ধারাবাহিক - সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
Posted in ধারাবাহিকধারাবাহিক
এক কিশোরীর রোজনামচা - ৩২
সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
Diary Entry - 30
12th. November, 1942,Thursday.
প্রিয় কিটী,
ড্যাসেলের এখানে আসার পর্বের শেষটা এবার তোমায় বলব। মিয়েপ শেষ পর্যন্ত ড্যাসেলকে গিয়ে বললেন, তার থাকার জন্যে একটা ভাল গুপ্তগৃহ খুঁজে পাওয়া গেছে।মিয়েপের কাছে খবরটা শুনে ড্যাসেল মহা খুশী। মিয়েপ তাঁকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গুপ্তগৃহে আসার জন্যে বললেন। এমনকি যদি সম্ভব হয়, সামনের শনিবারও ড্যাসেল গুপ্তগৃহে আসতে পারেন। কিন্তু ড্যাসেল জানালেন সামনের শনিবার উনি যেতে পারবেন কি'না, তা' ঠিক অনুমান করতে পারছেন না। কারণ তাঁর হাতে কিছু জরুরী কাজ আছে। যেমন যাওয়ার আগে, রেশন কার্ডের হালফিলের হিসাবটা করিয়ে নিতে হবে, তা’না হলে সেটা পরে বাতিল হতে পারে। তাছাড়া কিছু রোগী তার কাছে আসার তারিখ ও সময় আগে থেকে ঠিক করে গেছে। সবথেকে জরুরী হল, গুপ্তগৃহে লুকিয়ে পরার আগে, নিজের অর্থের হিসাবের বইটাকেও হালফিলের তারিখে করে নিতে হবে। মিয়েপ আজ সকালে আমাদের এখানে ড্যাসেলের সব কথাগুলো জানিয়ে গেল। আমরাও নিজেরা বলাবলি করলাম, 'সত্যি কাজগুলো শেষ না করে ওনার পক্ষে আসা সম্ভব নয়। বাইরে থাকতে থাকতেই তার এইসব অপরিহার্য কাজগুলো করে নেওয়া দরকার, বিশেষ করে কাজগুলোর সাথে বেশ কিছু লোক বিভিন্নভাবে জড়িত। বরং আমরা আপাততঃ তাকে ছাড়াও থাকতে পারি। কারণ এখনও ত' তিনি আসেন নি। শুধু আসার প্রস্তাবটুকু হয়েছে। তবুও মিয়েপকে বলা হল, সে যেন আবার একবার ড্যাসেলের সাথে দেখা করে জিজ্ঞাসা করে নেয়, যে শনিবারের মধ্যে সে এখানে আসতে পারবে কি'না। কারণ আমাদেরও ত’ সেই বুঝে নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে।
ড্যাসেল শেষ অবধি জানিয়েছেন, না, তিনি শনিবারে আসতে পারবেন না।পরিবর্তে সোমবার আসবেন। আমার মতে, আমাদের ভাবনাতেই ভুল ছিল। আমরাই অতিরিক্ত আগ্রহী আর উৎসাহী হয়ে ভাবতে লেগেছিলাম, যে গুপ্তগৃহে আসার ও থাকার প্রস্তাব দেওয়া মাত্র সে, সেই প্রস্তাব লুফে নেবে! তবে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। তার এই বাইরে অবস্থান ও ঘোরাফেরা করার সুযোগ তাকে যদি গেস্টাপো পুলিশ বাহিনী না দেয় ! তাকে যদি এই সুযোগে গ্রেপ্তার করে? তা'হলে সে তার বাকী কাজগুলো করবে কি'করে? কিংবা তখন কাজগুলো কি আর কেউ করবে? আদৌ কাজগুলো হবে ত'? কে'ই বা' তখন রেশন কার্ডের হালফিলের খবরাখবর রাখবে ?
আমার মনে হয়, বাবা গুপ্তগৃহে লোক সংখ্যা অকারণে বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ঠিক কাজ করেন নি। জানিনা বাবা কেন ও'কে এখানে আনতে বললেন? আর কি! আজ আর কোন খবর নেই।
ইতি,
অ্যানি।
অনুবাদকের সংযোজন ঃ-বর্তমান প্রসঙ্গে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘটনাবলীর কিছু ঐতিহাসিক বিবরণ দেওয়া জরুরী। পাঠককুলের এটা অনুমান করতে তা'হলে সুবিধা হবে, ১৯৪২ সালে জার্মানের পরিস্থিতি কিরকম ছিল! ১৯৪১ সালে হিটলার তার জার্মান বাহিনী নিয়ে, রাশিয়ার প্রায় একহাজার কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত পথে ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। উত্তরদিকে লেনিনগ্রাড লক্ষ্য করে, মধ্যবর্তী অংশে মস্কো লক্ষ্য করে এবং দক্ষিণদিকে স্ট্যালিনগ্রাড লক্ষ্য করে জার্মান বাহিনী আক্রমণ চালিয়েছিল। লেনিনগ্রাড ও মস্কোর পতনের পর হিটলারের বাহিনী দক্ষিণের ডন উপত্যকা অতিক্রম করে ইউক্রেনের কৃষিক্ষেত্র পর্যন্তে এগিয়ে যায়। স্ট্যালিনগ্রাড জার্মান বাহিনীর দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। মার্শাল জুকভের নেতৃত্বে লালফৌজ অতিমানবিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। প্রথম দিকে লালফৌজ পিছু হটতে বাধ্য হলেও, শেষ পর্যন্ত ১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বরে রুশবাহিনী জার্মান সেনাদের পিছু হটতে বাধ্য করে। এই যুদ্ধে জার্মান সেনার প্রায় ৯০ শতাংশ নিহত বা বন্দী হয়। রাশিয়া অভিযানের ব্যর্থতা থেকেই, চার্চিল উল্লেখ করেন, জার্মানির "শেষের শুরু" হয়। এরপর ১৯৪৩ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি ইতালির বাহিনী মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে। এ'সব সত্ত্বেও ১৯৪২ সালে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের ইহুদিরা জার্মান অধিকৃত ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রে উদ্বাস্তু হিসাবে এক অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে ছিল।
0 comments: