0

প্রাচীন কথা - দোলা সেন

Posted in


প্রাচীন কথা


পঞ্চকন্যা - তারা
দোলা সেন 


অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী তারা মন্দোদরীস্তথা।
পঞ্চকন্যা স্মরেন্নিত্যং মহাপাপম বিনাশনম॥

এই পঞ্চকন্যা নিয়ে আমার বিস্ময় আর ফুরায় না। এক তো সেই পুরুষশাসিত যুগে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ দেখে তাবড় তাবড় বীর ও জ্ঞানী পুরুষেরা চুপ করে বসে থাকেন। স্ত্রীকে হাতি ঘোড়া রথের মতোই বাজি রাখেন একপঞ্চমাংশের স্বামী। আবার নিজ শৌর্যের পরিচয় দিতে স্ত্রীকে উদ্ধার করার পরেও তাকে এমনই কটু অপমানজনক কথায় বিদ্ধ করেন তথাকথিত ঐশ্বরিক পুরোষোত্তম যে, রমণী ধিক্কারে, ঘৃণায় আগুনে ঝাঁপ দেন। আবার সেই যুগেই এই শ্লোক? দুই মহাকাব্যে এত অজস্র ঋষি মুনি রাজা মহারাজা থাকতে সর্বপাপ বিনাশ করতে পাঁচজন নারীকে বেছে নিতে হল শাস্ত্রকারদের? কিন্তু কেন? এই প্রশ্ন আমায় তাড়া করে বেড়ায়। আবার এই নির্বাচনে এমন পাঁচজনকে খুঁজে বের করা হয়েছে যাঁরা স্বীয় চরিত্রবলে ভাস্বর। সবচেয়ে বড় চমক বোধহয় এই শেষ দুই নির্বাচনে। সেখানে শ্লোককার আর্য অনার্যের সীমানা ছাড়িয়ে মানবতার অঙ্গনে উপস্থিত হয়েছেন। তীব্র বর্ণবৈষম্যকে পার করে তিনি খুঁজে নিয়েছেন, কাব্যে উপেক্ষিতা দুই অনার্য নারীকে। তারা এবং মন্দোদরী।

রামায়ণ যেহেতু মহাভারতের চেয়েও ভারতবাসীর অনেক প্রাণের কাছের জিনিস, তাই বিভিন্ন অঞ্চলের জনজীবন তাদের আপন আপন সংস্কৃতি, আচার, মনন অনুযায়ী কাহিনীকে তাদের আপন রসে জারিত করে নিয়েছে অনেক বেশি পরিমাণে। ফলে বিভিন্ন এলাকায় তার চেহারা এতোটাই বদলে গিয়েছে যে একের সঙ্গে আরেকজনের মিল পাওয়া দুস্কর। তাই মোটামুটিভাবে আমি বাল্মীকি রামায়ণের চলিত রূপটাকেই আশ্রয় করেছি। তবে বিভিন্ন অঞ্চলের রূপবদল যে আমার লেখা বা ভাবনাকে প্রভাবিত করে নি একথা বললে নেহাতই মিছে কথা বলা হবে।

তার এবং মন্দোদরী। আজকের যুগেও যখন এই দুই মানবীর কথা পড়ি, তখন আধুনিকতার সংজ্ঞাটা আরেকবার বুঝে নিই। পুরুষের অন্তরালে বাস নয়, পাশে বসে কর্মক্ষেত্রের ভার নিয়েছেন, এই দুই নারী। বিশেষ করে তারার কথা ভাবতে গেলে আমার বারবার চিত্রাঙ্গদার কথা মনে পড়ে। যুগের থেকে অনেকটাই এগিয়ে থাকা এই নারীকে বুঝতে গেলে সেই সামাজিক প্রেক্ষপটটির একটি রূপরেখা আমাদের জানা প্রয়োজন।

তারার জন্ম বানরবংশে। এখানে বানর বলতে অবশ্যই গাছের বানর নয়। সে সময় অনেক অনার্য সম্প্রদায় নিজেদের প্রতীক হিসেবে বিভিন্ন পশুপাখীর টোটেম ব্যবহার করত। যেমন বানর, সর্প, পক্ষী ইত্যাদি। প্রকৃতির অনেক কাছাকাছি থাকা এই মানুষগুলির রুচি, শিক্ষা, সামাজিক রীতি আর্যদের চেয়ে অনেকটাই আলাদা ছিল। শিক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রে নারীর যোগদানের কোন বাধা ছিল না বলেই মনে হয়। অন্তত তারার ব্যক্তিত্ব এবং তার সর্বজনগ্রাহ্যতা দেখে আমার এমনটাই মনে হয়েছে। গোষ্ঠিপতি পুরুষই হতো। কোন নারীর স্বামী মারা গেলে তার উপর স্বামীর ভাইয়ের অধিকার স্বীকৃত ছিল। তবে ভাই জীবিত থাকলে তার পত্নীকে অধিকার করা নিন্দনীয় এবং পাপ বলে পরিগণিত হতো। পারিবারিক আনুগত্য, ভাইয়ে ভাইয়ে সদ্ভাব কাম্য ছিল। গোষ্ঠীর সদস্যরা সাধারণভাবে গোষ্ঠিপতি বা রাজার বশ্যতা স্বীকার করে চলত।

অহল্যা বা দ্রৌপদীর মতো দৈবী কৃপায় জন্মাননি তারা। এমন কি কুন্তীর মতো রাজার ঘরেও নয়। তিনি বানরবৈদ্য সুষেণের কন্যা। অপুর্ব রূপশালিনী এই কন্যাটি তীক্ষ্ণ বুদ্ধিশালিনী এবং সর্বশাস্ত্রে পারঙ্গমা। বিভিন্ন সময়ে তাঁর দূরদর্শিতার পরিচয় আমাদের বিস্মিত করে। কিস্কিন্ধ্যার অধিপতি বানররাজ বালী তার স্বামী। প্রবল পরাক্রমী এই পুরুষটি তাঁর স্ত্রীর বিচক্ষণতা ও বিচারবোধে মুগ্ধ। তারার পরামর্শে বানররাজ্য ক্রমশ সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। সবই ঠিকঠাক চলছিল। কাল হলো বালীর শক্তির গর্ব আর ভয়ঙ্কর রাগ। সেখানে আঘাত লাগলে স্ত্রীর কথায় বিন্দুমাত্রও কর্ণপাত করেন না বানররাজ।

একদিন রাতে তিনি ঘুমোচ্ছেন – রাজবাড়ির দরজায় দানব দুন্দুভির বেজায় হাঁকডাকে তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। কী ব্যাপার! না, অসীম বলশালী এই দানব শুনেছে, এই পৃথিবীতে তার সমক্ষ একজনই আছে। তার নাম বানররাজ বালী। বালীকে হারাতে পারলেই সে এই জগতের শ্রেষ্ঠ শক্তিশালী বলে বিবেচিত হবে। তার এক্ষুণি লড়াই চাই।

রাতদুপুরে ঘুম ভেঙে এসব শুনতে কারই বা ভালো লাগে। বালীরও লাগলো না। তারা যতই নিষেধ করুক, এখনই এই অভদ্র দানবটাকে উচিত শিক্ষা দিতে তিনি কৃতসংকল্প।

অতএব লড়াই হলো। বালী জিতলেন এবং দুন্দুভিকে মাথার ওপর তুলে বাঁই বাঁই করে ঘুরিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন বহুদূরে। রাগ আর রাত দুয়ে মিলে দিক বুঝতে পারা সম্ভব নয়। তিনিও পারলেন না। কপাল খারাপ হলে যা হয়। দুন্দুভির দেহ গিয়ে পড়ল ঋষ্যমূক পর্বতে। সেখানে তখন মার্তণ্ড মুনি তাঁর শিষ্যদর নিয়ে যজ্ঞ করছিলেন। তাঁর পুজো পণ্ড হলো। তিনি বেজায় রেগে শাপ দিলেন – এই ঋষ্যমূক পর্বতের ধারেকাছে আসলেই বালীর মৃত্যু অবধারিত।

কি আর করা যাবে! সারা পৃথিবীতে ঐ একটিমাত্র জায়গা বালীর অনধিগম্য হয়ে রইলো।

কিন্তু লড়াই করতে যে ভালোবাসে, সে নতুন প্রতিপক্ষ খুঁজে নেবেই।। এবারে বালীর লড়াই মায়াবীর সঙ্গে। মায়াবী দুন্দুভির ভাই। ভাইয়ের মৃত্যুর বদলা নিতে সে এসেছে বালীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে। কিন্তু যুদ্ধে হার নিশ্চিত দেখে মায়াবী পালাতে গেল। ততক্ষণে বালীর রোখ চেপে গেছে। তিনি ভাই সুগ্রীবকে নিয়ে মায়াবীর পিছু ধাওয়া করলেন। ছুটতে ছুটতে মায়াবী এক গুহার মধ্যে আশ্রয় নিল। তখন সুগ্রীবকে গুহামুখে পাহারায় রেখে বালী ভিতরে ঢুকলেন। ভাইকে বলে গেলেন, গুহামুখ থেকে যদি সাদা রক্ত বের হয় তাহলে জানবে মায়াবী মেরেছে। তখন তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করবে। আর যদি দেখ লাল রক্ত বের হচ্ছে তাহলে বুঝবে আমি নিহত হয়েছি। সেক্ষেত্রে তুমি এই গুহামুখ বন্ধ করে রাজ্যে ফিরে যাবে এবং রাজা হয়ে সবার খেয়াল রাখবে।

দিন যায়। গুহার ভিতর কি হচ্ছে কেউ জানে না। বাইরে বসে বসে অধৈর্য হয়ে পড়েন সুগ্রীব। ক্ষমতার লোভও কি কাজ করে ভিতর ভিতর? যাই হোক, সুদীর্ঘ আঠাশ দিন (মতান্তরে একবছর) পরে গুহামুখ থেকে গলগল করে বেরিয়ে এল লাল রক্ত! সুগ্রীব তড়িঘড়ি গুহার মুখে বিশাল এক পাথর চাপা দিয়ে রাজ্যে ফিরে এলেন। তাঁর মুখে সব শোনার পর বানরকুল তাঁকেই রাজা বলে মেনে নিল। সমাজের নিয়মমতে তারা এখন তাঁর মহিষী!

এদিকে হয়েছে কি, প্রথমটায় গুরুতর আহত হলেও বালী আসলে মরেননি! আরও অনেকদিন তিনি মায়াবীর সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে হত্যা করলেন। লড়াই করতে করতে তাঁর একদমই সময়ের খেয়াল নেই। তিনি জানেনই না এর মধ্যে কতোদিন পেরিয়ে গেছে। এইবার তাঁর ফেরার পালা। কিন্তু বেরোতে গিয়ে তিনি ভীষণ অবাক! গুহামুখ বন্ধ কেন? ভাই সুগ্রীবের তো এখানেই অপেক্ষা করার কথা! অতিকষ্টে তিনি পাথর সরিয়ে বাইরে এলেন। তারপর একটু সুস্থ হলে রওনা দিলেন কিস্কিন্ধ্যার উদ্দেশ্যে।

রাজসভায় ঢুকে তো তাঁর চক্ষু চড়কগাছ! সুগ্রীব রাজসিংহাসনে! পাশে আবার তারা! বালী রাগে অন্ধ হয়ে গেলেন। সুগ্রীব কতো বোঝালেন, মাপ চাইলেন, রাজ্য ফিরিয়ে দিতে চাইলেন – কিন্তু বালীর কানে তার কিছুই ঢুকলো না। অন্যরাও চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোন ফল হলো না। তখন উপায়ান্তর না দেখে প্রাণ বাঁচাতে সুগ্রীব রাজ্য ছেড়ে ঋষ্যমূক পর্বতে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। পৃথিবীর এই একটিমাত্র স্থান বালীর হাত থেকে সুরক্ষিত।

বালী আবার রাজা হলেন। সুগ্রীবকে শাস্তি দিতে তিনি সুগ্রীবের বৌ রুমাকে অধিকার করলেন। তারা বারবার মানা করলেন, বোঝাতে চেষ্টা করলেন – এ অন্যায়, এ পাপ। জীবিত ভাইয়ের স্ত্রীতে উপগত হওয়া সামাজিকভাবেও অতি নিন্দনীয়। সুগ্রীব তারাকে মহিষী বানিয়েছিল বটে, কিন্তু সে তো বালীর মৃত্যু সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে।

তা রাগ, না চণ্ডাল! রেগে গেলে কবেই বা তারার কথা শুনেছেন বালী? বারবার বিপদে পড়েও তাঁর চৈতন্য হয়নি। অতএব তিনি তাই করলেন যা তাঁর মন চায়। আর এই অন্যায় আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে বানরসমাজের প্রমুখ – মহাবীর হনুমান, রাজবৈদ্য সুষেণ, নীলের মতো বিশিষ্ট শক্তিশালী কয়েকজন - তাদের অনুচরদের নিয়ে ঋষ্যমূক পর্বতে সুগ্রীবের কাছে চলে গেলেন।আত্মগর্বী বালী দৃকপাতও করলেন না।

দিন যায়। এর মধ্যে অযোধ্যা থেকে নির্বাসিত হয়েছেন পরমপুরুষ রাম। তাঁর চোদ্দ বছর বনবাসের সময় একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। তাঁর পত্নী সীতাকে হরণ করে নিয়ে গেছেন রাক্ষসরাজ রাবণ। কিন্তু কোথায় যে তিনি সীতাকে লুকিয়ে রেখেছেন কেউ জানে না। সেই খোঁজে ছোটভাই লক্ষ্মণকে নিয়ে তিনি এসে পৌঁছেছেন ঋষ্যমূক পর্বতে। সুগ্রীব দেখলেন এই সুযোগ। তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেন, রাজ্য ফিরে পেলে তিনি সর্বশক্তি দিয়ে সীতাকে খুঁজে বের করবার চেষ্টা করবেন। রামেরও তখন লোকবলের একান্ত প্রয়োজন। কাজেই চুক্তি হতে দেরি হলো না।

রামের ভরসায় সুগ্রীব ঋষ্যমূক পর্বতের আশ্রয় ছেড়ে বাইরে এসে বালীকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করলেন। তারা রামের ঋষ্যমূক পর্বতে আসর খবর রাখতেন। দুয়ে দুয়ে চার করতে তাঁর মতো বুদ্ধিমতীর ভুল হল না। বারবার তিনি বালীকে বারণ করলেন। বললেন, সুগ্রীবের মতো ভীতু মানুষ যখন এই দুঃসাহস করছে তখন তার পিছনে নিশ্চয় রামের মদত আছে। রাম নিশ্চয় কোন না কোনভাবে এই যুদ্ধে বালীকে মারার চেষ্টা করবেন। অতএব বালীর উচিত এই আহ্বানে সাড়া না দেওয়া।

বালী শেষবারের মতো তারার অবাধ্য হলেন। তিনি সুগ্রীবের সঙ্গে হাতাহাতি লড়াইয়ে যোগ দিলেন। চুক্তি অনুযায়ী রামচন্দ্র আড়াল থেকে তীর মেরে বালীকে ধরাশায়ী করলেন। অমিত শক্তিধর বালী কিন্তু বেশ খানিকক্ষণ বেঁচে ছিলেন এর পরেও। তিনি প্রথমে রামকে একহাত নিলেন কাপুরুষের মতো পিছন থেকে আঘাত করায়। তারপর বললেন – সীতার খোঁজ নেবার জন্য এই চাতুরির কোন দরকার ছিল না। আমাকে বললে আমিই রাবণকে মেরে তোমার সীতা উদ্ধার করে দিতাম। বালী কাউকে ফেরায় না।

ইতিমধ্যে রাজবাড়িতে খবর পৌঁছেচে। শোকে আকুল হয়ে তারা ছুটে আসছেন রণক্ষত্রে। পথের মাঝে তাকে আটকাল বালীর অনুগত বানরের দল। তারা তারাকে নিয়ে রাজধানী সুরক্ষিত করতে আগ্রহী। দাদার হত্যাকারীর হাত থেকে সিংহাসন বাঁচানোর এই একমাত্র উপায়। তারা দৃঢ়স্বরে জানালেন, বালীই যদি না থাকেন, তাহলে তারার কাছে রাজ্যের কোন মূল্য নেই। তিনি বালীর কাছেই যেতে চান। শত অঙ্গদও( তারা ও বালীর পুত্র) বালীর কাছে তুচ্ছ।

এরপর তিনি পৌঁছালেন বালীর কাছে। তাঁর দুঃখের কান্নায় পাথরের চোখেও জল আসে। সুগ্রীব তো সামান্য বানর। তার অনুতাপের অবধি রইলো না। তারা রামকে বললেন – আর দেরি কেন হে পুরুষোত্তম। যে তীরে আমার স্বামীকে হত্যা করেছেন, সেই তীরে আমাকেও বিদ্ধ করুন। আমি ছাড়া বালী স্বর্গেও ভালো থাকতে পারবে না। আমি শুধু তার সঙ্গেই থাকতে চাই।

তারার কান্নায় রামচন্দ্রও বিচলিত হয়ে পড়লেন। হনুমান তারাকে অনেক প্রবোধ দিলেন। অঙ্গ আর রাজ্যের কথা ভাবতে বললেন বারবার। এমন সময় বালী কথা বললেন –

- ভাই সুগ্রীব, যদি আমরা ভাই ভাইয়ে লড়াই না করে মিলেমিশে থাকতাম, তাহলে আমরা অজেয় থাকতাম। সময়ে তা করা হল না। এখন তুমি রাজ্য ও তারাকে ভোগ করো। তারা অত্যন্ত দূরদর্শী। সবসময় তার কথা শুনে রাজ্য চালনা করো। রাজ্যের এবং তোমার মঙ্গল হবে। অঙ্গদ আমার খুব আদরের। তার যত্ন নিও।

আর অঙ্গদ, তুমি কাকার কথা মান্য করে চলো। তার অনুগত থেকো। তার প্রিয়সাধন করো।

এইসব বলে বালি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। আর তারা? মৃত্যুকালে বালী রাম, অঙ্গদ এমনকি সুগ্রীবের সঙ্গেও কথা বললেন, কিন্তু তারার জন্য তাঁর মুখ থেকে একটি বাক্যও বের হলো না! অথচ তারাকে কিভাবে ব্যবহার করলে সুগ্রীব উপকৃত হবেন, তার টিপস দিতে ভুললেন না। তারা কি ভেবেছিলেন, তাঁর মনে কিসের আলোড়ন উঠেছিল, সে বিষয়ে মহাকবি একান্তই নীরব।

গুণীজন, অপরাধ নেবেন না, যদি এইখানে একটি মেয়ের মন দিয়ে আমি তারাকে বুঝতে চাই। তারা দেখলেন তিনি একা। যে স্বামীর জন্য তাঁর কাছে নিজের এমনকি একমাত্র ছেলের জীবনও তুচ্ছ মনে হয়েছিল, তিনি রাজ্যের সঙ্গে স্ত্রীকেও সঁপে দিলেন ভাইয়ের হাতে। নাকি বালীর অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল? কিছু কি বার্তা তিনি দিলেন তারাকে? চিরকালের প্রেমিক স্বামী হঠাৎ করে মৃত্যুমুখে এভাবে মুখ ফেরান যদি, তাহলে তার অবশ্যই কোন গূঢ় কারণ আছে। হঠাৎ করে পুরো দৃশ্যের আর একটি অর্থ তাঁর সামনে প্রতিভাত হল।

বালীর সাহায্যে সীতা উদ্ধার করলে রামের কোন কৃতিত্ব থাকে না। কারণ বালী একাই পুরোটা সামলে নেবেন। সে জায়গায় এই মেরুদণ্ডহীন সুগ্রীবকে রাজা করলে তিনি বাস্তবে সম্পূর্ণ বানর বংশকে হাতের মুঠোয় পেয়ে যাচ্ছেন। এখানে উদ্ধারের সব কৃতিত্ব রামচন্দ্রের। অঙ্গদ ও বানররাজ্যের গভীর সংকট এখন। তাই নিজেকেই নিজে শান্ত করলেন তারা। রামচন্দ্রের বন্দনা করে নিজের ভাগ্যকেই দোষারোপ করলেন। রামও নিজের কৃত অন্যায় শোধনের একটা রাস্তা পেয়ে গেলেন। তিনি সুগ্রীবের রাজ্যভিষেকের সঙ্গে সঙ্গে অঙ্গদের যৌবরাজ্যে অভিষেকও করালেন। তারা বুঝলেন বানরজাতি ও ছেলেকে বাঁচাতে হলে এ ছাড়া আর পথ নেই। তাই তিনি সুগ্রীবের মহিষীর পরিচিতিটা মেনে নিলেন।

এখানে তারার যে স্থিতপ্রজ্ঞার পরিচয় আমরা পাই, তা সত্যিই অবাক করার মতো। এরপর আমরা দেখবো তাঁর ক্ষুরধার কূটনৈতিক চালে কিভাবে বশীভূত হন লক্ষ্মণ।

সুগ্রীব রাজা হয়ে যথারীতি আমোদে গা ভাসালেন। রুমা, তারার মতো সুন্দরী যাঁর গৃহে, সে তো শ্রেষ্ঠ রম্য নিকেতন। বনবাসী রামের কথা, সীতা উদ্ধারের কথা তাঁর মনেই রইলো না। তারা অবশ্য বারে বারে মনে করিয়ে দেন পূর্ব প্রতিশ্রুতির কথা, না মানলে কী কী বিপদ হতে পারে সে কথা। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল দুই ভাইয়ের অবাধ্য হবার ব্যাপারে অন্তত বেশ মিল রয়েছে।

কিছুদিন বাদে সীতা উদ্ধারের কোন তোড়জোড় না দেখে রেগে গিয়ে রাম লক্ষ্মণকে পাঠালেন বিষয়টা সরোজমিনে তদন্ত করে দেখে আসতে। লক্ষ্মণ এসে দেখেন সুগ্রীব সুরায় ও নারীতে আকণ্ঠ ডুবে রয়েছেন। এমনকি নেশার ঘোরে লক্ষ্মণের সঙ্গেও যে ব্যবহার করলেন, সেটা ভোটে জেতার পরে নেতারা জনতার সঙ্গে যেমনটি করে থাকেন। লক্ষ্মণ স্বভাবতই খুব রেগে গেলেন। তারা দেখলেন সমূহ বিপদ। রাম আর্যবংশের মহান প্রতিভূ। তাঁকে চটালে বানররাজ্যের সর্বনাশ কেউ ঠেকাতে পারবে না। অতএব তিনি পরিস্থিতির হাল ধরলেন।তিনি লক্ষ্মণকে যথাবিহিত আপ্যায়ন করে বললেন –

- আপনি পরম জ্ঞানী। এই তুচ্ছ বানরের উপর রাগ করা আপনার শোভা পায় না। সুগ্রীব সামান্য বানর। তার উপর রাজার ভাই হয়েও দীর্ঘদিন বনে জঙ্গলে বহু দুঃখ কষ্টে দিন কাটিয়েছে। সে তো আপনি জানেন। তাই হঠাৎ এই বিলাস ব্যাসন পেয়ে একটু বিস্মরণ ঘটেছে মাত্র।

- আমি সামান্যা নারী হয়ে আপনাকে কী বোঝাবো। নারীর মোহে যুগে যুগে কতো বড় বড় মুনিঋষির তপোভঙ্গ হয়েছে সে আমার চেয়ে আপনি অনেক বেশি জানেন। আর এ তো বনের বানর। তার সেই শিক্ষাই বা কোথায়?

এইসব বলে টলে তারা যখন দেখলেন লক্ষ্মণ একটু নরম হয়েছেন, তখন তিনি তাঁর ব্রহ্মাস্ত্রটি বের করলেন। মধুরভাষে জানালেন, একা হাতে সীতা উদ্ধার করা সম্ভব হলে, রামের মতন বীর কখনো সুগ্রীবের মতো সামান্য বানরের সঙ্গে মৈত্রীতে আবদ্ধ হতেন না। সুগ্রীবের যেমন রামকে প্রয়োজন, রামেরও সুগ্রীব ও তার সৈন্যবাহিনীর প্রয়োজন।

লক্ষ্মণ শান্ত হলেন। ইত্যবসরে সুগ্রীব এসেও ক্ষমা টমা চেয়ে পরিস্থিতি সামলে নিলেন। তারার কূটনৈতিক বুদ্ধি সুগ্রীব তথা বানর জাতিকে রক্ষা করল। এরপরে রামায়ণে আর তারার কোন উল্লেখ পাই না। তাঁর আরব্ধ কাজ করে তিনি আবার কাব্যের অন্তরালে চলে গেলেন।

সত্যিই কি গেলেন? তাহলে পঞ্চকন্যার নাম করতে গিয়ে এই ধীময়ী দূরদর্শী এবং বিচক্ষণ রমণীর কথা শ্লোককারের মনে পড়ত না। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে জানেন – সীতা যখন রামের কটু অপমান সহ্য করতে না পেরে আগুনে ঝাঁপ দিচ্ছিলেন, তখন এই অসামান্য নারীটির ভাবনা কেমন ছিল? মহাকবি সে বিষয়ে কোন ইঙ্গিত দেননি।

0 comments: