ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়
Posted in ধারাবাহিক২৩.১
কোন এক গাঁয়ে কেউ কাউকে খুন করেছে। শত্রুতাবশ কেউ অন্য কারও নাম থানায় উন্মাদ খুনী রূপে
লিখিয়ে দিয়েছে। এবং কেউ শত্রুতাবশ ওর বিরুদ্ধে সাক্ষী হয়েছে। আবার কেউ একজন ওর হয়ে উপর
মহলে সুপারিশ করেছে। ফের কেউ ওর হয়ে কাউকে ঘুষ দিয়েছে। কেউ আবার কোন সাক্ষীকে ভয়
দেখিয়েছে, অন্য কাউকে বোকা বানিয়েছে, আবার অন্য কাউকে ভালবেসেছে। এই ভাবে হাকিমের
এজলাসে পৌঁছতে পৌঁছতে খুনের মামলাটার চেহারাই বদলে গেল। ওটা আর খুনের মামলা না হয়ে “খুন কা বদলা” নামের ড্রামা হয়ে গেল।
সেই নাটকে দু’পক্ষের দুই উকিল চমৎকার অভিনয় করল। জজের মনে হল যা প্রস্তুত করা হল সেটা
নাটক হিসেবে অতি উত্তম। কিন্তু প্রমাণ হিসেবে যা পেশ করা হল সেটা আসলে জাল। এই জালসাজির
থিওরি জজকে এমন প্রভাবিত করল যে উনি মেনে নিলেন আসামী নির্দোষ এবং এটাও ভাবলেন যে
আদপে কোন খুন হয় নি! পরিণামে ‘আসামী হরিরাম’ খুনের মামলায় সসম্মানে মুক্তি পেল।
কিন্তু আসামী হরিরাম সেরেফ জজের কথায় তো ‘সম্মানিত নাগরিক’ হয় না। সবাই জানে যে ও আগে
যেমন গুণ্ডা ছিল, জেলের বাইরে এসেও তাই থাকবে। কিন্তু ছাড়া পেতেই ও গোটা এলাকায় যাদের মানী
আদমি বলা হয়---মানে, মহিলা, অস্পৃশ্য এবং মুসলমান বাদে—তাদের সবাইকে ভোজ খেতে নেমন্তন্ন
করল। ফলে সেদিন শিবপালগঞ্জের সমস্ত বিশিষ্ট লোকজন হরিরামের বাড়িতে ভোজ খেতে গেল। শুধু
বৈদ্যজীর বাড়িতে রঙ্গনাথ একা।
সারাদিন কেটে গেল কোন নিরুত্তাপ, ক্লান্তিকর লেকচার শোনার মত। বিকেল হতেই ও হাঁটতে বেরিয়ে
পড়ল। দেখল, প্রিন্সিপাল সাহেব একটা পান দোকানে দাঁড়িয়ে আছেন।
উনি পান চিবুচ্ছেন এবং পানওয়ালাকে দাম দেয়ার চেষ্টা করছেন। তাম্বোলী অর্থাৎ পানওলা ওনাকে
পান তো খাইয়ে দিয়েছে, কিন্তু কত হল জানতে চাইলে বারবার বলছে—এটা তো আপনারই দোকান।
তখনই রঙ্গনাথ ওখানে হাজির। তাই দেখে প্রিন্সিপাল গম্ভীর চেহারায় দোকানের মালপত্রের স্টক
চেক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
চৌকাটের দেয়াল থেকে লটকে থাকা একটি বহুবর্ণের ছবিতে মহাত্মা গান্ধী দাঁত বের করে বিচ্ছিরি
হাসি হাসছেন। পাশে ওনার উত্তরাধিকারী নেহরু হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে। ছবিটির বিজ্ঞাপনের
তাৎপর্য একটি রঙিন তেল যা বাচ্চাদের সুখা রোগ সারাতে অব্যর্থ। রঙ্গনাথ প্রিন্সিপালকে বলল
‘দেখেছেন”?
জবাবে শোনা গেল এক অবধী প্রবাদ, “জইস পসু তইস বাঁধনা”। (যেমন পশু, তেমনই তার বাঁধন) যেমন
গেঁয়ো এলাকা, তেমনই তো ছবি হবে”।
-“গেঁয়ো শহুরে আবার কী কথা? সবাই তো গান্ধীজিকে সম্মান করে”। খানিকক্ষণ মন দিয়ে ছবিটা দেখে
রঙ্গনাথ বলল, “ইচ্ছে করছে যে এঁকেছে তাকে একশ’ ঘা জুতোর বাড়ি লাগাই”।
প্রিন্সিপাল হাসলেন। হাসি দিয়ে বোঝালেন যে রঙ্গনাথ নেহাতই বোকা। বললেন, “যত গুড় তত মিঠে।
তেলি-তাম্বোলীর ওজন কতটুকু? মামুলি দোকানে কেউ পিকাসো টাঙায় নাকি”?
উত্তেজিত রঙ্গনাথ মাঝখানে বলে উঠল, “দাঁড়ান, দাঁড়ান, মাস্টারমশায়! পিকাসোর নাম নাই নিলেন।
আপনার মুখে এমন নাম শুনলে বমি পায়।
হাঁটতে হাঁটতে দুজনেই এখন বড় রাস্তায় এসে গেছেন এবং গরুমোষের ভীড় ঠেলে হাওয়া খেতে চেষ্টা
করছেন। তবে, কোথাও হাওয়া নেই; আছে ফুসফুসে ঢোকার জন্যে ধূলো, নাকে ঢোকার জন্যে গোবরের
গন্ধ আর পিঠে ঢোকার জন্যে কোন গোমাতার শিং।
রঙ্গনাথের কথাটা প্রিন্সিপাল সাহেবের এত খারাপ লাগল যে উনি ভদ্র শিক্ষিত ব্যক্তির মত কথা
বলতে লাগলেন।
--“তো রঙ্গনাথজী, আপনি কি আমাকে একেবারে অশিক্ষিত ভাবেন? আমিও ইতিহাসে এম এ, ফিফটি
নাইন পারসেন্ট পেয়েছিলাম। নেহাৎ ভাগ্যের দোষে এখানে প্রিন্সিপাল হয়ে পড়ে আছি”।
এইরকম সিরিয়াস কথাবার্তার চোটে রঙ্গনাথের হিম্মত ফুস্ হয়ে গেল। ওর মনে হল, পিকাসোমার্কা
খোঁচা দিয়ে ও প্রিন্সিপালকে আহত করেছে। ও সোজা প্রিন্সিপালের কাছে ক্ষমা চাইল। বলল, “এ তো
আমি আগেই জানতাম। কোন বাজে ডিভিসন পেলে আপনি কি আর এখানে প্রিন্সিপাল হতেন”!
“সেটা ঠিক, বাজে নম্বর পেলে ইউনিভার্সিটির লেকচারার হতাম। আমার কিছু থার্ডক্লাস নম্বরওলা
বন্ধু এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়াচ্ছে বটে”।
প্রিন্সিপাল খানিকক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে চলতে লাগলেন। ভাবুক হবার চেষ্টা করছিলেন। একটু পরে
বললেন, “বাবু রঙ্গনাথ, তোমরা আমার সম্বন্ধে কী ভাব সব জানি। তুমি হয়ত ভাবছ—ব্যাটা একটা
কলেজের প্রিন্সিপাল, অথচ কীরকম ল্যাবা! সবার সামনে ‘ হেঁ -হেঁ-হেঁ’ করতে থাকে। কথাটা সত্যি।
আমি তো—খান্নাটান্নার কথা ছাড়, ও শালারা নেহাৎ ছোকরা—সবার কথা অনেকখানি মাথা নুইয়ে
শুনি। বিশেষ করে যারা আমার চেয়ে বড় তাদের কথায় হরদম তাল দিয়ে চলি। এবার তুমি আমায় বোকা
ঠাউরাতে পার, কিন্তু এরও এক কারণ আছে---
“কারণটা হল---“ কথা অসমাপ্ত রেখে উনি একটা মোষকে পথ ছেড়ে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে হেঁ -হেঁ
করে হাসতে লাগলেন।
“কারণটা হল -যেমন বুদ্ধির একটা ভ্যালু আছে, তেমনি হদ্দ বোকামিরও এক নিজস্ব ভ্যালু রয়েছে।
বোকার কথা তুমি হেসে উড়িয়ে দাও অথবা মেনে নাও—তাতে বোকার কিছু আসে যায় না। তাই আমার
কথা হল- বোকার হদ্দকে খোঁচাতে নেই।
কখনও কখনও এরকম করি বলে লোকে আমাকে হদ্দ বোকা ভাবে, আসলে ওরাই বোকা। কী বুঝলে বাবু
রঙ্গনাথ”?
প্রিন্সিপাল সাহেবের মুখ থেকে এত অবিরল বাক্যস্রোত! রঙ্গনাথ হকচকিয়ে গেল। তখনই একটা
বাছুর ওর পিঠে শিং দিয়ে খোঁচা মারল। কিন্তু রঙ্গনাথ কিচ্ছু টের পেল না। প্রিন্সিপাল ওর হাত ধরে
টেনে একপাশে সরিয়ে দিলেন। ওনার ওই ‘বুদ্ধিমান-রূপ দর্শন’ এক বিশিষ্ট অনুভব বটে। ও বুঝতেই
পারেনি কখন ওর দাঁত বেরিয়ে এল এবং কখন ও নিজেও ‘হিঁ -হিঁ-হিঁ’ করতে লাগল। পরমুহুর্তেই ও
প্রিন্সিপাল সাহেবের থেকে মাফ চাইছিল আর প্রায় এরকম কিছু বলছিল,” হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি জানি যে
আপনি পিকাসোর সম্বন্ধে সবই জানেন। জী, যাকগে যা হবার হয়েছে। জী, হয়েছে কি আপনি পিকাসোর
নাম নিয়েছেন শিবপালগঞ্জে দাঁড়িয়ে। আপনিই বলুন, এখানে কেউ পিকাসোর সম্বন্ধে ভাবতে পারে!
তাই আমার বমি পাচ্ছিল। আসলে দোষ না আপনার, না আমার; না শিবপালগঞ্জের—এমনকি
পানওয়ালারও নয়। যত দোষ সব পিকাসোর”!
প্রিন্সিপাল রঙ্গনাথের ব্যক্তিত্বের ভেঙে পড়ে খান খান হয়ে যাওয়া দেখতে লাগলেন। ফের গলার
স্বর ভারি করে বলতে লাগলে,”আমারও কখনও ওজনদার কথা বলার অভ্যেস ছিল। তখন এম এ
পড়ছিলাম। তুমি শহুরে ছুঁড়িদের রাস্তায় চলার ভঙ্গি খেয়াল করেছ? ওদের মধ্যে কেউ কেউ যুবতী
হয়েও বালিকার মত উচ্ছল হয়ে চলে। আমারও ছিল ওই অবস্থা। কখনও খেয়াল করতাম না কোন
প্রফেসর ওজনদার আর কে পাক্কা ইডিয়ট। সবার সামনে নিজেকে জাহির করতে চাইতাম। এক
প্রফেসর তাতেই খাপ্পা হয়ে আমার সর্বনাশ করলেন।
“জেনে নাও বাবু রঙ্গনাথ”!
এঁরা এখন গাঁয়ের বাজার পেরিয়ে বাইরে এসে গেছেন। সন্ধ্যা নামছে। ছোলা-বাদাম ভাজার ধুঁয়ো কড়াই
থেকে উপরে না উঠে সামনের দিকেই ভেসে বেড়াচ্ছে। সূর্য ডুবে গেছে। কিন্তু তার অন্তিম ছটা এখনও
যে আলো ছড়াচ্ছে তাতে রঙ্গনাথ ছোলাওয়ালার দোকানে বসে থাকা মেয়েটিকে দেখে চুপচাপ বুঝে নিল
–হ্যাঁ, দেখার মত জিনিস বটে!
লোকজনের বসতি প্রায় পঞ্চাশ গজ পেছনে ছেড়ে আসা হয়েছে। এ জায়গাটা জনশূন্য। এরকম
জায়গাতেই মানুষ কবিতা, লুঠপাট এবং পায়খানা সব কিছু করতে পারে। তাই কবিতা এবং লুঠপাটে
অক্ষম কিছু বাচ্চা রাস্তার দু’পাশে বসে পায়খানা করছে আর একে অন্যকে ঢিল ছুঁড়ছে। আরও
খানিকটা দূরে অনেক প্রৌঢ় এবং অভিজ্ঞ মহিলারা একই উদ্দেশ্যে রাস্তার দুপাশে লাইন লাগিয়ে
দলবেঁধে বসে আছেন। ওখানে ওনাদের আব্রুহীন উপস্থিতি নতুন ভারতের নির্মাতাদের দুয়ো দিচ্ছে।
কিন্তু ওই নির্মাতারা নিশ্চয়ই এসব ব্যাপারে অজ্ঞ, কিছুই জানেন না। কারণ, ওঁরা সম্ভবতঃ এই
সময় নিজের বাড়ির সবচেয়ে ছোট কিন্তু চকমক কামরায় কমোডে বসে খবরের কাগজ, কোষ্ঠকাঠিন্য
এবং বিদেশগমন গোছের সমস্যা নিয়ে চিন্তা করছেন।
এই দুই আগন্তুককে দেখে ওই মহিলার দল পায়খানার কাজে ফুলস্টপ লাগিয়ে সোজা উঠে
দাঁড়ালেন—যেন গার্ড অফ অনার দিচ্ছেন! তবে এসব নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তাই রঙ্গনাথ এবং
প্রিন্সিপাল সহজভাবে এগিয়ে চললেন। মহিলারাও সহজভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। একটা ছাগল ম্যা-ম্যা
করে রঙ্গনাথ আর প্রিন্সিপালের সঙ্গে ধাক্কা খেল এবং একদম রাস্তার ধারে পৌঁছে এক মহিলার
জলের লোটাকে উলটে দিয়ে পাশের একটা বাগানে ঢুকে গেল। কয়েকটা বাচ্চা ঢিল ছোঁড়া এবং প্রাকৃতিক
কাজকম্মের সাথে সাথে চেঁচাতে শুরু করল। আর ক’টা বাচ্চা ওই অবস্থাতেই উঠে ছাগলের পেছন পেছন
দৌড়তে লাগল।
এমন পরিবেশে প্রিন্সিপাল এবং রঙ্গনাথ খানিকক্ষণ মৌনব্রত ধারণ করলেন। আরও দশ গজ এগিয়ে
প্রিন্সিপাল ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিলেন—মহিলারা আগের মত লোটা নিয়ে মাটিতে বসে পড়েছে।
প্রিন্সিপাল আবার নিজের কথা শুরু করলেন-
“আমার এক প্রফেসর ছিলেন জনৈক ব্যানার্জি সাহেব। আমাকে ইতিহাস পড়াতেন। ওনার বৈশিষ্ট্য
সোজা কথাকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলা। ব্যস, লোকে ওনাকে ভারি পণ্ডিত ভাবত।
“আমি নতুন নতুন ওনার ক্লাস করছিলাম, উনি আমাকে খেয়াল করলেন এবং চাইছিলেন যে আমিও
ওনাকে বিদ্বান বলে মেনে নিই। ---
“একদিন উনি আমাদের অশোকের শিলালেখ পড়াচ্ছিলেন। তখন দেশ মাত্র আজাদ হয়েছে আর গৌতম
বুদ্ধ, সম্রাট অশোক এসব নিয়ে খুব চর্চা হচ্ছে। কারণ, তখনও চীন থাবড়া মারে নি। আমরা অহিংসা
নীতি নিয়ে খুব কিচিরমিচির করছি। রাস্তা এবং পাড়ার নামও অশোক এবং গৌতম বুদ্ধের নামে রাখা
হচ্ছে।
“প্রফেসর ব্যানার্জিও খুব আবেগে ভাসছিলেন। উনি ক’দিন ধরে খালি অশোক পড়াচ্ছিলেন এবং কথায়
কথায় গোলপোস্ট থেকে সরে আজকের রাজনীতিতে অশোক কী চমৎকার ফিট হচ্ছেন সেটা নিয়ে দু’চার
কথা বলে দিতেন। একদিন উনি এদিক সেদিক নানাপ্রসঙ্গের পর একটা শব্দে আটকে গেলেন।
“শব্দটা হল ‘বিমান’।
“হ্যাঁ, সেটাই –যেমন পুষ্পক বিমান। অশোকের শিলালেখে একজায়গায় বিমানের উল্লেখ আছে। প্রফেসর
ব্যানার্জি বললেন—‘তোমরা বোধহয় ভাবছ বিমান মানে দেবযান বা দেবতাদের বাহন’।
“রঙ্গনাথ বাবু, এইটুকু বলে বুড়ো চুপ মেরে গেল আর মুচকি মুচকি হাসতে লাগল, যেন আমরা সব
বোকাপাঁঠা। আমি বললাম, ‘প্রফেসর সাহেব, বিমানের আরও একটা মানে আছে’। তখন উনি হাত দেখিয়ে
আমাকে থামিয়ে দিলেন।
“তারপর শুধু উনিই মুখ চালাতে থাকলেন, আর কাউকে বলার সুযোগই দিলেন না। বললেন, “প্রফেসর
ভাণ্ডারকরও ঠিক এই ভুলটাই করেছিলেন। অনেকদিন আগের কথা, আমি ওনার সঙ্গে কিছু জৈন
গ্রন্থের উপর রিসার্চ করছিলাম। আর উনি আমার সঙ্গে অশোকের শিলালিপি নিয়ে রিসার্চ
করছিলেন। একদিন আমি ওনাকে জিজ্ঞেস করলা, ‘ডক্টর ভান্ডারকর, বিমান মানে কী’? উনি বললেন,
‘ব্যানার্জি, এ তো সবাই জানে—এর সামান্য অর্থ হল বাহন, বিশেষ করে দেবতাদের বাহন’।
“রঙ্গনাথ বাবু, এই গল্পটা উনি থেমে থেমে বেশ সাসপেন্স তৈরি করে বলছিলেন। আর সব ছাত্রগুলো
ভ্যাবলা মুখ করে শুনছিল। খানিকক্ষণ চুপ করে ফের শুরু করলেন, ‘শোন তোমরা, আমি ডক্টর
ভাণ্ডারকরের কথার প্রতিবাদ করলাম। বললাম যে ওই শিলালেখে বিমান শব্দের অর্থ এটা নয়।
ভাণ্ডারকর জানতে চাইলেন সঠিক অর্থটি কী? তোমরা শুনছ তো? আমি বলে দিলাম যে অন্য কিছু’।
“প্রফেসর ব্যানার্জি বললেন যে এটা শোনার পর ভাণ্ডারকরের চেহারা যা হল না! তারপর উনি বললেন,
‘সংস্কৃত ভাষার সমস্ত কোষ আমি পড়েছি। বিমানের সামান্য অর্থ সবাই বলেছে—আকাশগামী যান।
আর ব্যানার্জি, তুমি কী করে বলছ যে অন্য কোন মানে আছে’? জবাবে আমি বললাম,’ডক্টর,
গোড়াতে আমিও তাই ভাবতাম। সংস্কৃত সাহিত্য আর ব্যাকরণ পড়তে পড়তে আমারও অর্ধেক জীবন
কেটেছে। কিন্তু বুঝলাম যে বিমান শব্দের সঠিক অর্থ জানতে হলে খালি সংস্কৃত পড়লে হবে না,
প্রাকৃত পড়তে হবে। আমি প্রাকৃত ভাষায় বেশ কয়েকটা জৈন গ্রন্থ পড়েছি। ডক্টর ভাণ্ডারকর,
আপনার প্রাকৃত জানা আছে’?
“রঙ্গনাথ বাবু, প্রফেসর ব্যানার্জি এই গল্প খুব রসিয়ে রসিয়ে বলছিলেন। বলছিলেন। ‘ভাণ্ডারকর
প্রাকৃত জানতেন না। অথবা আমার চেয়ে অনেক কম জানতেন। তাই আমি ওনাকে একটা প্রাকৃত গ্রন্থ
পড়ালা্ম, যেটাতে বিমান শব্দের প্রয়োগ যা অশোকের শিলালিপিতে রয়েছে-- সেই অর্থে করা আছে ।
বুঝলে তোমরা, তখন উনি বিমান শব্দটির সঠিক অর্থ শিখলেন’।
“রঙ্গনাথ বাবু, আমি গেঁয়ো লোক, তায় জাতে বামুন, আবার ভূতপূর্ব জমিদার বংশের। ব্যানার্জির এই
তামাশা দেখে আমার সর্বশরীর জ্বলতে লাগল। মন তো চাইছিল –ঘাড়টা ধরে এত জোরে ঝাঁকাই যে
বিমান শব্দের আসল অর্থ ওর জিভ থেকে টপ্ করে বেরিয়ে আসবে। ততক্ষণে ব্যানার্জি উত্তেজিত
হয়ে বলছেন—‘তোমরা নোট করে নাও, বিমান শব্দের আসল অর্থ সাতমহলা বাড়ি’!
“চারদিক নিস্তব্ধ। রঙ্গনাথ, আমারও নিজের ক্ষমতার অহংকার ছিল। চ্যাংড়ামি করে বসলাম।
দাঁড়িয়ে উঠে বললাম, ‘প্রফেসর সাহেব, বিমান শব্দের এমন অর্থ তো সংস্কৃত সাহিত্যের সব
পণ্ডিতেরই জানা। এ নিয়ে এত রিসার্চ করার কী ছিল’?
“শোনামাত্র প্রফেসর আমাকে চোখ ছোট করে দেখলেন। তারপর বললেন,’ঠিক আছে। আপনি না হয়
রিসার্চ না করেই এতসব জেনে ফেলেছেন, তো বলুন শ্রীমান, এই অর্থটি আপনি কোন পুস্তকে
পেয়েছেন? নিন, বলে ফেলুন’।
“রঙ্গনাথ বাবু, চ্যাংড়ামি বলে কথা। আমিও এক লেকচার ঝেড়ে দিলুম। দশটা সংস্কৃত বইয়ের নাম এক
নিঃশ্বাসে আউড়ে দিলাম। মেঘদূত নামের চালু গ্রন্থের নামও নিলাম। শেষে ফের বললাম যে বিমান
শব্দের এমন অর্থ তো সবারই জানা। আপনারা এর জন্যে এত পরিশ্রম করলেন! আশ্চর্য !
“এর ফল কী হল আন্দাজ করতে পার?
“ সেইদিন থেকে আমি প্রফেসর ব্যানার্জির দু’চোখের বিষ। বললেন,” আপনি তো খুব বড় স্কলার।
আমি ইউনিভার্সিটির অতি সাধারণ অধ্যাপক’। মন করল, বলে দিই যে আপনি আমার সম্বন্ধে ভুল
বলছেন কিন্তু নিজের সম্বন্ধে ঠিক; কিন্তু ওনার রাগ দেখে চুপ মেরে গেলাম। কিন্তু উনি থামার পাত্র
নন। ফের শুরু করলেন, ‘আমি তো সব কথাতেই রিসার্চ করি। আপনার মত পণ্ডিত তো নই যে সব
বিষয়ের সমাধান মুখে মুখে করে ফেলব? এটাই কি কম যে আপনি যে বিমান শব্দের অর্থ নিয়ে আমার
সঙ্গে সহমত হয়েছেন? এ তো আমার সৌভাগ্য! যাকগে, আপনার মত স্কলার আমার ক্লাসে উঠে
দাঁড়াবেন এটা ঠিক হল না। আপনি বসে পড়ুন’।
“ তো রঙ্গনাথ বাবু, সেই যে উনি চটে গেলেন, সেটাই আমার কাল হল। আমার সব কথায় উনি ভুল ধরতে
লাগলেন। শেষে আমার ডিভিসন খারাপ করে দিলেন আর এমন কিছু কান-ভাঙানি দিলেন যে উনি যতদিন
ছিলেন আমি ইউনিভার্সিটিতে পা রাখতে পারি নি।
“ওই বছরে ওনাকে না চটালে আজ আমি ওখানে ওঁর জায়গাতে হতাম”।
প্রিন্সিপাল সাহেব এই কিসসা শুনিয়ে খানিক চুপ করে রইলেন। দুজনে কোন কথা না বলে চুপচাপ
চলছিলেন। একটু পরে প্রিন্সিপালই মুখ খুললেন,”এরকম বেশ ক’বার গচ্চা খেয়েছি। শেষে মেনে নিলাম
যে সব এভাবেই চলতে থাকবে। তাহলে চলুক। সবাই যখন পাখি শিকার করেই সন্তুষ্ট, আমি কেন
খামোকা বাঘ শিকার করি? তাতে কার কী ছিঁড়বে? আর এখন আমার অবস্থা দেখছ রঙ্গনাথ বাবু? তুমি
কিছু বললে-হ্যাঁ, ভাই! ঠিক বলেছ। বৈদ্যজী মহারাজ কিছু বললেন?—হ্যাঁ মহারাজ, একদম ঠিক। আর
রূপ্পন বাবু কিছু বললে? -- হ্যাঁ মহারাজ, একদম ঠিক। বদ্রী পালোয়ান?—হ্যাঁ ভাই, সব ঠিক আছে”।
0 comments: