0

গল্প - দেবাশিষ পুরকায়েত

Posted in

গল্প


১৪ই জুলাই, ২০১৮
দেবাশিষ পুরকায়েত


আজ রথযাত্রা। ছোট থেকে শুনে আসছি এইদিন বৃষ্টি হবেই। তা হলোও এক পশলা জোর বৃষ্টি দুটো নাগাদ। আকাশ কালো করে মেঘ এলো। কড়কড় করে মেঘ ডাকল ক’বার। আকাশ চিরে গেল বিদ্যুৎ ঝলকে আর গঙ্গার দিক থেকে ঠাণ্ডা হাওয়া ধেয়ে এলো ঘর্মাক্ত শহরে। ডালহৌসির এক প্রান্তে স্ট্র্যান্ড রোডে আমার অফিস, জানলা দিয়ে দিব্যি গঙ্গা দেখা যায়। মেঘ বৃষ্টির খেলা দেখতে দেখতে মনটা উদাস হয়ে গেলো। পাঁচটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম অফিস থেকে। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম স্কুপের কাছে।

বৃষ্টি হলেও বাতাসের চিটচিটে ভাবটা আবার ফেরত এসেছে। সারা গায়ে ঘাম, ভাবলাম বেঞ্চে বসে একটু জিরিয়ে নেওয়া যাক। বসার পর দেখি একপাশে এক প্রৌঢ় গোছের সাহেব বসে আছে। লম্বা, রোগাটে, মুখটা লম্বাটে আর ঠোঁটের কোনো এক চিলতে হাসি। দেখে খুব মিশুকে মনে না হলেও বলে ফেললাম –হ্যালো স্যার, আমার নাম দেবাশিস। কিছু যদি মনে না করেন আপনাকে কোথায় যেন দেখেছি মনে হচ্ছে। ভদ্রলোক বললেন –হাই, আমার নাম ঈঙ্গমার বার্গম্যান। 

শুনে আমার পিলে চমকে যাবার অবস্থা আর কী। আমার অবস্থা দেখে ভদ্রলোক নিজেই বললেন –আমার আজকে একশো বছর বয়স হল কিনা। সেই যে বছর তোমাদের দেশ স্বাধীন হলো, একটা ছবি বানিয়েছিলাম ‘আ শিপ টু ইন্ডিয়া’। কিন্তু ছবিটার মধ্যে ইন্ডিয়া কিস্যু ছিলো না, ওটা একটা প্রতীক ছিলো মাত্র। তাই ভাবলাম একবার ঘুরে যাই তোমাদের এই গরম দেশ। আমি প্রায় খাবি খেতে খেতে বললাম –স্যার আপনি জানেন না আপনি আমার কাছে প্রায় ঈশ্বর। সেই ১৯৮১ সালে সরলা রায় মেমোরিয়াল হলে আপনার সিনেমা প্রথম দেখি স্যার। কোনও প্রস্তুতি, পড়াশুনা ছাড়াই। দেখে মাথার মধ্যে ঘোর লেগে গেলো। ফিল্ম কবিতার মতো এরকম অন্তরঙ্গ হয়! আমাদের কবি বলেছিলেন –আমার সকল নিয়ে বসে আছি, সর্বনাশের আশায়। তা স্যার দেখলাম আপনার সিনেমাতেও আলো, অন্ধকার, জীবন, মৃত্যু, প্রেম, নিয়তি, স্বপ্ন এই সব কিছুকে ধারণ করে মানুষ কোন এক পরম সর্বনাশের আশায় বসে থাকে। বার্গম্যান সাহেব একটু উদাস হয়ে গেলেন। পকেট থেকে একটা কৌটো বার করে লেমনড্রপ খেলেন একটা। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন –একটা লজেঞ্চুষ খাবে নাকি ছোকরা? আমি লজ্জা পেয়ে বললাম –স্যার পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছি, আমাকে প্লিজ ছোকরা বলবেন না। সাহেব বললেন –আরে আমার তো একশো হলো, তুমি তো আমার কাছে ছোকরাই বটে। লেমনড্রপ দিয়ে ভদ্রলোক বললেন –তা সেই ছবিটা কী ছিলো? আমি বললাম –‘উইন্টার লাইট’ স্যার। সাহেব বললেন –হ্যাঁ ঐ ছবিটা বানিয়ে খুব তৃপ্তি পেয়েছিলাম, মনে হয়েছিলো যা বলতে চেয়েছিলাম বলতে পেরেছি। খুব বুঝেশুনেই, বুঝলে ছোকরা, এই ছবিটাকে আমি বানিয়েছিলাম প্রায় চেম্বার সিনেমার মত, নিরাভরণ। ছবির আলোটা কিরকম বিষণ্ণ দেখেছো? নিকভিস্টকে বলেছিলাম, এমন আলো বানাও যেটা হবে লাইট উইদাউট শ্যাডো। তা তোমাদের দেশে কিন্তু সত্যি এত আলো, এত রঙ, এত আওয়াজ। কত আলাদা। 

আমি জিজ্ঞাসা করলাম –এই পরিবেশ কেমন লাগছে স্যার? বার্গম্যান বললেন –আমার মেজাজটা আসলে অন্যরকম, আমার রক্তটা সাপের মতো শীতল। আমার নাটক, সিনেমা এগুলো কিছুই এখানে বোধহয় বানাতে পারতাম না। তোমাদের লম্বা ফিল্মমেকারের সিনেমা আমি দেখেছি। ভাল বাট নট মাই কাপ অফ টি। 

সাহস করে বলেই ফেললাম –স্যার আপনার জীবনে তো অনেক নারী, কিন্তু আপনার ছবিতে সেইভাবে প্রেম নেই কেন? 

সাহেব আবার অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। পকেট থেকে রুমাল বার করে কপালের ঘাম মুছলেন একবার। বললেন পাঁচটা বৌ, কিছু বান্ধবী, নটা ছেলেমেয়ে... বিশাল সংসার আমার। কাবি আমাকে বুঝেছিল অনেকটা। কাবি তো পিয়ানিস্ট শুধু নয়, শি ওয়াজ আ থিংকিং উওম্যান। অটাম সোনাটায় শোপ্যাঁর ইন্টারপ্রিটেশনটা তো ওরই আইডিয়া। দিস ওয়াজ হার আ্যপ্রোচ টু মিউজিক ইন পার্টিকুলার আ্যন্ড আর্ট ইন জেনারেল। একটু থেমে বললেন –আই আ্যম আ ডিফিকাল্ট পার্সন টু লিভ উইথ। অনেকটা শয়তানের মতো। এই বলে সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে আবৃত্তি করলেন…

আমাকে খোঁজো না তুমি বহুদিন- কতদিন আমিও তোমাকে
খুঁজি নাকো;- এক নক্ষত্রের নিচে তবু- একই আলো পৃথিবীর পারে
আমরা দু’জনে আছি; পৃথিবীর পুরোনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,
প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়।


আমি অবাক হয়ে বললাম –আপনি জীবনানন্দ পড়েছেন! সাহেব বললেন তোমাদের এই কবি আমার খুব কাছের মানুষ। আমার মতো দেখি ওঁরও জ্বলেনি আলো অন্ধকারে। ভালো অনুবাদ হলো না হে ছোকরা, নাহলে নোবেল বাঁধা ছিলো। 

কথায় কথায় সন্ধ্যা গড়িয়ে এলো। বিদ্যাসাগর সেতুর প্রেক্ষাপটে সূর্য পাটে যেতে বসল। একটি দুটি করে আলো জ্বলে উঠলো চারিদিকে। বার্গম্যান বললেন –তোমাদের এখানে যে এত লোক, এত উষ্ণতা, এত রঙ, এত আওয়াজ... মানুষ বিষণ্ণ হয় কী আমাদের দেশের মতো? আমার ফারো দ্বীপের বাড়ির কথাই চিন্তা করো, ত্রিসীমানায় কোনও জনপ্রাণী নেই। আধো অন্ধকার ঘিরে আছে চারদিক, বিষণ্ণতা তো আমাদের অনিবার্য নিয়তি। 

একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস শুনলাম যেন। আমি বললাম –স্যার, আমাদের সমস্যাটা আত্মিক বিচ্ছিন্নতার, পরিবেশটা তো সেখানে খুব ইম্পর্ট্যান্ট নয়। আর আপনার প্রিয় কবিই তো বলেছেন না- 

সকল লোকের মাঝে ব’সে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা?

সাহেব চুপ করে বসে আঙ্গুল মটকালেন কিছুক্ষণ। আমি জিজ্ঞাসা করলাম –স্যার, এখানে পাওভাজি খুব ফেমাস। খাবেন নাকি একটু? আড়মোড়া ভেঙ্গে বার্গম্যান বললেন –আমি ছোটবেলা থেকে পেটরোগা হে, এসব খাবার আমার সহ্য হবে না। দেখছ না সঙ্গে মিনারেল ওয়াটারের বোতলটা কেমন আকঁড়ে ধরে ঘুরছি। মৃত্যুর সঙ্গে লুকোচুরি খেলা আমার পুরোনো অভ্যাস। অত সহজে মরতে আমি চাই না। 

আমি সাহস করে বললাম –কিন্তু স্যার, আপনার ছবিতে তো কোনও পরিত্রাণের আশ্বাস নেই, তাহলে এই জীবন যাপনের খেলা কেন? 

একটু কি চোখ মটকালেন সাহেব? সন্ধ্যার অন্ধকারে ঠাহর হলো না। বললেন –সাফারিং এর মধ্যে একটা গ্র্যাঞ্জার আছে না হে ছোকরা? ওটাই আমার রাজমুকুট। চলি ভাই, যাবার সময় হলো আমার। তা, তুমিও তো খুব ভালো নেই হে ছোকরা। তোমার চোখের কোণে বিষণ্ণতা দেখছি যেন।

সাহেব গোদারকে খুব একটা পছন্দ করেননা জেনেও ব্যান্ড অফ আউটসাইডার্স থেকে এক পিস ডায়লগ ঝাড়লাম –মাঝে মাঝে বুঝি না স্যার ‘হোয়েদার লাইফ ইজ এ ড্রিম অর আই আ্যম ড্রিমিং আবাউট লাইফ’।

জীবনটা বড়ো ছোট। এই উত্তর-পঞ্চাশে এসে মনে হয় যদি আবার নতুন করে জীবনটাকে গড়ে নেওয়া যেতো!

বার্গম্যান উঠে দাঁড়ালেন। ওঁর পিছনে আকাশে তখন তারা ফুটে উঠেছে। দূরে গঙ্গা পারাপারের স্টিমার ভোঁ দিলো একটা। শীতল একটি হাত আমার কাঁধে রাখলেন উনি। মৃদু চাপ দিলেন একটু। আর কিছু বলার দরকার হলো না। চক্ররেলের লাইনটা পড়ে ছিলো আদিম সর্পিনীর মতো। ওঁর ঈষৎ ন্যুব্জ দেহটা ধীরে ধীরে তার উপর দিয়ে মিলিয়ে গেলো সাতটি তারার তিমিরের দিকে।

0 comments: