দিয়ে রাস্তা ।দুপাশের গাছ ছাতার মত রাস্তা ঢেকে আছে। প্রাণপনে দৌড়।পায়ে পা জড়িয়ে আছড়ে পড়ল সে রাস্তার উপর। ডান হাতের কুনুই জ্বালা করছে।তবু উঠে পড়ে দৌড়।পা ব্যথা করছে।বাগান সবে ককে।আবার নদীর পাড়।পায়ের পেশী যেন পিছু টানছে।
ততক্ষণে লোকটার হাত এসে পড়ল তার পিঠে।আঁতকে উঠল পূরবী। নৌকার সেই লোকটা।হাতের টানে চুড়িদারের কিছুটা অংশ ছিঁড়ে গেল তার মুঠোয়।হাতের ব্যাগ গেল ছিটকে নদীর বাঁধানো পাড়ের ঢালে।ব্যাগের মোবাইল বাজতে বাজতে গড়িয়ে পড়ল জলে।

সর পেছন থেকে জাপ্টে ধরল পুরবীকে।ছটপট করে হাতের নাগপাশ থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলে সে পেরে উঠছে না।লোকটা 
দুই হাত ধরে টানতে টানতে তাকে নিয়ে যাচ্ছে বাগানের দিকে।গোড়ালি দুটো রাস্তার ক্ষয়ে যাওয়া ইঁটের কানায় লেগে চিরে জ্বালা করছে।
পূরবীর কাতর আকুতি......
আমাকে ছেড়ে দিন। আপনার পায়ে পড়ি।আমাকে ছেড়ে দিনননননননন.......
তার আর্তনাদ যেন বাজ পড়াকে চাপিয়ে যাচ্ছে।
লোকটা যেন আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে।

বাগানের কাছেই এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল পুরবীর উপর।মাটিতে ধস্তাধস্তি চলল কিছুক্ষণ।ওড়নাটা খুলে ফেলল তার কোমর থেকে। গায়ের জামাও টান মেরে হেঁচকা টানে ছিঁড়েছে।
পুরবীর প্রতিরোধ হার মানতে শুরু করল।তার কান্না আওয়াজ ছাপিয়ে গেল বৃষ্টি পড়ার শব্দকে।
লোকটা কামড়ে কামড়ে তার সারা শরীরে ক্ষত চিহ্ন এঁকে দিতে লাগলো।বিষ ঢাললো পুরবীর শরীরে।

মুষলধারায় বৃষ্টি শুরু হল আবার । সারা শরীরের যন্ত্রনা আত্মশক্তিতে যেন তাকে টেনে তুলতে চাইছে।মাথার ক্লিপে হাত পড়ল তার। টান মেরে খুলে সে।শক্ত করে চেপে ধরল ডান হাতের তালুতে।

লোকটা তখন আত্মতৃপ্তিতে মগ্ন।পুরবীর শরীরের উপর বসে।দাঁড়িয়ে উঠছে ।পূরবী ক্লিপটা সজোরে ফুটিয়ে দিল তার মুখে।যন্ত্রনায় চিৎকার করে পুরবীকে আঘাত করছে।পূরবী দুই হাত দিয়ে আটকাতে আটকাতে হঠাৎ তার হাতের ক্লিপটা ফুটে গেল লোকটার চোখে।তীব্র যন্ত্রনায় লোকটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
এখন পূরবী আর যেন পূরবী নয়..... '
মহামেঘপ্রভাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভুজাং
কালিকাং দক্ষিণাং মুণ্ডমালা বিভুষিতাং।

লোকটা যন্ত্রণায় পাগলের মতো ঘাটের দিকে পালাতে চাইল।তাকাতে পারছে না। রাস্তার গাছে ধাক্কা লেগে আছড়ে পড়ল মাটিতে। পূরবী টলতে টলতে তার পিছু নিল।তাকাতে পারছে না ঠিক করে এক চোখে তাকিয়ে দৌড়তে চাইলেও যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে।
নদীর পাড় ধরে দুটো অবসন্ন শরীর টলতে টলতে চলেছে।
এখন পূরবীর ভয় নেই। বাড়ির, স্কুলের কারোর কথা মনে পড়ছে না।শরীরের যন্ত্রনা, সম্মান হারানোর বেদনা কোথায় উবে গেছে।
দূরে কোথাও আলো জ্বলছে না।দুটো ছায়া শরীরের আত্মরক্ষার আর প্রতিঘাতের ক্লান্ত লড়াই চলছে। 
নদীর পাড়। পূরবী লোকটাকে ধাক্কা দিল। ছিটকে গিয়ে পড়ল পাড়ে। ঢাল বেয়ে গড়িয়ে যেতে লাগলো জলের দিকে। তার আর্তনাদ জলে তলিয়ে গেল।

সারা চরাচর শান্ত হয়ে অন্ধকারে মুখ লুকিয়েছে।কেউ কোথাও নেই।চিৎ হয়ে পূরবী শুয়ে পড়ে মাটি মায়ের বুকে। কান্নায় বুকটা ফেটে যেতে চাইছে । কেউ নেই, কিছু নেই।কতক্ষণ পড়ে রইল কে জানে। এখন সে কোথায় যাবে?
প্রায় অনাবৃত শরীর তার।বাড়ি ফিরবেই বা কোন মুখে?

ধীরে ধীরে উঠে পড়ল সে। কত রাত হলো তা সে ঠাওর করতে পারল না।
টলতে লাগল। পা যেন তাকে টেনে নিয়ে চলল ঘাটের দিকে।
আলো কোথাও নেই। আকাশে মেঘের মিছিল ভেসে চলছে। ধীরে ধীরে নেমে এল ঘাটের শেষ ধাপে, যেখানে গঙ্গার স্রোত বয়ে চলেছে নিজের গতিতে।পা ঝুলিয়ে বসল জলে। বুকে,পিঠে জল এখন টপে টপে পড়ছে তার আলুথালু চুল থেকে।

বৃষ্টির পর গঙ্গার জল ফুলে ফেঁপে উঠেছে।
তার মায়ের আর বাবার মুখটা এখন খুব খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে অঝোর ধারায়।সমস্ত জগৎ যেন তার কাছে কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে।
মা গঙ্গা যেন তাকে হাত বাড়িয়ে ডাকছে।জলের শব্দে সে যেন শুনতে পাচ্ছে... 'শঙ্কর মৌলী বিহারিণী বিমলে /মম মতি রাস্তাং তব পদকমলে।'
ঝপাস করে একটা শব্দ মিলিয়ে গেল স্রোতের টানে।

0 comments: