0

বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in

বইপোকার বইঘর 
অনিন্দিতা মণ্ডল



সম্প্রতি পড়লাম চিত্রা ব্যানার্জি দিবাকারুনির লেখা দ্য প্যালেস অফ ইলিউশানস। যাঁরা মহাভারত পড়েছেন বা শুনেছেন এ বই তাঁদের কাছে বিষয় হিসেবে অতি পরিচিত। তাহলে কি আমরা আরেকবার মহাভারত পড়ব? না। এ কাহিনীর ভিত্তি মহাভারত। কিন্তু কাহিনীর গতি ক্রমশ হিংসা দ্বেষ ক্রোধ থেকে দুঃখ ও শোকের আবরণে কখনো একক মানবের কখনো বা সমগ্রতায় আধ্যাত্মিক উত্তরণে উন্নীত। কী অপরূপ উপলব্ধির জগৎ খুলেছেন চিত্রা! তাঁর লেখনী যেন স্বয়ং পাঞ্চালী। কিংবা, এই সময় দাঁড়িয়ে আমরাও কি সেই সব চরিত্রের অজ্ঞেয় অন্ধকারে ডুবে যাই না? এখানে দ্রৌপদী কথাকার। নিছক নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নয়, বরং দেহের আপাতপ্রকাশ লিঙ্গবৈশিষ্ট ছাড়িয়ে তাঁর স্বপ্নচেতনায় তিনি কখনো নারী কখনো পুরুষ। কখনো বা শিখণ্ডী। স্বপ্নে তাঁর কাছে অতীত ভবিষ্যতের সীমারেখা ছাপিয়ে জেগে ওঠে কাল, মহাকাল। আর তাই টিলার মাথায় দাঁড়িয়ে একরকম ধ্যানমগ্ন দ্রৌপদী দেখতে পান ও শুনতে পান কুরুক্ষেত্রের পুঙ্খানুপুঙ্খ। শুনতে পান অর্জুনের সেই দিব্য সারথির কণ্ঠস্বর। যা কিছু আছে সবই অনিত্য। আজ যা সত্যি কাল তা নেই। পার্থিব সম্পদ তো বটেই এমনকি স্নেহ ভালোবাসার মতো মানবিক সম্পদও অনিত্য। যা কিছু ঘটছে তা আসলে পূর্বনির্ধারিত। নিয়ন্তার অদৃশ্য অঙ্গুলিহেলনে আমরা পুতুলের মতো নেচে চলেছি। দ্রৌপদী প্রত্যক্ষ করছেন যুদ্ধ, আর ধীরে ধীরে দিব্যপাবকসম্ভূতা নারী খোলসের মতো ত্যাগ করছেন তাঁর ঘৃণা ক্রোধ আর জিঘাংসা। উত্তরণ ঘটছে তাঁর আত্মার। আমরা জানি যে পঞ্চস্বামীকে বরণ করতে কি ভীষণ অপমানিত বোধ করেছিলেন দ্রৌপদী! চিরকাল কুন্তীকে দায়ী করেছেন নারীত্বের অসম্মানের কারণে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন নারীর সঙ্গে ব্যক্তিত্বের সংঘাত সরে গিয়ে সে স্থান নিয়েছে সহানুভূতি। সমব্যথী হয়ে অনুভব করেছেন কুন্তী নিজের প্রবৃত্তির বশে বালিকাকালে যে ভুল করেছেন তার মাশুল গুনেছেন জীবন ভরে। আহা মানুষ! প্রবৃত্তির কাছে সেও কি শক্তিহীন নয়? সমস্ত কাহিনী জুড়ে যে অনুচ্চার অস্তিত্ব আমাদের একটি প্রেমের ভুবনে নিয়ে যায় সে অস্তিত্ব কর্ণের। মানবিক প্রেমের অস্তিত্ব। আমাদের প্রচলিত ধারণাকে ভেঙে দিয়ে চিত্রা লিখেছেন, দ্রৌপদী প্রথম থেকেই কর্ণের প্রতি প্রেমাসক্ত। কর্ণও তাই। কিন্তু দুজনেই অপার সংযমের মধ্যে দিয়ে শেষ পর্যন্ত প্রেমকে নিয়ে গিয়েছেন আধ্যাত্মিকতায়। অপূর্ব সে অনুভব! 
আমরা জানি যে কৃষ্ণ, মথুরার কৃষ্ণ আর বৃন্দাবনের কৃষ্ণ মানুষ এক হলেও চরিত্রে বিস্তর ফারাক। বৃন্দাবনের প্রেমিক কৃষ্ণ রাধা বিনে অসুখী। দ্রৌপদীকে আমরা এক বিষাদাচ্ছন্ন প্রবল অহংকারী নারী বলেই জানি। রাজা কৃষ্ণ যাঁর সখা। আবাল্য সখ্য তাঁকে কৃষ্ণের অতি নিকটে নিয়ে গেলেও তা কখনোই মধুর ভাবের অনুসারী হয়নি। বিপদেআপদে কৃষ্ণ শুধু কৃষ্ণাকে রক্ষা করেছেন। কখনো দৈহিকভাবে উপস্থিত থেকে, কখনো বা চেতনার গভীরে জেগে। 
এ কাহিনীর শেষে মৃত্যুকে অবশ্যম্ভাবী জেনে দ্রৌপদী মহাপ্রস্থানে চলেছেন। সঙ্গে স্বামীরা থাকলেও প্রথা অনুযায়ী কেউই পতনোন্মুখ দ্রৌপদীর হাত ধরতে পারছেন না। তিনি দেহের সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেও শুনতে পাচ্ছেন। কারণ শ্রবণশক্তি গর্ভেই আসে আর সবশেষে যায়। (আমরা জানি শুকদেব মাতৃগর্ভে থাকাকালে বেদ শুনে শুনে বেদজ্ঞ হন। পরীক্ষিতও।) দ্রৌপদী শুনতে পাচ্ছেন যুধিষ্ঠির ও ভীমের কথা। অনুভব করছেন প্রথম পাণ্ডব সব বুঝেও কর্ণের প্রতি তাঁর প্রেমের কথা গোপন করছেন। তিনি কৃতজ্ঞ বোধ করছেন। মৃত্যুতে যদি জানা যায়, যে যাঁরা সঙ্গে ছিলেন তাঁরা আসলে তাঁকে ভালোবেসেছেন, তিনিই বুঝতে পারেননি, তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি কি? 
এবং যে কৃষ্ণকে তিনি বান্ধব বলে জেনেছেন তিনি যে তাঁর স্বীয় আত্মা সেটি জেনে কি পরম নিশ্চিন্ততায় পরম প্রেমে হাত বাড়িয়ে ধরছেন তাঁকে তা জেনে কোথাও যেন দ্রৌপদীকে রাধার মতোই লাগে। 
এ কাহিনীর মধ্যে দিয়ে একক মানবের ঈশ্বরত্বে উত্তরণের প্রত্যেক স্তর উন্মোচিত হয়। পড়ে ঋদ্ধ হই। 
যাঁরা জীবনের গভীর অর্থের অনুসন্ধান করেন এ বই তাঁদের জন্য।

0 comments: