0

ধারাবাহিক - সোমঙ্কর লাহিড়ী

Posted in


ধারাবাহিক


পায়ের শব্দ 
সোমঙ্কর লাহিড়ী


১০ 

‘উই প্রোভাইড সিকিয়োরিটি,’ কোম্পানীটার নাম। যে ভদ্রলোক সেটার মালিক তাঁকে সিকিয়োরিটির ব্যাপার ছাড়া বিশ্বসংসারের বোধহয় সমস্ত রকমের পেশার সাথেই রিলাট করা যেতে পারে। বেঁটে, মোটা, তবে থলথলে মোটা নয়, গাঁট টাইপ মোটা। মাথার সামনের দিকে চওড়া কপাল অথবা টাক যেটা ইচ্ছে বলা যেতে পারে। বয়েস পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের ভেতরেই। আর বেশ একটা হাসি হাসি মুখ। যেটা দেখলে বেশ ভালো লাগে। নাম বিজন বোস। 

কিরন বাবুকে বললেন, 

আপনার সেই গায়কের কেস তো? 

হ্যাঁ। 

পড়েছি, আর টিভিতে দেখেওছি। সামলাতে পারা যাচ্ছে না, তাই না? 

ঠিক তাই। 

নিজেই লোক লাগিয়ে করাচ্ছে না তো? 

না না তা কেন করাবে? 

আরে পাবলিসিটির জন্য লোকে কি না করে এটাও হয়ত সেই রকম কিছু। 

না ওকে এখন যা দেখেছি তাতে করে নিজের পাবলিসিটির অন্য অ্যান্ডি এটা করছে বলে মনে হচ্ছে না। 

আপনি আমায় কি করতে বলেন? ঐ লোকটা কে খুঁজে বার করে দিতে? না অ্যান্ডির পার্সোনাল প্রোটেকশান? 

দুটোই। ঐ লোকটাকে ধরতে পারলেই অ্যান্ডির উপরে বিপদের আশঙ্কা বন্ধ হবে তাই না? 

তা হবে কিন্তু এই এত বড়ো শহরে সেটা খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজার মতো ব্যাপার হবে, তাই না? 

সেটা মানছি। কিন্তু এভাবে তো ছেড়ে রেখে দেওয়াটাও যাচ্ছে না, তাই না, ছেলেটা স্টেজ করতে পারছে না, কিছু না, শুধু বাড়িতে বসে থাকতে হচ্ছে। এভাবে তো চলতে দেওয়া যায় না। 

আচ্ছা সেই কয়েক মাস আগে চা বাগানে কি একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছিল না অ্যান্ডি? ব্যাপারটা তার সাথে কোনো ভাবে জড়িত নয় তো? 

সেটা তো আমার জানার কথা নয়। ভেতরে কি ঘটেছে। 

আমি খোঁজ নিয়ে নিচ্ছি, ভাববেন না। তবে ঐ মহিলা মারা যাননি, তাহলে এতদিনে পুলিস আপনাদের ঐ গায়ককে পাকড়াও করত, তাই না? 

কিরন ঘোষ দোস্তিদার মাথা নেড়ে সায় দেন। 

আপনি আমায় দিন তিনেক সময় দিন, আমি প্রপার রেকি করে নিই আগে। তারপরে ঘুঁটি সাজিয়ে খেলা শুরু করব। 

এরমধ্যে? 

অ্যান্ডির ফ্ল্যাটের উপরে আমি নজর রাখব, চিন্তা করবেন না। 

কিরন ঘোষ পেমেন্ট টেমেন্ট করে চেয়ার ছাড়লেন ঘরে ফেরার জন্যে। 



দুদিন বাদেই বিজন বোস ফোন করে বললেন 

মিঃ ঘোষদস্তিদারএবারে যে একবার নিজেদের মধ্যে বসতে হবে। 

কিরন ঘোষ ওনার অফিসে আসলে পর দুজনে কথা শুরু করলেন, 

অ্যান্ডি যে বিল্ডিংএ বর্তমানে থাকে তাতে যারা সিকিয়োরিটি গার্ডটার্ড প্রোভাইড করে সেই কোম্পানীর লোকেদের সাথে কথা হয়েছে। মুশকিলটা হল ওরা মেনলি অ্যামেচার লোকজন প্রোভাইড করে। হাটে মাঠের থেকে লোক তুলে এনে সাজগোজ করিয়ে বসিয়ে দেয়। এই রকম একটা ধুরন্ধর ব্যাপারে ওদের কি করতে হবে সেটা সম্বন্ধে ওদের কোন ধারনা নেই। আমি বাড়ির আশে পাশে লোক দিয়ে এমন কাউকে পাইনি যে কিনা নজর রাখছে। তারমানে বাড়ির ভেতরে ঢোকার কোন প্ল্যান হয়ত এই মুহুর্তে সেই লোকের নেই। আর একটা হতে পারে যে ঐ বাড়িতে যে অ্যান্ডি রয়েছে সেটা সে জানে না। বা আমার নজরদারির আগেই সে সব কিছু করে কেটে পড়েছে। 

কিরনবাবু সায় দেন, মুখটা বেশ চিন্তাক্লিষ্ট দেখায়। 

দুবারে অ্যাটাকের প্যাটার্নটা ফলো করলে বোঝা যায় যে লোকটা স্থান কাল পাত্র হিসাব করে নিজের রুপ বদলায়। আর খুব দ্রুত কাজ সেরে পালাতে পারে। অ্যান্ডির সেফটির জন্যে আমি সাজেস্ট করব ওর ফ্ল্যাটে পার্সোনাল বডি গার্ড। আর পারফর্মেন্স করতে গেলে সেখানে বাউন্সার। যারা আগে গিয়ে ভ্যেনুটা রেকি ইত্যাদি করে নেবে। 

কতদিন? 

আমরা বাইরে থেকে ঐ লোকটাকে ধরার জন্যে সবরকম চেষ্টা করব। আশা করি ধরে ফেলতে পারব তাড়াতাড়ি। পুলিসের সাহায্যও আমার লাগবে। সেই মতো ব্যবস্থা করব আমি। আপনি চিন্তা করবেন না। কাল আমি নিজে গিয়ে আমাদের দুজন বেস্ট পার্সোনেলকে অ্যান্ডির বাড়িতে ডিপ্লয় করে দিচ্ছি। দুজনেই ইনফ্যাক্ট এক্সসার্ভিসমেন, শর্টসার্ভিস থেকে রিটায়ার করে একসাথে ফার্ম খুলেছে, আমরা জয়েন্টলি কাজ করে থাকি বিভিন্ন প্রোজেক্টে। 

পরেরদিন অ্যান্ডির ফ্ল্যাটে বিজন বোস তার দুই সহযোগীকে নিয়ে বসে অ্যান্ডিকে বঝাচ্ছিল ওকে এই ক্রাইসিস পিরিয়ডে কি করে নিজেকে বাঁচাতে হবে। অ্যান্ডির তখন মাথায় নতুন গান করার চিন্তা ঘুরছিল। বিজন বোসের অনেক কথার মানে ও ঠিক করে বুঝতে পারল না। খালি এইটুকু বুঝল যে ওকে দিনে রাতে এই দুটো লোক পাহার দেবে। একটু প্রথমে মনে খচখচ করলেও মেনে নিল। ওরা অনেক কথা বলে কয়ে যখন চলে গেল, অ্যান্ডি কিরন ঘোষ দস্তিদারকে জিজ্ঞাসা করল, 

জেঠু কাঞ্চনদা আর অলিদি আর আমার কাছে আসবে না? 

এই কথার কি জবাব দেবেন কিরন? বাড়িতে এক অদ্ভুত শৈত্য দেখা যাচ্ছে তাদের বাবা ছেলে আর বৌমার মধ্যে। ওনার নিজের ফার্মের দায়িত্ব ছেলের উপরে ন্যাস্ত করে নিজে এই যে একটা বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো ছেলেটার পিছনে নিজের তাবত উৎসাহ ঢালছেন সেটা ওদের দুজনের যে ভালো লাগছে না, সেটা উনিও বুঝতে পারছেন, কিন্তু এটা একটা অদ্ভুত চ্যালেঞ্জের মতো লাগছে এখন তার নিজের। আর উনি বেশ বুঝতে পেরেছেন, নেশা ইত্যাদি ছেড়ে ছেলেটা এখন মুলস্রোতে ফিরে আসতে চাইছে। তার চেষ্টাটাই তাকে আরো উৎসাহিত করে তুলছে। নিজে বুঝছেন যে ওরা হয়ত বিশ্বাস করছে না, বা করছে অ্যান্ডির পরিবর্তনের ব্যাপারটা। কিন্তু একদিন যে ভুল বোঝাবুঝিটা তৈরী হয়েছে সেটা কেটেযাবে নিশ্চয়ই। 

আপনমনে নিজের তৈরী করা সুরটা শিষ দিয়ে তুলতে লাগল, ফ্ল্যাটের জানলার দিয়ে বাইরের দিয়ে তাকিয়ে। কিরন বাবু বুঝতে পারলেন, অ্যান্ডির চোখের কোন থেকে একটা জলের ধারা নেমে আসছে। উনি উঠে দাঁড়িয়ে ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। কারণ আর কিছুই নয় কিছু মুহুর্ত সব মানুষের একান্ত নিজের হয়। তাকে সেই স্পেসটা দেওয়াটা সভ্যতার একটা অংশ। 



অনেক রাতে অ্যান্ডি যখন একা বসে আছে আর নতুন গান সুর এই সব নিয়ে ভাবছে এমন সময় বীরু ফোন করল। 

একটা গুছিয়ে ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে হবে তো? 

কি ভাবে করব? কে শুনবে আমার কথা? আর কিভাবে? 

উপায় আছে বস্‌! শুনবে? 

হ্যাঁ, বল শুনি। অ্যান্ডির গলায় একটা কৌতূহলের ছোঁয়া শোনা গেল। 

“সম্বিতের সাথে আনকাট” এই প্রোগ্রামটায় একটা ইন্টারভিউ দেবে? সম্বিতদা আর আমি এখন বসে মাল খাচ্ছি। এখন ওকে বললে কাজটা হয়ে যাবে। আর এই শোটার টি আর পি হেব্বী হাই। সব বাঘা সেলেবরা এখানে আসার জন্যে ত্যালায়। বল আসবে? 

ওকে বস্‌। আমি রাজী। 

সেদিনের ফাংশানে অজ্ঞান হয়ে যাওয়াটার ড্যামেজ কনট্রোল ও হয়ে যাবে। 

অ্যান্ডির আবার মনে পড়ে গেল সেদিনের ঘটনাটা। পেটের ভেতরটা গুরগুর করে উঠল। 



মিডিয়ার যারা ফ্রন্ট ফেস তাদের একটা সবজান্তা ইমেজ করে রাখতে হয়, সারা বিশ্বের যেখানে যা ঘটছে সেই ব্যাপারটা তাদের এমন করে পাবলিকের সামনে প্লেস করতে হয় যেন সে ঐ ব্যাপারটার একজন বিশেষজ্ঞ। সম্বিত সেনগুপ্ত মোটের উপরে এই ইমেজের বাইরে নিজেকে রাখতে সচেতনভাবে সক্ষম। এমন সাদা মুখ করে বসে থাকবে যে দেখে কারো মনেই হবে না যে পরের মুহুর্তে লোকটা একটা বোমা ফাটাতে চলেছে। আর ঠিক এটাই তার শোয়ের ইউ এস পি। রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব থেকে খেলোয়ার, গায়ক গায়িকা, নায়ক নায়িকা সবাই জানে এই শো তাদের বাজারদরও টেনে তুলবে। তাই এখানে আসার জন্য একটা রেষারেষি আছেই। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে এখানে সম্বিতের সামনে কেউ শান্তিতে বসে থাকতে পারে না। কখন যে বোমা ধেয়ে আসবে আর কোন দিক থেকে সেটা অজানা, সাথে জায়ান্ট স্ক্রীনে রিসার্চ ফাইন্ডিংস চলতে থাকে। ভুলে যাওয়া বন্ধুর ইন্টারভিউ, থানার রেকর্ড, কি নেই সেখানে। তবুও এই খুঁড়ে বার করাটাই মানুষ পছন্দ করে। 

অ্যান্ডি রাজি হওয়ার পরে তার ইন্টারভিউয়ের ডেট দেওয়া হল প্রায় একমাস বাদে। সেই একমাসে অ্যান্ডি আর তাদের আর্মাডিলোমাত্র দুটো মাচার শো পেলো। নিজের ভয় কাটাতেই হোক বা টাকা পয়সার জোগাড়ের জন্যেই হোক অ্যান্ডি শো দুটো করল। আর সাহস খানেকটা হলেও বাড়ল। 

এর মধ্যে আরো কিছু কাজে অ্যান্ডি হাত দিয়েছিল সেটা মোটের উপরে লুকিয়ে রাখতে সক্ষমও হয়েছিল। তার মধ্যে একটা হচ্ছে সাজিদ হুসেনের সুরে একটা সিনেমার প্লেব্যাক, আর নিজের লেখা গোটা ছয়েক গান নিয়ে একটা সিডির কাজ। “সম্বিতের সাথে আনকাট” সেটে রেডী হয়ে ঢোকার পরে যখন সে সোফায় একটু সুস্থির হয়ে বসেছে, এক গ্লাস জলে গলাটা ভিজিয়ে একটু তৈরী হয়েছে আর সম্বিত, প্রোগ্রামের প্রোডিউসার আর ডিওপি নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে নিয়েছে, রেকর্ডিং লাইট জ্বলে উঠেছে তখনই সম্বিত ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে দর্শকদের কাছে নিজের প্রোগ্রামের ইন্ট্রো দিয়েই অ্যান্ডির দিকে ফিরে হাত বাড়িয়ে বলল, 

প্রথমে তোমাকে সাজিদ হুসেনের সুরে ফিল্মে প্লে ব্যাক করা আর নিজের নতুন অ্যালবাম “নোয়ারের” জন্য অভিনন্দন জানাই। 

অ্যান্ডি উত্তর দেবে কি! এই দুটো প্রজেক্টে যে ও কাজ করছে সেটা জানে খুব কম লোক। কিরন জেঠু, আর তার দুজন সারক্ষনের সিকিয়োরিটির, দেবদত্ত, আর দেবী। তারপরেই মনে হল, তার দিকের কেউ না বললেও উল্টোদিকের যারা আছে তাদের কেউ যদি বলে সেটা ওর পক্ষে জানা সম্ভব নয়। 

একটা লাজুক হাসি দিয়ে ব্যাপারটা ম্যানেজ করতে চেষ্টা করল অ্যান্ডি। 

পরের প্রশ্নটা কি হবে সেটা ভাবার আগেই সম্বিত প্রশ্ন করল, 

আচ্ছা অ্যান্ডি, তোমার হোমোফোবিয়া আছে? 

এটা যে প্রশ্ন হতে পারে অ্যান্ডির সেটাই ধারনার মধ্যে ছিল না। 

অ্যান্ডি ভেতর ভেতর কুঁকড়ে গেল, শুধু শান্ত গলায় উত্তর দিল, 

হ্যাঁ। 

কেন? 

0 comments: