0

বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in


বইপোকার বইঘর
অনিন্দিতা মণ্ডল


বম্বে স্টোরিজ
সাদাত হাসান মান্টো 
সাদাত হাসান মান্টো উর্দু সাহিত্যের একটি এমন নাম যা উপমহাদেশের স্বাধীনতাপূর্ব ও উত্তর, এবং দেশভাগের যন্ত্রণায় দীর্ণ হতে থাকা অসংখ্য সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি স্বরূপ। তাঁর দেখার চোখ আর সমাজের তথাকথিত নীতিবাদের গণ্ডি ছাড়িয়ে যাওয়া মানবিক বোধ, মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান উপেক্ষা করে তাদের যাপনের যন্ত্রণাগুলোকে সামনে এনেছে। সাহিত্য বলে শুধু নরম পেলব স্বপ্নময়তা দিয়ে আঁকা রোম্যান্টিক কিছু কথন নয়। সাহিত্য তীব্রভাবে জীবনের সেই সব দিককেও তুলে আনে যা আমাদের চোখে পড়লেও আমরা এড়িয়ে যাই। এসব সাহিত্যের বিষয় হতে পারেনা, এমনটাই ভাবি। লেখক আমাদের বাস্তবের মাটিতে দাঁড় করিয়ে দেখিয়েছেন, জীবন মানে এটাও হয়। শিউরে উঠেছি। কষ্ট পেয়েছি । 
এই বইটিতে মোট চোদ্দটি গল্প আছে । নামেই যাদের পরিচয় লেখা। আমার দুর্ভাগ্য যে মূল উর্দুতে আমি লেখককে পড়তে পারিনি। উর্দু পড়তে পারিনা বলেই। উর্দুতে অডিও বুকের মাধ্যমে শুনলে আমার মনে হয় গল্পগুলোর আরো কাছে যাওয়া সম্ভব। যে কোনও রচনা তার স্থান কাল পাত্র পরিবেশের একটি দুর্লঙ্ঘ্য গন্ধ বয়ে আনে। ইংরিজিতে যাকে বলে ফ্লেভার। অনূদিত গল্পের ক্ষেত্রে, যত ভালো অনুবাদ হোক না কেন, মূল গল্পের সেই ফ্লেভার কিছুটা হলেও অনুপস্থিত থাকে। এ ক্ষেত্রে ম্যাট রীক অবশ্য অত্যন্ত সুষ্ঠ ভাবে যত্নের সঙ্গে অনুবাদ ও সম্পাদনা করেছেন। উপমহাদেশের লেখক হওয়া সত্ত্বেও মান্টোকে যে প্রতীচ্য পোস্টমডার্ণ সাহিত্যিক হিসেবে এই জায়গা দিয়েছে সেটা অত্যন্ত গর্বের বিষয়। একথাটির কারণ এই, যে মান্টো অবিভক্ত ভারতের মানুষ বলেই নিজেকে ভাবতেন। দেশ ভাগ তাঁকে চরম দুর্ভাগ্যের দিকে টেনে নিয়েছিল। যার ফলস্বরূপ অকালমৃত্যুর শিকার হন তিনি। 
এই বইয়ের চোদ্দটি গল্প মান্টোর বম্বের স্মৃতি। বেশির ভাগই লাহোরে চলে যাবার পর লেখা। তবে কিছু গল্প বম্বে থাকাকালেও লেখা। যেমন ‘বু’ গল্পটি। এই গল্পটি এবং ইসমত চুঘতাইয়ের লিহাফ গল্পটি একই সঙ্গে অশ্লীলতার দায়ে আদালতে পৌঁছেছিল । দুই লেখক ও দুই বন্ধু একই সঙ্গে কোর্টে যান। কি ছিল গল্পটিতে? রীক নামকরণ করেছেন, স্মেল । যেহেতু মান্টোর চিন্তার মধ্যে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা একটি চেনা বৈশিস্ট্য, এক্ষেত্রে তা উঠে এসেছে এক যুবকের যৌনতুষ্টির সঙ্গিনী এক নিম্নবর্গীয় তরুণীকে ঘিরে। বিবাহিত যুবকটির সুন্দরী স্ত্রী নিদ্রিত। সে নিজে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বহু আগের সেই মেয়েটির কথা মনে করছে । যার ক্লেদাক্ত শরীরের প্রতিটি রোম থেকে উঠে আসছিল এক অদ্ভুত গন্ধ, যা কখনোই সুগন্ধ নয়, অথচ যা তাকে দিয়েছিল এক অদ্ভুত তুষ্টি । তার মনে হয়েছিল এ গন্ধ তার খুব চেনা । শৈশবে দুধ খাওয়ার কালে কি সে এই গন্ধ পেয়েছিল? আজ সুন্দরী স্ত্রী তাকে সেই তুষ্টি দিতে পারছেনা যা সেই মেয়েটি তাকে দিয়েছিল। কিংবা ধরা যাক ‘দশ টাকা’ গল্পটি। চৌলে থাকা কিশোরী মেয়েটি যে ধান্দায় যায় তা সকলেই জানে। কিন্তু প্রচন্ড জীবনসংগ্রামের মধ্যে এ নিয়ে কেউই মাথা ঘামায়না। তার মায়ের মিথ্যেকথা নিয়েও কেউ প্রতিবাদ করেনা। কিশোরীটি যাই করুক না কেন , তার মধ্যে বালিকাবেলার একটি নিষ্পাপ মন রয়ে গিয়েছে। তাই সে ধান্দায় যেতে ভালোবাসে। কেননা তাহলে সে গাড়ি চড়তে পারে। এটি তার অত্যন্ত প্রিয়। এমনই একদিন সে গাড়িতে চেপে বম্বে ছাড়িয়ে এক নির্জন সমুদ্রের ধারে গেল। সঙ্গী ছিল তিন অল্পবয়সী তরুণ। কিশোরীটির নিষ্পাপ উচ্ছ্বলতা তাদেরকেও প্রভাবিত করেছিল। ফলে তারা কেউই দৈহিকভাবে একে অন্যের সঙ্গে লিপ্ত হলোনা। বরং চার বন্ধু যেন একটি অমলিন বিকেলবেলা সাগরের পাড়ে কাটিয়ে ফিরল। প্রথমে একটি ছেলে কিশোরীটির বুকে একটি দশ টাকা গুঁজে দিয়েছিল। ফিরে এসে গাড়ি থেকে নামার সময় কিশোরী সেই টাকাটা ফিরিয়ে দেয়। সিটের ওপরে টাকাটা রেখে সে যখন চলে যায় তখন পাঠকেরও বুক চিনচিন করে। কি অসম্ভব অসহায়তা ! জীবন কি ছেলেখেলা করে! এমন করে লিখতে বসলে গোটা চোদ্দটি গল্প বলা হয়ে যাবে। সেটা ঠিক হবেনা। শুধু পাঠক হিসেবে নিজের কথাটি বলি। মান্টোকে যেভাবেই চিহ্নিত করা হোক না কেন, আমার কাছে তিনি এক অভিমানী মানুষ বলেই প্রতিভাত হলেন । তাঁর চেতনার গভীরে তিনি যেন নিখাদ ভালোবাসাই খুঁজেছেন সারাটা জীবন। আদিম মানবের মতো তাঁর খোঁজ শরীর ছাপিয়ে চেতনায়, মস্তিষ্কের শিরায় উপশিরায় ছড়িয়ে গিয়েছে । তাঁর সময় ও পরিবেশ যে তাঁর ওপরে এক চূড়ান্ত বিরূপ প্রভাব ফেলেছিল তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। রাশদি বলেছেন মান্টো নিম্নবর্গীয় জীবনের ব্যাখ্যাতা। অবশ্যই তাই। বঞ্চিত অসহায় দুঃখী মানুষের জীবনজোড়া সুখ ও ভালোবাসার খোঁজ তাঁর এই চোদ্দটি গল্পের পরতে পরতে মিশে আছে।

0 comments: