2

গল্প - শমিত বিশ্বাস

Posted in


গল্প


লেট - কাট 
 শমিত বিশ্বাস 


সুখময় পুরোনো বাড়িটার কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ভাবছিল। এলেম্ আছে বটে লোকগুলোর। লোকগুলোর মানে, ইন্সপেক্টরদের। সত্যি, এদের রকম সকম বোঝা ভার।। কারো ঠোঁটের কোনে সর্বদাই এক রহস্যময় 'মোনালিসা হাসি। কেউ বা থেকে থেকে,দাঁত খিঁচিয়ে উঠছে। কারো আবার হাসা বারন। ইন্সপেক্টর মানেই কি বৈচিত্র্যময়? সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে এই কথাটাই চিন্তা করছিল সুখময়। একটা করে ধাপ উঠছে, আর মনটা কেমন ভার হয়ে উঠছে। ওঃ কি কুক্ষনেই যে বাড়ি তৈরী করার মত কুচিন্তা মাথায় ঢুকেছিল! লাও এখন ঠ্যালা সামলাও। না পারছে গিলতে, না পারছে উগরোতে। একচিলতে জমিটাতো ছিলই পড়ে এতগুলো বছর। নাহয় থাকতোই পড়ে। সুখে থাকতে ভুতে কিলোনো বলে একেই। 

নক্সাটা তৈরী করে দিয়েছে ওর এক বন্ধু ইন্জিনিয়ার। এখন, এই মিউনিসিপ্যালিটি অফিস থেকে তা পাশ করিয়ে নিতে হবে। প্রায় দশ-বারো দিন আগে ড্রইং জমা করেছে। বিল্ডিং- ইন্সপেক্টর প্রথম দেখবে সেটা। আজ পাঁচ দিন হয়ে গেল সুখময় ঘু্রছে। কিন্তু মহামতি ইন্সপেক্টর এর সঙ্গে দেখা হয়নি। শুধু গতকাল এক ঝলক তাঁকে দেখতে পেয়েছে দূর থেকে। তবে এত ভীড় ছিল যে কাছে ঘেঁষতে পারে নি। আজ আবার এসেছে। ওনার অ্যাসিস্ট্যান্ট বলে দিয়েছে আজ থাকবেনা। তাই আজ সুখময় মরীয়া। 

আচ্ছা ইন্সপেক্টর কত ধরনের হয়? সুখময় ভাবতে থাকে। পুলিশ- ইন্সপেক্টর, সেতো সবাই জানে। তাছাড়া? স্কুলের ইন্সপেক্টর, রেলের ইন্সপেক্টর, ফুড ইন্সপেক্টর এবং 'লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট' এই বিল্ডিং এর ইন্সপেক্টর। এ মায়া প্রপঞ্চময় / এ ধরা ইন্সপেক্টর ময়। সুখময় গুনগুন করে ওঠে। এবং,তারা সব প্রতিভাময়ও বটে। নাহলে ব্যতিক্রমহীনভাবে আপামর জনতা এদেরকে সমীহ করে কেন? একটা ভাববার মতই ব্যাপার বটে।। সেই ছেলেবেলার স্কুলের হেডমাস্টারমশাইকেও দেখেছে, বোর্ডের ইন্সপেক্টর এলেই কেমন ফুটো বেলুনের মত চূপসে যেতেন ; অথচ এমনিতে, সাংঘাতিক জাঁদরেল আর ভারিক্কি মানুষ ছিলেন। তবে সবাইকে ছাপিয়ে,একজন ইন্সপেক্টরকে, সুখময় যথার্থই নমস্য বলে মনে করে। কলেজের বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে, বিবেকানন্দ রোডের মোড়ে তখন আড্ডা মারতো ওরা রোজ সন্ধেবেলা। ঠিক তখনি, প্রায়ই আবির্ভূত হতেন তিনি, যাকে বলে ভৈরব হরষে। একটা মোটরসাইকেলে চেপে। উনি ছিলেন রেষ্টুরেন্ট- ফুড ইন্সপেক্টর মাখন ভটচায্। না না, সুখময়দের দিকে দৃকপাতও না করে,এসেই সোজা ঢুকে পড়তেন, 'চাচার হোটেলে'। সেখানে বেশি সময় নষ্ট না করে, চটপট সাবাড় করে দিতেন, চাচার বিখ্যাত ফাউল কাটলেট, গোটা তিনেক। এর সঙ্গে,স্টার্টার হিসেবে এক প্লেট চিকেন-কাবাব খেয়েই উঠে পড়তেন। এরপর, পদধূলি দিতেন হাত দশেক দূরে 'স্যাঙ্গূভ্যালি 'রেষ্টুরেন্টে। এইখানে,জমিয়ে, আয়েশ করে খেতেন, মোগলাই পরোটা আর কষা মাংস। সবশেষে, ললিত পদক্ষেপে ঢুকতেন উল্টোদিকের ' বসন্ত কেবিনে‌'। এখানে দূটো মাত্র স্পেশাল ফিশ কবিরাজি, আর 'কপিলা-আশ্রম' থেকে আনিয়ে দেওয়া একটা মালাই -সরবত‌। আর আনুসঙ্গিক আপ্যায়নের কথা? দোকান মালিকদের হাত কচলে বিগলিত হাসি, দামি সিগারেটের প্যাকেট, বাইকের ক্যারিয়ারে খাবারের পার্সেল –––, আহাহা, কপালের নাম গোপাল। তবে দোকানদাররা বলতো, মাখনবাবু গুরুদেব লোক, খেতে এত ভালোবাসেন কিন্তু পয়সা খান না। 

চারতলায় উঠে, সুখময় বাস্তবে ফিরে আসে। হলঘরটায় উঁকি মেরে দেখলো ইন্সপেক্টরের চেয়ার যথারীতি খালি, কিন্তু অ্যাসিস্ট্যান্ট হাজির। প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। অ্যাসিস্ট্যান্ট ছোকরার মাথায় কোঁকড়ানো চুল আর পাকানো কালো চেহারা। বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়। তীক্ষ্ণ দুটি চোখ সদাই এদিক ওদিক ঘুরছে। কে ঢুকছে, কে বেরোচ্ছে,সব নখদর্পনে। সুখময় কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। জিজ্ঞেস করল, ---" সাহেব আজ আসেননি?" কোনো উত্তর নেই। ওকে যেন দেখতেই পায়নি। সুখময় আবার জিজ্ঞেস করলো। এবারে বিরক্ত স্বরে কোঁকড়া চুল বলল ----"আসার সময় কি পেরিয়ে গেছে? এখনো আসেননি।" -------"ও হ্যাঁ হ্যাঁ , ভুল হয়ে গেছে " সুখময় কুন্ঠিত হয়ে বলে। একটু আশ্বস্তও হোল যে,আজ তাহলে দেখা হবার চান্স আছে। সুখময়ের হাঁফ ধরা, ঘামে ভেজা চেহারাটা একবার দেখে নিয়ে ছেলেটি বললো ---" আপনার তো ঐ ছোট বাড়ির কেস? এখন সাহেব ভীষন বিজি। আচ্ছা বসুন, দেখছি কি করা যায়।" সুখময় যেন হালে পানি পেল। কৃতজ্ঞ হয়ে বসে রইল একটা টুলের ওপর। আরো প্রায় মিনিট পঁয়তাল্লিশ পর, যখন একটু ঝিমুনি মত এসেছে, ঠিক তখনি একটা "এসে গেছে, এসে গেছে " বলে গুঞ্জন শুনে চমকে উঠল ও। দেখল সত্যি সত্যিই ইন্সপেক্টর আসছে। দেখে নয়ন সার্থক করলো। কিইবা এমন বয়স ! বড় জোর বছর চল্লিশ। কি অপার ব্যক্তিত্ব। মাথায় চকচক করছে টাক। খুব পাকা মাথা যে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহই থাকতে পারে না। গম্ভীর মুখে,ভুরু দুটো কুঁচকোনো। হবেই তো, এত 'কেস ' সামলানো কি সোজা কাজ ! 

আসার সঙ্গে সঙ্গেই একটা যেন অপারেশন শুরু হয়ে গেল। এদিক থেকে ওদিক থেকে কতজন যে ঘিরে ধরলো। কোথায় যে এরা সব ছিল এতক্ষণ, কে জানে। সুখময় শুনলো যে, এদেরই বলে ডেভেলপার। ডেভিলেরই দোসর তাতে সন্দেহ নেই। বাপরে কি দাপট ! কে আগে সাহেবের কাছে যাবে তাই নিয়ে হুড়োহুড়ি। সুখময়ের অবাক হওয়া দেখে মজা পেয়ে,একজন পিওন ওকে চিনিয়ে দিল এদের। দেখতে পেল, সিংহানিয়া শিং দিয়ে গুঁতিয়ে ঢুকছে তো, ভুঁড়িওয়ালা পরক্ষনেই ভুঁড়ি ঠেসে দিচ্ছে। আবার শর্মা,ফর্মা দেখাচ্ছে তো কুন্ডু, মুন্ডু বাড়িয়ে দিচ্ছে। আর, এদেরই মধ্যে কাউকে কাউকে ডেকে নিচ্ছেন ইন্সপেক্টর।সেই ভাগ্যবানের মুখটি তখন দেখবার মত হচ্ছে। রামভক্ত হনুমানের মত সঙ্গে সঙ্গে হাজির হচ্ছেন মুখে এক বিমুগ্ধ হাসি নিয়ে। এদিকে কোঁকড়া- চুল অ্যাসিস্ট্যান্টের কাজে তখন বিস্ময়কর তৎপরতা। নিমেষে ফাইল এগিয়ে দিয়ে,ইন্সপেক্টর এর কানে কানে ফিসফিস করে 'ব্রীফ' করে দিচ্ছে। সাহেবের প্রতিক্রিয়াও হচ্ছে নানাবিধ। কখনও - "তোমার টা হয়ে গেছে, পরে দেখা কোরো।" কিংবা ---"তোমার অনেক গন্ডগোল, দেরি হবে।" কখনও আবার হঠাৎ খিঁচিয়ে উঠছেন ---" কেন জ্বালাতন করতে আসেন বলুনতো ! আমার কি আর কোনো কাজ নেই? "ইত্যাদি ইত্যাদি। সুখময় এক পা এগোয় তো দু পা পেছোয়। বুকের ভেতর ধুকপুক। টেনিস প্লেয়ার দের মত মুঠো শক্ত করে মনে মনে বলতে লাগল "কাম অন্ শুভময়,ইউ ক্যান ডু ইট।"। কিন্তু ও পারলোনা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পা ধরে এল, কোমর টনটন করতে লাগল ; কখনও বা রবি ঠাকুরকে মনে পড়ছে,--" তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর, এখনি অন্ধ বন্ধ কোরোনা পাখা।" কিন্তু হায়রে পোড়াকপাল ! ঠিক যখনই মনে হোল একটু ফাঁকা হয়েছে, তখনই ইন্সপেক্টরএর ডাক পড়ল বড় সাহেবের ঘরে। সুখময় ভাবলো,' না আর আশা নেই, আজও হোলনা।' কিন্তু না। আছে,আছে,ঈশ্বর আছে। একেই বলে দৈবপ্রভাব। চলে যেতে যেতেই হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালেন সাহেব। সুখময়কে দেখিয়ে সাকরেদকে বললেন --"এনার নতুন প্ল্যান তো? তুমি দেখে রাখো। তিনদিন পর আসতে বলে দাও।" বলে আর দাঁড়ালেন না ; সুখময় এর দিকে না তাকিয়ে ই চলে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে আ্যাসিস্ট্যান্ট ওকে বলল,---"দেখলেন? আপনারটা করিয়ে দিলাম।" বলে নিজেকে দেখিয়ে বললো "এই কেষ্ট কোনদিন কথার খেলাপ করে না।" তারপরেই কেষ্ট,গলাটা একটু নামিয়ে সুখময়কে বলল-----" আজকে মাল কিছু দিয়ে যান। আমি আপনার ফাইল আরও এগিয়ে দেব।" সুখময় বলতে যাচ্ছিল "আমি তো বেআইনি কিছু চাইনি। তাহলে কেন......? কিন্তু পরক্ষণেই ওর 'শুভবুদ্ধির' উদয় হোল। মনে পড়লো এই কদিনের নিদারুণ প্রানান্তকর অভিজ্ঞতার কথা। ও ঠিক করল, যদি দিতে হয় দেব। যস্মিন দেশে যদাচার। সুতরাং, সুখময় 'মাল' বার করল। তবে যা চেয়েছিল তার থেকে একটু কম দিতে পেরে নিজেকে তারিফ করল মনে মনে। ছোকরা অবশ্য চামার নয়।। বললো ----" ঠিক আছে ঠিক আছে, আজ ওটাই দিন। প্রথম দিন। টাকা বড় কথা নয়,এই রিলেশনটাই তো থাকবে জীবনে। কি বলেন?" সুখময় সজোরে মাথা ঝাঁকিয়ে বললো "তাতো বটেই, তাতো বটেই।" 

আড়াই মাস পর। সুখময় আজ আবার মিউনিসিপ্যালিটি অফিসে। এখন আর সিঁড়ি দিয়ে উঠতে ও অতটা হাঁপায়না। এখন ডিপার্টমেন্টে ও গট মট করে ঢোকে। সবচেয়ে বড় কথা, কাকে কখন কত মাল দিতে হবে সেটা অনেকটা রপ্ত হয়ে গেছে। কোঁকড়া চুল কেষ্ট এখন ওকে দেখলে শুধু যে বসতেই দেয় তাই নয়, ভাঁড়ে চাও খাওয়ায়। আর মাঝে মাঝে বলে----"এই রিলেশন টাই তো থাকবে লাইফে, কি বলেন?" সুখময় তখন সজোরে মাথা নাড়ে ---"তাতো বটেই, তাতো বটেই।" সুখময়ের বাড়ীর নক্সাও অনুমোদনের শেষ পর্যায়ে। আর একটি মাত্র গাঁট বাকি ––– ডেপুটি অরুন ঘোষাল। সবাই বলে ডেপুটি ঘোষাল। ঐ যে,জানলার ধারে বড় টেবিল। ফর্সা, মোটাসোটা। কোনোদিন টকটকে লাল, কোনোদিন টিয়ারং সবুজ, টি শার্ট পরে আসেন। সামনেই নাকি রিটায়ারমেন্ট। অফিসের কাঁচা বয়সের ছেলে মেয়েদের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা মারেন আর দামি সিগারেট খান। কেষ্টর খবর অনুযায়ী, সুখময়ের ফাইল ওনার কাছে চলে গেছে; এখন শুধু ওকে, খেলে বের করে আনতে হবে। মুস্কিল হোল ওনার টেবিলে সবসময়ই ভীড়। আবার চিন্তা, কত খাবে কে জানে ! সুখময় এগিয়ে গেল। কনুই দিয়ে দুজনকে ট্যাকল্ করে, মেসির কায়দায় অনবদ্য ড্রিবল করে, সুরুৎ করে সোজা বক্সের ভেতরে। ঘোষাল তখন ডানহাতে পেন্সিল দিয়ে আঁকি বুকি কাটছে আর বাঁ হাতে মোবাইল ধরে বলছে ---------"শোনো রকি, তুমি আমার জন্য দুখানা টিকিট অবশ্যই রেখো, বুঝলে। টাকা আজ রাতেই পাঠিয়ে দেব। টিকিট যেন বেরিয়ে না যায়।" ফোনটা বন্ধ করে, সুখময়ের দিকে চোখ ফেরায়। অমনি সুখময়, মুখে একটা পবন-নন্দন হাসি হেসে আর গলাটাকে নকুড়ের সন্দেশের মত মোলায়েম করে বলে ফেললো "স্যার আমার বাড়ির প্ল্যানটা,আপনার কাছে......... " ডেপুটি ঘোষাল, ওর কথা শুনতে পেলেন কিনা বোঝা গেল না। কারো দিকেই না তাকিয়ে, আবার সবার দিকে তাকিয়ে, বললেন ....... "আরে দুদিন বাদেই তো ইডেনে, ইন্ডিয়া - পাকিস্তান ম্যাচ। আরে ঐযে নতুন ছেলেটা ঢুকেছে না বেঙ্গলের -- আরে নামটা বলুননা -------ও হ্যাঁ মনে পড়েছে -- সুমন সাঁতরা। দেখেছেন ওর খেলা?" সবাই বোকার মত তাকিয়ে রইল। " "দেখেননি? সেকি? আমি দেখেছি। রনজি ফাইনালে। একটা 'লেট কাট' করল মশাই, কি বলবো, বলটা যেন বুলেটের মত বাউন্ডারিতে চলে গেল।দেখবার মত শট। ঘোষাল বলে চলেন, --অনেক দিন পর বেঙ্গল থেকে একটা প্লেয়ার উঠেছে,টিকিট পেতেই হবে।" সুখময় আরো একবার ওর প্ল্যান টার কথা বলতে গেল, কিন্তু ঘোষাল ওকে হাত নেড়ে থামিয়ে দিল----" আজ আমাদের মিটিং আছে স্টাফ ক্লাবে একটু পরেই। আজ হবেনা। কাল আসুন।‌" সুখময় ঘাড় নেড়ে উঠে পড়ল অগত্যা। মনটা খারাপ হয়ে গেল। আরো একটা দিন নষ্ট হোল। ও ধীরে ধীরে হলঘর লাগোয়া ছাদটায় এসে দাঁড়ায়। একটা সিগারেট ধরালো। পকেটে হাত দিয়ে দেখল ঘোষাল কে দেবার জন্য 'মালটা', ঠিকঠাকই আছে। হঠাৎ ওর আশঙ্কা হোল,আচ্ছা, ঘোষাল আবার, খেলার টিকিট এনে দেবার ইঙ্গিত দিল নাতো ! সর্বনাশ। সে তো বিরাট দাম। পাবেই বা কোথায়? অনেক খরচ বাঁচিয়ে এ টাকাটা রেখে দিয়েছিল আলাদা করে ; এখন আবার যদি অন্য বায়না ধরে তাহলেই হয়েছে। সুখময় অস্থির হয়ে উঠল চিন্তায়। ওদিকে স্টাফ ক্লাবে মিটিং শুরু হয়ে গেছে। বাকি অফিস প্রায় ফাঁকা। সুখময় বসে রইল। উদ্বেগও বাড়তে লাগল। টাকাগুলো ঘোষাল কে আজ দিয়ে দিতে পারলেই ল্যাঠা চুকে যেত। ও ও হাঁপ ছেড়ে বাঁচত। 

বেলা পড়ে এসেছে। গোধূলির সোনালি আলো তেরচা হয়ে ছাদের কার্নিশে যেন তুলি বুলিয়ে দিয়েছে। আরো একটু পরে ছটা নাগাদ মিটিং ভাঙলো। সবাই বেরোল একে একে। ঘোষাল ব্যাগ হাতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন। সুখময়ও তড়িঘড়ি ফলো করে নীচে নামতে থাকলো। একতলার লবিতে পৌঁছে ও পেছন থেকে নীচু স্বরে ডাকলো "স্যার, একটা কথা .... ঘোষাল চমকে পেছন ফিরেই ওকে দেখে ভুরু কুঁচকে বললেন , "একি আপনি? এখনো যাননি?' --" না স্যার, মানে... .. সুখময় পকেটে হাত ঢোকালো। "আরে, কিছু বলার থাকলে চটপট বলে ফেলুন। অনেক দেরি হয়ে গেছে।" সুখময় তাড়াতাড়ি টাকার গোছাটা পকেট থেকে বের করে বললো ... স্যার, মানে এই সামান্য ...আপনার জন্য.." ডেপুটি ঘোষাল এক পলক সুখময়ের, হাতে ধরা টাকাগুলোতে চোখ বুলিয়ে নিলেন। তারপরেই উচ্চৈঃস্বরে হা - হা করে হেসে উঠে বললেন -- " আমার জন্য? কত দিচ্ছেন? হা--হা..হা । সুখময় অপ্রস্তুত হয়ে তাড়াতাড়ি বলে উঠলো --" স্যার, আপাতত এইটা জোগাড় করেছি। পরে নাহয় আরও কিছু ... " ––―"আপনি এইটা দেবার জন্য এতক্ষণ বসে ছিলেন? হা..হা....হা..। সুখময় কিছু বলতে যাচ্ছিল,কিন্তু তার আগেই অরুণ ঘোষাল একটা থাবার মত হাত থপাস করে ওর কাঁধের ওপর ফেললেন। কাঁধটা ঝনঝন করে উঠল। - ---"পঁয়ত্রিশ বছর,বুঝতে পেরেছেন -- পঁয়ত্রিশ বছর চাকরি করছি এই ডিপার্টমেন্টে। সামনের মাসে রিটায়ারমেন্ট। বুঝলেন?" -----ঘোষালের গলা গমগম করছে ---- যতই আপনারা বাউন্সার ঝারুন, ঘোষাল ইজ স্টিল ব্যাটিং -- আনবিটেন। আজ পর্যন্ত, কোনো দিনতো কিছু ....আর এই কটা দিনের জন্য, কেন আর মিছিমিছি ..? একটু আনবিটেনই থাকতে দিন না। কি বলেন? ওটা রেখে দিন, আপনার কাজে লাগবে।" ডেপুটি ঘোষাল থামলেন। হতভম্ব সুখময়ের মুখ দিয়ে কোনো কথা বার হোলনা। ঘোষাল ওর কাঁধে হাত রেখে ফের বললেন ---"কাল আসুন। মনটা আজ বড্ড খারাপ। মোহনবাগান হেরে গেছে। নইলে একটু চা খাওয়া যেত কোথাও। আচ্ছা চলি।" বলে আর দাঁড়ালেন না। মিশে গেলেন মুহূর্তে,কলকাতার রাজপথের ভীড়ে। 

সুখময় ক্ষনিক সেদিকে তাকিয়ে রইল। তারপর পেছন ফিরে অফিস বাড়িটার দিকে দেখল একবার। খেয়াল করেনি এতক্ষন, কখন, সব আলোগুলোই জ্বলে উঠেছে লবিতে। সেই মান্ধাতার আমলের কাঠের সিঁড়ি, সেই ধূসর দেওয়াল, তবুও একটু যেন অন্যরকম। 

সুখময় বাড়ির পথ ধরল।

2 comments:

  1. বাহ্, খুব ভাল লাগল পড়ে।

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো লাগলো লেট্ কাট গল্পটি

    ReplyDelete