ধারাবাহিক - ফাল্গুনি ঘোষ
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
বইপাড়ার তন্ত্রধারক - ৫
ফাল্গুনি ঘোষ
এই মানুষটির প্রতি বইপাড়ার লোকজনের পছন্দ এবং অপছন্দ - দুইই প্রবল। আর দুয়েরই সংগত কারণের অভাব নেই। তবে আজ এঁকে নিয়ে লেখার কারণ এই যে, এঁর সঙ্গে কাটা অন্য এক সময়ের কথা মনে পড়ে গেল। রমানাথ মজুমদারের এক দোতলার টঙের ঘরে এঁর বাস। মানে ওই দুপুর থেকে সন্ধে অব্দি আরকি ! তবে দুপুরটাও বেশ অদ্ভুত। কারণ স্বঘোষিত ভাবে বারোটায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও অঘোষিত ভাবে শুরু হয় আড়াইতে তিনটেয়। আড্ডা আর প্রকাশনজগতের টানে আমিও তখন কিছুটা জুড়ে আছি ওই দোতলার টঙের ঠেকে। মোটামুটি বারোটার মধ্যেই হাজির হই সেখানে। আর ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ঘর খুলে মৌরসিপাট্টা বসাই। শুরু হয় লোকসমাগম। আড়াইটে তিনটেয় তিনি ঢোকেন। আড্ডা জমাটতর। তারই মধ্যে কাজ- প্রুফ বইবিক্রি সাপ্লাই ... । তরুণ কবি সদ্য পাশ করা ইন্টেলেকচুয়াল খইনি গালে হাঁটু লুঙ্গি পাড়াতুতো দাড়িমুখো ছবি আঁকিয়ে প্রুফরিডার মিষ্টি মুখের স্নেহময়ী লাইব্রেরিয়ান অন্যায্য রকমে লম্বা প্রকটগুম্ফ সম্পাদক পাড়ার বৃষস্কন্ধ মস্তান বাথরুম-অভিমুখী প্রতিবেশী প্রকাশক - এহেন নানান মুখের সমাগমে সরগরম দোতলার একফালি ঘর আর তার সামনের একফালি জায়গা। ঘরের মালিকানা তাঁর আর সামনের জায়গাটুকু এজমালি। কবিতা থেকে কেচ্ছা হয়ে কৃষ্টি ছুঁয়ে ভ্রাম্যমান গতিতে সন্ধে নামে। একে একে বাড়ি ফেরেন সমাগতরা। এবার খাতা খোলা হয়। সারাদিনের হিসেবনিকেশে মিলিয়ে দেখে নিতে হবে আগামীদিনের রসদ। একদিন দেখা যায় এত আড্ডার ফাঁকে খাতাটা শূন্য থেকে গেছে। টানা দুই সপ্তাহ একটাও বই বিক্রি হয় না। আর এই দুই সপ্তাহগুলো আসতেই থাকে ক্রমাগত। নানা ঘরে জমায়েত চলে এমন দু-সপ্তাহের ক্রমাগত সঙ্গী প্রকাশকদের। কী করা যায় ? কী করা যায় ? কিন্তু বইপাড়া ছাড়ার কথা কেউই ভাবেন না একবারও। দু’সপ্তাহ জুড়ে জুড়ে প্রায় দু'বছর। তবু আড্ডা চলে। সমাগম ঘটে। কবিতা কেচ্ছা কৃষ্টির বিরাম ঘটে না ; সমাগতদের হাসিমুখে ঘরে ফেরারও নয়। কেবল যেদিন দিনশেষে টঙের ঘরের ক্রমাগত শূন্যখাতায় প্রবল অবসাদ ঘিরে ধরে, আমি আর তিনি বীণা সুইটসের একটি সস্তার জিবে গজা কিম্বা ল্যাংচা চাঁদা করে কিনি। ভাগ করি। খাই।
এসব দশক দুই আগের গল্প। তারপর বহুবার কলেজস্ট্রিটে জমেছে বর্ষার জল। আর দিনকয়েক আগে আমাদের স্বভাবসুলভ অস্পষ্টতায় রেখে পাহাড়ি পথে পা ভেঙেছেন তিনি। অবশেষে স্পষ্ট ভাবে দীর্ঘদিন গৃহবন্দী থেকে অতঃপর এক সন্ধ্যায় পা রেখেছেন বইপাড়ায়। একটু দূরেই বীণা সুইটস তাকিয়ে আছে, দু’দশক আগের দুই হাড়কেপ্পন খরিদ্দারের দিকে।
#প্রসঙ্গত এঁর নাম শ্যামল ধর। বইপাড়ায় অফবিট নামক একটি প্রকাশনা প্রসঙ্গে এঁর দেখা মেলে।
0 comments: