0

গল্প - রূপশ্রী ঘোষ

Posted in




















সবে সবে সকাল হয়েছে। তখনো দিনের আলো খুব ভালো করে ফোটেনি। হালকা শিশিরে ভেজা ভেজা রাস্তা। মোড়ল গিন্নি বাড়ির পাশের পুকুর পাড় পেরিয়ে পৌঁছে গেল তাদের গোয়াল ঘরে। ভোরেই ওঠা অভ্যাস গ্রামের মানুষের। উনানে চায়ের সস্‌প্যান বসানোর আগে তাদের অনেক কাজ থাকে। বাড়ির পুরুষরা উঠে পড়ার আগেই কাজগুলো সেরে নিয়ে তাদের ঘরের কাজে মন দিতে হয়। মোড়ল গিন্নিও সকাল সকাল উঠে গোয়াল ঘর থেকে গোরুগুলো গোয়াল চালায় বের করে দিয়ে গোয়ালটা পরিষ্কার করে নেয়। মশা তাড়ানোর জন্য বিকেলে ধোঁয়া দেওয়ার নোংরাগুলো সরিয়ে, গোরুর খাবারের ডাবায় জল, জাব সব দিয়ে যতটা পারা যায় কাজ গুছিয়ে নিচ্ছিল। এমন সময় ভজু এসে হাজির। অত ভোরে ভজুকে দেখে মোড়ল গিন্নি একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল,

কী রে ভজু এত ভোরে উঠেছিস কেন? কী খবর?

(ভোরের মতোই শান্ত গলায়) কিছু না দিদা... একটু খাবার দাবার জোগাড় করব...

(আরো অবাক চোখে) খাবার দাবার? কী খাবার তুই এই ভোরে জোগাড় করবি?

(শান্ত গলাতেই বলতে থাকে) কিছু না, তোমাদের পুকুর পাড়ের একটু শুশনি শাক, গেঁড়ি গুগলি, বা যদি কোনো মাছ পাই...

(অবাক হওয়া আর থামে না) তুই মাছ ধরবি কীভাবে? তোর জাল কই?

(খুব নিরুত্তাপ হয়েই) জাল তো আমাদের নেই দিদা। আমি জলের ধারে ধারে ঘুরে হাতড়ে হাতড়েই ধরি...

সেকি! তুই রোজ ভোরে এসব করিস? ইস্কুল পাঠশাল কি তারপরে যাস? আগে তো তোকে দেখিনি কোনোদিন?

(একটু উচ্ছাসে) কদিন হল যাচ্ছি দিদা। কিন্তু আমি তোমাকে দেখি রোজ। তুমি গোয়াল ঘরে ঢুকে যাও যখন তখন আমি যাই, তাই দেখতে পাও না। ও হ্যাঁ, আমি এখন আর স্কুলে যাই না। পড়া ছেড়ে দিয়েছি...

(বিস্ময়ে) সেকি! কেন? তোকে খাবার জোগাড় করতে হচ্ছে বলে? তোর দাদু জোগাড় করে না?

(বেশ অবাক চোখে তাকিয়েই) তুমি জানো না দিদা? দাদুর পা ভেঙে গেছে তো। আগে তো এমনিতেও কষ্ট করেই ভিক্ষে করত লাঠি ধরে ধরে... একদিন পুকুরঘাটে পড়ে পা ভেঙে গেছে...

(উদ্বিগ্ন হয়ে) ও তাই নাকি? আমি শুনিনি তো কারোর মুখে। তোর দিদার সঙ্গেও তাই দেখা হয়নি অনেকদিন। তা তোর মা আর টাকা পাঠায় না?

(বেশ নিচু স্বরে) না গো দিদা! তাই জন্যই তো এত কষ্ট...

গ্রামে কোনো ঘটনা ঘটলে এমনিতে কারোর জানতে বাকি থাকে না। ছোটো জায়গায় সবাই সবার পরিচিত। সবাই সবার আপনজন যেন। ঝগড়া বিবাদ যেমন থাকে আবার একে অপরের বিপদে আপদে এগিয়ে এসে সাহায্য করতেও কোনো কার্পণ্য করে না। বড়ো বেশি আন্তরিক গ্রামের মানুষ। তবুও ভজুর দাদুর পা ভাঙার কথাটা মোড়ল গিন্নির কানে কেন যায়নি কে জানে। এমন মাঝে মধ্যে হয়েও থাকে, কিছু ঘটনা মিস হয়ে যায়, অজানা থেকে যায় মানুষের কাছে। যেভাবে ভজুর দাদুর ঘটনাটা অজানা রয়ে গেছে মোড়ল গিন্নির কাছে, তেমনই।

ভজু গ্রামে থাকলে সে ‘খাব না’, ‘যাব না’ করেই কথা বলত। ওই গ্রামের ছেলেমেয়েদের মতো খাবুনি যাবুনি সে বলতে শেখেনি। কারণ ভজুর জন্ম কলকাতায়। ভজু প্রথম কথা বলাটাও শিখেছে কলকাতার আদলে। তাই ভজুর কথায় শুরুতে অমন গ্রামের টান ছিল না। পরে থাকতে থাকতে সে ওই টানটা রপ্ত করে নিয়েছিল। ভজু ওই গ্রামে যখন পৌঁছল তখন তাকে নিয়ে সবার বেশ একটা কৌতূহল ছিল। হঠাৎ করে কলকাতা থেকে একটা নাদুস নুদুস বাচ্চা গ্রামে উড়ে এসে জুড়ে বসল আর গ্রামের মানুষ তাকে ছেড়ে দেবে? বুড়ো থেকে বাচ্চা তাকে নিয়ে কেউ কৌতূহল প্রকাশ করবে না, এটা কি সম্ভব? সম্ভব নয়। গ্রামের ছেলে বুড়ো সবাই ভজুকে দেখলেই একগাদা প্রশ্ন করত। ভজুর একটা ভালো নাম থাকা সত্ত্বেও সে সবাইকে ওই ‘ভজু’ নামটাই বলেছিল। ভজু যখন তার দিদা বা দাদুর হাত ধরে দোকান পাটে বেরোত তখন ভজুকে কেউ ঝামেলা করত না। বলা ভালো করার সাহস পেত না। কিন্তু ভজু একা বেরোলেই তাকে সবাই ছেঁকে ধরত। ধীরে ধীরে আবিষ্কার হল ভজু বেদোছেলে। না গ্রামের বাচ্চাদের মতো ভজু নিজে জানত না ‘বেদোছেলে’ মানে কী? কিন্তু ভজু বাইরে বেরোলেই গ্রামের কোনো কোনো আধবুড়ো লোক তাকে দেখতে পেলেই বলত,

(একেবারে অবলীলায় ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে) কী রে বেদোছেলে কোথায় যাচ্ছিস?

(যেন এটাই তার নাম এমনটা ধরে নিয়েই, খুব অকপটে) ওই তো সাঁতেদের দোকানে যাচ্ছি... (সামন্তকে ‘সাঁতে’ বলত সবাই, ভজুও শিখে গিয়েছিল)

(তার মুখের দিকে তাকিয়েই) ও, দোকান যাচ্ছিস? তা কী আনবি বেদোছেলে?

(গড়গড় করে, যা যা দরকার) তেল, নুন, লঙ্কা, হলুদ...

(বলার প্রয়োজন নেই জেনেও) ও, যা তবে... তা তোর মা কোথায়?

(উত্তর যেটা হয় সেটাই) কলকাতায়...

(বেশ কৌতূহলে) তা কবে আসবে তোর মা?

(উদাসীনভাবে) আমি জানি না... তবে দিদা বলছে, মা ছুটি পেলে আসবে বলেছে...

স্বাভাবিকভাবে এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতেই চোখের আড়ালে মিলিয়ে যায় ভজু। ভজুর মা কবে গ্রামে আসবে তার থেকে মানুষের বেশি কৌতূহল ভজুর মা কলকাতায় কিসের চাকরি করে তা নিয়েই...। ভজু, ভজুর দিদা গ্রামের সবাইয়ের কাছে বলে রেখেছে ভজুর মা কলকাতায় চাকরি করে। গরিবের সংসারে গ্রাম থেকে ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে অনেকেই চাকরি করতে যেত কলকাতায়। মেয়েদের থেকে ছেলেরাই বেশি যেত। তাই মেয়েরা গেলে কৌতূহল বেশি হওয়ারই কথা। ভজুর মায়েরও গরিবের সংসার থেকে, পরিবারের সকলের মুখে দুটো খাবার তুলে দিতেই কলকাতায় চাকরি করতে যাওয়া। কিন্তু সবাই জানে চাকরি করতে গিয়ে ভজুর মা বিয়ে করে ফেলেছে, বাচ্চাও হয়েছে। বাচ্চাকে দেখার কেউ নেই তাই গ্রামে মা-বাবার কাছে রেখে গেছে। কিন্তু না। ভজুর মায়ের চাকরির হদিস একদিন গ্রামের লোক আবিষ্কার করে ফেলল। ভজুর মা আবার গ্রামে এসেছিল তার একটা ভাইকে গ্রামে রাখতে। কিন্তু ভজুর বাবা হিসেবে যাকে প্রথমে গ্রামে এনেছিল ভজুর ভাইয়ের বাবা হিসেবে সে ভদ্রলোক আর আসেননি। তখন থেকেই মানুষ খোঁজ খবর লাগিয়ে উদ্ধার করেছে ভজুর মায়ের চাকরিটা কী, আর ভজু কেনোই বা ‘বেদোছেলে’।

ভজু এখন রোজই ভোর ভোর বেরোয়, মোড়ল গিন্নির সঙ্গে তার দেখা হয়। এক তরফা গল্প করে ভজু পুকুর পাড় ঘুরে ঘুরে জোগাড় করে রোজকার খাবার। কোনো কোনদিন মোড়ল গিন্নি তাকে ওই ভোরেই শাড়ির আঁচলে করে মুড়ি এনে দেয়। আগে থেকে ভজুকে বলে রাখে, ‘ভজু কাল ভোরে একটা কৌটো আনিস’। এভাবে মোড়ল গিন্নি যখন যেমন পারে ভজুকে এটা সেটা এনে দেয়। তাদের বৈভবের কাছে ভজুকে সামান্য জিনিস দেওয়াটা খুবই নগণ্য ব্যাপার। কিন্তু মোড়ল গিন্নির মনেও প্রশ্ন জাগে ভজুর দাদুর না হয় বয়েস হয়েছে, পা ভেঙেছে, কিন্তু ভজুর মা হঠাৎ টাকা পাঠানো বন্ধ করেছে কেন? একা একা ভেবে কোনো উত্তর পায় না। কিন্তু মাঝে মধ্যেই ভজুর কাছে জানতে চায় মা টাকা পাঠিয়েছে কিনা। পাঠায় না শুনে, দয়ালু মোড়ল দিদার হৃদয় কেঁদে ওঠে, তাই এটা সেটা যেমন পারে সাহায্য করার চেষ্টা করে। ভজুর দিদার সংসারে আর একজন সদস্য তো বেড়ে গেছে, ভজুর ভাই। কিন্তু কী আর করে এই দিদা চেয়েচিন্তে সংসার চালানোর চেষ্টা করে। ভজু যতক্ষণ না বড়ো হচ্ছে ততক্ষণ একটা কাজ জোগাড় করতে পারবে না। ততদিন এভাবেই ভিক্ষাবৃত্তি করেই চালাতে হবে তাদের। গ্রামের নিম্নসম্প্রদায় তারা। চাষের জমি জায়গা বলতেও কিছু নেই। মাথা গোঁজার ঠাঁই বলতে মাটির ঝিটেবেড়া, খড়ের চালের ছাউনির দু কুঠরি একটা বাড়ি। বাড়ি না বলে ঘর বলাই ভালো। যেমন অন্ধকার, তেমনই স্যাঁতসেঁতে। দিনের বেলাতেও লন্ঠনের আলোয় ঘরে ঢুকতে হত তাদের। এই ঘর নিকোনোর জন্য রাস্তা থেকে গোবর কুড়িয়ে আনতে হত কিংবা মোড়ল গিন্নির থেকে চেয়ে নিত। পরে অবশ্য সরকারি আবাসন প্রযোজনা থেকে এক কামরার একটা পাকা ঘর তাদের করে দিয়েছে। ফলে মাথা গোঁজার ঠাঁই নিয়ে তাদের ভাবতে হয়নি কখনো। তবে পাকাবাড়ি হওয়ার আগে পর্যন্ত মাটির ঘর দিনে দুর্যোগের দিনে দুশ্চিন্তাতেই কাটাতে হত তাদের।

ভজুর ভাই দিনে দিনে বেড়ে ওঠে। ভজু বড়ো হয়ে কাজে বেরোনোর চেষ্টা করে। ভজু ঠিক করে নেয় সেও মায়ের মতো কলকাতায় চাকরি করবে। এবং মায়ের চাকরিটা সত্যি সত্যি কী চাকরি এবং মা কেনোই বা আর টাকা পাঠায় না, বা গ্রামের লোক তাকে কেনোই বা ‘বেদোছেলে’ বলে এসব সে আবিষ্কার করবে। বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে বুঝেছে ‘বেদোছেলে’ মানে একটা গালাগাল। কিন্তু যার অর্থ সে জানে না। শুধু সে কেন, গ্রামের বহু ছেলেমেয়েই জানে না। কিন্তু শুনে শুনে সবাই প্রয়োগ ঠিকই করে। এবং প্রয়োগটাও বুঝে করে, ভুলভাল জায়গায় করে না। তাই ভজুকে ছাড়া তারা আর কাউকেই কিন্তু খুব সাবলীলভাবে অবলীলায় ওই সম্বোধন করে না। ঝগড়ার সময় রাগের মুখে গালাগাল দেওয়া একটা আলাদা ব্যাপার, আর সচেতনভাবে বলা, দুটোর তফাৎ খুবই স্পষ্ট। তবে ভজু এমন একটা ছেলে সে একথা শুনে কোনোদিন রাগ করেনি। গ্রামের ধাঁচ, কথাবার্তা সে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বুঝেছে। তবুও রাগ করেনি কখনো। আসলে মানুষের যখন দুবেলা দুমুঠো খাবার জোগাড় করে বেঁচে থাকাটাই জীবনের মূল হয়ে দাঁড়ায়, তখন আর এসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো সময় হয়তো কারোর জীবনেই থাকে না। ভজুরও ছিল না। ভজু বড়ো হয়েছে। ওই পাড়ারই এক মামার হাত ধরে সে কলকাতায় এক বেকারিতে কাজে ঢুকেছে। আড়িয়াদহের কাছে একটা কারখানায়। কর্মচারীর কাজ। ভজু যেহেতু ওই গ্রামেরই এক মেয়ের সন্তান, তাই সে গ্রামের মানুষদের মামা, মামি, দিদা, মাসি সম্বোধনই করত।

ভজু কলকাতায় এসেছে। কাজে ঢুকেছে। কাজ করার পাশাপাশি কলকাতা সম্পর্কেও জ্ঞান আহরণ করছে। সে কলকাতার বহু জায়গার নাম শিখে গেছে এখন। একা একা এদিক সেদিক যাওয়াটাও রপ্ত করেছে। ভজুর মতো একই বয়সের বহু ছেলে বিভিন্ন জেলার গ্রাম থেকে এসেছে কলকাতায় কাজে। তারা কাজ সেরে বিকেলে রোয়াকে বসে আড্ডা দেয়। উত্তর কলকাতায় যেকোনো বাড়ির রোয়াকে বসে চাইলেই আড্ডা দেওয়া যায়। বাড়ির মালিক কিছু না বললে। ভজুরাও নিয়ম করে অমন আড্ডা দিত। কোনো কোন দিন তারা এদিক সেদিক ঘুরতে বেরিয়ে যেত। কাছাকাছি কোথাও। গঙ্গার ঘাট, দক্ষিণেশ্বর, আদ্যাপীঠ মন্দির। যেদিন যেখানে মন চাইত। একদিন ভজুর এক সহকর্মী বলল,

(কাঁধে টোকা দিয়ে) চল ভজু, আজ আমরা দক্ষিণেশ্বর যাই

(উৎসাহী হয়ে) হ্যাঁ হ্যাঁ, চলো চলো। আমি মন্দিরে যাইনি কখনো

(বেশ ব্যঙ্গ করে) সেকি! এতদিন হয়ে গেল এখনো দক্ষিণেশ্বর যাসনি? ছি ছি লজ্জার কথা, এখান থেকে তো দু’পা গেলেই হয়ে যায়... চল আজই তোকে নিয়ে যাই...

(সিরিয়াস হয়ে) হ্যাঁ, জানি। আমি গ্রাম থেকে আসার সময় বাস থেকে দেখি মন্দিরটা, কিন্তু যাওয়া হয়নি...

(উচ্ছ্বল হয়ে) চল চল, তোকে তো তাহলে নিয়ে যেতেই হচ্ছে... আর কোনো কথা নয়...

বলেই ওরা দুজনে বেরিয়ে যায় দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের উদ্দেশ্যে। ভজুর প্রথমবার যাওয়া। তাই সে শুরুতে গিয়েই চোখ কপালে তুলে হাঁ হয়ে যায়। ও গিয়ে দেখে ওখানে মন্দিরে ঢোকার মুখে যে পথ, সেখানে সারি সারি হয়ে ভিখারি বসে। এত ভিখারি যে, সে গুনে শেষ করতে পারছে না। সবাই বাটি হাতে লাইন দিয়ে বসে। নানান বয়সের মানুষ। নানান ধরনের। বয়স্ক, কানা, খোঁড়া, বিকলাঙ্গ, বোবা কী নেই সেখানে। একজনকে দান করলে হবে না। একজনকে দিলে সবাইকেই দিতে হয়। তারা বাটি বাড়িয়ে চিৎকার করতে থাকে না দেওয়া পর্যন্ত। বাটিতে রাখা খুচরো পয়সার আওয়াজ কানে বেশ ধাক্কা লাগায়। কিন্তু অত পয়সা পাবে কোথায় ভজু? কলকাতায় ভিক্ষার মূল্যও অনেক বেশি। এক টাকা দু টাকা কেউ নেয় না আর। কেউ কেউ তো আবার কিউ আর কোড নিয়ে বসে আছে। মোবাইলে স্ক্যান করে যাতে টাকা দিতে পারে, ক্যাশ না থাকলে। এটাও ভজুর কাছে একটা অভিনব পদ্ধতি। গ্রামে এত ভিখারি সে দেখেনি কখনো। একসঙ্গে তো নয়ই। গ্রামে ভিক্ষা করার ধরন আলাদা। ভিখারিরা লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষা চায়। গৃহস্থ তাদের ঝুলিতে চাল, মুড়ি এসব দেয়। ভিক্ষা করতে করতে দুপুর গড়িয়ে গেলে কেউ কেউ গৃহস্থের কাছে দুপুরের ভাতও চেয়ে বসে। তখন তাদের বাড়ির ভিতরে নিয়ে গিয়ে ভাত তরকারি খাওয়ানো হয়। আবার দুপুরের আগে ভিক্ষা করা শেষ হয়ে গেলে, ভিখারিরা নিজেরাই বাড়ি গিয়ে রান্না করে। ভজুর দাদুও ভিক্ষা করত। ভিক্ষা শেষে বাড়ি ফিরলে দিদা রান্না বসাত। তার আগে শাক সবজি, গেঁড়ি গুগলি, কোনো কোনোদিন মাছ জোগাড় করে আনত ভজু। পোষা হাঁস মুরগি থাকলে ডিমও খেতে পেত। না থাকলে ভিক্ষার চাল দোকানে বিক্রি করে তা দিয়ে তেল, নুন, ডিম ইত্যাদিও কিনত তারা। কিন্তু এমনতর ভিক্ষার ধরন তার চোখে ধাঁধা লাগায়। ভজু অবাক হয়ে চারদিক দেখতে থাকে। মন্দির দেখা শেষ হলে ওরা গঙ্গার ঘাটে গিয়ে বসে, তখন গ্রামের অনেক গল্প মনে পড়ে ভজুর। ভজু গল্প করতে থাকে বন্ধুর কাছে। সেদিন তাদের ইচ্ছে হয়েছিল হিঙের কচুরি খাওয়ার। এও ভজুর কাছে নতুন অভিজ্ঞতা। গঙ্গার ঘাট থেকে নেমে এসে সামনেই একটা দোকানে তারা গরম গরম হিঙের কচুরি আর আলুর দম খেয়ে ফিরেছিল কারখানায়। এভাবে ভজু দিন বয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে। তার কাছে আদ্যাপীঠ, বরানগর, কাশীপুর, শ্যামবাজার, বাগবাজার, সিঁথির মোড় সব এখন চেনা। দিনেদিনে আরও বেশি পোক্ত হয়ে উঠেছে ভজু। গা থেকেও চলে গেহে গ্রামের গন্ধ। কলকাতার ঘিঞ্জি রাস্তায় নির্ভয়ে রাস্তা চিনে একা চলাফেরার উপযোগী করে ফেলেছে বেশ অল্পদিনের মধ্যেই। এভাবেই আরো যত দিন যাবে তত শিখবে ভজু।

ভজু তার সমবয়সীদের কাছে সোনাগাছির নাম আর ওই জায়গার মাহাত্ম্য সম্পর্কেও জেনে নিয়েছে। একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে ভজু বেরিয়ে যায় সেখানে। এ গলি সে গলি ঘুরে সে মায়ের দেখাও পেয়েছে। কিন্তু মাকে দেখা দেয়নি সে। দূর থেকে দেখে বুঝে যেতেই সে একপ্রকার লুকিয়ে বেরিয়ে এসেছে ওই জায়গা থেকে। ভজু বন্ধুদের কাছে জেনেছে, ওখানকার বেশ্যাদের গল্প। তাদের বাচ্চাদের গল্প। ভজু নিজে বুঝেছে সে এক বেশ্যার ছেলে, তার মা বেশ্যা। তাই সে বেদোছেলে। গ্রামের ভাষায় বেদোছেলে মানে যার জন্মের ঠিক নেই। যার বাবা কে, কেউ বলতে পারবে না। এতকিছু জেনে ভজুর ঘেন্না হয়নি নিজের প্রতি। কারণ সে মনে করে, সে একজন মানুষ। তার মায়ের জন্য সে এই পৃথিবীর আলো দেখেছে। ওটা একটা পেশা। মায়ের কোনো দোষ ছিল না। মা এই পেশার বাইরে আর অন্য কোনো পেশা বাছতেই পারত না, কলকাতায় যাদের হাত ধরে এসেছিল তারা এটুকুই জোগাড় করে দিতে পেরেছে।

কিন্তু ভজু অবাক হয়েছে আরো একটা অন্ধকার দিকে আবিষ্কার করে। আরো বড়ো এক অসহায়তাকে আবিষ্কার করে। কেন তার মায়ের বা মায়ের মতো বেশ্যাদের আয় কমে যাওয়া বা ব্যবসা এখন বন্ধ হওয়ার পথে একথা জেনে। ভজু আবিষ্কার করেছে, তার মা তো প্রকৃত অর্থে গরিব তাই সে কলকাতায় আয় করতে এসেছিল। কিন্তু সে দেখছে গোটা কলকাতা এখন গরিব। অসহায়। বেশিরভাগ শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ছাত্রছাত্রী, গৃহবধূ, চাকুরিরতা মহিলা পুরুষ নির্বিশেষে সবাই গরিব। সবাই অসহায়। কেউ আর বাঁচার তাগিদে খিদের জ্বালায় অস্থির হয় না। সবাই এখন যৌন ক্ষুধায় ভুক্তভূগি। অন্যান্য কাজ বা পড়াশুনোর পাশাপাশি কল গার্ল বা অ্যামেচার প্রসটিট্যুট বা জিগোলো বানিয়ে নিজেছে নিজেদের। ভজুর ভাষায় ‘সখের বেশ্যা’। তবে হ্যাঁ, ভজু বুঝেছে এরা তার মতো কোন বেদোছেলের জন্ম দেবে না কেউ। এরা পেটের খিদের পরিবর্তে মনের খিদে মেটাবে বেশিরভাগ মানুষ। ভজুর মতো, ভজুর মায়ের মতো, ভজুর দাদু-দিদার মতো পেটের খিদে আর কারোর নেই। কারোর। এখন কেবল মানুষ মনের খিদে মেটাতে ব্যস্ত। এখন আর বেশ্যাপল্লী নয়। কলকাতার হোটেল, ফাঁকা ফ্ল্যাট সব রমরমিয়ে চালাচ্ছে এই ব্যবসা।

ভজুর মতো ছেলেরা কেবল গ্রাম থেকে এসে ভোরের তিনচাকা ঠেলাগাড়ি ঠেলে দোকানে, দোকানে, হোটেলে হোটেলে, রেস্তোরাঁয় পৌঁছে দিচ্ছে কেক, পেস্ট্রি, প্রজাপতি বিস্কুট আর স্যান্ডুইচের ব্রেড। মায়ের টাকা না পাঠানোর গল্প আর বেদোছেলে হওয়ার গল্প ঠেলাগাড়ির চাকায় ঘুরপাক খেতে খেতেই রোজ কলকাতার ভোর দেখে এখন। ভোর হয় এখনো, ঠেলাগাড়ির চাকায়।

ভজু ভাবতে থাকে মোড়ল গিন্নিদিদা আজো হয়তো ভোরে উঠে গোয়াল ঘরে চলে গেছে গোরুগুলোকে খাবার দেবে বলে। আজো হয়তো রোজ বিকেলে ঘুঁটের আগুন জ্বালিয়ে বিকেলের ধোঁয়া দেয় গোরুদের গায়ে। গোরুদের তাই ম্যলেরিয়া হয় না। কলকাতায় এখনো ম্যালেরিয়া হয়। নিয়ম করে। প্রতিটি পাড়ায়, প্রতিটি গলিতে। ভজু সাবধানে থাকার কথা ভাবে। একটা মশারী কিনে নিতে পেরেছে সে, তার আয় থেকে। কোনো মাধুকরী নয়। সুস্থভাবে বাঁচতে চায় ভজু। বাঁচার স্বপ্ন দেখে। ভোগের স্বপ্ন ভজুকে ছুঁতে পারবে কিনা ভজু নিজেও জানে না। ভজু কোনো বৌদ্ধ ভিক্ষুক নয়। ভজুর ভালো নাম ‘ভজন’। নিজস্ব কোনো পদবী নেই। সে মায়ের পদবীতে আজ ‘ভজন মালিক’। মা তপতী মালিক আজো গলিতে দাঁড়ায়। খদ্দেরের অপেক্ষায়।

0 comments: