গল্প - সমীক্ষণ সেনগুপ্ত
Posted in গল্প
গল্প
একটি তরুণ সিংহের গল্প
সমীক্ষণ সেনগুপ্ত
একুশ তলার ছাদে উঠে নিচের দিকে তাকালে গাছগুলোকে কি ছোট ছোট লাগে না? গাড়িগুলোর দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকলে মনে হয় যেন চলমান আলোর স্রোত... আর মানুষগুলোকে... মানুষগুলোকে তো প্রায় দেখাই যায় না!
বিদেশ-বিভুঁই যেখানেই থাকি না কেন, দিনে একবার অন্তত ছাদে যাওয়ার চেষ্টা করি। আসলে ছাদে উঠলে আকাশটাকে একই রকম লাগে যে, বাড়ির কথা মনে পড়ে যায়...হ্যাঁ, বাড়ি ! আমাদের সেই সিংহবাড়ি !
কতদিন যে যাওয়া হয়নি সেখানে, কতো বছর আগে যে বেরিয়ে এসেছিলাম - দশ না বারো - কে জানে, নিজেরই খেয়াল নেই !!
প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেল আমি এই বিদেশীয় ড্রাগন কোম্পানির চিফ এডভাইজার। কোম্পানির মালিকের ঠিক পরেই আমার স্থান। অবশ্য ড্রাগন কোম্পানির মালিক নয় , মালকিন ! কোম্পানির হেড কোয়ার্টার্স এই সাংহাই হলেও, ব্লন্ড ম্যাডাম কিন্তু আবার এখানকার নন। তাঁর গল্প আরেক দিন বলবো খন...
ভাবতে ভাবতে চোখ চলে যায় ছাদে কোম্পানির ফ্ল্যাগপোস্টের দিকে...কালো পতাকার উপর তিনটে লাল ড্রাগন সেখানে হওয়ায় দোল খাচ্ছে...
মনে আছে, বছর দশ বারো আগে একটা ঝলমলে সকালে যেদিন সিংহবাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম বরফের দেশের উদ্দেশ্যে, সেদিনও আমাদের লায়ন কোম্পানির লাল-হলুদ পতাকাটা এরকম হওয়ায় উড়ছিল...মনে আছে, বাড়ির ছোট ছেলে কতো দূরে যাচ্ছে, তাও কেউ এগিয়ে দিতে আসেনি। অবশ্য, আমি যে এক্সপেক্ট করেছিলাম, তাও না।
বাবা যে কোনদিনই আমাকে ঠিক মানুষের পর্যায় ফেলেন নি।
আসলে, আমি বাবার কাছে ছিলাম একটা লজ্জার বিষয়, তাঁর লায়নস গ্রূপের বিশাল লাল-হলুদ নিশানের উপর একটা কালো ছোপ ! আমার চেহারা, আমার ক্লাসের বোরিং লেকচারে অমনোযোগ, আমার ভৃত্য-স্থানীয় লোকজনদের সঙ্গে মেলামেশা, আমার ঠোঁটকাটা স্বভাব... কোনটাই তিনি দেখতে পারতেন না। তাই আমার বুদ্ধি বা ক্ষমতা আছে জেনেও নিকৃষ্ট মানের কাজ দিতেন আমায় - বাগান পরিষ্কার করা, ছাদের ট্যাংক পরিষ্কার করা...বলতেন "তরুণকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না, ও একটা অপদার্থ !"
মা বেঁচে থাকলে কি এরকমটা হতো ? কে জানে...
বাবার পেয়ারের লোক ছিল দাদা রাজদীপ আর দিদি রাজরূপা। অবশ্য, আমার সব সময়েই মনে হয়েছে মেয়ে হওয়ার দরুন দিদিকে বাবা নিজের উচ্চাকাঙ্খার একটা সিঁড়ি ছাড়া কিছুই ভাবেন নি। আমাদের পারিবারিক ব্যবসাটা ছিল মূলত সোনার, লায়নস গ্রূপের নাম সারা দেশে সবাই এক ডাকে চিনত। আর সেই সোনার মুকুটে হিরেটা ছিল আমার দাদা রাজদীপ। বাবা ওকে সেরকম ভাবেই ঘষে-মেজে তৈরি করেছিলেন। দেখুন না, নামটাই কেমন রেখেছেন...রাজদীপ ! শুনেই মনে হয় বুঝি রাজা-গজা কেউ হবে !! কিন্তু শুধু 'নাম' দিয়েই সব কিছু হত...যাক সে কথা ।
যে কথা হচ্ছিল সেটা হচ্ছে , শরতের এক ঝলমলে সকালে আমরা সবাই বরফের দেশে রওনা দিয়েছিলাম। নীল আকাশে সাদা তুলোর মত মেঘ, গাছে-গাছে ঝলমল করছে ফুল-ফল, পরিবেশটাই যেন আনন্দে ভরা, ঝকমক করে হাসছে...
সেদিন কি আর জানতাম সিংহবাড়ি থেকে সেটাই আমার শেষ যাত্রা, কোনদিনই আর বাড়ি ফেরা হবে না আমার...
তারপর যে কতো কাণ্ড ঘটল !!! বলে শেষ করা যাবে না !
আমার বাবা তপন সিংহ যে পাকা, নির্মম ব্যবসাদার মানুষ জানতাম, কিন্তু যেটা জানতাম না সেটা হচ্ছে তলায় তলায় তিনি প্রেসিডেন্সির জন্য লড়ছেন। বরফের দেশের মানুষদের সাথে তাঁর ঝামেলা লাগলো। ব্যবসা সংক্রান্তই ঝামেলা, কারণ ওরা নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ, প্রেসিডেন্টের পদের জন্য ওদের কোনোদিন উচ্চাকাঙ্খা ছিল না।
তারপর, যে কোনো লড়াইয়ে যা হয়। দু পক্ষই ক্লান্ত, রক্তাক্ত, বিধ্বস্ত...বাবা ধকল সামলাতে না পেরে ভগ্ন-স্বাস্থ্যে মারা গেলেন।
আর আমি...আমি স্রেফ বেঁচে থাকার চেষ্টায় দেশ ছেড়ে পালিয়েছি। অনেক ঘাটের জল খাবার পর ড্রাগন কোম্পানির এই ম্যাডাম আমাকে আশ্রয় দিলেন। অবশ্যই আমার বুদ্ধি-বিচক্ষণতা দেখে।এখন দারুন জায়গায় থাকি, খানা-পিনা-মোচ্ছবে ডুবে থাকি একেবারে...মাঝে মাঝে মনে পড়ে সেই মেয়েটার কথা, যাকে কাঁচা বয়সে ভালো লেগেছিল বলে বাবা আমাকে এক সপ্তাহ বাড়িতে আটকে রেখেছিল। আর এর মধ্যে গুন্ডা দিয়ে তার বাড়িতে ভাঙচুর চালিয়েছিল। সে নিচু জাতের ছিল কিনা...
আজকে সে নেই, আর আমি মনে মনে জানি প্রকৃত আশ্রয় আমি কোনোদিনই পাইনি।
দাদার সাথে যোগাযোগ আছে...একমাত্র ওর সাথেই আছে। দিদি যথারীতি এখনো আমায় দেখতে পারে না। তাই সিংহবাড়িতে কার্যত আমার জন্য দরজা বন্ধ !
আজকে লায়নস গ্রূপের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী এই ড্রাগন কোম্পানির, আর তার অন্যতম বড় শক্তি আমি নিজে। কি বলবো...কপালের ফের !
আকাশের দিকে তাকিয়ে তারার খসে পড়া দেখতে দেখতে ভাবি : পৃথিবীর ইতিহাসে আর কারুর কোনোদিন এরকম হয়েছে কিনা কে জানে...
0 comments: